‘এক ঘন্টে সে দেখ রাহা হুঁ, মতলব ক্যা তুমহারা?’ গর্জে উঠলেন চম্বল-কাঁপানো ডাকাত মোহর সিং

দুর্ধর্ষ দুশমন - ২৪
আগের পর্বে

পরদিন ভিণ্ড থেকে মোহর সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে মেহেগাঁও। চম্বলের একসময়ের সব থেকে বড় গ্যাং-এর সর্দার মোহর সিং। যার কাছে বন্দুক শিখতে এসেছিলেন ফুলন দেবীও। ডাকাতি থেকে সরে আসার পর মোহর সিং ছিলেন মেঁহেগাও পৌরসভার দু’বারের চেয়ারম্যানও। তাঁর সঙ্গে কথা শুরুর আগেই একটা ছেলে ছুটে আসে কোনো সংবাদ নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুক বের করতে বলেন মোহর সিং। স্পষ্ট জানিয়ে দেন মাত্র ১০ মিটিন সময় দিতে পারবেন তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় গাড়ি। হাত তুলে প্রশ্ন থামিয়ে দেন চম্বলের ‘বাগীভাই’। তারপর...

চম্বলে যাওয়ার পর এমন কিছু অযাচিত সাহায্য পেয়েছি যা না পেলে হয়তো আমার চম্বল অভিযান সম্পূর্ণ হত না। সেই সব সাহায্যকারী মানুষদের মধ্যে একজন ছিলেন জগরূপজি। বাগী মাধো সিং-এর এক সময়ের সঙ্গী এখন ভিণ্ড বাসস্ট্যান্ডের টাইমকিপার। আমাকে মাধো সিংয়ের জীবনকাহিনি শুনিয়েছিলেন, আরও অনেক ইনফরমেশন জোগাড় করে দিয়েছিলেন। মোহর সিং-এর বাড়ি যাওয়ার জন্যও তিনি প্রচুর সাহায্য করেছিলেন। জগরূপজির কথা পরে হয়তো বলব কখনও। আপাতত পরিকল্পনা মোহর সিং এর বাড়ি যাওয়ার। আগেরদিনই কথা হয়েছিল। সেইমতো সকাল সকাল ভিণ্ড বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে যাই।

একটা সাদা বাসে আমাকে বসিয়ে দেন জগরূপজী। সেই সঙ্গে কন্ডাক্টরকে ডেকে বলেন আমাকে যেন মেহগাঁওয়ের পানিট্যাঙ্কির কাছে নামিয়ে দেওয়া হয়। একদম গেটের কাছে জানলার ধারে বসেছিলাম। কলকাতার বাস বা দিল্লির বাসের মতো নয় এখানকার বাসগুলি। যেখানে-সেখানে যখন-তখন দঁড়ায় না প্যাসেঞ্জার তোলার জন্য। প্রায় দশ-পনেরো মিনিট পর পর গিয়ে বাস দাঁড়ায়। কিন্তু এই বাসটা প্রথম থামল প্রায় আধঘণ্টা পর। সেখানে অন্তত মিনট সাতেক দাঁড়াল। সকলেই বাস থেকে নেমে যে যার মতো চা-সিগারেট খাচ্ছে। আমিও নেমে একটা দোকানে চা নিলাম, দেখলাম কন্ডাক্টরও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকেও চা অফার করি। কন্ডাক্টর আমাকে বলেন, ‘আপ ক্যা জগরূপজীকে রিস্তেদার হো?’ আমি নিজের পরিচয় দিলাম। চা খেয়ে বাসে আমার পাশেই বসলেন কন্ডাক্টর। আমি ডাকাত নিয়ে কাজ করতে এসেছি শুনে নিজেই জানালেন তিনি বিলাও গ্রামের বাসিন্দা। অর্থাৎ যে গ্রামে মালখানের জন্ম, এবং ডাকাতজীবনের শুরুয়াত। মালখান সম্বন্ধে আমাকে নানান তথ্য দিলেন। মালখানকে ধরার জন্য গ্রামে একটা থানাও তৈরি হয়েছিল। যদিও সে থানা এখন সেখানে নেই, পুরোনো ভাঙাচোরা ব্যারাকই পড়ে রয়েছে খালি। আরো খুঁটিনাটি তথ্য পেয়ে গেলাম তার কাছে, যা পরে আমার অনেক অনেক কাজে এসেছে। খানিক পরে আমাকে নামিয়ে নামিয়ে দিলেন মেহগাঁও বাসস্ট্যান্ডের কাছে। এবার কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না।

