‘রক্তে বোনা’ গান...

শ্রুতিমধুর – ৮

আগের পর্বে

“এই দেহটা তো নই রে আমি/ নইলে ‘আমার দেহ’ বলি কেমনে...” রজনীকান্ত সেনের লেখা এই গান যেন জীবন-মৃত্যুর বাইরে অবিনশ্বরের কথাই বলে। গীতার সঙ্গেও সাদৃশ্য রয়েছে এই গানের। তবে শাক্ত এবং বৈষ্ণব দুই ভাবই প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। তাঁর সুরের মধ্যে মিশে গিয়েছিল কীর্তন, মধুকানের সুর। রামপ্রসাদীও। মারণ রোগের কাছে হার মেনেছিল তাঁর শরীর। তবু সৃষ্টি থেকে সরে আসেনি মন। নির্বাক রজনীকান্ত হারমোনিয়ামের রিডেই স্বরলিপি বুঝিয়েছিলেন ক্ষিতীন্দ্রনাথ, শান্তিলতাকে। রজনীকান্ত নিজেই একটা দর্শন।

সব প্রজন্মের লোকেরই মনে হয়, তাদের একটা এক্কেবারে অন্যরকম শৈশব ছিল। সেটাই সেরা শৈশব। সেই নস্টালজিয়ারোগ আমার মনেও মিলেনিয়াম-জাতকদের প্রতি সমবেদনা জাগায়। ইস, তারা তো জন্মে ইস্তক আট আনা পয়সা দেখল না! ঈস, তারা তো মনোক্রোমে সাপখেলা দেখল না! ইস, তারা জানলই না পেঁচানো ক্যাসেটের সুতো ছাড়াতে পেন্সিলের কী ভূমিকা! ঈস, তারা বুঝতেই পারল না দু টাকায় ছ’টা ফুচকার তেঁতুল মোটেই টক লাগে না; ‘মিষ্টি যেন গুড়’!

এর সবকিছুই ছিল আমার যে শৈশবে, সেই নব্বই দশকের বাংলায় হরদম কিছু গান শোনা যেত। ‘হরদম শুনতে বাধ্য হওয়া’ গানের তালিকায় ইদানীং থাকে ভোজপুরি পপ কিংবা অত্যাশ্চর্য উদ্ভট সব ‘কভার-সং’। সেই ভয়ানক অভিজ্ঞতাপ্রান্তরে চোখ বুজলে মাঝেমাঝে মনে পড়ে, বহরমপুরের ইস্কুল থেকে ঝুঁটিবাঁধা একটা দুপেয়ে প্রাণী ফিরছে, খিদে পেলেও দূর থেকে আওয়াজ শুনে তার মন ঘুরে গেছে অন্যদিকে। দরজা দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেল, অনেকগুলি মেয়ের গলা একসঙ্গে মিশে গাইছে, - ‘সাথীদের খুনে রাঙা পথে দ্যাখো, হায়নার আনাগোনা’। বাকি আরও কীসব বলা হচ্ছে, খুব দ্রুত উচ্চারণে, ফলে বুঝে উঠতে পারছে না। তবে যে লাইনটা বুঝতে পেরেছে, সেটাও বেশ গোলমেলে লাগছে। ‘খুন’ মানে সে জানে মার্ডার। মার্ডার নিয়েও গান হতে পারে, তাও এরকম তবলা বাজিয়ে গাওয়া যেতে পারে, সেটা মোটেই স্বাভাবিক লাগছে না তার। কিন্তু ততটা স্বাভাবিক নয় বলেই প্রচণ্ড পছন্দ হয়েছে গানটা। মন দিয়ে দু তিনবার শুনে সে বুঝতে পারে, ‘খুন’ মানে এখানে রক্ত, তবে কেউ কাউকে খুন করেছে বলেই সে রক্ত রাঙিয়ে দিয়েছে কারও রাস্তা। গানের মধ্যে যে এমন বীভৎস দৃশ্য থাকতে পারে, এ গান না শুনলে সে বুঝত না। এটাও বুঝত না যে, ‘বাঁচবার লড়বার অধিকার’ গান গাইবার জন্যেও কত জরুরি! কে জানে, এ গানদুনিয়ার সঙ্গে পরিচয় না থাকলে টিফিনে তার বাক্সে থাকা দুটোমাত্তর ‘মেরি’ বিস্কুটের একটা পাশের বন্ধুকে দিতেও শিখত না সে।

