অল্প রেখার গল্প

মানিকলমকারি - ২৯
আগের পর্বে

ফেলুদার গল্প মানেই ফেলুদা আর তোপসের সঙ্গে জটায়ুর উপস্থিতি অনিবার্য। সোনার কেল্লা থেকে তাঁর উপস্থিতিই গল্পের চরিত্র সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। তবে আরও গভীরভাবে দেখলে মনে হয়, তার আগেও একটা অনুরূপ চরিত্র তৈরির চেষ্টা সত্যজিৎ করে গিয়েছেন। প্রথম গল্প ‘ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি’-র রাজেন মজুমদার এবং তিনকড়ি মুখোপাধ্যায় দুজনের মধ্যেই সেই ছাপ স্পষ্ট। তিনকড়ি বাবু আবার জটায়ুর মতোই রহস্য গল্পলেখক। আবার এখানে ফেলুদাই দুটি ইংরেজি শব্দ মিশিয়ে বলবেন ‘হরেন্ডাস’। পরে যে স্বভাবটা জটায়ুর মধ্যেই দেখা যাবে। ‘গ্যাংটকে গণ্ডগোল’ গল্পের নিশিকান্ত সরকারের মধ্যেই একটা জটায়ুসুলভ ব্যাপার আছে। সব মিলিয়ে এই সময়ের গল্পে জটায়ু না থেকেও আছেন। 

সত্যজিৎ রায়ের আঁকা ছবির, মানে তাঁর করা অলংকরণের, একটা ভারী আশ্চর্য মজা আছে। ছবির মূল বিষয় যা দেখা যাচ্ছে, ছবিতে তা তো দেখা যাচ্ছেই। তবে কি না, তার বাইরেও আছে নানা রকম টুকরো-টাকরা অংশ। মূল ছবির সঙ্গে যুক্ত না থেকেও কী অদ্ভুতভাবে তা তৈরি করে দেয় একটা ছবির পরিবেশ। ছবিটা যে-দেখছে সে এমনিতে হয়ত সেভাবে দেখলই না সেইদিকে। তবু, সেই টুকরো-ই একটা আসল কাজ করে যায় দর্শকের মনের ভেতর, তার অজান্তেই। ছবির মেজাজটা বেঁধে দিতে তার জুড়ি নেই। প্রথমদিকে একটি পর্যায়ে সত্যজিৎ ছবি এঁকেছেন বেশ ডিটেলস ব্যবহার করে। পরে তার পাশাপাশি এই টুকরো-কাজে অল্প রেখায় গল্প বলার একটা ধরন তিনি নিজেই তৈরি করে নিলেন তাঁর অলংকরণশিল্পে।