একটা দোকানে গিয়ে প্রশ্ন করি। দোকানদার আমাকে জানালেন ওই যে দূরে জলের ট্যাঙ্ক দেখা যাচ্ছে সেখানে গিয়ে খোঁজো। সেখানে গিয়ে আরো একটা দোকানে খোঁজ করি। দোকানদার আমাকে খানিক দাঁড় করিয়ে রাখে। তারপর হঠাৎ কয়েকটা স্কুলের ছেলেকে সেখানে দেখতে পেয়ে তাদের মধ্যে একজনকে ডেকে আমাকে বললেন এর সঙ্গে যান, ও-ই নিয়ে যাবে আপনাকে বাগীভাইয়ের বাড়ি। ক্লাস থ্রি ফোরে পড়া সেই বাচ্চাটা আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল।

অতীতের সেই দুর্দান্ত বাগী মোহর সিং

 

আরও পড়ুন
‘চম্বলের থেকেও অনেক বড়ো বড়ো ডাকাত আছে রাজনীতিতেই’ : বাগী মোহর সিং

সরু-সরু গলি ডাইনে বাঁয়ে একেবেঁকে চলে গেছে সাপের মতো। আমরা তার মধ্যে দিয়েই চলেছি। যেতে যেতে কথা বলছি বাচ্চাটার সঙ্গে। আমাকে জিঞ্জাসা করল, ‘আপ ভলুকে মেহমান হো?’ আমি তো অবাক, ভলুটা আবার কে? বাচ্চাটা জোরের সঙ্গে বলল, ‘মেরা দোস্ত, আপ জিনকে ঘর যা রহে হো’। আমি বললাম আমি মোহর সিং-এর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, কাজ আছে। বাচ্চাটা জানায় ভোলুর দাদুর নাম মোহর সিং। খানিকটা চলার পর একটা নীলচে রঙের দেওয়ালওয়ালা বাড়ি দেখিয়ে আমাকে বলল এটা ভলুর বাড়ি। দেখিয়ে দিয়েই এক দৌড়ে ছুটে চলে গেল। এবার? চারদিকের বাড়ির সমস্ত দরজাই বন্ধ। কাউকে চিনি না, কী করব ভাবতে ভাবতে একবার ভালো করে বাড়িটার দিকে তাকাই। বাড়িটার সামনে লম্বা টানা রোয়াক দু-দিকে। মাঝে দু-ধাপ সিঁড়ির পর দরজা। দরজার কড়া ধরে নাড়তে থাকি। অনেকক্ষণ পর একজন মহিলা দরজা খুলে দিলেন।

প্রায় দেড়-হাত ঘোমটা-টানা মহিলা, মুখই দেখতে পারছি না, প্রশ্ন করব কী! তার উপর কোলে একটা বাচ্চা। যাই হোক, তাকে বললাম আমি অনেকদূর থেকে আসছি, মোহর সিং-এর সঙ্গে দেখা করতে চাই। মহিলা আমাকে বললেন, তিনি তো বাড়ি নেই, বাজারে গেছেন। কখন ফিরবে প্রশ্ন করায় বললেন, বাজারে গেছেন ওখানেই আড্ডা মারেন, ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেতে পারে। এখনই বাজে প্রায় সাড়ে বারোটার মতো, এতক্ষণ কী করব। অগত্যা একরামদাকে ফোন করি। একরামদা আমাকে বলেন, অপেক্ষা করো, যতক্ষণ না ফেরেন। ততক্ষণে মহিলা দরজা বন্ধ করে চলে গিয়েছেন। পুরো পাড়াটা নিস্তব্ধ, প্রত্যেক বাড়ির দরজা বন্ধ। দুপুরবেলার টাইম, আমি বাইরের রোয়াকে বসে আছি, অস্বস্তি হচ্ছে খুব। কেউ যদি এসে আচমকা প্রশ্ন করে, কী বলব আমি? বাড়িটা ঘুরে দেখার মনস্থির করলাম। রোয়াক ধরে এগিয়ে গেলাম সোজা, সেখানে একটা বড়ো লোহার গেট। তারপর পাঁচিল শুরু। আবার ফিরে আসি উল্টো দিকে। এদিক দিয়ে বাড়িটাকে পাক খেয়ে দেখলাম আরো একটা দরজা আছে, আর তার পাশ দিয়ে উঠে গিয়েছে একটা সিঁড়ি। চারপাশে তাকিয়ে দেখি এখানকার বাড়িগুলো পুরোনো দিল্লির বাড়ির প্যাটার্নেই। অর্থাৎ সমস্ত বাড়িগুলোই গায়ে-গায়ে। তিন-ইঞ্চি পাঁচিলের গাঁথনি। বেশিরভাগ বাড়িগুলোরই ইঁট বার করা, অর্থাৎ পলেস্তারা করা নেই। পাকা বাড়ি হলেও ছিরিছাঁদহীন, বিশ্রী দেখতে। কোনোরকম পরিকল্পনাহীন, ইঁট-কাঠ-পাথরের খাঁচার মতো। রাস্তায় লোক দেখতে পাচ্ছি না। কতক্ষণইবা উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরা যায়।

