অপহরণই বদলে দিয়েছিল নীলমের জীবন, চম্বলের ধূর্ত ডাকাতের নেপথ্য কাহিনি

দুর্ধর্ষ দুশমন – ১৮

আগের পর্বে

চম্বলের আরেক দস্যুসুন্দরী নীলমের গল্পও মিলে যায় রেণুর সঙ্গে। তাকেও অপহরণ করেছিল নির্ভয় সিং গুজ্জর। নির্ভয়ের চারটি স্ত্রীয়ের মধ্যে শেষ স্ত্রী ছিল নীলম। নির্ভয়ের প্রথম স্ত্রী মুন্নী পাণ্ডে নির্ভয়েরই পাতানো ভাইয়ের সঙ্গে পালিয়ে গিয়েছিল। দু’জনেরই শাস্তি হয় মৃত্যু। এর পর ১৯৮৬ সালে নির্ভয় সীমা পরিহারকে বিয়ে করে। ২০০০ সালে আত্মসমর্পণ করে সেও। তবে সবথেকে বড় আঘাত করেছিল নীলম। নিজের সৎ ছেলে শ্যামের সঙ্গেই পালিয়েছিল সে। বিয়ের ছ’মাসের মধ্যেই। তারপর তাদের সাহায্যেই পুলিশ হত্যা করেছিল নির্ভয়কে। যদিও সে কথা পুলিশ মানতে চায়নি। ২০১৭ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে নীলম ভেবেছিল ভোটে দাঁড়াবে।

২০০১-এ উত্তরপ্রদেশের আউরিয়া জেলার বিধুনা এলাকা থেকে নীলমকে অপহরণ করে নির্ভয়। সেই সময় নীলমের বয়েস ছিল মাত্র চোদ্দ বছর। ধীরে ধীরে নির্ভয়ের দলে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে নীলম। কারণ নির্ভয় তাকে জোর করে ধর্ষণ করত। সে বুঝেছিল, আর মুক্তি নেই তার। তাছাড়া চম্বলের নিয়ম ছিল যখন কোনো দল ডাকাতি করবে, তখন ডাকাতির জায়গায় দলের সকলের নাম একটা চিরকুটে লিখে ঘটনাস্থলে রেখে আসা। যাতে দলের সকলের নাম পুলিশের খাতায় উঠে যায়, আর কেউ দল ছেড়ে পালাতে না পারে। ফলে নীলমের নামও জড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে নিজের পরিধানে বদল আনে সে। জিন্স প্যান্ট আর গেঞ্জির উপর বুক খোলা শার্ট। পেটের কাছে গিট্টু মারা। মাথায় লাল টিপ, কাঁধে কার্তুজের বেল্ট আর হাতে বন্দুক। এটাই নিলমের পরিচিত ছবি। বহু ছবিতে, ইন্টারনেটের ইউটিউব ভিডিয়োতে এই পরিধানেই নীলমকে দেখা গেছে নির্ভয়ের লম্বা চুল বেঁধে দিতে। শ্যাম জাটভও ছিল নির্ভয়ের অপহৃত। কিন্তু শেষমেশ তাকে দলে নিজের ছেলে বলে পরিচিত দিতে থাকে নির্ভয়।

ট্রেকার চলে এসেছিল শীশগরান। এখানে নেমে খানিক দিশাহারা। হাইওয়ের সামনে নেমেছি। দু-দিকে খেত আর গ্রাম। আশেপাশের বেশ কয়েকটি বাড়িতে প্রশ্ন করেও নীলমের কোনো খোঁজ পাই না। কেউ বলতেই পারে না নীলম গুপ্তা নামের কেউ আছে কিনা। প্রায় এক ঘণ্টা ঘোরার পর ঠিক করি, আউরিয়া ফিরে যাব। এভাবে ঘোরার কোনো মানে হয় না। ট্রেকার ধরে ফিরি আউরিয়ার সেই পেট্রোল পাম্পের কাছে। একটা চায়ের দোকানে দেখে সেখানেই ঢুকে বসি। কী করব, কোথায় যাব, কীভাবেই বা নীলমের খোঁজ করব এসব ভাবতে ভাবতেই দেখি দুজন পুলিশের লোক সেই চায়ের দোকানে ঢুকছে। নিশ্চই তারা জানবে নীলমের বর্তমান ঠিকানা। প্রায় গায়ে পড়েই আলাপ জমাই তাদের সঙ্গে। একজনের নাম বাবুরাম গুর্জর, আরেকজন বিকাশ সিং। বিকাশের বয়েস ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ, বাবুরামের বয়েস প্রায় পঞ্চান্নর কাছাকাছি। বাবুরাম বলেন, “কহি আপ নির্ভয় কি রখেল নীলম কি বাত তো নেহি কর রহে হো? আরে ওহ রেন্ডি তো ইধারই রহতী হ্যায়।” এ কী ভাষা একজন পুলিশের! বলি, বাবুরামজী উনি তো নির্ভয়ের বিয়ে করা স্ত্রী ছিলেন। বাবুরাম, চায়ের গ্লাস হাতে অট্টহাস্য করে ওঠেন। তারপর বলে, “কাহা আপ ভি না বাঙ্গালীবাবু, আরে ইয়ে সব বেহড়ওয়ালি শাদি ওয়াদি কি বাত ছোড়ো। আসলমে ও এক নম্বর কি রেণ্ডি হ্যায়। হ্যাঁ, উসকা অপহরণ হুয়া জরুর থা। পর উসনে ভি কম গুল খিলায়া নেহি। নেহি তো আপনি সতেলি বেটেকে সাথ ইয়ে সব না করতি।” এখানে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। বললাম, কোথায় থাকেন জানেন? বাবুরাম বললেন, এইখানেই থাকে নীলম। ওই পেট্রোল পাম্পের বাঁ-দিক দিয়ে এগিয়ে গেলে একটা রামলীলা ময়দান পড়বে। সেখানেই মাঠের ধারে একটা পানবিড়ির দোকান আছে। সেটা নীলমের ভাই মনীশ গুপ্তার। এখন ওর কাছেই আছে নীলম আর তার মা। তুমি সেখানে খোঁজ করো। ধন্যবাদ জানিয়ে চায়ের দাম মিটিয়ে বেরিয়ে আসি। মনটা তেতো হয়ে গিয়েছিল।

