জীবনে বাদল ছাইয়া

শ্রুতিমধুর – ৭

আগের পর্বে

বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের জোয়ারে তখন ভাসছে বাংলার পথঘাট। মেসের ছেলেরা অনুরোধ করলেন কান্তকবিকে, একটা গান লিখতে হবে তাঁকে। প্রথক দুটি স্তবকের লেখা, সুর হয়ে গেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই। তারপর ছাপাখানায় গিয়ে বাকি লেখা। আগুনের মতই মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছিল সে গান। ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’। কিন্তু কান্তকবির দেওয়া সেই সুরের বিকৃতি হয়েছে। বিভিন্ন শিল্পী বিভিন্ন সময়ে নিজের মত করে বদলে নিয়েছেন স্বরলিপি। বাদ যাননি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ও। বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন কান্তকবির দৌহিত্র দিলীপকুমার রায়। তাল-ছন্দ-লয় তো পরের কথা। কান্তকবির ধরতে চাওয়া দেশের বিষাদ, দুঃখ, যন্ত্রণার সুর কোথাও যেন হারিয়ে গেছে জনশ্রুতি থেকে।

ডাকসাইটে বাঙালি সিভিল অফিসার স্যর কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত। কলকাতার অভিজাতমহলে পরিচিত নাম। পরিবারটি সেকালের কলকাতার ব্রাহ্মসমাজের অঙ্গ। ভাইদের পারস্পরিক সখ্য প্রবল। বোনের সঙ্গে বিবাহসূত্রে সম্বন্ধ ঘটেছে ঢাকার সেনপরিবারের সন্তান রামপ্রসাদ সেনের। রামপ্রসাদ মানসিক রোগের স্থানীয় ডাক্তার, তবে শখ বেশি গানের। কনিষ্ঠ পুত্রসন্তানকে নিয়ে মাঝেমাঝে প্রভাতীকীর্তন গেয়েও বেড়ান। তবে পরিবারের সুখ বেশিদিন স্থায়ী হল না। হঠাৎই মারা গেলেন রামপ্রসাদ। চার সন্তানকে নিয়ে দিশেহারা কৃষ্ণগোবিন্দের বোন হেমন্তশশী। দাদার সাহায্য নিয়েই বিয়ে করলেন চিত্তরঞ্জন দাশের জেঠামশাই বিপত্নীক দুর্গামোহন দাশকে। রামপ্রসাদ ও হেমন্তশশী কেশবচন্দ্র সেনের অনুগত ছিলেন। নববিধান ব্রাহ্মসমাজ আদি ব্রাহ্মসমাজের তুলনায় আধুনিকমনস্ক প্রগতিপন্থী বলেই পরিচিত। কিন্তু বিধবা নারীর দ্বিতীয় বিয়ে? সে মানা তাঁদের অনেকের পক্ষেও বড়ো কঠিন। ফলে, প্রচুর ঝড় বইল। সেসব সয়েই ফের সংসার পাতলেন দুর্গামোহন-হেমন্তশশী। ছেলেমেয়েরা ততদিনে একটু বড়ই, তারাও যে খুব সহজে মেনে নিতে পারল না সবটা। ছেলে অতুলপ্রসাদ ব্যারিস্টারি পড়াশোনা করার সুবাদেই ঘর ছেড়ে একরকম বাঁচল। কলকাতায় এসে মামাদের কাছে কিছুদিন থেকে পাড়ি দিল বিলেত। তার কিছুদিনের মধ্যেই সপরিবার সেখানে এলেন বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দও, তাঁদের সঙ্গে থাকতে শুরু করল বছর কুড়ির ছেলেটি। কী এক আশ্চর্য টানে বিলেতের পথঘাট জলজঙ্গলের মধ্যে তাকে জড়িয়ে ফেলল একটি মেয়ে। কোন্‌ শৈশব থেকেই তাকে চেনা, তবু সদ্যযৌবনের আলো মেয়েটিকে নতুন করে দেখাল যেন। বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দের মেয়ে হেমকুসুম। সোনারই ফুল যেন, সুদর্শনা, ব্যক্তিত্বময়ী, বেহালা বাজাতে পারে, পিয়ানো বাজাতে পারে, গানের গলাও চমৎকার।

