গরুর চামড়া-ধোয়া জল থেকেই উৎপত্তি চর্মণ্বতী নদীর

দুর্ধর্ষ দুশমন - ৩৪
আগের পর্বে

গ্রামের মন্দিদের জমি ফিরিয়ে দিতে হবে মন্দিরকেই। আর তার জন্য লিখিত অনুমতি দেবেন স্বয়ং রাজীব গান্ধী। এই ছিল মালখানের আত্মসমর্পণের শর্ত। তবে মালখান দলে কোনো মহিলাকে জায়গা দেয়নি। একমাত্র কমলাসুন্দরী ছাড়া। রক্ষিতা নয়, কমলাসুন্দরী ছিল মালখানের বোন। মালখানের দেখা না পেয়ে ফিরে আসতে হচ্ছিল বিলাও গ্রাম থেকে। সেসময় ডাক পড়ল পিছন থেকে। এক গ্রামবাসী এসে জানালেন ঠিক তার আগেরদিনই তাঁর সঙ্গে এক অনুষ্ঠানে দেখা হয়েছে মালখানের। তিনিই জোগাড় করে দেবেন ঠিকানা। তারপর...

চম্বলের নাম শুনলেই শুধু একের পর এক ভয়ঙ্কর বাগী ডাকাতদের কথা মনে আসে। তা সে মান সিং হোক বা মোহর সিং, মালখান সিং হোক বা চম্বলের শেষতম ভয়ঙ্কর ডাকাত নির্ভয় সিং গুর্জর। আর পুতলীবাঈ আর ফুলনদেবী তো মিথ হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে চম্বল মানেই শুধু বাঘা বাঘা সব বাগী নয়। চম্বল মানে এক অদ্ভুত গড়নের ভূমি, এক অদ্ভুত ধরণের সমাজ ব্যবস্থা। চম্বল মানে জাত পাতের রাজনীতির এক অদ্ভুত সমন্বয়। আর এসবেরই মিলিত ফসল হল বাগী। একথা একদমই সত্যি যে চম্বলের ভূমির গঠন, সেখানকার সমাজ ব্যবস্থা, সেখানকার আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি এবং জাতপাতের রাজনীতিই একের পর এক বাগী জন্ম দিয়েছে গোটা চম্বল জুড়ে। আর তা অতি প্রাচীন কাল থেকেই।

তাই চম্বলের ভূমি, চম্বলের এই জাতপাতের রাজনীতি বা সামাজিক গঠন সম্পর্কে আলোচনা না করলে, শুধুই যদি চম্বলের বাগীদের নিয়ে গপ্পো ফেঁদে বসলে এক প্রকার অন্যায় হবে। চম্বলকে বুঝতে গেলে, জানতে গেলে আগে চম্বলের ভূ-প্রকৃতি বুঝতে হবে। চম্বলের অস্তিত্ব কিন্তু সেই পুরাণ মহাভারতের সময়কাল থেকে। যখন এই চম্বলের নাম ছিল চর্মন্বতী। আসলে চর্মণ্বতী একটি নদী, গল্পকথা, পুরাণ এবং মহাভারত নামক মহাকাব্যের কথা অনুযায়ী যার জন্ম গরুর চামড়া ধোয়া জল থেকে। তাই চম্বলের বাগীদের গল্প আবার পরে শুরু করা যাবে, তার আগে একবার অতীত সফর করে দেখে নেওয়া যাক কেনো চম্বল এত ডাকাত এত বাগীর জন্ম দিয়েছে। সেই সঙ্গে চম্বলের এই বাগীপর্বের শুরুয়াত কীভাবে হয়েছে, আর পাশাপাশি দেখে নেওয়া যাক, পুরাণ, মহাকাব্যেই বা কীভাবে উঠে এসেছে চম্বল।

