জগন্নাথ-খুনের বদলা নিয়ে তবেই হোলি খেলবেন, প্রতিজ্ঞা মালখান সিং-এর

মালখান একদিন নিজের বাড়িতে ঘুমোচ্ছিলেন। সেই সময় পুলিশ তার বাড়িতে রেড করে। মালখান কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে কব্জা করে ফেলে পুলিশ। থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশ তাঁকে এত মারধর করে যে তিনি প্রায় চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়েন। আহত মালখান আরো বড়ো ধাক্কা খান, যখন পুলিশ তাঁকে থানা থেকে সোজা কৈলাস পণ্ডিতের পায়ের কাছে নিয়ে গিয়ে ফেলে। পুলিশের পরিকল্পনা ছিল মালখানকে চিরতরে শেষ করে দেওয়া। কিন্তু গ্রামবাসীদের সামনে এই মিথ্যে এনকাউন্টারে তারা ফেঁসে যেতে পারেন, এই ভয়ে পুলিশ তাকে ফের থানায় নিয়ে যায়। 

আত্মসমর্পণের পর এভাবেই মালখান আর তার গ্যাঙ সাংবাদিকদের পোজ দিয়েছিলেন

 

গ্রামের রাজনীতির কারণে শত্রুতা বেড়েই চলেছিল, আর মালখানের ভাগ্য তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল বেহড়ের দিকে। ১৯৭০ সাল। পঞ্চায়েত নির্বাচনে জিতে যান মালখান। ফলে কৈলাশের কাছে সরাসরি বিপদ হয়ে ওঠেন তিনি। সরপঞ্চের নির্বাচনী লড়াইয়ে কৈলাস পণ্ডিতের একজন কট্টর দলিত সমর্থক পঞ্চ (পঞ্চায়েত প্রধানের পর্ষদ) খুন হয়ে যান। পুলিশ আবারো মালখান আর তার একজন সঙ্গীর নাম এই মামলায় জড়িয়ে দেয়। এই মামলায় আদালত মালখান আর তার সঙ্গীকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। অন্যদিকে গ্রামের উত্তেজিত দলিতরা মালখানের গুরু জগন্নাথ ওরফে হিটলারকে জনসমক্ষে খুন করে। হোলির দিন হওয়া এই হত্যাকাণ্ডে মালখান ভেঙে পড়েন। জগন্নাথের লাশের উপর আছড়ে পড়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি প্রতিজ্ঞা করেন, যতক্ষণ পর্যন্ত না তিনি জগন্নাথের খুনের বদলা নিতে পারবেন, তিনি হোলি খেলবেন না। চম্বলের চিরাচরিত আইন। খুন কা বদলা খুন, চম্বলের সেই চারণ গান ‘জাকে বৈরি জীবত রহে/ উয়াকে জীবন রহে বেকার’। 

অর্জুন সিংয়ের সামনে আত্মসমর্পণ করছেন মালখান

 

আরও পড়ুন
‘বাগীসম্রাট দদ্দা মালখান সিং’, এখনও বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা এই পরিচয়

এদিকে মালখানের জীবন দিনকে দিন বিপদের মধ্যে কাটতে থাকে। গ্রামের শত্রুরা তাকে মেরে ফেলতে চাইছিল। এর মধ্যেই ১৯৭৬ সালের এক রাতে মালখান যখন বাড়িতে ঘুমোচ্ছিলেন  ঠিক সেইসময় তাঁর বাড়িতে গুলিবৃষ্টি শুরু হয়। মালখান বাড়ির পেছনের দরজা খুলে বেহড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে নিজের জীবন বাঁচান। এই ঘটনার পরই তিনি বেহড়কেই নিজের ভাগ্য বলে মেনে নেন। সেই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেন এক  দশক ধরে চলা শত্রুতার মুখোমুখি হওয়ার। অর্থাৎ যাকে চম্বলের ভাষায় বলা হয় ‘উসনে বেহড় পাকড় লী হ্যায়’। কিছুদিন পরেই হঠাৎই মালখান একদিন বিলাও গ্রামে কৈলাস পণ্ডিতের বাড়িতে উদয় হন আর চেঁচিয়ে বলেন, ‘কৈলাস আগর বাঁচ সকতে হো তো বঁচ লো’। সেইসঙ্গে নিজের হাতে থাকা স্টেনগান থেকে গুলি করতে থাকেন। তিন-তিনটে গুলি লাগে কৈলাস পণ্ডিতের গায়ে, আর বাকিগুলি কৈলাসের এক সঙ্গীর বুক ঝাঁজরা করে দেয়। কৈলাস বেঁচে যান, কিন্তু পুলিশ মালখানকে শেষ করতে রাত-দিন এক করে দেয়। মালখান বুঝে যান যে, তার জন্য এই মুহূর্তে সমাজের রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন চম্বলই তার একমাত্র ঠিকানা। চম্বলে নিজের গ্যাং বানান মালখান। পুলিশ মালখানের দলকে তাদের তালিকায় নাম দেই ই-৪৯ অর্থাৎ শত্রু নম্বর ৪৯। আর মালখানের উপর ১০০০ টাকার পুরস্কার ঘোষিত হয়। 