আরও পড়ুন
গ্রেনেডের আঘাতে উড়ে গেল গব্বর সিং-এর চোয়াল

বন্দুক নিয়ে জমি বাঁচাতে ছুটছেন ৮৫ বছরের মোহর সিং

 

আবারো কড়া নাড়ি, এবার একটা বাচ্চা ছেলে দরজা খুলে দেয়। দূর থেকে দেখতে পাই সরু বারান্দা ধরে একজন অশীতিপর বৃদ্ধ লাঠি হাতে হেঁটে আসছেন। ইয়া বড়ো গোঁফ, প্রায় ছ-ফুট তিন-ইঞ্চি লম্বা, বড়ো বড়ো চোখে হাই-পাওয়ারের চশমা। হাতে লাঠি থাকলেও মেরুদণ্ড সোজা করে হেঁটে এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। ইন্টারনেটের ছবির সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে যাচ্ছে। বুঝলাম, ইনিই মোহর সিং, আমার কাঙ্ক্ষিত, দুর্ধর্ষ, চম্বল-কাঁপানো ডাকাত। কিন্তু কখন ফিরলেন ইনি, দেখতেই তো পেলাম না! আমাকে এসে বললেন, ‘কা চাহিয়ে? এক ঘণ্টে সে দেখ রাহা হু তুমে, ঘরকে সামনে চহেলকদমী কর রহে হো, মতলব ক্যা তুমহারা?’ আশির কাছাকাছি বয়েস হলেও, যা জলদ্গম্ভীর তার কণ্ঠস্বর, অনায়াসে অমিতাভ বচ্চনের ব্যারিটোনকেও লজ্জায় ফেলে দেবেন তিনি। গলা শুনেই তো আমার হয়ে গেছে। আমতা আমতা করা বললাম, ‘বাঙ্গাল সে আয়ে হ্যায়, পত্রকার হুঁ, আপকা ইন্টার্ভিউ লেনা হ্যায়’। মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে হাওয়ায় হাতটা উড়িয়ে দিলেন তিনি, তারপর বাইরের রোয়াক ধরে হেঁটে এলেন লোহার বড়ো গেটটা পর্যন্ত। তারপর এক ধাক্কায় সেটা খুললেন। বললেন, ‘আও মেরে সাথ’। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে দেখলাম, ইঁট আর সিমেন্টে বাঁধানো বড়ো উঠোন, তার পাশে বাঁশ আর ত্রিপল দিয়ে একটা খাটাল। তাতে গোটা দুই গোরু আছে। উঠোনের মাঝখানে একটা খাটিয়া পাতা। ততক্ষণে এক বছর চব্বিশের যুবক আর দুটো বাচ্চা ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে সেখানে। আমাকে হাতের ইশারায় বসতে বলে, নিজেও বসলেন চম্বলের প্রবাদপ্রতিম ডাকাত মোহর সিং।

আরও পড়ুন
১১৬ জনের নাক কাটলে ছুঁতে পারবে না পুলিশ, গব্বর সিং-কে ‘উপদেশ’ তান্ত্রিকের

Powered by Froala Editor

More From Author See More