১৮৯৫ সাল। সিদ্ধান্ত নিলেন সেই যুবক, দেশে ফিরে আসতে হবে। ফিরে এলেন, কিন্তু কলকাতায় পসার তেমন জমল না। যেতে হল রংপুর। এই দুঃসময়ে হেমকুসুমকে আরও আঁকড়ে ধরলেন তিনি, বুঝলেন, এ দুদিনের খেলা নয়। পরিবার আবারও একটা ঝড়ের মুখে পড়ল। আর ১৯০০ সালে ফের যেতে হল বিদেশ। আইনব্যবসায়ী যুবক জানতেন, ব্রিটিশ ভারতের বাঙালি ব্রাহ্মপরিবারে মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের বিবাহসম্বন্ধ আইনত সিদ্ধ নয়। অতএব বিয়ে হল স্কটল্যান্ডে। কিন্তু সেখানে থাকাও পাকাপাকি সম্ভব হল না। ১৯০১-এ যমজ সন্তান হল তাঁদের, একটি সন্তান সাতমাস বয়সে মারা গেল। মৃত শিশুর স্মৃতি নিয়ে ছোট্ট পরিবারটি আবার নতুন লড়াই লড়তে ফিরে আসে কলকাতায়। কিন্তু কলকাতা শহর যেন কিছুতেই তাঁদের গ্রহণ করল না। তখন হাত বাড়িয়ে দিল উত্তরভারতের নবাবি শহর লখনৌ।

লখনৌ অতুলপ্রসাদকে অনেক কিছু দিল। অভিজাত আদব, সম্ভ্রান্ত যাপনশৈলী, রঈসি মেজাজ। সম্মান, প্রতিপত্তি, যশ, সবকিছুই এল একে একে। কিন্তু, জীবন তো আসলে সমুদ্রেরই মত; এক ঢেউ এলে অন্য ঢেউকে তার জায়গা ছেড়ে দিতে হয়। বিনিময়ের নিয়ম অভ্রান্ত। ১৯০২ থেকে অতুলপ্রসাদ পেলেন অনেক কিছু, হারালেন তার একটু বেশিই। হারালেন এত লড়াই করে বানানো সংসারখানা, লড়াইয়ের সঙ্গিনীকে, একটিমাত্র সন্তানকেও। সারা জীবনের জন্যে ঘটে গেল বিচ্ছেদ। ভেঙে গেল সাজিয়ে তোলা সাধের সেই কুঞ্জবন।

লখনৌয়ের কায়জারবাগে যে বাড়িতে থাকতেন অতুলপ্রসাদ সেন, ব্যারিস্টার মিস্টার এ পি সেন নামেই যিনি অঞ্চলে বেশি খ্যাত, তার থেকে মাইল দেড়েক দূরে আরেকটি বাড়িতে থাকতে শুরু করন হেমকুসুম, ছেলে দিলীপকুমারকে নিয়ে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর পেরোয়, অভিমান দু পক্ষের কেউই কাটিয়ে উঠতে পারেন না। কী নিয়ে ছিল অভিমান? তা বোধহয় দুজনের কেউই বুঝে উঠতে পারেননি। অহং, নৈরাশ্য, অপরাধবোধ, অধিকারবোধ, সবকিছু মিলিয়েই বিচিত্র এক টানাপোড়েনে দুজনে ক্রমাগত ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন বারবার। আর অপেক্ষা করে গেছেন দুজনে, দুজনের জন্যে। অন্তহীন সেই অপেক্ষা সুর পেয়েছে, ভাষা পেয়েছে অতুলপ্রসাদের একের পর এক গানে।–“আর কতকাল থাকব বসে দুয়ার খুলে বঁধু আমার?/ বাহিরের উষ্ণ বায়ে, মালা যে যায় শুকায়ে, নয়নের জল, বুঝি তাও বঁধু মোর যায় ফুরায়ে, শুধু ডোরখানি হায় কোন্‌ পরানে তোমার গলে দিব তুলে, বঁধু আমার!”

আরও পড়ুন
‘মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে’...