দুর্গার পায়ে নিজের সত্র সমর্পণ করে আত্মসমর্পণ করছেন যুবক মালখান

 

আরও পড়ুন
সুড়ঙ্গের গোলোকধাঁধায় প্রাণসংকট, প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসছে প্রত্যেকটা ডাক

এইবার শুরু হল বিলাও গ্রামে শত্রুতার ধারাবাহিকতা। মালখানের দলে সবার আগে যোগ দেন তার এক জ্ঞাতি ভাই তথা বন্ধু, প্রভু। হাতিয়ার হাসিল করার জন্য ‘পকড়’ অর্থাৎ অপহরণের রাস্তা ব্যবহার করা হল। বেহড়ে মালখান ধার্মিকরীতি অনুযায়ীই চলতেন। প্রথম অপহরণের পয়সা মন্দির ঠিক করার জন্য দান করা হয়। এদিকে মালখান ফেরার হলেও গ্রামের শত্রুরা হার মানেনি। প্রভুকে খুন করা হয়। অন্যদিকে চম্বলে নতুন গ্যাং বেড়ে ওঠার আগেই তা শেষ করার জন্য প্রভুর শ্রাদ্ধের দিন মালখানকে ধরার জন্য পুলিশ জাল বেছায়। কিন্তু মালখান পুলিশের জাল কেটে বেরিয়ে যান। একে একে মালখানের অপরাধের সংখ্যা বাড়তে থাকে, সেইসঙ্গে বাড়তে থাকে তার মাথার দাম। পাঁচ মাস পর মালখানের মাথার দাম বেড়ে দাঁড়ায় ৫০০০ টাকা। পুলিশ সমস্ত রকম পরিকল্পনাই ব্যবহার করছিল। মালখানকে ধরার জন্য পুলিশ সেই সময় চম্বলের সবচেয়ে বড়ো ডাকাত মোহর সিং-এর প্যারোল বাড়িয়ে দেওয়ার পরিবর্তে তাঁর কাছ থেকে মালখানকে শেষ করার সাহায্য চেয়ে বসে। মোহর সিং মালখানের সন্ধান পেতে পুলিশকে সাহায্য করেন, কিন্তু পুলিশ মালখান পর্যন্ত পৌঁছতে পারেনি।

তৎকালীন চম্বলের আতঙ্ক মালখান

 

আরও পড়ুন
থিকথিক করছে পোকা, দূষিত জলেই তেষ্টা মেটান চম্বলের ‘নিচু জাতে’র মানুষরা!

সেই বছরই মালখান দুই দলিতকে হত্যা করে নিজের গুরুর মৃত্যুর বদলা নেন। পুলিশও মালখানের থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য তার দলের এক সদস্যকে ভাঙিয়ে নেয়। কিন্তু মালখান তাকেও শেষ করে দেন। একদিকে পুলিশ নিজের যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলেছিল, অন্যদিকে চম্বলের বেহড়ে মালখানের আতঙ্ক বেড়েই চলেছিল। এমনকি এক বছরের ভেতর পুলিশের খাতায় মালখানের দল ই-৪৯ থেকে উঠে এসে ই-৩-এ পৌঁছে যায়। মালখানের দল অপহরণ করা শুরু করে। কিন্তু অপহরণের ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে দলেই ভাঙন ধরে। দলের পাঁচজন লোক মালখানকে ছেড়ে চলে যায়। বাবু গুজ্জর নামে এক ডাকাত মালখানের প্রিয় রাইফেল উইনচেস্টার নিয়ে পালিয়ে যায় (বাবু গুজ্জর সেই লোক যে ফুলনকে তুলে নিয়ে গিয়ে দিনের পর দিন ধর্ষণ করেছিল। পরে তাকে বিক্রম মাল্লাহ খুন করে ফুলনকে উদ্ধার করে)। মালখানের দল ডাকাতির চেয়ে বেশি অপহরণ করার দিকে মন দেয়। লক্ষ্মণপুর, বারপুরের মতো গ্রাম থেকে অপহরণ করে মোটা অর্থ উসুল করা হয়। এর মধ্যেই মালখান নিজের এক গ্যাং মেম্বারকে মুখবীর সন্দেহে খুন করেন। আত্মবিশ্বাস বাড়তে শুরু করে মালখানের দলের, আর তা এতদূর যে তার দল এবার পুলিশকেই নিজের  নিশানা বানাতে শুরু করে। পিএসির এক কনস্টেবলকে হত্যা করেন মালখান। এরপর তিনি আর তার ভাঙাচোরা দল আবারো চম্বলে জড়ো হয়। প্রায় ছ-বছর পর মালখান আরো কিছু অপহরণ করে মোটা অর্থ উসুল করে হোলি পালন করেন।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
নিজের স্ত্রী এবং মেয়েকেও খুন করে নদীর জলে ভাসিয়ে দেন চম্বলের এই ডাকু!

More From Author See More