ধরা যাক, ‘বঙ্কুবাবুর বন্ধু’ গল্পের সেই বিরাট ছবিটি, যেখানে বিরাট বড়ো বাঁশবনে দেখা যাচ্ছে একদিকে দাঁড়িয়ে আছেন বঙ্কুবাবু আর তাঁর সামনে মহাকাশযান থেকে নেমে এসেছে ভিনগ্রহের প্রাণী অ্যাং। এখানে ছবিটা বড়ো মানে, বেশ বড়ো। পুরো পাতা জুড়ে লাল-কালো রংয়ে ছাপা হয়েছিল সেই ছবি সন্দেশ পত্রিকার পাতায়। চারপাশে বড়ো বড়ো বাঁশগাছের ঝাড়, পাতা জোড়া অন্ধকারের ভেতরে দেখা যাচ্ছে মহাকাশযান থেকে অ্যাংয়ের নেমে আসার দৃশ্য। একটি নিতান্ত সাধারণ গ্রাম্য পরিবেশ, ওই বাঁশঝাড় আর ডোবার পরিবেশটা বেশ ছড়িয়ে না দেখালে কী করে জমবে অকস্মাৎ সেখানে ওই মহাকাশযানের অবতরণের ছবি! এই বিস্তারিত পরিবেশ তিনি রচনা করেছিলেন সেই সময়ে লেখা আরেকটি ছোটগল্প ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’-এও। সেখানে পত্রিকার পাতা জুড়ে আঁকলেন প্রাগৈতিহাসিক যুগের ছবি। মজা হল, গল্পটা যারা পড়েছেন, তারা জানেন, ওই পরিবেশটা গল্পে নেই। ওটা গল্পের চরিত্র বদনবাবুর কাছে অকস্মাৎ-আবির্ভূত আগন্তুকটি যে-গপ্পোটা শোনায়, ওই পরিবেশটি সেই গপ্পোর ছবি। কলকাতার গঙ্গা যেখান দিয়ে বইছে ঠিক সেখানেই নাকি তিনি দেখেছিলেন প্রাগৈতিহাসিক স্টেগোসরাস আর টেরোড্যাকটিলকে। সেই যুক্তিপটেই ছবির এক কোণে ভয়ার্ত সেই গপ্পোবাজের মুখ আর তার পিছনে যে আদিম পরিবেশ, সেটি আর কোথাও নয় সময়ের ডানায় পিছিয়ে গেলে নাকি কলকাত্তাই গঙ্গার পাড়ের ছবি! এখানেও বেশ ডিটেলস ব্যবহার করে আঁকা হল পরিবেশ, অন্য রকম গাছপালা আর শ্যাওলার ছবি।

কিন্তু সেখানেই দেখা যাবে আরেক ধরনের ছবিও শুরু হয়ে গেছে। সামান্য একটি মোক্ষম উপকরণ ব্যবহার করে গোটা পরিবেশটিকে ধরে দেওয়া। ওই ‘টেরোড্যাকটিলের ডিম’ গল্পেই আছে দুটি বসে থাকা মানুষের ছবি আর তাদের বসে থাকার জায়গা হিসেবে এমন একটি বেঞ্চের ছবি যা দেখলেই চারপাশে একটিও গাছপালা না আঁকা সত্ত্বেও বোঝা যাবে ওটা একটা পার্কের ছবি না হয়ে যায় না। এই সামান্য উপকরণে কত অদ্ভুত সব পরিবেশ তৈরিই না করেছেন তিনি। মনে পড়বেই ‘সহদেববাবুর পোর্ট্রেট’ গল্পের পশ্চাৎপটটি। মূল ছবিতে যে দুটি চরিত্র আছে, তারা তো আছেই, লক্ষণীয় তারা কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, সেটা ধরা পড়ল পিছনের ওই রেখাচিত্রে। দেখা যাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা শিল্পদ্রব্যের ছবি আর দু-তিনজন যেন সেই জিনিসগুলে দেখছেন। কেউ তাতে হাত দিয়ে দেখছেন, কেউ পিছনে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখছেন। ওই শিল্পবস্তু আর তাদের দেখনেওয়ালাদের অবস্থান আর ভঙ্গিটাই চিনিয়ে দেবে ওটা একটা নিলাম-ঘর।

টেরোড্যাকটিলের ডিম গল্পের অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
জটায়ুর দাদারা

লক্ষ করে দেখতে বলি, দুটি চায়ের হোটেলের দৃশ্য। একটি ছিল ‘ফটিকচাঁদ’ গল্পে ফটিকচাঁদ যে হোটেলে কাজ করতে ঢোকে, সেই হোটেলের দৃশ্য আর অন্যটি ‘বহুরূপী’ গল্পে বহুরূপী- হিসেবে নিকুঞ্জবাবু ছদ্মবেশ নিয়ে যখন পাড়ার চায়ের দোকানে বসেন, সেই চায়ের দোকানের ছবি। দুটি গল্পেই শুধু বসার জায়গার গড়ন, টেবিলের গঠন আর চায়ের কাপের ধরন থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় ওই পরিবেশ। ওই ‘বহুরূপী’ গল্পেই কেবলমাত্র একটি আয়নাকে এমনভাবে আঁকলেন তিনি যেটি এক নিমেষেই বুঝিয়ে দেবে এই আয়না বাড়ির আর চারটে কাজে ব্যবহৃত আয়না নয়, এটা একেবারেই মেক-আপ শিল্পীর নিজস্ব কাজের জন্য ব্যবহার করার আয়না। কারণ, তার চারপাশে আছে আলো লাগাবার ব্যবস্থাও।