হেমকুসুম ও কিশোর দিলীপকুমার সেন 

 

তবে, ভাঙা সংসার নিয়েই যে কেবল দিন কাটিয়ে দিয়েছেন তিনি, তা নয়। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত সাড়ায় বাংলা যখন মুখর, তখন বাংলা থেকে দূরে অতুলপ্রসাদ, কিন্তু সমকালীন জাগরণ থেকে দূরে থাকেননি। জাতীয় কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন, তার আগেই লিখে ফেলেছেন ‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’-র মত আইকনিক দেশাত্মবোধক গান। ক্রমশ লখনৌয়ের নাগরিকমহলে রীতিমত উল্লেখযোগ্য আসন তৈরি করে নিয়েছেন। যত্ন করে উর্দু শিখেছেন, তাঁর চোস্ত জবান শুনে বিস্মিতও হয়েছেন চেনা মানুষেরা। অভিজাত ওস্তাদদের কাছে নিয়ম করে শুনেছেন, শিখেছেন খাঁটি উত্তরভারতীয় ঠুংরি-গজল। লখনৌ কংগ্রেসে গাওয়া হয়েছে তাঁর গান ‘হও ধরমেতে ধীর, হও করমেতে বীর’। ঘনিষ্ঠতা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। কুমায়ুন পাহাড়ে রামগড়ে রবীন্দ্রনাথের হৈমন্তী বাড়িতে কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ জানতে পেরেছেন তাঁর দাম্পত্য-সংকটের কথা। এই অশান্তি যে প্রেমিক মানুষটাকে কতটা পীড়া দেয়, তাও অনুভব করেছেন রবীন্দ্রনাথ।

আরও পড়ুন
‘সুর কী সর্বনাশা’!

বিশেষ বাগ্মী যে ছিলেন অতুলপ্রসাদ, তা নয়, বরং একটু লাজুক, অন্তর্মুখী, এমনকি একটু তোতলাও। তা সত্ত্বেও আইনের কাজে তিনি যে সাফল্য পেয়েছিলেন, তার কারণ বোধহয় তাঁর সহজাত সততা, স্বাভাবিক সারল্য আর মানুষের সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্ত আন্তরিক সম্পর্ক। কৈশোর বড় জটিলতায় কেটেছিল, প্রথম যৌবনও স্বস্তি দেয়নি, তাই বড় হয়ে, সফল হয়ে যখন পরিবারের মানুষজন, আত্মীয়স্বজনের বিরূপতাও ক্রমে কাটতে দেখলেন, তখন আর অতীতের অভিযোগ নিয়ে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেননি অতুলপ্রসাদ। অনেকদিন দূরে ঠেলেছিলেন নিজের মাকে, দুর্গামোহন মারা যাবার পর একা হয়ে পড়ে প্রৌঢ়াকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন। কিন্তু এর কোনোকিছুই সহজভাবে নিতে পারেননি হেমকুসুম, তাঁর অভিমানের পাল্লা যে আরও ভারি ছিল, দুর্গম ছিল তাঁর মনের রাস্তা। শহরের সব মানুষের প্রিয়, কাছের জন হয়ে ওঠা ‘অতুলদা’, ‘সেনসাহেব’ বাড়ির মানুষটাকে কেন পারেন না সময় দিতে? হেমকুসুম যত আগুন ঝরান, অতুলপ্রসাদ ততই শীতল দূরত্বে সরে যান তাঁর থাকে। অভিমানের পাথর জমে জমে পাহাড় হয়। ১৯১৫-তে সে পাহাড়ের শিখর দেখা গেল যেন। আলাদাই থাকতেন দুজন। এবার লখনৌ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন অতুলপ্রসাদ।

বয়েস তখন চুয়াল্লিশ। কলকাতায় প্রাণকৃষ্ণ আচার্যের বাড়িতে থাকতে শুরু করেন প্রথমে। পরে যান ওয়েলেসলি ম্যানসনের ভাড়াবাড়িতে। যোগ দেন মনডে ক্লাবের সাপ্তাহিক আসরে। কাজে থাকতে চান তিনি, আরও বেশি করে থাকতে চান গানে। গান ছাড়া জীবন বইবেন কেমন করে? যত আঘাত, যত জটিলতা, যত মার, তত গান। রবীন্দ্রনাথের ১৯২৬-এ লেখা ‘গানে গানে তব বন্ধন যাক টুটে’-র পূর্বধ্বনিই যেন শোনা যায় অতুলপ্রসাদের ১৯১৪-তে লেখা ‘মিছে তুই ভাবিস মন/ তুই গান গেয়ে যা, গান গেয়ে যা, গেয়ে যা গান আজীবন’ গানটিতে। “পাখিরা বনে বনে গাহে গান আপন মনে/ নাহয় তাদের মত শুকিয়ে যাবি গন্ধ করি বিতরণ।”— গড়ে উঠতে থাকে এমন এক নিরাসক্ত শৈল্পিক অবস্থান। আরেকবার যান শান্তিনিকেতনে। কিন্তু যতই লিখুন ‘মিছে তুই ভাবিস মন’, মনের ভাবনা মেটে না। জেঠতুতো দাদা সত্যপ্রসাদ সেনের সঙ্গে একটু স্বাদ বদলাতে ঘুরতে যান দার্জিলিং, আর সেখানে অপ্রত্যাশিতভাবে জানতে পারেন, ছেলের গৃহশিক্ষক তথা পারিবারিক বন্ধু মহেশ চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে দার্জিলিং এসেছেন হেমকুসুম। এই ঘটনায় একজন সংবেদনশীল মানুষের ঠিক কেমন প্রতিক্রিয়া হতে পারে, তা আমি নিজেও ভেবে পাই না। ঢাকা হয়ে আবার কলকাতায় ফিরে আসেন অতুলপ্রসাদ, আর আলাদাভাবে আসেন হেমকুসুমও। থাকতেও শুরু করেন আলাদা। ঘরে ফেরার ইচ্ছে আদৌ ছিল না, প্রকৃতির রূপময় আশ্রয়ে ভালই ছিলেন তিনি। তবু ফিরতে হল একসময়।