গানের যে লাইন সেই ছোটবেলায় আকৃষ্ট করেছিল আমায়, তা ছিল ধুয়া, গানের ধ্রুবপদ, যা ফিরে ফিরে আসে। গোড়ার অংশের আবেদনটা একটু অন্যরকম। হুঁশিয়া—র বলে এক টান দিয়ে শুরু হত গান। তার সঙ্গে দ্রুত লয়ে বাজতে থাকত তালবাদ্য। এক-দুই-তিন-চার ছন্দে তালের আঘাতে আঘাতে গানের শব্দগুলোকে পৌঁছে দিত আমাদের কানে। বাংলা গানজগতে কাহনের চল তখনও এখনকার মত বিপুল ছিল না, তার জায়গায় ছিল বংগো, অথবা ট্রিপল কংগো ড্রাম। সম্ভবত সেগুলোই বাজত গানটির রেকর্ডে। অন্তত পরে এ গানের মঞ্চ-পরিবেশনায় চোখের সামনে কংগোই বাজতে দেখেছি। এই যন্ত্রগুলোর উদ্ভব আর প্রচলন আফ্রিকা, স্পেন, কিউবার যে সমস্ত অঞ্চলে, যে সমস্ত সমূহের মধ্যে, সেই সমূহচেতনাই তো কাজ করেছিল এই যুগের গানে। তেমন উদ্দাম নির্ভীক দুরন্ত প্রাণশক্তিই এই গানের সম্বল।

হুঁশিয়ার, ও সাথী কিষাণ মজদুর ভাইসব হুঁশিয়ার।
ওই মৃত্যুর বিভীষিকা ছড়াতে ছড়াতে, গ্রাম জ্বালাতে, জ্বালাতে মাটি
হিংস্র সাপের সারি তুলেছে ফণা,
কেড়ে নিতে বাঁচবার লড়বার অধিকার,
রক্তে রক্তে বোনা ফসলের অধিকার।

আরও পড়ুন
‘মলিন মর্ম মুছায়ে’

এই পর্যন্ত গান জুড়ে একইরকমভাবে কাজ করতে থাকে তাল, বৈচিত্র্য ছাড়া। আর এর পরেই, ধুয়ায় অদ্ভুতভাবে আওয়াজ বদলে যায় দুটিমাত্র তবলার ঠেকায়। আর তাতে গানের স্বাদটাই পালটে যায়। আমি নিশ্চিত, শ্রোতাদের কাছে গানটাকে পৌঁছে দেবার পিছনে এই সুর-তাল-নকশা অনেকটা দায়ী। প্রতিশোধ-প্রতিরোধ, তার সঙ্গে সাথীহারা হবার ক্ষুব্ধ বেদনায় প্রতিহিংসার জ্বলন, এর সবকিছুই আমার সেই সঙ্গীত-অপুষ্ট কানকেও স্পর্শ করেছিল। ফলে এই যন্ত্রানুষঙ্গ যিনি পরিকল্পনা করেছিলেন, সেই অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের আলাদা করে ধন্যবাদ প্রাপ্য, ঘটনাচক্রে যিনি কিংবদন্তি সঙ্গীতকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র। আমাদের কৈশোরকে যে সমস্ত মৌলিক আর রিমেক বাংলা গান ভরিয়ে রেখেছিল, তার অনেকগুলোতে অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতের ছোঁয়া ছিল।

আরও পড়ুন
“ভরসা যেন পড়ায় এবং...”


আরও পড়ুন
‘আমার’ ‘আমার’ বলতে লাগে লাজ...