টেরোড্যাকটিলের ডিম গল্পের অলংকরণ

 

আরও পড়ুন
না-হিরোর গল্প

এইভাবেই দেখা যাবে দুই ধরনের ট্রেনের কামরার ছবি বোঝাতে তিনি একেবারেই আর কিচ্ছুটি ব্যবহার না করে শুধু তিনি আঁকলেন কামরাতে বসার জায়গাটি। একটি ট্রেনের কামরা ‘দুই ম্যাজিশিয়ন’ গল্পে আর অন্যটি ‘ফার্স্ট ক্লাস কামরা’ গল্পে। প্রথম গল্পে দ্বিতীয় শ্রেণির কামরার বসার জায়গা বলে এক ধরনে আঁকা আর দ্বিতীয় গল্পে ফার্স্ট ক্লাস কামরা বলে তার ধরনটি আরেক রকম। একটিতে কাঠের তৈরি বসার ব্যবস্থা আর অন্যটিতে রীতিমতো গদি-আঁটা বসার জায়গা।

দুই ম্যাজিশিয়ন গল্পের অলঙ্করণ

 

আরও পড়ুন
শঙ্কুর গল্প শুরুতে কি কল্পবিজ্ঞানের?

একই গল্পে কীভাবে একই মুহূর্তের ছবি দু-দুবার এঁকেছিলেন তিনি। বহুলপঠিত ‘ক্লাস ফ্রেন্ড’ গল্পের অলংকরণে দেখা যায়, একই মুহূর্তের ছবি। ধনী ও সম্পন্ন বন্ধু মোহিতের পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছি আমরা মুখোমুখি তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মুখে সময়ের-ছাপ-পড়া তার ক্লাস ফ্রেন্ড জয়দেব। প্রায় হুবহু এক ছবি। শুধু পত্রিকার ছবিতে পিছন থেকে দেখা যাচ্ছে মোহিতের মুখের অংশ আর পরের ছবিটিতে আছে তার একটি হাতের ভঙ্গি। আর পরের ছবিটিতে দেখা যাচ্ছে তার বাড়ির বাড়তি কিছু অংশ। দুটি পরিবর্তনই লক্ষণীয়। মোহিতের মুখের সামনে তার দুটি হাত তোলার ভঙ্গিতে স্পষ্ট তার দেহ-ভাষা। সামনের লোকটির প্রতি তার নির্লিপ্ততা বোঝাবার জন্য ওই ওই দুটি হাত একটা দারুণ ভিসুয়াল উপাদান। আর বাড়ির দরজায় লাগানো পেলমেট আর তার বাড়ির সোফার ওপরে রাখা বাহারি কাজ-করা কুশন কভার তার আর্থিক অবস্থানটি স্পষ্ট করে দেয় এক নিমেষেই। ওই যে বলছিলাম, সেভাবে হয়ত লক্ষই করি না আমরা, তবু ছবির দর্শকের মনে একটা ছবি গড়ে তোলে এই টুকরো-টাকরাগুলি।        

বহুরূপীর অলঙ্করণ

 

আরও পড়ুন
তিনি কি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প লিখতেই?

