বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই সৎ ছেলের সঙ্গে পালাল নীলম, অগ্নিগর্ভ চম্বল

দুর্ধর্ষ দুশমন – ১৭

আগের পর্বে

স্কুলে যাওয়ার জন্যই বেরিয়েছিল রেণু। তবে পথেই তাকে অপহরণ করেছিল ডাকাত চন্দন যাদব। মুক্তিপণ চেয়েছিল দশ লক্ষ টাকা। বলাই বাহুল্য, রেণুর গরীব বাবা-মা সেই টাকা দিতে পারেনি। বন্দি রেণুকে পরে বিয়ে করেছিল চন্দন যাদব। তবে রেণুর সৌন্দর্যে, রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল চম্বল। রেণুকে পাওয়ার লোভেই চন্দনকে গুলিতে ঝাঁঝরা করেছিল বন্ধু রামবীর গুজ্জর। আর রেণুকে জোর করায় রামবীরকে গুলি চালিয়েছিল রেণু। তারপর বেহড়ের পথে কয়েকদিন ঘুরে বেরিয়ে আত্মসমর্পণ করেছিল সে। সাতবছরের জেল খেটে ২০১২ সালে যখন ছাড়া পায় রেণু। তখনও দুর্ভাগ্য কাটেনি তার। তাকে ভোগ করার লোভে বিভিন্ন আশ্বাস দিয়েও পিছিয়ে গিয়েছিল পুলিশ কর্তা থেকে নেতা সকলেই। স্বাভাবিক জীবনে ফিরেও চলছে সেই অসম লড়াই। আজ ভাগ্যের পরিহাসে আবার চম্বলের জীবনে ফিরে যাওয়ার কথাই ভাবে চম্বলের ইতিহাসের সবথেকে সুন্দরী ডাকাত রেণু যাদব।

রেণুর মতোই নীলমও একদিন স্কুল যাওয়ার পথে অপহৃত হয়। এক স্কুল পড়ুয়া পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী কীভাবে একজন ডাকাতসুন্দরী হয়ে উঠল নীলমের জীবন সেই কাহিনিই জানায়। যতবার চম্বলের বেহড়ে কোনো মহিলা ঝাঁপ দিয়েছে, তাকে নিয়ে খুনোখুনি হয়ে গিয়েছে চম্বলে। তার দখলদারি কে পাবে, তা নিয়ে চম্বল হয়েছে উত্তপ্ত। আবার কেউ ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে ডাকাতদের পয়সা দিয়ে অপহরণ করিয়েছে শত্রুর মেয়েকে। পরবর্তীতে সেই মেয়েই হয়ে উঠেছে চম্বল কাঁপানো মহিলা ডাকাত। চম্বল আজকাল শান্ত, কয়েকবছর আগে পর্যন্ত বেহড়ে দস্যুসুন্দরীদের  পদচারণায় যেখানে চুড়ির আর পায়ের মলের ছনছন শব্দের পাশাপাশি গুলির কর্কশ শব্দ খুব সাধারণ ব্যাপার ছিল, আজ সেখানে চম্বল প্রায় শূন্য। মানসিং, মোহর সিং, মালখান, গব্বরের মতো ডাকাতের পর, আশি পরবর্তী এমন এক ডাকাত দেখেছে চম্বল, যার স্টাইলই ছিল আলাদা। তার দলে ভর্তি ছিল অনেক সুন্দরী মহিলা, যাদের সত্যিকারের সুন্দরী বলা চলে। সেই ডাকাত নিজের ডেরায় মিডিয়াকে ডেকে ইন্টারভিউ দিত। এমনই ছিল তার প্রতাপ। প্রায় দুশোর বেশি গ্রামে নিজের এক আলাদা সরকার স্থাপন করেছিল সে। সেই ঠিক করত, এই এলাকা থেকে কে ভোটে দাঁড়াবে, আর কে নয়। যে বিদ্রোহ করত, তাকে শেষ করে দেওয়া হত। নির্ভয় সিং গুর্জর। চম্বল ঘাটির অন্যতম ভয়ঙ্কর আর শেষতম পুরোনো দিনের ডাকাত। ২০০৫-এ তাকে পুলিশ গুলি করে মারে। এই নির্ভয়েরই নথিভুক্ত চতুর্থ স্ত্রী হল নীলম গুপ্তা।

সীমা

 

