দি.দা. - তিনি দিগম্বর দাশগুপ্ত

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে  - ১৬

আগের পর্বে

মুক্তিপ্রকাশ মুখোপাধ্যায়, আমাদের মুক্তিমামু। পাড়াতুতো সেই মামা ছিলেন এক অদ্ভুত চরিত্র। ড্রামাটিক এফিসিয়েন্সি থেকে ইংলিশ কম্পোজিশন সবেতেই জিতেছেন মেডেল। লিখতেন অন্ত্যমিল থেকে ঘনবদ্ধ প্রবন্ধও। বাজাতে পারতেন প্রায় সমস্ত বাদ্যযন্ত্রও। ছিল একটি ডলসুনোও। তবে বেহালা বাজানো শেখেননি, কারণ তাতে যে দুঃখের সুর বাজে মূলত। এহেন মুক্তিমামু ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন বেশ কিছু সুকুমার রায়ের কবিতা। নিজে গিয়ে শুনিয়েও এসেছিলেন সত্যজিৎকে। কৌতুকে পরিপূর্ণ মুক্তিমামুর কোনোদিনও বুঝতে দেননি বয়সের তফাৎ। যা শেষ বয়স অবধি ধরে রেখেছিলেন তিনি।

এ খবর এমনভাবে আসবে, তাও এতদিন পরে এমনটি কল্পনাতেও ছিল না। আমাদের অনেকদিনের বন্ধু প্রদীপ, প্রদীপ দেববর্মন মেদিনীপুরের বাড়মানিকপুর থেকে তার ছড়ার পত্রিকা ‘সুসাথি’র শারদ সংখ্যার সূচিপত্রের পিডিএফ ফাইল পাঠিয়েছে হোয়াটসঅ্যাপে। যে পত্রিকা বা বই ছাপা হবে তার পিডিএফ ফাইল আগে থেকে পাঠাবার রেওয়াজ নেই, তাই একটু অবাকই হয়েছিলাম। হয়তো প্রদীপ তখনও নিশ্চিত ছিল না যে এমন দুঃসময়ে শেষ পর্যন্ত ছেপে বার করতে পারবে কিনা - তাই। 

কিন্তু সূচিপত্র পড়তে গিয়ে হতবাক হয়ে যাই ‘স্মরণে দিগম্বর দাশগুপ্ত’ ছাপা দেখে। প্রথমটা বিশ্বাসই করতে পারিনি। ফোন করার সাহস করতে না পেরে হোয়াটসঅ্যাপই করি বন্ধুকে ‘ভাই দিগম্বরদার ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না তো।’ প্রদীপ জানায় ‘সেকি? তুমি জানো না গৈরিক? দিগম্বরদা তো জুন মাসে মারা গেছেন!’

নাহ্, আর মনের থেকে মেনে নেওয়া অথবা অস্বীকার করার জায়গা রইল না।

মনে পড়ে যাচ্ছিল এখন থেকে প্রায় চব্বিশ-পঁচিশ বছর আগে কবি দীপ মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ‘ব্যঙ্গমা’র এক সভাতেই কবি দিগম্বর দাশগুপ্তের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপের দিনটি। অন্যান্যদের সঙ্গে সেদিন সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রীমতি কৃষ্ণা বসুও। কৃষ্ণাদি ব্যঙ্গমার সদস্য তো ছিলেনই, সঙ্গে তিনি তখন ওই কেন্দ্রের সাংসদও।

আমি ব্যঙ্গমায় সেই প্রথমবার। কিন্তু শুরুর সেই দিন থেকেই দিগম্বরদা আমায় কাছে টেনে নিয়েছিলেন। আর আমায় বুঝিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন যে অন্যান্য লেখার পাশাপাশি ব্যঙ্গরস রচনাতেও আমার একটা সম্ভাবনা রয়েছে এবং আমি যেন সেটি অবহেলা না করি। নিরন্তর উৎসাহও দিয়ে এসেছেন সে ব্যাপারে। সে কারণেই বড়দের ছড়া (যা কিনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক) এবং নক্সা ইত্যাদি নিয়মিত লেখার অভ্যাসটি হয়েছে ও রয়ে গেছে।

