বইমেলা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন নারায়ণ সান্যাল, পরদিন ভেসে এল মৃত্যুসংবাদ

বইমেলামেশা || পর্ব— ৫

নতুন সহস্রাব্দের (২০০০) প্রথম বইমেলার থিম কান্ট্রি ছিল ব্রাজিল। সেটা বইমেলার রজতজয়ন্তী বর্ষ। উৎসবের মেজাজ রাখতেই কি ব্রাজিল! কার্নিভাল, সাম্বা নাচ, ভেস্টিভিটি, দক্ষিণ আমেরিকার একমাত্র পর্তুগিজ বলা রাষ্ট্র। নিজেদের প্যাভেলিয়ান দারুণ সাজিয়েছিল ব্রাজিল সেবার। বেদেশি প্যাভেলিয়ানগুলোয় আমরা বিশেষ ঢুকতাম না।

কেবল সেইদনই যেতাম, যেদিন সঙ্গে দেবুদা থাকতেন। দেবব্রত ঘোষ অর্থাৎ আমাদের দেবুদার চাকরি ছিল কাগজের (আজকাল) দপ্তরে। কোনোরকমে ছুটি ম্যানেজ করে দু’দিন আসতেন বইমেলায়। একদিন পরিবার নিয়ে আর একদিন একা— আমাদের সঙ্গে। যেদিন পরিবার নিয়ে আসতেন সেইদিন আমি এবং কিন্নরদাও সপরিবার যেতাম মেলায়। তারপর আমরা সবাই মিলে চক্কর কাটতাম সারা মেলাজুড়ে। ছেলেমেয়েরা আইসক্রিম খেত আর আমরা চা বা কফি। 

টুলকি, তিতলি, তিন্নি ও আকাশ— সব বইয়ের স্টলে উল্টোদিক দিয়ে ঢুকত। বাপ-জ্যাঠাদের পরিচিতির এই সুযোগটা তারা নির্দ্বিধায় নিত। আর বেশ আনন্দও পেত। এসব করে ক্লান্ত হয়ে গেলে সবাই মিলে গিয়ে বসা হত মমার্ত-এ। মমার্ত ছিল শিল্পী শিবির। বহু জুনিয়ার ও সিনিয়ার আর্টিস্ট সেখানে বসে মাটির ভাস্কর্য বানাতেন। পেইন্টিং ও করতেন অনেকে। ওই সময়ে আজকালের আলকদা এসে যেতেন। তিনি আমাদের ছেলেমেয়েদের ‘লাঙুরাম’, ‘গজারাম’ ইত্যাদি নামে ডাকতেন। 

আরও পড়ুন
ভস্মীভূত বইমেলাকে মাত্র ৩ দিনে পুনর্জন্ম দিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য

এমনই একবার, ময়দানে দে’জ-এর স্টলের সামনে সোফায় বসে সই দিচ্ছেন নারানদা (নারায়ণ সান্যাল)। আমি আর কিন্নরদা সপরিবার দাঁড়িয়ে গল্প করছি রাস্তার উল্টোদিকে মিত্র ও ঘোষের স্টলের গা ঘেঁষে। আকাশ বলল ‘চলো না বাবা ঐ জ্যেঠুর অটোগ্রাফ নিয়ে আসি!’ আমি বলি, ‘তুমি একে গিয়ে নিয়ে এসো। আমি এখানে আছি।’ সে বলে, ‘জ্যেঠু যদি রাগ করে?’ আমি বলি, ‘উনি খুব ভালো মানুষ। একটুও রাগ করবেন না।’ কিঞ্চিৎ দ্বিধা নিয়ে আকাশ রাস্তা পার হয়ে এগিয়ে যায়। একটু পরেই আকাশ অটোগ্রাফ নিয়ে ফিরে আসে। তবে মুখ তার থমথমে। আমাকে বলে, ‘তুমি যে বললে জ্যেঠু খুব ভালো মানুষ রাগ করবেন না! আমাকে তো রেগে রেগেই সই দিলেন।’ 

আরও পড়ুন
যখন টিকিট কেটে ঢুকতে হত বইমেলায়

শিশুকে বুঝিয়ে বলি, ‘হয়তো ওঁর শরীরটা ভালো নেই। তবে সই তো দিয়েছেন তোমাকে। রাগটা ভুলে যাও।’

আরও পড়ুন
প্রথম বইমেলা, প্রথম বই

এর মধ্যেই দেখি নারানদার গাড়ি এসে দাঁড়ায় দে’জ-এর সামনে এবং উনি মেলা ছেড়ে বেরিয়ে যান। আমিও বেশ অবাক হই অমন মানুষের এমন ব্যবহারে।

পরের দিন সকালেই খবরের কাগজে নারায়ণ সান্যালের মৃত্যু সংবাদ পাই।

আজও আকাশের অটোগ্রাফ খাতায় জ্বলজ্বল করছে তারিখ ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০০৫। নারায়ণ সান্যালের শেষ সই!

Powered by Froala Editor