প্রায় তেরো বছর জেলে থাকার পর আমার চম্বল যাওয়ার দু-মাস আগে ২০১৭-এর জানুয়ারিতে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। নীলমের যখন চোদ্দ বছর বয়স, সেইসময় গ্রামে তার বাবার এক শত্রু, নির্ভয়কে টাকা দিয়ে তাকে অপহরণ করায়। এরপর নীলমকে বেহড়ে রেখে নির্ভয় বাধ্য করে তার দলে শামিল হতে। ২০০৪-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে বিয়ে করে নির্ভয়। শেষপর্যন্ত নীলম নির্ভয়ের দত্তক সন্তান শ্যাম জাটভের সঙ্গে পালিয়ে যায় বেহড় থেকে। নীলমের নামে বহু হত্যা আর অপহরণের মামলা ছিল। ৩১ জুলাই ২০০৪-এ নীলম এটাওয়ার অ্যান্টি ডেকয়েট কোর্টে আত্মসমর্পণ করে। এরপরে তাকে লখনউয়ের নারীমুক্তি কেন্দ্র ওপেন জেলে পাঠানো হয়। জেল থেকে বেরনোর পরদিনই নীলম ঘোষণা করেছিল যে, সে ভোটে দাঁড়াবে। কিন্তু কোন পার্টি থেকে, সেটা তখনো পর্যন্ত সে ঠিক করে উঠতে পারেনি। এভাবে খাপছাড়া নীলমে কথা বলা যাবে না। নীলমের কথা বলতে গেলে আসতে হবে নির্ভয়ের কথাতেও। নির্ভয়ের ব্যাপারে না বললে নীলমের গল্প অপূর্ণই থেকে যাবে।

আত্মসমর্পণের সময় সীমা

 

আরও পড়ুন
দস্যুসুন্দরীকে পাওয়ার জন্য খুনোখুনি, লাল হয়ে উঠেছিল চম্বলের মাটি

১৯৮৬ সাল। একটি চুরির ঘটনায় নির্ভয়কে গ্রেপ্তার করে তাকে যথেষ্ট মারধোর করে পুলিশ। সেখান থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেই সে বদলা নেওয়ার জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে যোগ দেয় লালারামের দলে। ধীরে ধীরে নির্ভয় লালারামের দলের সবচেয়ে শক্তিশালী ব্যক্তি হয়ে ওঠে। লালারামের পর দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি। কিন্তু লালারামের রক্ষিতা কুসুমা নাইনের সঙ্গে তার একটা অবৈধ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। টের পেয়ে নির্ভয়ের উপর হামলা করে লালারাম। শেষমেশ পালিয়ে গিয়ে নিজের আলাদা দল তৈরি করে নির্ভয়। চম্বল আর তার আশেপাশের গ্রামে বাড়তে থাকে তার আতঙ্ক। একের পর এক মেয়েদের অপহরণ করে এনে দলে সামিল করতে থাকে সে। তার দলের দস্যুসুন্দরীদের মধ্যে সীমা পরিহার, মুন্নী পান্ডে, পার্বতী ওরফে চমকো, গৌরি জাটভ, সরলা জাটভ, নীলম ছিল প্রধান। তার দলে ২০০৫ পর্যন্ত প্রায় আড়াইশোজন ডাকাত ছিল। তার খুন করার এক আলাদাই ধরন ছিল। নির্ভয় খুন করার পর, কারো নাক কান কেটে নেয়, তো কারো হাত-পা। তার মাথার উপর প্রায় দুশোটি খুন আর সাড়ে তিনশোর বেশি অপহরণের মামলা ছিল। ২০০৫-এ মারা যাওয়ার আগে পর্যন্ত, মধ্যপ্রদেশ আর উত্তরপ্রদেশের পুলিশের তরফে তার মাথার দাম ছিল আড়াই লাখ টাকা। নির্ভয়ের দল জনপ্রিয় ছিল তার দলের মহিলাদের কারণে। সে প্রথমে মেয়েদের অপহরণ করত, তারপর তাদের ট্রেনিং দিয়ে বাধ্য করত তার দলে যোগ দিতে। আইনত সে চার-চারটি বিয়ে করেছিল। সবার আগে সে বিয়ে করে মুন্নি পান্ডে নামে এক দস্যু সুন্দরীকে। কিন্তু মুন্নী নির্ভয়ের পাতানো ভাই মুন্না গুর্জরের সঙ্গে পালিয়ে যায়। বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি হিসেবে সে দু-জনকেই খুঁজে বার করে খুন করে।