এই লুকোনো টুকরো ছবির মধ্যেই তো সত্যজিৎ নিজের ছবিও এঁকেছেন। ‘যখন ছোট ছিলাম’ লেখার সময় তিনটি অলংকরণে নিজের ছেলেবেলার ছবি এঁকেছেন তিনি। একটি গিরিডিতে উশ্রী নদীর ধারে বাড়ির বৃদ্ধ ভৃত্য প্রয়াগের সঙ্গে বালি খোঁড়ার দৃশ্য--- সেখানে অবশ্য শিশু সত্যজিৎকে দেখা যাচ্ছে পিছন থেকে। দ্বিতীয়টি অসহযোগ আন্দোলনের সময়ে নিজেদের বাড়িতে তকলি থেকে সুতো-কাটার দৃশ্যে। এখানে অবশ্য মুখোমুখি দেখা যাচ্ছে কিশোর সত্যজিৎকে। আর তৃতীয়ত, বালিগঞ্জ গভর্নমেন্ট স্কুলে খেলার মাঠে ড্রিল শিক্ষক সনৎবাবুর মুখোমুখি যে-ছেলেটিকে দেখি সে-ই যে সত্যজিৎ, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এটা তো সহজে চেনা যায়। আরেক জায়গাতেও তিনি নিজেকে এঁকেছেন বলে মনে হয় আমাদের। সেই গল্পটা বলি এবার। প্রস্তাবনার গল্পটা আছে ‘যখন ছোট ছিলাম’-এই। সেখানে নিজের ছেলেবেলার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন এক আশ্চর্য বাঙালি ম্যাজিশিয়নের কথা। সত্যজিৎ লিখেছেন, ‘‘এই ভদ্রলোক ম্যাজিক দেখালেন প্যান্ডেলের তলায় ফরাসের উপর বসে, তাঁর চারিদিক ঘিরে চার পাঁচ হাতের মধ্যে বসেছেন নিমন্ত্রিতরা। এই অবস্থাতে একটার পর একটা এমন খেলা দেখিয়ে গেলেন ভদ্রলোক যে ভাবলে আজও তাজ্জব বনে যেতে হয়।… ফরাসের উপর দেশলাইয়ের কাঠি ছড়িয়ে দিয়েছেন ভদ্রলোক, নিজের সামনে রেখেছেন একটা খালি দেশলাইয়ের বাক্স। তারপর ‘তোরা আয় একে একে’ বলে ডাক দিতেই কাঠিগুলো গড়িয়ে গড়িয়ে এসে বাক্সোয় ঢুকছে।’’ শৈশবের এই কাহিনিটি বলার সময়ে তিনি জানিয়েছিলেন ‘এই জাদুকরকে অনেক পরে আমার একটা ছোটগল্পে ব্যবহার করেছিলাম’। অভিজ্ঞতার এই নাম-না-জানা জাদুকরই তো তাঁর ‘দুই ম্যাজিশিয়ন’ গল্পের সুরপতিবাবু। সেই গল্পের পত্রিকাপাঠে হুবহু ওই ছবিটিই এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। সেখানেও দেখা গেল, ফরাসের উপরে বসা জাদুকরকে, তাঁর চারপাশে ঘিরে বসে থাকা দর্শকদের ভিড়, ওই জাদুকরের সামনে খোলা দেশলাই বাক্স আর তাঁর ডাকে একে একে ছড়ানো দেশলাই কাঠির সেই বাক্সে ঢুকে পড়ার ছবি। সবাটাই মিলে গেল। তবে এর মধ্যেই ওই ভিড়ের মধ্যে একটি বাড়তি চরিত্র ছিল। লক্ষ করে দেখবেন, সুরপতির ঠিক পাশ থেকে মুখ বাড়িয়ে রয়েছে একটি কিশোর, তার দিকে তাকালেই মনে পড়ে যাবে ‘যখন ছোট ছিলাম’ বইয়ের প্রচ্ছদে দেখা গোলগাল মুখের শিশু সত্যজিতের ছবিটি। এটিই তাঁর আঁকা নিজের একটি অসামান্য শৈশবচিত্র, যে লুকিয়ে আছে অলংকরণের ভেতর।

ফার্স্ট ক্লাস কামরা গল্পের অলঙ্করণ

 

Powered by Froala Editor