ক্রিকেট খেলতে শিখেছেন চিনা ভাষা, অবনীন্দ্রনাথের প্রহার লজ্জা দিয়েছে বার্ধক্যেও

তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। সারা কলকাতা জুড়ে জাপানি বোমার আতঙ্ক। শহর ছেড়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে পালাচ্ছেন নাগরিকরা। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন কলাভবনের দায়িত্বে। দৌহিত্র অমিতেন্দ্রনাথ-সহ গোটা পরিবার গিয়ে হাজির শান্তিনিকেতনে। সেখানেই কিছু ছেলেকে একদিন ক্রিকেট খেলতে দেখলেন তরুণ অমিতেন্দ্রনাথ। কিন্তু চেয়েও খেলতে পারলেন না তাদের সঙ্গে। কেননা, একমাত্র বিশ্বভারতীর ছাত্ররাই খেলতে পারে সেখানে।

তাহলে উপায়? খেলার জন্য তখন ছাত্র হতেও রাজি অমিতেন্দ্রনাথ। গিয়ে হাজির সদ্য-প্রতিষ্ঠিত চিনা-ভবনে। চিনা ভাষার ছাত্র হিসেবে বিশ্বভারতীতে নাম উঠল তাঁর। ব্যস, আর কোনো বাধাই রইল না ক্রিকেট খেলার।

হ্যাঁ, ক্রিকেটের সূত্র ধরেই অমিতেন্দ্রনাথের জীবনে ঢুকেছিল চিনা ভাষা। পরবর্তীকালে যে ভাষার শিক্ষক হিসেবে পরিচিত হবেন তিনি। 

ছোটোবেলা কেটেছে জোড়াসাঁকোতেই। অবনীন্দ্রনাথের কোলে-পিঠে বড়ো হওয়া অমিতেন্দ্রনাথের জন্ম ১৯২২ সালে। আজ, ৯৯ বছর বয়সে প্রয়াত হওয়ার সময়, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বর্তমান প্রজন্মের মধ্যে প্রবীণতম ছিলেন তিনিই। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে শেষ হল ঠাকুরবাড়ির এক দীর্ঘ অধ্যায়ও।

দীর্ঘই বটে! কৈশোরে ঠাকুরবাড়িতে তাঁর ও অন্যান্য কচিকাঁচাদের যাত্রাপালা উপভোগ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে শিখেছেন গানও। এমনকি, স্মৃতিচারণে জোড়াসাঁকোর ‘দক্ষিণের বারান্দা’র কথাও ফিরে এসেছে বারবার। 

জোড়াসাঁকোয় অবনীন্দ্রনাথের চানঘর-লাগোয়া একটি বিশাল চৌবাচ্চা ছিল। শৈশবে একদিন সকলের চোখ এড়িয়ে সেই চৌবাচ্চার পাড়ে উঠলেন অমিতেন্দ্রনাথ। কিন্তু পড়বি তো পড়, ধরা পড়লেন ‘দাদামশায়’ অবন ঠাকুরের কাছেই। তারপর আর কী! শাস্তিস্বরূপ কুকুর বাঁধার চেন দিয়ে বাঁধলেন অমিতেন্দ্রনাথকে। তারপর, পায়ের জুতো দিয়ে পিঠে আঘাত। ব্যথা হয়তো লাগেনি, কিন্তু সবার সামনে অবনীন্দ্রনাথের সেই মার প্রৌঢ় বয়সেও ভুলতে পারেননি অমিতেন্দ্রনাথ। 

অবশ্য না-ভোলার মতো স্মৃতি জীবন তাঁকে নেহাত কম দেয়নি। শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা শেষ করে, অমিতেন্দ্রনাথ সহপাঠীদের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন চিনে। সেখানে একবার চিনা ছেলেরা যাতায়াতের পথে ‘ওয়াই কোরেন, ওয়াই কোরেন’ বলে উত্যক্ত করত তাদের। ‘ওয়াই কোরেন’ মানে ‘বিদেশি’। একদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে অমিতেন্দ্রনাথরা কড়া গলায় জবাব দিলেন, ‘চুং কোরেন, চুং করেন’। অর্থাৎ, ‘চুপ করো।’ নাহ, সেই উত্তর শোনার পর আর কোনো চিনা ছেলে জ্বালাতে আসেনি তাঁদের।

পড়াশোনা সেরে কলকাতায় ফেরার সময় আরেক বিপত্তি। জাহাজঘাটায় দাঁড়িয়ে অমিতেন্দ্রনাথের মা-বাবা। খিদিরপুরে জাহাজ থেকে একসঙ্গেই নামছিলেন অমিতেন্দ্রনাথ ও জাহাজে আলাপ-হওয়া এক আমেরিকান ভদ্রমহিলা। তা দেখে মায়ের বুক ধড়ফড়। ছেলে আবার মেম বিয়ে করে আনল নাকি! পরে অবশ্য আসল ঘটনা জেনে স্বস্তি।

চিন থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনেই শিক্ষকতা শুরু করেন অমিতেন্দ্রনাথ। তারপর দেরাদুন, পুনে হয়ে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীকালে ওকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও চিনা ভাষা পড়িয়েছেন দীর্ঘ দু-দশক। অবসর জীবনে কলকাতায় ফিরে সল্টলেকে বসবাস শুরু করেন। আমৃত্যু কাটিয়েছেন সেখানেই। 

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে সল্টলেক – দীর্ঘ জীবন দেখেছেন অমিতেন্দ্রনাথ। জোড়াসাঁকোর ৫ নং বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার সময়, সাক্ষী ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের দীর্ঘশ্বাসেরও। সেই সূত্রের শেষতম সংযোগটুকুও ছিঁড়ে গেল আজ। ‘দাদামশায়’-এর অভিমানও কি উত্তরাধিকার হারাল এভাবেই? আমরা অবশ্য তা বলতে পারব না...

তথ্য ঋণ - অমিতকথা, অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More