হাঁটতে শুরু করি পেট্রোল পাম্পকে বাঁ-দিকে রেখে। প্রায় মিনিট দশেক হাঁটার পর বড়ো একটা মাঠ চোখে পড়ে। তার সামনেই একটা গুমটি দেখতে পাই। সেখানে একজন মহিলা বসে আছে।   তাকে গিয়েই নীলমের কথা জিজ্ঞাসা করি। মহিলা আমাকে প্রশ্ন করেন কোথা থেকে আসছি? নিজের পরিচয় দিলে তিনিই খবর পাঠান। ততক্ষণে এক বৃদ্ধা চলে এসেছেন সেখানে। জানলাম, তিনি নীলমের মা। আমাকে দোকান থেকেই একটা ঠান্ডা পানীয়ের বোতল খুলে দিলেন। নানা ধরনের গল্প হতে থাকে তাদের সঙ্গে। প্রায় তিরিশ মিনিট অপেক্ষার পর নীলম আর তার ভাই মনীশ আসে। মনীশই মাঠের পাশে একটা মিনারেল ওয়াটারের গুদামে দুটো চেয়ারের বন্দোবস্ত করে ইন্টারভিউর ব্যবস্থা করে দেয়। শুরু হয় ইন্টারভিউ। ছবিতে যে নীলমকে দেখেছিলাম, সে ছিল মাত্র চোদ্দ-পনেরো বছরের এক কিশোরী। এই নীলম তিরিশের এক যুবতী। ইউটিউবে যে ভিডিয়ো দেখেছিলাম, তার চেয়েও অনেক স্মার্ট। সতর্ক, হুঁশিয়ার, মেপে কথা বলে। প্রায় সব অপরাধ অস্বীকার করা, উচ্চকাঙ্খী এক স্মার্ট নীলমের মুখোমুখি হই আমি। দারুণ ডেসপারেট মেয়ে নীলম। চম্বলের থাকতে থাকতেই সে বুঝে গিয়েছিল তার সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার তার শরীর আর রূপ। আর সেটা দিয়েই অনেক মুশকিলের সে আসান করতে পারে। নির্ভয়ের মধ্যে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা পাওয়ার লোভ ছিল সেটাও জাগিয়ে তুলেছিল এই নীলমই। আর সেই ক্ষমতার লোভ চম্বলে থাকাকালীনই প্রকাশ পেয়েছিল নীলমের মধ্যে। নির্ভয় না থাকাকালীন, সরলাই দল চালাত। এমনকি ডাকাতি, অপহরণের টাকাও ভাগ করার দায়িত্ব ছিল সরলার। ধূর্ত নীলম সেটা মেনে নেয়নি। কৌশলে শ্যামের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক তৈরি করে সকলের অজান্তে। এমনকি আরেক ধূর্ত সরলাও সেটা বুঝতে পারেনি।