আরও পড়ুন
‘ধন ধান্য’ : ভুলে ভরা

কী বিচিত্র এক সম্পর্ক! দুজনে একও হতে পারেন না, পুরোপুরি আলাদাও হতে পারেন না। সেকালে বিবাহবিচ্ছেদ আইনসিদ্ধ ছিল না বলে নয়, থাকলেও তাঁদের আইনত বিচ্ছেদ সম্ভব হত না। ১৯১৬ সালে কংগ্রেস অধিবেশন উপলক্ষে অতুলপ্রসাদ যখন লখনৌ ফিরে আসেন, হেমকুসুমও চলে আসেন বাড়িতে। এক বছর কেবল বাইরে বাইরে ঘুরে অতুলপ্রসাদের যে কিঞ্চিৎ স্বাস্থ্যভঙ্গ হয়েছে, হেমকুসুম না এলে চলে কীকরে! অসুস্থ স্বামীর পাশে দিনরাত পড়ে থেকে সারিয়ে তোলেন তাঁকে। আর অতুলপ্রসাদ? যথারীতি, গান বাঁধেন। তাঁর শূন্য ঘরে এতদিন পর সুন্দর এসেছে, সুর তো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবেই! কিন্তু, ভাঙা ঘর কি অতই সহজে ভরে ওঠে? ভিতরের তারটিই যে ছেঁড়া! দুই ঘরে দুটো মানুষ। অনেক রাত। ঘুম আসে না। আর কলম লিখে চলে-

“আমিও একাকী, তুমিও একাকী, আজি এ বাদলরাতে,

বঁধুয়া, নিদ নাহি আঁখিপাতে।”

কার গান এ? কার কথা?

গানটার দিকে একটু তাকাই তবে। অন্তরায় গীতিকার বলছেন- “ডাকিছে দাদুরী মিলনতিয়াসে/ ঝিল্লি ডাকিছে উল্লাসে/ পল্লীর বধূ বিরহী বঁধুরে মধুর মিলনে সম্ভাষে/ আমারো যে সাধ, বরষার রাত কাটাই নাথের সাথে।”—নাথের সঙ্গে বর্ষারজনী কাটাবার ইচ্ছে কার? এই গানের অচিহ্নিত কথকের, যে একটা মোহময় মধুর পরিবেশে নিজেকে তুলনা করছে ওই পল্লীবধূটির সঙ্গে। পল্লীবধূ কত সহজে তার বন্ধুকে মিলনসম্ভাষণ করতে পারে, কিন্তু সে পারে না, তারও সাধ আছে, কোনো দুর্জ্ঞেয় কারণে সাধ্য নেই। এই আপাত তুলনাটিই কথকের লিঙ্গপরিচয় দেয় আমাদের। এবার সঞ্চারীর দিকে তাকিয়ে দেখুন,- “গগনে বাদল, নয়নে বাদল, জীবনে বাদল ছাইয়া/ এসো হে আমার বাদলের বঁধু, চাতকিনী আছে চাহিয়া।” যে কাতর অনুনয় এখান থেকে শুরু হচ্ছে, তাতে কথকের নিজের সম্বন্ধে কয়েকটি শব্দ স্থাপন করা হয়েছে। প্রথম শব্দটি ‘চাতকিনী’, আভোগে এই একই প্রয়োজনে বসানো হয়েছে ‘সজনী’ শব্দটি। দুই শব্দেই লিঙ্গচিহ্ন স্পষ্ট। অতুলপ্রসাদের এই গানের কথক এক নারী। সে গাইছে- “কাঁদিছে রজনী তোমার লাগিয়া, সজনী তোমার জাগিয়া,/ কোন্‌ অভিমানে হে নিঠুর নাথ, এখনো আমারে ত্যাগিয়া?” বহুশ্রুত এই গানটি আরেকবার শুনতে গেলেই দেখবেন, অর্ঘ্য সেন ও মান্না দে ছাড়া এর অধিকাংশ রেকর্ড নারীকণ্ঠে। গায়ত্রী বসু, মঞ্জু গুপ্ত, কৃষ্ণা চট্টোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, এঁদের পুরনো আমলের রেকর্ড সংরক্ষিত আছে। এই গানটি নারীকণ্ঠে তুলনামূলকভাবে বেশি প্রযোজ্য, এর অন্দরে সেই নারীস্বর আছে বলেই।

