মাঝরাতে হঠাৎ দরজায় ধাক্কা; অভিশপ্ত চম্বল আবার কী বিপদ নিয়ে এল?

দুর্ধর্ষ দুশমন – ১০

আগের পর্বে

বেহড়ের ওপরে এক প্রাচীন পরিত্যক্ত দুর্গ। নাম দেবগিরি দুর্গ। ভদাওর রাজ বদন সিংহ তৈরি করেছিলেন এই দুর্গ। দুর্গের দরজার উপরে ভেড়ার মাথা কেটে রাখা হত। সেখান থেকেই ঝরত রক্ত, চম্বলে প্রচলিত আছে এমন গল্পও। এই দুর্গই একসময় পৃষ্ঠপোষকতা করত ডাকাতদের। ভিণ্ড থেকে যাওয়ার কথা মেহেগাঁওয়ে। সেখানে মোহর সিংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা উদ্দেশ্য। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে এক ছোট্ট ঠেলাগাড়ি দোকানে আলাপ হল এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তির সঙ্গে। মেহেগাঁওয়ের নাম শুনে খানিকটা সন্দেহের চোখেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “মেহেগাঁও গিয়ে কী করবে তুমি?”

তাঁকে জানাই আমার উদ্দেশ্যের কথা। তিনি আমাকে জানালেন তিনি এখানকার বাসস্ট্যান্ডের বাসের টাইমকিপার। তিনিই জানিয়ে দেবেন কোন বাস যাবে মেহেগাঁও। তবে সেই বাস ছাড়বে বিকেলের দিকে। পাশের দোকানে দুটো চায়ের অর্ডার দিয়ে বলেন, ‘আপ পত্রকারলোগ মালখান সিং, মোহর সিং-কে পিছে দৌড়তে হো, লেকিন মাধো সিং-কি কাহানি লোগোকে সামনে নেহি লাতে’। আগ্রহ নিয়ে বলি, কী-রকম? আমাকে সেই বাস কন্ডাক্টর জগরূপ সিং বলেন, ‘মাধো সিং বাগীওকে বীচ অলরাউন্ডার থে। ম্যায় জানতা থা উনকো করীব সে। টাইম হ্যায় আপকে পাস? তো আও মেরে সঙ্গ’। আমি হ্যাঁ বলাতে তিনি আমাকে নিয়ে একটা গুমটি ঘরে এলেন। অনেক কথাই জানতে পারি তার কাছ থেকে। মাধো সিং নামক সেই দুর্ধর্ষ আতঙ্ক, যিনি কিনা চলে গেছিলেন কলকাতাতেও। এমনকি দেখা করেছিলেন জ্যোতি বসুর বাড়িতে। রাতের অন্ধকারে এক হাঁড়ি মিষ্টি দই আর রসোগোল্লা নিয়ে জ্যোতি বসুর হিন্দুস্তান পার্কের বাড়ির পাইপ বেয়ে উঠে, জ্যোতি বসুর সঙ্গে দেখা করে আবেদন করেছিলেন তার আত্মসমর্পণে সাহায্য করতে। সেসব গল্প অনেকেই ‘আবার চম্বল’ বইয়ে পড়েছেন। এবার গল্প একটু অন্যদিকে নিয়ে যাওয়া যাক। পুরনো ডাকাত ছেড়ে আসা যাক বর্তমান ডাকাতের কাহিনিতে।

 হোটেলে ফিরে এসে হাত মুখ ধুয়ে খানিকটা ফ্রেশ হয়ে নিলাম। মাথা হালকা করতে হবে খানিক। কারণ আমাকে বুঁদ করে রেখেছে মাধো সিং-এর অসাধারণ কাহিনি। তা থেকে বেরতে না পারলে পরবর্তী কাজ কিছুই হবে না। হালকা হালকা খিদে পাচ্ছে দেখে ভাবলাম একবার নিচ থেকে ঘুরে আসি। তবে এবার আর নিচের মিষ্টির দোকানে নয়, আশেপাশে একটু ঘুরে দেখব। যেমন ভাবা তেমনি কাজ। রাস্তায় এদিক সেদিক ঘুরে কাছাকাছি একটা ফাস্টফুডের দোকান দেখতে পেয়ে সোজা সেঁধিয়ে গেলাম তার ভেতর। ছোটো একটা দোকান। একটা স্যান্ডুইচের অর্ডার দিলাম দোকানের একটা বাচ্চা ছেলেকে। একটু দেরি হবে জানানোয় ওখানেই বসে একটা হিন্দি পত্রিকার পাতা উল্টোতে থাকি। এই সময় হঠাৎই একজন লম্বা চওড়া লোক ঢুকল দোকানে। তাকে দেখলে নির্ঘাত দক্ষিণী সিনেমার নায়ক বলে ভুল করবে কেউ। প্রায় ছ-ফুটের কাছাকাছি লম্বা। জিন্স আর শার্ট গুঁজে পরা। ইয়া বড়ো গোঁফ। দোকানে ঢুকেই কাউন্টারে থাকা ছেলেটাকে নানা রকম হুকুম করতে থাকে ভদ্রলোক। হঠাৎ তার কোমরের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ তো ছানাবড়া। তার কোমর থেকে খাপের মধ্যে ঝুলছে একটা রিভলবার। প্রথমে মনে হল তিনি বোধহয় পুলিশ-টুলিশ হবেন।