যদি এই নদীর সন্ধানে পুরাণ এবং মহাভারতের সময়কালে পৌঁছে যাওয়া যায় তাহলে অবাক হতে হবে। অভিশপ্ত নদী চম্বলের প্রাচীন নাম ‘চমরাবতী’ বা ‘চর্মণ্বতী’। চম্বলের প্রতি আর্য জাতি দীর্ঘকাল ধরেই উপেক্ষার মনোভাব নিয়ে থেকেছে। তার কারণ চম্বলের উৎপত্তিগত কাহিনি। যেমন আশ্চর্যের তেমনই বিতর্কিত। এই ২০২১-এ দাঁড়িয়ে সে কাহিনি শোনাতে গেলে রাজনৈতিক হিংসার শিকার হওয়ার সম্ভবনা প্রবল। কিন্তু ইতিহাসকেইবা অস্বীকার করি কীভাবে। চম্বল নদী থেকে অনতি দূরেই দশপুর নগর। সেখানকার রঘুবংশীয় প্রবল পরাক্রমী রাজা ছিলেন রন্তীদেব। মহাভারত অনুসারে তিনি ‘গোয়ালম্ভ’ বা গোমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। এই বিশাল যজ্ঞে কয়েক হাজার গরু বলি হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে বলিপ্রদত্ত সেই গরুর চামড়া ধুয়ে শুকোতে দেওয়া হত, আর ওই চামড়া থেকে যে জল ঝরে পড়ত তা থেকে চর্মণ্বতী বা চম্বলের উৎপত্তি। চম্বল অববাহিকায় এটাই জনশ্রুতি যে গরুর চামড়া থেকে উৎপন্ন হওয়ার কারণেই এই নদীকে অপবিত্র ধরে নেওয়া হয়।

সমস্ত চম্বলের এই ধরণের পতিত জমি ফসল না ফলাক, কিন্তু বাগী ফলাতে এর জুড়ি মেলা ভার

 

আরও পড়ুন
একের পর এক ডাকাতের আত্মসমর্পণ, তবু পরিস্থিতি বদলায়নি চম্বলে; কেন?

মহানদী চর্মরাশেরুৎকলেদাত্‌ সসৃজে যতঃ
ততশ্চর্ম ণ্বতীত্বেবং বিখ্যাতা সা মহানদী। (শান্তি পর্ব ২৯/২৩)

এই শ্লোক অনুসারে চর্মরাশি দ্বারা ঝরে পড়া ক্লেদ থেকেই এক বিশাল নদীর সৃষ্টি হয়েছে যা চর্মণ্বতী (চম্বল) নামে বিখ্যাত। অন্যদিকে মহাভারতের বনপর্বে রন্তিদেবকে গো হত্যাকারী রাজা বলা হয়েছে।

আরও পড়ুন
শত্রুর মেয়েকে অপহরণ দলের, পা ছুঁয়ে ক্ষমা চাইলেন ‘দস্যুসম্রাট’ মালখান

রাজ্ঞো মহানসে পূর্বে রন্তিদেবস্য বৈ দ্বিজ
অহন্যহনি বধ্যেতে দ্বে সহস্রে গবাং তথা। (বনপর্ব ২০৮/8)

এই ঘটনার কথা উল্লেখ রয়েছে রাহুল সাংকৃত্যায়ণের ‘ভোলগা থেকে গঙ্গা’ বইটিতেও। মহাভারতের অন্য একটি সংস্করণের মতে বলি দেওয়া গরুর রক্ত থেকেই এই নদীর উৎপত্তি। তবে তা প্রমাণসাপেক্ষ। এখানেই শেষ নয় মহাভারতে চম্বলের উল্লেখ। আরো উল্লেখ রয়েছে চম্বলের মহাভারতে।

আরও পড়ুন
জগন্নাথ-খুনের বদলা নিয়ে তবেই হোলি খেলবেন, প্রতিজ্ঞা মালখান সিং-এর

ততশ্চর্মণ্ববতী কুলে জম্ভকস্যাত্মজং নৃপং দদর্শ বাসুদেবেন শেষিতং পূর্ববৈরিণা। (সভাপর্ব ৩১ অধ্যায়)

অর্থাৎ ‘এরপর সহদেব (দক্ষিণ দিকে বিজয় যাত্রা প্রসঙ্গে) চর্মণ্বতীর তীরে জম্ভকের পুত্রকে দেখেন যাকে তার পূর্ব-শত্রু বাসুদেব জীবিত ছেড়ে দিয়েছিলেন। সহদেব তাকে যুদ্ধে হারিয়ে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলেন’।