 

আমার উপর ওনার দুর্বলতার আরো দু’একটি কারণের মধ্যে একটি ছিল আমার মতই ওনারও একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ব্যাকগ্রাউণ্ড থাকা। আর আমি বদ্যি বাড়ির জামাই। শেষেরটি নিয়ে কিছুই বলার নেই যেহেতু বদ্যিরা স্বভাবতই একটু clanish হয়। দিগম্বরদাও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। 

তবে ব্যতিক্রমী ছিলেন তিনি – তাঁর চরিত্রে। প্রয়োজনে সমালোচনা যেমন করতেন, ভালো মনে হলে উদার হৃদয়ে প্রশংসাও করতে পারতেন। বেশ ক্ষুরধার রাস্তা! তাই না? বিশেষ করে আজকের দিনে। যখন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা আসন গ্রহণ করার আগে তাঁদের কেদারাটি ঝেড়ে দিতেও কবি - সাহিত্যিক এগিয়ে আসেন। 

এক অগ্রজ অত্যন্ত নামী ছড়াকার আমায় বলেছিলেন ‘ওই দিগম্বরের ব্যঙ্গমার সভায় বেশি যেও না গৈরিক। ও একজন আপাদমস্তক অ্যান্টি-এস্টাব্লিস্মেন্ট লোক।’ ছড়াকার ও কবি হিসাবে ওঁকে খুবই শ্রদ্ধা করতাম তাই বলিনি যে ‘মশাই অ্যান্টি-এস্টাব্লিসমেন্ট হতে গাটস্ লাগে। সবার সে কষ থাকে না।’

সত্যি, গুছিয়ে নেবার থাকলে অ্যান্টি-এস্টাব্লিসমেন্ট হলে তো চলবে না। 

এ ব্যাপারে একটা কথা বলেই রাখা যায় যে, কর্পোরেট ম্যানেজমেন্ট কিন্তু এই ‘বিরুদ্ধ গলার’ কথাগুলি মন দিয়ে শোনে। নাম দিয়েছি ‘The Voice of descent!’ অর্থাৎ ‘না’ বা ‘অমতের আওয়াজ’। কারণ যে মানুষ প্রশাসকের (এক্ষেত্রে শাসক) মতের বা বক্তব্যের বিরুদ্ধে গলা তোলে বা অমত জানায় সে নিশ্চয়ই প্রতিষ্ঠানটির ভাল চায়। নতুবা ‘হ্যাঁ’ বলাই তো সবচেয়ে সহজ এবং নিরাপদও। কিন্তু আমরা এই সংস্কৃতিটাকে নষ্টই করে ফেলেছি প্রায়। গোটা সমাজই প্রায় ‘Safer Side of the Fence’ –এ থাকতে চাইছে। আর তাই মেরুদণ্ডী প্রাণীরা ক্রমশ সংখ্যায় কমছে এবং একলা হয়ে পড়ছে। দিগম্বরদা তাদের গুনতিটা আরো কমিয়ে দিয়ে গেলেন। 

ব্যক্তি দিগম্বর দাশগুপ্ত এক অতীব রঙিন মানুষ। বহু-ভাষাবিদ, প্রযুক্তিবিদ, জাদুপ্রেমী, অভিযাত্রী। আর তিনি যে সুলেখক, বুদ্ধিদীপ্ত ছড়াকার, ক্যালিগ্রাফীর দক্ষ শিল্পী এবং নিপুন ব্যঙ্গচিত্রী তা আমরা সকলেই, বিশেষ করে ব্যঙ্গমার বন্ধুরা ভালো করেই জানি দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গ করার সুবাদে।