 আমি তো তাকিয়েই আছি তার দিকে। খানিক পর চলে যেতেই আমি কাউন্টারের ছেলেটাকে জিজ্ঞাসা করি, কে ওই লোকটা? ছেলেটা বলল, দোকানের মালিক, রবি সিং। কোমরে বন্দুক নিয়ে ঘোরে? ‘হ্যাঁ ভাইয়া হামেশাই বন্দুক লেকে ঘুমত হ্যায়’। জানতে চাই, কিঁউ? ‘অ্যায়সে হি, পর হামেশা বন্দুক রহেতে হ্যায় উনকে পাস’। আবারো লোকটা দোকানে আসে। আমার সঙ্গে গল্প করতে দেখে ধমক দেয় ছেলেটাকে। এবার আমিই বলি, ‘ভাইয়া বুরা মত মাননা, উসকে সাথ ম্যায়হি বাত কর রাহা থা’। আমার দিকে ফিরে লোকটা প্রশ্ন করে, ‘কৌন হো আপ?’ নিজের পরিচয় দিই। তারপর তাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি বন্দুক নিয়ে ঘোরেন কেন? রবি সিং খানিক আমার দিকে চেয়ে থাকে। তারপর বলে, ভাই আপনি এখানে থাকেন না, আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন না। আসলে আমাদের এখানে যার কাছে ট্র্যাক্টর, বন্দুক, আর গোঁফ নেই তার কোনো অউকাদ নেই। নিজের অউকাদ বোঝানোর জন্যই আমি বন্দুক নিয়ে ঘুরি। আমার লাইসেন্স আছে বন্দুকের। আবার বিনা লাইসেন্সেরও বন্দুক আছে।

আত্মসমর্পণের দিন ফুলন দেবী

 

 

আরও পড়ুন
‘খুনি দরওয়াজা’, ঝরতে থাকা রক্ত এবং মধ্যযুগের চম্বল

 পুলিশ ধরে না? আমার অবাক মুখের দিকে তাকিয়ে সুদর্শন এই রাজপুত পুরুষ বলে ওঠে, ‘পুলিশনে হি তো দিয়া বন্দুক। হম হিঁয়া চৌধরি হ্যায়, ইধার ইয়ে সব চলতা হ্যায়। আপকা বাঙ্গালকি তরহ হিঁয়াকা ইলাকা ইতনা ঠন্ড নেহি। ইধার সব গরম খুনওয়ালা রেহেতে হ্যায়’। বোঝো কাণ্ড! রক্ত গরম আর স্টেটাসের জন্য বন্দুক আর গোঁফ রাখতে হবে!  স্যান্ডুইচ চলে এসেছিল, খেতে খেতেই গল্প করছি রবির সঙ্গে। ডাকাত কি তবে এখনো চম্বলের সমস্যা? রবি জানায়, আগের মতো ডাকাতির সমস্যা এখানে আর নেই, সমস্যা হল বেহড়ের। কারণ বেহড় ধীরে ধীরে চাষের জমি গ্রাস করে নিচ্ছে। বাকি ডাকাতদের পুলিশ অনেকটাই ঠান্ডা করে দিয়েছে। চম্বল এখন আগের চেয়ে অনেক শান্ত। তবে ডাকাত একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। তাকে বলি, এখন যারা ডাকাত তাদের কি দেখা পাওয়া যাবে? কিংবা যোগাযোগ করা যাবে? একটা রহস্যময় হাসি দেয় রবি। তারপর অদ্ভুতভাবে বলে ওঠে, ‘আপকো ডাকুও সে মিলনা হ্যায়, মিল যায়েঙ্গে’। বলেই দোকানের বাইরে রাখা বুলেটে চড়ে বেরিয়ে যায় নিমেষে। আমার স্যান্ডুইচ মুখেই রয়ে যায়। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বুঝতে পারি না, রবির কথায় কোন ইঙ্গিত ছিল। স্যান্ডুইচ খেয়ে দাম মিটিয়ে ফিরে আসি।

মোহর সিংয়ের বাড়ি

 

