প্রকৃতিই কি আধুনিক ‘ডাকাত’ হয়ে উঠছে চম্বলের?

দুর্ধর্ষ দুশমন— ৩৬
আগের পর্বে

রাজস্থানের বৎস-গোত্রীয় সামন্ত মহাসেন, ওরফে চণ্ড ছিলেন চম্বলের প্রথম নথিভুক্ত বাগী। তাঁকে হত্যা করে তোমর সেনারা। তাদের দিল্লি থেকে বিতাড়িত করেছিলেন পৃথ্বীরাজ চৌহান। তবে হামেশাই লেগে থাকত সংঘর্ষ। খুন কা বদলা খুন— চম্বলের সেই অতিপরিচিত আইন। চম্বলে ডাকাতদের হাতে প্রাণ হারিয়েছিলেন আবুল ফজল। অল্পের জন্য রক্ষা পান হিউয়েন সাঙ। তবে বেহড় এমনই এক গোলকধাঁধাঁ, যে তাকে ডাকাতমুক্ত করতে পারেনি ক্ষমতাশালী সম্রাট থেকে ব্রিটিশ শাসকরাও। তারপর...

চম্বলের এই প্রাকৃতিক পরিবেশ কতটা দায়ী এই সব সাধারণ মানুষগুলোর বাগী হওয়ার পেছনে? এই যে উঁচুনীচু রুক্ষ ভূমি, এর সৃষ্টিইবা কেমন করে আর কীভাবেই বা তা প্রভাব ফেলেছে এখানকার অর্থনীতিতে, জেনে নিতে হবে তাও। না-হলে কেনই বা চম্বলের মানুষ পরিবার পরিজন সবকিছু ছেড়ে বেহড়ে ঝাঁপ দিত বাগী হওয়ার জন্য, তা বোঝা খানিকটা মুশকিল হবে। মানুষ ডাকাতের গল্প পরে হবে, আগে দেখে নেওয়া যাক প্রকৃতির ডাকাতি চম্বলকে কতটা গ্রাস করেছে।

ভূমি হ্রাস বিশ্বের বেশ কিছু অংশেই ইতিমধ্যেই একটি তীব্র প্রাকৃতিক সমস্যার রূপ নিয়ে ফেলেছে। উপত্যকা বা স্থানীয় আঞ্চলিক বুন্দেলখণ্ডী এবং ঠেঁট হিন্দিতে যাকে ঘাটি বলা হয় তা আসলে ভূমি হ্রাসেরই একটা রূপ যা ভূমির অত্যধিক ছিন্নবিছিন্ন অংশ তৈরি করে। ঘাটি বা উপত্যকা তৈরি হওয়ার প্রধান কারণ নদীর জলের দ্রুত বহমানতা যা মুখ্যত একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। ভারতে নদীবাহিত জলে মাটি ক্ষয়, ভূমি হ্রাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণগুলির একটা। ভারতের প্রায় ৩.৬১ কোটি হেক্টর ভূমি জল দ্বারা ক্ষয়ের কারণে প্রভাবিত। ভূমি ক্ষয়ের তালিকায় সবচেয়ে প্রভাবিত এলাকা হল গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান আর উত্তরপ্রদেশ। মধ্য ভারতে চম্বল উপত্যকা দেশের সবচেয়ে প্রভাবিত ক্ষেত্রগুলির একটি। চম্বল, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, আর উত্তরপ্রদেশে ক্ষয়ে প্রভাবিত এলাকা, যা সাধারণভাবে ঘাটি বা উপত্যাকা হিসেবে পরিচিত। চম্বল, যমুনা নদীর একটা গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক নদী চম্বলের অববাহিকায় অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে বেহড়ের নামে পরিচিত চম্বল উপত্যকা ভারতের সবচেয়ে নিম্নমানের ভূখণ্ড। চম্বলের বেহড়ে বড়ো বড়ো নালা আর অনেক উপত্যকা সামিল হয়েছে।

চম্বলের এই প্রাকৃতিক পরিবেশই সাধারণ মানুষদের বাগী হওয়ার পেছনে দায়ী।

 

