নারায়ণ সান্যালই যখন 'হরিদাস পাল'

বইমেলামেশা || পর্ব— ৭

বইমেলায় গেলে লিটল ম্যাগ প্যাভেলিয়নে অবশ্যই দেখা করতে হয় ‘ক্লেদজ কুসুমু’-এর সম্পাদক কবি প্রণব কুমার চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি অনেকদিনের বন্ধু। অনেক উত্থান পতনেরও সাক্ষী।

আর আছেন ‘কিঞ্জল’-এর সম্পাদক চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। যিনি না থাকলে বড়োদের জন্য ছড়া লেখার যে অভ্যাস, সেটিই নষ্ট হয়ে যেত আমার। অন্তত গত ২৫-৩০ বছর ধরে বইমেলার বেশ কয়েক মাস আগে থেকেই কিঞ্জল-এর সেই সংখ্যার বিষয় জানিয়ে তাগাদা দিয়ে সমক্ষেই আদায় করে নেন লেখা। সে লেখা ব্যঙ্গদর্শনে রবীন্দ্রনাথ, নারায়ণ দেবনাথ অথবা সত্যজিৎ রায়— যে সংখ্যাই হোক না! স্বামী-স্ত্রী যৌথ উদ্যোগে পত্রিকা চালান তাঁরা। এখন তো ছেলেমেয়েরাও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। অভিজাত পরিবারের সন্তান চন্দ্রনাথ ভারি নম্র ও ভদ্র স্বভাবের মানুষ। আমার সাধ্য কি তাঁকে এড়িয়ে যাই!

অন্তত আমার ক্ষেত্রে স্মৃতি যে সময়ক্রম মেনে ফিরে আসে না তা আগেই বলেছি। যেমন এই মুহূর্তে মনে পড়ছে দুটি ঘটনার কথা যাদের ঘটনাস্থল একই। দে’জ-এর স্টলের সামনের সোফায় বুদ্ধদেব গুহ বসে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তিতলি (আমার মেয়ে) এগিয়ে গেছে অটোগ্রাফের খাতা নিয়ে। দূরে দাঁড়িয়ে আমি দেখছি বুদ্ধবাবু সেই দিতে দিতে ওকে কি বললেন। আর জবাবে তিতলিও কি বলল ওঁকে। ফিরে আসার পর জিজ্ঞেস করি, ‘কীরে? কী বললেন উনি?’ ও বলে, ‘উনি বললেন, তিতলি তো আমার উপন্যাসের নায়িকার নাম!’ আমি বলি, ‘আর তুই কি বললি?’

আরও পড়ুন
বইমেলায় কাউন্টার টেবিলে চড়ে অপেরা স্টাইলে গান ধরতেন পীযূষকান্তি সরকার

তিতলি বলে, ‘কেন? আমি বললাম নামটা আমার মায়ের দেওয়া। আর যখন দেওয়া তখন আপনি ‘কোজাগর’ লেখেননি।’ ভাবি মেয়ে পুরো বাপের ধাত পেয়েছে। মুখে কিছুই আটকায় না।

আরও পড়ুন
বইমেলা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন নারায়ণ সান্যাল, পরদিন ভেসে এল মৃত্যুসংবাদ

অন্য ঘটনাটিও একই জায়গায়। মিত্র ও ঘোষের গায়ে একটি তরুণ বটগাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছি সপরিবারে কিন্নরদা ও আমি। মুখোমুখি উল্টোদিকে রাস্তার অন্যপারে দে’জ-এর সামনে সোফায় বসে সই বিলাচ্ছেন নারায়ণ সান্যাল। তাঁর সামনে একটি সেন্টার টেবিল। আর তাঁর ঠিক পিছনে ওই সোফারই হেলানটিতে দু’হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছেন ভগীরথদা। সিনিয়রকে সঙ্গ দিচ্ছেন। যেমন আমরাও করে থাকি। হঠাৎ লক্ষ করি, নারানদার সঙ্গে কি কথা বলার পরই হাসতে হাসতে ভগীরথদা আমাদের দিকেই আসছেন।

আরও পড়ুন
ভস্মীভূত বইমেলাকে মাত্র ৩ দিনে পুনর্জন্ম দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

আমরা জিজ্ঞেস করি, ‘কী ব্যাপার দাদা? এত হাসছেন কেন?’