আরও পড়ুন
‘বাগীসম্রাট দদ্দা মালখান সিং’, এখনও বাড়ির নেমপ্লেটে লেখা এই পরিচয়

এ এক অদ্ভুত নদী যা উল্টো পথে বয়

 

 এছাড়াও বনপর্বের তীর্থযাত্রা অনুপর্বে চর্মণ্বতীকে পুণ্য নদী বলে উল্লেখ করে বলা হয়েছে,

চর্মণ্বতী সমাসাদ্‌য় নিয়তো নিয়তাশন
রন্তিদেবাভ্যয়নু জ্ঞাতমগ্নিষ্টোমফলঃ লভেত্‌

মহাভারতে অশ্বনদীর চর্মণ্বতী নদীতে, চর্মণ্বতী নদীর যমুনায় আর যমুনা নদীর গঙ্গায় মিলিত হওয়ার উল্লেখ রয়েছে।

মঞ্জুষাত্বশ্বনদ্‌য়াঃ সা য়য়ো চর্মাণ্বতী নদীম্‌
চর্মাণ্বত্যাশ্ব যমুনা ততো গঙ্গা জগামহ।
গঙ্গায়াঃ সুতবিষয়ে চংপামনুয়য়োপুরীম।

অন্যদিকে শ্রীমদ্ভগবতগীতাতেও চম্বল বা চর্মণ্বতীকে নর্মদা নদীর সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে।

সুরসানর্মদা চর্মণ্বতী সিন্ধুরন্ধ।


সমগ্র চম্বল জুড়েই রয়েছে এই বেহড় যার জীববৈচিত্র অসীম

 

এ তো গেল মহাভারতের কথা। আদি সাহিত্যেও চম্বল কিন্তু রীতিমতো তার জায়গা করে নিয়েছে। চম্বল নদীর সৌন্দর্য্য থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেননি স্বয়ং কালিদাসও। এখানে মূল সংস্কৃত পঙ্‌ক্তি তার বাংলা মর্মার্থসহ তুলে দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না।

আরাধ্যৈনং শরবণভবং দেবমুল্লঙ্ঘিতাধ্বা
সিদ্ধদ্বন্দ্বৈর্জলকণভয়াদ্বীণিভির্মুক্তমার্গঃ
বাল্যম্বেথাঃ সুরভিতনয়ালম্ভজাং মানয়িষ্যন্‌
স্রোতোমূর্ত্ত্যা ভুবি পরিণতাং রন্তিদেবস্য কীর্ত্তিং।
                (মেঘদূত, পূর্বমেঘ ৪৬, কালিদাস)

পত্নীসহ সিদ্ধগণ, (যাঁর পূজা তরে
আসি’) বীণাকরে, পথ যাইলে ছাড়িয়া,—
বৃষ্টিপাতে তন্ত্রী সিক্ত হইবার ডরে,—
শরবণজাত সেই কার্ত্তিকে পূজিয়া,
কিছুদূরে সসম্ভ্রমে নামিবে (অচিরে)—
রন্তিদেবকীর্ত্তিরূপা যেথা চর্ম্মণ্বতী,
উদ্ভুতা হইয়া তাঁ’র গোমেধরুধিরে,
প্রবাহিতা ধরাধামে নদী মূর্ত্তিমতী।
(অনুবাদ, পাঁচকড়ি ঘোষ, ১৯৩৮)

ত্বয্যাদাতুং জলমবনতে শার্ঙ্গিণো বর্ণচৌরে
তস্যাঃ সিন্ধোঃ পৃথুমপি তনুং দূরভাবাৎপ্রবাহম্‌।
প্রেক্ষিষ্যন্তে গগণতয়ো নূনমাবর্জ্য দৃষ্টী—
রেকংমুক্তাগুণমিব ভুবঃ স্থুলমধ্যেন্দ্রনীলম্‌।।
(কালিদাস, পূর্বমেঘ ৪৭)