এই এলাকা নিজের কম বিকাশ আর উচ্চ অপরাধের হারের জন্য পরিচিত। চম্বল নদীর এই উপত্যকার প্রায় ৪৮০০ বর্গকিমি এলাকা এই বেহড়ের অন্তর্গত, যার বিকাশ মূলত চম্বল নদীর দুই তীরে হয়েছে, যা এই এলাকাগুলির প্রধান জীবনরেখা। চম্বলের তীরে এই উপত্যকাগুলির গঠন ভীষণই ঘন এবং এর ৫ থেকে ৬ কিমি এলাকা গভীর নালার জালে ভাগ করা। বেশ কিছু ছোটো-বড়ো নালা শেষ পর্যন্ত নদীতে মিশে নদী প্রণালীর গর্তকে যথেষ্ট বাড়িয়ে দেয়। জলপ্রবাহের কারণে উৎপন্ন এই গর্তগুলিকে এই উপত্যাকা প্রভাবিত এলাকার এক প্রধান সঞ্চালক শক্তি হিসেবে মনে করা হয়। চম্বলের জনবসতিপূর্ণ এলাকার আর্থ-সামাজিক কাঠামো যথেষ্ট জটিল। গ্রামগুলিতে বসবাস করা ৮০ শতাংশর বেশি মানুষ মুখ্যরূপে কৃষি নির্ভর। এই অঞ্চলে বড়ো কোনো শিল্প নেই তথা জীবনযাপনের অন্য বিকল্পও সীমিত। এই কারণে জমির উপর নির্ভরতা অত্যধিক।

আরও পড়ুন
একের পর এক খুন, জেল ভাঙার ‘কৃতিত্ব’; কেন আত্মসমর্পণ করলেন ‘বিকিনি কিলার’?

ভূমিক্ষয় আর নালাগুলির কাঠামো, যা তাদের জমির সহজলভ্যতাকে আরো কমিয়ে দেয়, এর মুখোমুখি প্রায়ই হন এখানকার চাষিরা। আর তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য বেশ কিছু বিকল্প উপায় বের করে এসেছেন নিয়মিত। এই সমস্যাগুলি থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়গুলির মধ্যে বাঁধের রূপরেখা বানানো, চ্যানেলিং, নালাগুলির গতিপথ বদলানো, ফসল উৎপন্ন করার ধরনে পরিবর্তন তথা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকে সমতল করা সামিল রয়েছে। ভারী এবং আধুনিক মেশিনারির সহজলভ্যতার কারণে হালের বছরগুলিতে ভূমি সমতল করার কাজ বেড়ে গিয়েছে। যদিও আমার এই এলাকা ঘুরে বেড়ানোর সময় কৃষকেরা সমতল করা ভূমির গুণ এবং উৎপাদকতার ব্যাপারে নিরাশাই জানিয়েছেন। নিজের জমির এক অংশকে সমতল করার জন্য, মেশিনারি ভাড়া করার জন্য প্রচুর দেনা করা এক বয়স্ক কৃষক জানিয়েছিলেন যে বেশিরভাগ ব্যাপারে, সমতল করা ভূমি অনুৎপাদক হয়ে যায়, আর এই ভূমিকে সমতল করে রাখা বেশ দামি কাজ। পাম্পসেট থাকা কিছু গ্রাম আর কিছু সম্পন্ন চাষিকে বাদ দিলে, এই এলাকার কৃষি সম্পূর্ণরূপে বর্ষার উপর নির্ভরশীল। 

আরও পড়ুন
চম্বলের ডাকাতদের হাতে প্রাণ হারাতে বসেছিলেন হিউয়েন সাঙ!

চম্বলে এভাবেই দুই পার ভাঙতে ভাঙতে বয়ে চলে

 