ধীরে ধীরে নিজের শ্যামকে বেঁধে ফেলে নীলম। শুধু শ্যাম নয়, নির্ভয়ের দলের ক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য দলের প্রভাবশালী আরো বেশ কয়েকজনের সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক গড়তে পেছপা হয়নি সে। সেইসময় ভোটের সাহায্য চাইতে অনেক স্থানীয় নেতারাও আসত নির্ভয়ের ডেরায়। তাদের খুশি করার জন্য সরলা এবং নীলমকে দিয়ে আসর বসাত নির্ভয়। তখন বহু স্থানীয় নেতার সঙ্গেও শারীরিক সম্পর্ক গড়েছিল নীলম। সেটা যে শুধু নির্ভয়ের নির্দেশে তা নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রেই স্বেচ্ছায়। অন্যদিকে  নিজের স্ত্রীর নির্ভয়ের অঙ্কশায়িনী হওয়া, ছেলে হওয়া সত্ত্বেও দলের দায়িত্ব না পাওয়া, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চম্বলের ওই কষ্টের জীবন, যেখানে বিনোদন বলতে শুধু মদ, গাঁজার নেশা, সেখানে নীলমের উপেক্ষা করতে পারেনি শ্যামও। বোকার মতো নিজেকে সঁপে দিয়েছিল নীলমের কাছে। আর নীলম তাকে ক্রমাগত ব্যবহার করে গিয়েছে। প্রথমে ধীরে ধীরে সে সরলা আর নির্ভয়ের বিরুদ্ধে শ্যামকে উস্কানি দিত। তারপর সুযোগ বুঝে শ্যামের সাহায্যে বেড়িয়ে আসে প্রচুর টাকা, লুঠের আর সরলার গয়না, এবং হাতিয়ার নিয়ে। যে হাতিয়ার আজো উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। একই জেলে বন্দি ছিল নীলম, রেনু যাদব, এবং কুসুমা নাইন। কৌশলে দুজনের সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতিয়েছে সে। তাদের কাছ থেকে জেনেছে উত্তরপ্রদেশের মাথাদের যোগাযোগ। আর সবার আগে জেল থেকে বেরিয়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। আর এখন মিডিয়ায় সামনে, নিজেকে তুলে ধরেছে অসহায়ের মতো। বারবার তার একই কথা, সে অত্যাচারিত, নিপীড়িত। সে কখনো কোনো ডাকাতি, খুন বা অপহরণের সঙ্গে যুক্ত ছিল না। যা সর্বৈর্ব মিথ্যা। একথাও মিথ্যা যে পুলিশ তার মা আর এক ভাইকে মিথ্যে অপরাধে জেলে পুরেছে। কারণ নীলম জঙ্গলে থাকাকালীনই তার ভাই কাল্লুর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। ডাকাতির মাল দল থেকে সরিয়ে ভাইয়ের মাধ্যমেই সে গোপনে চালান করত বেহড়ের বাইরে।

বেনারসের এই প্রভাবশালী ব্যক্তিকে ফাঁদে ফেলে অনায়াসেই সে পেয়ে গিয়েছে রাজনৈতিক টিকিট। যতই সে নিজেকে নিরাপরাধ বলুক, চম্বলের জঙ্গলে বসে তার গুলি চালানোর ভিডিয়ো কিন্তু নেট জগতে একটু খুঁজলেই পাওয়া যায়। তার নামে গোটা বিশেক খুন এবং প্রায় পঁয়ত্রিশ-চল্লিশটি অপহরণের মামলা রয়েছে। আছে ডাকাতির মামলাও। যার অনেক কিছু আজ প্রমাণিত সত্যি আইনের চোখে। এমনকি যে শ্যামকে সে বেহড় থেকে বেরনোর জন্য ব্যবহার করেছে, বেহড়ের বাইরে আসতেই সে-ই শ্যামকেই ফাঁসিয়ে দিয়েছে সে। নীলমের মতো আর কোনো মহিলা ডাকাত এতটা ধূর্ত, নির্লজ্জ ছিল না। সেইসঙ্গে ছিল নীলমের তুমুল মেজাজ। যে মেজাজের কারণে এক সময় দলে অপহরণ করে আনা এক বাচ্চাকে আছড়ে মেরে ফেলেছিল সে। তবে কে জানে হয়তো সেদিন স্কুল যাওয়ার পথে অপহৃত না হলে হয় চম্বল অঞ্চলের আর পাঁচটি সাধারণ গ্রাম্য মেয়ের মতোই হতো নীলমের জীবন। সামাজিক শত্রুতাই বছর ১১-র নীলমকে সমাজের বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে নিয়েছিল, আর তারপর ভাগ্যের পরিহাস তাকে বানিয়েছিল নিষ্ঠুর খুনি এক ডাকাত। এভাবেই তো সেই কত কত বছর ধরে চম্বলের নারীদের সম্মান ভুলণ্ঠিত হয়েছে, তাদের সমাজচ্যুত হয়ে হয় অপমানে মৃত্যুর পথ বেছে নিতে হয়েছে নয়তো অন্যায়ের পথ।

Powered by Froala Editor

More From Author See More