কেন এই ভাষ্য? এ কি তবে সজ্ঞানে তৈরি করা এক ছদ্মবেশ? যে বেদনা অনুভব করেছেন অতুলপ্রসাদ নিজে, যে প্রতীক্ষা করে গেছেন নিরন্তর, তাকে প্রকাশ করার জন্যে এই ‘চাতকিনী’-র আড়ালটি তৈরি করেছেন কি তিনি? নাকি এই ভাষ্য আদতে হেমকুসুমেরই, যা পড়তে পারছেন প্রেমিক অতুলপ্রসাদ? এই ঘটনার বেশ কিছু বছর বাদে, যখন অতুলপ্রসাদ নিজের প্রাসাদোপম বাড়ি বানিয়েছেন, তখন সেই নতুন বাড়ি দেখতে আসেন হেমকুসুম। মায়ের মৃত্যুর পর মায়ের স্মৃতি ধরে রেখে অতুলপ্রসাদ বাড়ির নাম দিয়েছিলেন ‘হেমন্ত-নিবাস’, বেডরুমে হেমন্তশশীর বড় এক পোর্ট্রেটও রেখেছিলেন, এই সবই হেমকুসুমের পছন্দের বহির্ভূত ছিল। ওই তৈলচিত্রটি পুড়িয়ে দেন তিনি, সেই আগুনে পুড়িয়ে দেন অতুলপ্রসাদের কিছু পোশাকও। এই আকস্মিক ঘটনায় নিজেই অবশ্য বিব্রত হয়ে পড়েন, চলেও যান ফিরে। পরে নিজে মুখে না হলেও পরোক্ষে ক্ষমা চান অতুলপ্রসাদের কাছে। আর অতুলপ্রসাদ লেখেন, “আমায় ক্ষমা করিও যদি তোমারে জাগায়ে থাকি”। বুঝতেই পারছেন, এই আমি-তুমি আসলে স্থানান্তরিত, লেখক আমি অতুলপ্রসাদ হলেও কথক আমি অংশত হেমকুসুম। এটি অবশ্য কিংবদন্তি, ঘটনার সত্যতা যাচাই করার যে খুব উপায় আছে, তা নয়। তবে এমন গানের দৃষ্টান্ত কম নয়, সবই মিথের মিথ্যে নয়। ‘নিঠুর দরদী’-র বিচিত্র খেলা তাঁকে দিয়ে সত্যিই অনেক গান লিখিয়ে নিয়েছিল। হেমকুসুম নিষ্ঠুর তো বটেই, কিন্তু দরদিও যে। আর সেই দরদ অনুভব করতে পারতেন অতুলপ্রসাদ। সারা জীবনেও ওই ‘উদ্ভট বাজিকর’-এর ইন্দ্রজাল থেকে বেরোতে পারেননি তো সেজন্যেই। ভুলতে পারেননি প্রথম যৌবনের নতুন আলোয় দেখা সেই কিশোরীকে। তাই, পাঠক আর শ্রোতা হিসেবে আমার এমন সন্দেহও হয়, এই গানের বা গানগুলির ভাষ্য সত্যিই হেমকুসুমের না হলেও অমনটা কল্পনা করতে চেয়েছেন অতুলপ্রসাদ। কল্পনা করতে চেয়েছেন, হেমকুসুম পাশের ঘরে বিনিদ্র, এই বর্ষার মায়াবী রাতটি তাঁর সঙ্গে কাটাতে চান হেম, কিন্তু ‘নিঠুর নাথ’ যে ত্যাগ করেছেন তাঁকে, দুর্বহ এই জীবন তাঁর কাছে সমর্পণ করতে পারলেই বেঁচে যান হেম, পারেন না, তাই ‘নিদ নাহি আঁখিপাতে’...