আরও পড়ুন
গরুর চামড়া-ধোয়া জল থেকেই উৎপত্তি চর্মণ্বতী নদীর

সমতল করা সিঞ্চিত ভূমি বর্ষার শুরুতে উৎপাদক এবং লাভজনক প্রমাণিত হয়। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে সমতল করা জমি লাগাতার সেচের কারণে আরো ক্ষয় পেতে শুরু করে। খেতের মাঝে নালা আর ছোটো ছোটো গর্ত তৈরি হতে থাকে। সমতল করা জমির দেখভাল ভীষণই শ্রমসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এই জমিকে দ্বিতীয়বার ভারাট করে তাকে সমান করে গাদা তৈরি করে, বাঁধ দিয়ে রক্ষণাবেক্ষণ করা নিরন্তর প্রয়োজন। এটা জানা গেছে যে গত ৪০ বছরে (১৯৭০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত) নীচের চম্বল ঘাটিতে প্রায় ৬০০ বর্গ কিমি এলাকা সমতল করা হয়েছে। মাটির টিলাকে ভাঙার জন্য মেশিন ভাড়া করার জন্য খরচ হয় ৮০০ টাকা প্রতি ঘণ্টা। জমির নৈকট্য আর সেখানে পৌঁছোনোর মতো কারণের আধারেই সমতল করা যেতে পারে এমন জমি নির্বাচন করা হয়। এভাবেই সঠিক পরিকল্পনার অভাবে সমতল করা জমির রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বেড়ে যায়। বেহড় সমন্বিত ইকো সিস্টেমের একটা অংশ। জমি সমতল করায়, না কেবল ইকো সিস্টেম নষ্ট হয় বরং মাটির উপরের স্তরও ঢিলে হয়ে যায়, যে কারণে মাটির ক্ষয়ের বিপদ আরো বেড়ে যায়। জমি আরও নালা তৈরি হওয়ার জন্য সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। মাটির টিলা কেটে জমিকে সমতল করে চাষ শুরু করতে প্রায় এক বছর সময় লেগে যায়। যে বছর অনিয়মিত বৃষ্টি হয় সে বছর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়, কারণ লাগাতার ভারি বৃষ্টির কারণে জমিতে বড়ো ধরনের মাটি ক্ষয় শুরু হয়ে যায়। সমতল করা জমিতে নালা তৈরি হওয়ার প্রক্রিয়া আর অতিক্রমণ বেশি স্পষ্ট দেখা যায়। যদি মনোযোগ দেওয়া না হয় তাহলে অল্প সময়েই বহুমূল্য অচ্ছুত জমিও নালাগুলির কারণে ক্ষয়ের শিকার হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন
শত্রুর মেয়েকে অপহরণ দলের, পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইলেন ‘দস্যুসম্রাট’ মালখান

কেরিয়া বা কের গাছ

 

ভূমি সমতল করার প্রভাব এই এলাকার সামাজিক-আর্থিক অসমানতার উপরেও পড়ে। ভূমিকে সমতল করার ভারী খরচ দেখে এটা বলা যেতে পারে যে একমাত্র সেই মানুষেরাই ভূমিকে সমতল করে তাকে চাষযোগ্য করে তুলতে পারেন যাদের কাছে পর্যাপ্ত শ্রম শক্তি এবং অর্থ রয়েছে। প্রত্যেকবার বৃষ্টির পরে নালাগুলির মাথা দ্বিতীয়বার ভরা আর ভূমিকে সমতল করে রাখার জন্য নিরন্তর রক্ষণাবেক্ষণ এবং সতর্ক নজর রাখা প্রয়োজন। এই উপত্যকার জমির একটা বড়ো অংশকে প্রত্যেক বছর সমতল করা হচ্ছে তথা জঙ্গলসমেত ভাগ জমি আর পশুপালনের জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। এভাবে বেহড়কে সমতল করায় ভাগ জমির নিজস্বীকরণের সম্ভবনা তৈরি হয়ে গেছে। যদিও ছোটো চাষিরাও জমিকে সমতল করেন, তথাপি গ্রামীণ কৃষকদের মধ্যে সঙ্গতি সম্পন্নরা এর সবচেয়ে বেশি ফায়দা তোলেন। গ্রামীণদের পাশাপাশি আমার সার্বিক চম্বল সফরে স্থানীয় লোকেদের জীবনযাপনের সাধন হিসেবে বেহড়ের বেশ কিছু ব্যবহার সামনে এসেছে। এই প্রাকৃতিক স্থল ভীষণই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি স্থানীয় মানুষদের জ্বালানি কাঠের প্রধান উৎস, যার মধ্যে বাবলা, পার্বতী, কের বা কেরিয়া (এক ধরনের ছোটো কাঁটা গাছ, যাতে দু-বার ছোটো ফল হয়। এই ফলের আচার তৈরি হয়, অনেকটা ছোটো জংলি কুলের মত) প্রভৃতি গাছ প্রধান। জংলি ফল যেমন টেন্টি (এক ধরণের ছোটো বন কুলের মতো ফল), আর কুল আচার বানানোর জন্য সংগ্রহ করা হয়। যার ব্যবহার ঘরে খাবার জন্য আর আশেপাশের বাজারে বেচার জন্য করা হয়। এছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দারা গবাদি পশুর চারণভূমি হিসেবে উপত্যকার জমি ব্যবহার করে থাকে। এমন জমি অধিগ্রহণ করে তাকে সমতল বানানোয় ভাগের জমি নিজস্ব জমিতে পরিণত হয়, আর এর পরিণাম হিসেবে সাধারণ গ্রামবাসী, বিশেষ করে সামাজিকভাবে পিছিয়ে-পড়া গ্রামীণদের এই ভূমিতে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More