সরলা জাটভ

 

আরও পড়ুন
‘আজ তুমনে হামার ইজ্জত বাড়া দি’, বলে উঠলেন চম্বলের দলিত গৃহবধূ

১৯৮৬ সালে নির্ভয় এরপর বিয়ে করে সীমা পরিহারকে। কিন্তু সেও নারীদেহলোভী নির্ভয়ের সঙ্গে থাকতে না পেরে অন্য এক ডাকাতের সঙ্গে পালিয়ে যায়। পরে ২০০০ সালে আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু নির্ভয়কে সবচেয়ে বড়ো আঘাত দেয় নীলম। ২০০৪-এ বিয়ে করার মাত্র ছ-মাসের মাথায় নির্ভয়ের পাতানো ছেলে শ্যাম জাটভের সঙ্গে পালিয়ে যায় সে। সঙ্গে নিয়ে যায় প্রায় আট লাখ টাকা, চার লাখ টাকার লুঠের গয়না, আর নির্ভয়ের দলের প্রচুর হাতিয়ার। নিজের বিয়ের আগে সরলার সঙ্গে শ্যামের বিয়ে দিয়েছিল নির্ভয়। কিন্তু তাকে ভোগ করত সে নিজে। আর এই সুযোগেরই সদ্বব্যবহার করেছিল নীলম। নিজের সৎ ছেলে শ্যামকে সে নিজের দিকে আকর্ষিত করে শরীরকে ব্যবহার করে।  ধীরে ধীরে নির্ভয়ের বিরুদ্ধে উস্কাতে থাকে তাকে। আর একদিন সুযোগ বুঝে শ্যামের সাহায্যে বেহড় ছেড়ে পালায়। স্ত্রীর এই আচরণে রাগে ফেটে পরে নির্ভয়। ঘোষণা করে, যে নীলমকে ধরে দিতে পারবে তাকে সে একুশ লাখ টাকা পুরস্কার দেবে। নির্ভয় এরপর নিজের পুত্রবধু সরলাকে বিয়ে করে নেয়।

জঙ্গলের ডেরায় নির্ভয়ের চুল বেঁধে দিচ্ছে নীলম

 

আরও পড়ুন
‘খুদকে কিস্মত পর ক্যা রোনা, যাহা লে যায়েঙ্গী জায়েঙ্গে’, পিঠে চাপড় মেরে বলল গৌরী

নির্ভয়ের মৃত্যর পর বহুদিন পর্যন্ত দল চালিয়েছিল ষোলো বছরের সরলা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ আর সেইসঙ্গে ক্ষমতার ইচ্ছা ছিল নির্ভয়ের সবচেয়ে বড়ো শত্রু। উত্তরপ্রদেশের সরকার নির্ভয়কে ধরতে শুরু করে ‘অপারেশন নির্ভয়’। নির্ভয়ের পেছনে পরে যায় স্পেশাল টাস্কফোর্স। এসটিএফ  তার দলের প্রায় চল্লিশজনকে শেষ করে দেয়। তার উপর নীলম আর শ্যামের পালিয়ে যাওয়ায় আরেক বিপদ উপস্থিত হয়। এসটিএফকে নির্ভয়ের দলের সমস্ত খবরাখবর দিতে থাকে নীলম আর শ্যাম। দুজনেই এসটিএফের কাছে আত্মসমর্পন করেছিল। শেষমেশ ২০০৫-এর ৮ নভেম্বর ছতরপুর এলাকায় এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে দেখা করার খবর এসটিএফকে জানিয়ে দেয় নীলম। সেখানেই এসটিএফের সঙ্গে এনকাউন্টারে মারা যায় নির্ভয়। যদিও পুলিশ আর এসটিএফের তরফে নীলমের সাহায্য করার কথা অস্বীকার করা হয়। যেমনটা প্রতিবারই করে থাকে চম্বলের পুলিশ। কিন্তু নীলম না থাকলে সেইসময় পুলিশের সাধ্য ছিল না নির্ভয়কে এনকাউন্টার করার।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘নিচু জাতের’ হওয়ায় হেনস্থা, অপহরণ, ধর্ষণ; ক্রমশ ডাকাতদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে গৌরী

More From Author See More