অতুলপ্রসাদের প্রিয় ছাত্র, তাঁর মধ্যবয়সের যুবক বন্ধু পাহাড়ী সান্যাল তাঁর অতুলদার কাছে বেশ কিছু বাংলা গান শিখেছিলেন। যার মধ্যে ‘যাব না যাব না যাব না ঘরে’, ‘সে ডাকে আমারে’, ‘মোরা নাচি ফুলে ফুলে’, ‘জল বলে চল’, ‘আমায় ক্ষমা করিও’, ‘কত গান তো হল গাওয়া’ এসবের সঙ্গে ছিল ‘বঁধুয়া, নিদ নাহি আঁখিপাতে’ গানটিও। কেমন ছিল সেই গানের ধরণ? পাহাড়ী সান্যাল যেমন করে এ গানটি গেয়েছেন, তা বেশ কিছুটা অন্যরকম আমাদের শোনা গায়কীর থেকে। অনুমান করা যায়, এই রূপেই তাঁকে গানটি শিখিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদ।


দেখুন, সঞ্চারীতে পাহাড়ী সান্যাল গাইছেন ‘গগনে বাদল, নয়নে বাদল, আমার জীবনে বাদল ছাইয়া/ এসো হে আমার বিরহের বঁধু, চাতকিনী আছে চাহিয়া’।
অতুলপ্রসাদের গানের বই ‘গীতিগুঞ্জ’ এবং স্বরলিপির বই ‘কাকলি’-তে এই কথাটি আছে ‘বাদলের বঁধু’। তাছাড়া, স্বরলিপিবদ্ধ কাঠামোকে অনুসরণও করেনি পাহাড়ীর গাওয়াটি। সাধারণত দাদরা তালে ধীর লয়ে এ গান গাওয়া হয়, বেহাগের সরল আঙ্গিকে। ঠুংরির ভিন্ন চালে, বৈতালিক গায়নে একমাত্র পাহাড়ীর গাওয়াই পাওয়া যায়, তাও ঘরোয়া কোনো গানের আড্ডায়। এ গান রেকর্ড করেননি পাহাড়ী। যদিও প্রথম রূপ সম্ভবত পাহাড়ী সান্যালের গাওয়াটিই, কারণ ওই একই গাওয়া অনুসৃত হয়েছে অতুলপ্রসাদের আরেক শিষ্য নীহারবিন্দু সেনের ছাত্রী অনসূয়া সেনের স্মৃতিনির্ভর গাওয়াতে।

পাহাড়ী সান্যাল বড় নিবিড় করে চিনেছিলেন তাঁর অতুলদাকে। তাই অনুভব করেছিলেন, রাজকীয় বাংলোর ততোধিক কেতাদুরস্ত ঘরে বিলিতি কায়দায় গানা আর খানা দুই-ই চলত বটে, ভেতরে ভেতরে কিন্তু এক অপূরণীয় শূন্যতাকে ওই বাড়ি বয়ে বেড়িয়েছে। সেই শূন্যতা হঠাৎ ভরে উঠেছে, যখনই কোনো না কোনো কারণে দুজনের সাক্ষাৎ হয়েছে। অতুলপ্রসাদের অসুস্থতাই হোক্‌, রবীন্দ্রনাথের অতিথি হয়ে আসাই হোক্‌, কিংবা দেরাদুনে গিয়ে হেমকুসুমের দুর্ঘটনায় পড়াই হোক্‌, বারবার অদ্ভুত সব কারণে পুনর্মিলন হয়েছে দুজনের। আর, যতবার মিলন, ততবারই বিচ্ছেদ। ওই বিচ্ছেদের অপেক্ষায়, বিরহকে ভর করেই যেন বাঁচতেন অতুলপ্রসাদ, বা বলা ভাল, অতুলপ্রসাদের গান। শূন্য না থাকলে তো পূর্ণ আসবে না। কঠিন আঘাত না এলে মীড় বাজবে কেমন করে? সাধক, প্রেমিক আর পাগলের ধর্মই তো এই। আমরাও যেমন, “বোকা বনে যাই বারবার, তবু বলি, পায়ে পড়ি তোর, প্রেমের গানটা বাজা”...

Powered by Froala Editor