আর তিনি যে সুসংগঠকও তার প্রমাণ তিনি রেখেছেন চার দশক ধরে সুষ্ঠুভাবে ব্যঙ্গ রসিকসভা ‘ব্যঙ্গমা’ পরিচালনা করে। সংগঠন চালাতে হলে সব সময় সবাইকে খুশি করে চলা যায় না। অনেক সময় রূঢ় হতে হয়। কিন্তু তারপরেও টিকিয়ে রাখতে হয় সম্পর্ক। এ এক ভয়ানক ভারসাম্যের খেলা। এ খেলাতেও তিনি এক পারদর্শী খেলোয়াড়। অভিজ্ঞতাই বলাচ্ছে একথা। 

এতকাল পাশাপাশি হেঁটেছি আমরা, কাজেই মনোমালিন্যও হয়েছে মাঝেমধ্যে। বয়ঃকনিষ্ঠ আমি, আমারই নমনীয় হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু প্রত্যেকবারই তাঁর সুলিখিত ও সুচিত্রিত চিঠি এসে পর্বতপ্রমাণ অভিমান গলিয়ে জল করে দিয়েছে। এ ব্যাপারে বৌদির ভূমিকাও কম থাকতো না বলেই জেনেছি – দিগম্বরদার মুখেই। আর হবে নাই বা কেন! তিনিও অসাধারণ চিত্রশিল্পী। বাড়ির দেওয়ালগুলি ভরে আছে ‘ওরিয়েন্টাল স্কুল অফ আর্ট’-এর আলোয়। 

যখনই গেছি বাড়িতে, ফোন করে অথবা না করে, একা অথবা পুত্রসহ – আন্তরিক খুশি দেখেছি তাঁদের - মুখমণ্ডলে।

ছোটখাটো চেহারার দিগম্বরদার পৃথিবীটা কিন্তু বিরাট ছিল। আর তাই বোধহয় প্রতিদিন আশেপাশের ছোটখাটো নীচতাগুলি উপেক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে অস্বীকৃতির একটা বেদনা তাঁর মনের গভীরে ছিল। বিশেষত প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি না পাওয়ার।

কিন্তু এতো হবার নয় দাদা! আপনি আপোষ করবেন না অথচ প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি পাবেন — এতো হয় না। যারা মুখ খুলে নিন্দে করে, কিন্তু বুক খুলে প্রশংসা করতে পারে না তাদের কাছে আর কি আশা করা যায়? ওদের মাফ করবেন না, কিন্তু নজর-আন্দাজ্ করুন!

ব্যঙ্গমায় বহু পেশা এবং বহু নেশা (সখ)-র মানুষ আসতেন। সবাইকে সুযোগ করে দিতে হত। দিতেনও দিগম্বরদা। আমাদের কার্টুনিস্ট বন্ধু তমাল ভট্টাচার্য বলতো (হয়তো মজা করেই): ‘ভুল সুরে এসব রবীন্দ্রসঙ্গীত সহ্য করা যায় না। দুঃখ-কষ্ট সইতে পারি গৈরিক, কিন্তু এই সূক্ষ্ম-কষ্ট সহ্য হয় না।’ এই কারণেই নাকি সে ব্যাঙ্গমার সভায় যাওয়া বন্ধ করেছিল।

আমারও যাওয়া বন্ধ হয়ে যেত মাঝেমধ্যে নানা কারণে। কিন্তু দিগম্বরদার একটি চিঠি বা ফোন পেলেই বাধ্য হতাম আবার যেতে। এমনই ভালোবাসা, স্নেহ, জোর থাকত সে=সংযোগে। 

কিন্তু এবার কী করলেন দাদা! কিছু না বলে কয়েই নেটওয়ার্ক এরিয়ার বাইরে চলে গেলেন। সুইচ অফ করে নিলেন - একতরফা।

এবার থেকে তাহলে আর ফোনে-ফোনেও নয়— কেবলই মনে মনে!

Powered by Froala Editor