 এখন আর কোথাও যাওয়ার নেই। এই অচেনা অজানা শহরে কোথায় আর ঘুরব! বাধ্য হয়েই ফিরে আসি হোটেলের ঘরে। না টিভি আছে না কিছু। ফলে মোবাইলই ভরসা। এমন একটা জায়গায় এসেছি যে সন্ধে সাতটার পর এখানে কোনো চায়ের দোকান খোলা থাকে না। এর মধ্যেই লজের একটা ছেলে এসে বলল, আপনি ঘর বদলানোর কথা বলেছিলেন, আসুন একটা বড়ো রুম ফাঁকা হয়েছে। তার পেছন পেছন গেলাম রুম দেখতে। বেশ বড়ো। একদম রাস্তার পাশে, কাচের স্লাইডিং জানলা। ছেলেটাই আমার মালপত্র নিয়ে এল আগের ঘোর থেকে। জল এনে দিল ছেলেটা। দেখলাম দাঁড়িয়ে আছে, ইতস্তত করছে। ভাবলাম বকশিস চায় বোধহয়। তাকে হাতে দশ টাকা দিয়ে বললাম আমাকে কাল সকাল সাতটায় ডেকে দিও তো। ছেলেটা হাসল, ঘর ছেড়ে বেরলো না। জানতে চাই, কিছু বলবে? এদিক ওদিক তাকিয়ে ছেলেটা বলল, ‘আপ রবিজীকে দুকান গয়ে থে? ডাকুওকে বারেমে পুঁছনে?’

মেহেগাঁও গ্রাম

 

 অবাক হলাম, তুমি জানলে কী করে? সবে তো এলাম। ছেলেটা বলল, ‘রবিজী ঠিক আদমি নেহি হ্যায়, উনসে অ্যায়সা বাত মত কিজিয়ে’। রাগ হল, আমি কার সঙ্গে কথা বলব, কোন দোকানে যাব, তাও কি হোটেলের ছেলেটাকে জিঞ্জাসা করে যেতে হবে নাকি! জবাব দিই, তুমসে মতলব? আপনা কাম সে কাম রাখো। ছেলেটা বলল, রাতে ভালো করে দরজা বন্ধ করে শোবেন। বললাম তোমাদের মিষ্টির দোকানে চা হবে? আমার রাতে একটু চা লাগে। বলল সাতটার পর আর চা পাওয়া যাবে না। তবে আমি বললে ও বানিয়ে ফ্লাস্কে করে দিয়ে যাবে, যাতে রাতে খেতে পারি, ওর হাতে পঞ্চাশ টাকা দিলাম। ছেলেটা খানিক পরেই চা দিয়ে গেল। সঙ্গে একটা কাপ। চা নিয়ে জানলার ধারে বসে আকাশপাতাল ভাবছি... এক সময় এই রাস্তাতে হেঁটেচলে বেড়াত মালখান সিং, মোহর সিং-এর মতো ডাকাত। হোটেল থেকে খানিক দূরেই থাকে লোকমান দীক্ষিত। ভাবছি চম্বলের ইতিহাসের কথা, কত কত ডাকাত, যাদের নামে এক সময় আসমুদ্র হিমাচল কাঁপত। খানিক দূরেই বয়ে যাচ্ছে অভিশপ্ত চম্বল নদী। তিন রাজ্যের মধ্যে দিয়ে বয়ে চলা এই নদী ৯০০ কিমি রাস্তা পেরিয়ে যমুনানদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। কিন্তু এই নদীর দৈর্ঘ্যের তুলনায় বেশি দীর্ঘ চম্বলের কাহিনি।

আরও পড়ুন
‘বীহড়ো মে শাপ হ্যায়, পতা নেহি ফির কিসকো কব খিঁচ লে’

এভাবেই চম্বলের বেহড়ে ঢাকা রাস্তা দিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে গাড়ি

 

এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কে জানে। কত রাত হবে জানি না, হঠাৎ ঘরের দরজায় ধাক্কা দেওয়ার আওয়াজ হল। ভাবলাম হোটেলের সেই ছেলেটা এসেছে, খেতে যেতে দেখেনি বলে হয়তো ডেকে দিতে এসেছে। কারণ রাত দশটার পর বাইরের গেট বন্ধ হয়ে যাবে। তখন আর হোটেল থেকে বেরনো যাবে না। চোখ কচলে উঠে মোবাইলে দেখি রাত প্রায় দুটো বাজে। খানিকটা অবাক হলাম, এত রাতে তো খেতে যাওয়ার জন্য কেউ ডাকতে আসবে না। তাহলে এত রাতে দরজা ধাক্কা দিচ্ছে কে? ঘরে লাইট জ্বালিয়েই শুয়ে পড়েছিলাম, কিন্তু হোটেলের ঘরে তো কেউ লাইট বন্ধ করার কথাও বলতে আসবে না। তখনো ঘুম কাটেনি পুরোপুরি। খানিকটা বিরক্তই হলাম। বিছানা ছেড়ে উঠলাম দরজা খুলে দেখার জন্য, যদি ছেলেটা হয় তাহলে আজ আমি ওর মুণ্ডপাত করব। জানতাম না, এই মধ্যরাতের শব্দ সারাজীবন আমার মনে থেকে যাবে। জানতাম না, পরের প্রায় পঁচিশ মিনিট আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় হয়ে উঠতে চলেছে, যার আতঙ্ক আমাকে বহুদিন তাড়া করে নিয়ে বেড়াবে, আর তা এতটাই যে চম্বল থেকে ফিরে আসার পরেও বেশ কয়েকদিন আমাকে ঘুমোতে দেবে না।

Powered by Froala Editor

More From Author See More