উনি বলেন, ‘আর বলিস না! অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি নারানদা যা সই দিচ্ছেন সেগুলি আর যাই হোক না নারায়ণ সান্যাল-এর নয়। তাই জিজ্ঞেস করেই ফেললাম, ‘দাদা সইয়ের নামে ওগুলো কী লিখছেন?’ দেখে উনি বললেন, ‘লী করব বলো! দূর থেকে হৈ হৈ করে যারা আসছে সই নিতে তারা কেউ রাখবে মনে করো এই অটোগ্রাফ যত্ন করে? একটু এগিয়ে গিয়েই ফেলে দেবে এই হুজুগে নেওয়া সই। কেউ হয়তো বলেছে ঐ দ্যাখ সোফায় বসে আছে পাকা চুল বুড়ো! নিশ্চয়ই অথর! চল সই নিই। তাই এসেছে। একটু পরেই ফেলে দেবে মাটিতে। আর সবাই মাড়িয়ে যাবে নারায়ণ সান্যালকে। তাই কি আর করি নিজেকে বাঁচাতে ‘হরিদাস পাল’ সই করছি। কিন্তু ভগীরথ! মজার ব্যাপার দেখেছো, কেউ তো লক্ষও করছে না সইটা নকল!’

আমরাও হেসে কুল পাই না।

এই বইমেলাতেই একবার উর্দু অ্যাকাডেমির স্টলে, না সেটা তাঁবু ছিল— খুব বাহারি গালচে পাতা মেঝেয় বসে আয়ান রশিদ খাঁ’কে উর্দু শায়েরির আমার করা অনুবাদ শুনেছিল। হ্যাঁ, সামী শায়ের, উচ্চপদস্থ আইপিএস অফিসার আয়ান রশিদ খাঁ’কে।

রেওয়াজ চালু থাকলেও আমি বহুদিন আমার প্রকাশকদের ঠেকিয়ে রেখেছিলাম বইয়ের জ্যাকেটের ইনসাইড ফ্ল্যাপে লেখকের ছবি দেওয়া থেজে। কেউ কেউ ক্ষুণ্ণও হয়েছেন এজন্য।

কিন্তু স্টলের বাইরে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে আসা পাঠকের কাছে নিজের বইয়ের সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া জানার অনুভূতি সত্যিই অন্যরকম। 

এমনই একবার। গিল্ড অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাধ্বনি ও তৎপরবর্তী হাততালি শুনে বাড়ি ফিরব বলে পার্কস্ট্রিটমুখো রাস্তা ধরেছি দীপদা আর আমি। মাঠের ভিতরের রাস্তাগুলি ফাঁকা হয়ে এসেছে ততক্ষণে। আমাদের উল্টোদিক থেকে এক ভদ্রমহিলা হেঁটে আসছিলেন। দীপদা আমার হাতটা টেনে বললেন, ‘এসো আলাপ করিয়ে দিই মাধবী মুখার্জির সঙ্গে।’

‘আরে দীপ! তুমি!’

‘হ্যাঁ, মাধবীদি আমি। আর এ হল গৈরিক। ও বিজ্ঞান লেখে। আর লেখে ছড়া।’

‘ও! তাই তোমার বন্ধু!’, উনি বলেন ‘ছড়া’-র দিকেই ইঙ্গিত করে।

আমি হাতজোড় করে নমস্কার জানাই। উনি প্রতিনমস্কার করেন।

বইমেলার কমে আসা আলোয় তাঁকে মুখোমুখি দেখে মনে হয়েছিল এমন সুন্দরী ও ব্যক্তিময়ীর প্রতি ক্যামেরাও সবসময় সুবিচার করতে পারেনি।

ঘণ্টাধ্বনির সংখ্যাটা মনে করতে পারলে সালটা বলা যেত। কিন্তু আজ আর তা মনে করতে পারি না। 

সাল মনে না থাকলেও সেবারের কথাটাও কি ভুলে যাবার? মেলার শেষদিন, অন্তিম প্রহর! রাত ন’টার সমাপ্তি ঘোষণার দশ মিনিট আগেই আমরা (অর্থাৎ কিন্নরদা, দীপদা ও আমার ট্রায়ো) পৌঁছে গেছি গিল্ড অফিসের সামনের রাস্তায়। যথারীতি বেশ কিছু লোকজনও জমা হয়ে গেছে। কবি সোমকদা আমার সিনিয়ার হলেও দাদাদের সমসাময়িক।

ন’টার ঘণ্টা বাজে। সেই ঘণ্টাধ্বনির মধ্যেই সোমকদা তাঁর স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে সপাটে চুমু খান। আর তাঁর বাঁহাতের উপর শরীর এলিয়ে দেন তাঁর সহধর্মিণী। একেবারে ‘বর্ষাৎ’-এর সেই বিখ্যাত শট্। আরকে স্টুডিও-র সিম্বল। আমরা সে ছবি ফ্রিজ করতে পারিনি। উল্টে আমরাই ফ্রিজ হয়ে যাই ঘটনার আকস্মিকতায়। ততক্ষণে ঘণ্টা বাজা থেমে গিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল হাততালি। 

আনন্দ-বেদনার এক মিশ্র অনুভূতি আর আরও ভালো লেখার প্রতিজ্ঞা করে আমরা উৎসব ফেরত বাড়ি ও কলেজস্ট্রিটের দৈনন্দিনতার দিকে মুখ ফেরাই এবার।

Powered by Froala Editor

Latest News See More