অবনত হ’লে তুমি, শ্যামতনুধর,
তটিনীর নীর সেই করিতে গ্রহণ,
গগনবিহারী যত গন্ধর্বকিন্নর
নিশ্চয় নুয়া’য়ে আঁখি করিবে দর্শন
বিশাল প্রবাহ তা’র (সুদূরবিস্তৃত),
—তথাপি দূরতা হেতু যেন ক্ষীণধার,—
স্থূল ইন্দ্রনীলখন্ডে মধ্য-অলঙ্কৃত
ধরাব-বক্ষে একগাছি যেন মুক্তাহার!
(অনুবাদ, পাঁচকড়ি ঘোষ)

তামুত্তীর্য্য ব্রজ পরিচিতভ্রূলতাবিভ্রমাণাং
পক্ষ্মোৎক্ষেপাদুপরিবিলসৎকৃষ্ণশারপ্রভাণাম্‌।
কুন্দক্ষেপানুগমধুকরশ্রীমুষামাত্মবিম্বং
পাত্রীকুর্ব্বন্‌ দশপুরবধূনেত্রকৌতুহলানাম্‌।
(মেঘদূত ৪৮)

চর্মণ্বতী অতিক্রম করি’ (অতঃপর),
তব দরশন আশে তৃষিতনয়ন
দশপুর-বধূগণে (প্রিয় বন্ধুবর!)
দেখাইয়া নিজমূর্ত্তি করিয়ো গমন।
ভ্রূবিলাসপটু সেই নয়নস্পন্দনে
উথলে বিমলজ্যোতিঃ শ্যাম শোভাময়,—
কম্পমান (মৃদুমন্দ সমীর-তাড়নে)
কুন্দ-অনুগামী যেন মধুপনিচয়!
(অনুবাদ, পাঁচকড়ি ঘোষ)

চম্বলের ভূ-প্রকৃতিই এমন

চম্বল যে বেশ প্রাচীন এবং পৌরাণিক একটি নদী, তার প্রমাণ তো পাওয়া গেল। কিন্তু বীহড় বা বেহড় ঠিক কী? সোজা বাংলায় এর মানে দাঁড়ায় নদীর অববাহিকায় সৃষ্টি উচুঁ-নীচু অসমতল জমি। চম্বল নদীর আববাহিকাজুড়ে এই বীহড়ের অবস্থান। যেখানে যেখানে চম্বল নদী বয়ে গিয়েছে, তার আশেপাশের এলাকায় নদীর ভাঙনে কোথাও সৃষ্টি হয়েছে গর্ত, কোথাওবা উচুঁ-নীচু টিলা। যার কোনোটার উচ্চতা চার-পাঁচতলা বাড়ির সমান, আবার কোনোটা একমানুষ সমান। এর ভেতর কখনো তৈরি হয়েছে প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গ, কখনোবা তৈরি হয়েছে দুই টিলার মাঝখানে অপ্রশস্ত পায়ে চলার পথ। এই পতিত জমিতে একমাত্র কিছু কাঁটা গাছ এবং লবণাক্ত জমিতে উৎপন্ন গাছ ছাড়া আর কোনো গাছ-গাছালিই দেখতে পাওয়া যায় না। অনেকটা আমেরিকার গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন বা আমাদের মেদিনীপুরের গড়বেতার গুনগুনি এলাকার মতোই। তবে আরো ব্যপক হারে। আর এই বীহড়ের কারণেই চম্বল এলাকার অর্থনীতির দৈন্যদশা। বীহড়ই এখানকার অর্থনীতি ঠিক করে দিয়েছে। কেবল চম্বল নদী নয়, চম্বলের খ্যাতি মূলত পাঁচের দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ পর্যন্ত তার বাগী বা ডাকাতদের জন্য। কালের নিয়মে শুরু থেকেই এই চম্বল অববাহিকজুড়ে ছিল ডাকাতদের আগ্রাসন। ভুল হল, ডাকাত নয় বাগী। প্রচলিত অর্থে বাগী মানে বিদ্রোহী। অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদে যারা হাতে তুলে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন অস্ত্র, আশ্রয় নিয়েছিলেন কাঁটাঝোপ-ভর্তি অসমতল পার্বত্য চম্বল উপত্যকায়।

Powered by Froala Editor

More From Author See More