এই গানটির কথা আর সুর ছিল বাসুদেব দাশগুপ্তের। পশ্চিম মেদিনীপুরের সংস্কৃতিকর্মী বাসুদেব দাশগুপ্ত। যে মেদিনীপুর চল্লিশ দশকের স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান, একের পর এক কৃষক-অভ্যুত্থান যে মেদিনীপুরে ঘটেছে, সেই জমি থেকে উঠে আসা মানুষ, গণতান্ত্রিক লেখক-শিল্পী সংঘের সদস্য বাসুদেব দাশগুপ্ত। সোনার ফসল যে ফলায়, তার আধপেটা জীবনের কথা কতরকম করেই না বলেছেন শিল্পীরা, বলেছেন সেই আধপেটা জীবনকে ভরপুর জীবনের স্বপ্ন দেখতে, লড়াই করে সেই স্বপ্নকে ছিনিয়ে আনতে। গান হয়ে উঠেছে গণ-এর। জ্যোতি ঠাকুর, শিবনাথ শাস্ত্রী, মুকুন্দদাস, নজরুল ইসলামদের উত্তরাধিকার বহন করে একে একে গান বেঁধেছেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, সলিল চৌধুরী, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়, নিবারণ পণ্ডিত, দিনেশ দাস, শিবদাস বন্দ্যোপাধ্যায় বা আরেকটু কম প্রচারিত গোবিন্দ সিংহ, কৃপাসিন্ধু দাশ, পরেশ ধর, সাধন দাশগুপ্ত, দিলীপ সেনগুপ্ত, সমরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, কমল সরকার, হাসান হাফিজুর রহমানরা। আর সেখানে বারবারই লোকগানের আঙ্গিককে ধারণ করেছে গণসঙ্গীত, লোকগানের স্বতঃস্ফূর্ত ঔদার্য দিয়েই সমরসঙ্গীতের তেজকে ছড়িয়ে দিয়েছে আরও। বাসুদেব দাশগুপ্তের এই গান লোকসঙ্গীত আর গণসঙ্গীতের মাঝের এক খোলা আঙিনায় দাঁড়িয়ে থাকে। মার্চ-সং-এর উদ্দীপনা জাগিয়ে রাখে এর সুরকে, র‍্যাপিং শৈলীর দ্রুতি, বিরামহীন শব্দজাল শ্রোতার চেতনাকে সতর্ক করে রাখে, স্ট্রেট নোটসের ঋজুতা জ্বালিয়ে রাখে মুখোমুখি লড়াইয়ের পৌরুষ, প্রত্যয়। আর ধুয়ায় গেলেই তার মধ্যে আবার হাহাকার করে ওঠে করুণকঠিন কান্না;- ওই কান্নায় মিশে থাকে পটকথার সানুনাসিক উচ্চারণ, পাঁচালীগানের একঘেয়ে আর্তি, বহুযুগের জমিয়ে রাখা ‘মেয়েলি’ দুঃখ। এই বৈপরীত্যই গানটাকে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে আমার স্মৃতিতে। নিজের ব্যক্তিগত স্মৃতি বলে একে মনে করি না, এই স্মৃতি অনেক বড় একটা সমূহের অঙ্গ, এই স্মৃতি সামূহিক নির্জ্ঞানের ভিতর জীয়ন্ত। আর সেই সমূহ যতবার কোনো আঘাতের মুখে দাঁড়ায়, ততবার একইভাবে স্মৃতি ফিরে আসে। সব গান সমান নয়। কোনো কোনো জাতিস্মর গান এজন্যেই আর কোনো দলের প্রচারপত্রে পড়ে থাকে না, পার্টি-আপিসের লকারে ধুলো মাখে না; বারবার, মুখে মুখে ঘুরে আসে, বসন্তের মত, বর্ষার মত, বিপ্লবের মত।

আরও পড়ুন
জীবনে বাদল ছাইয়া

জানি পারবে না কেড়ে নিতে জনতার অধিকার, পারবে না কেড়ে নিতে পারবে না,
জাগ্রত জনতার রোষানলে ছাই হবে, পুড়ে যাবে শত্রুর শাণিত ফণা।
তাই আহ্বান দিকে দিকে নয় আর দেরি নয়, সময় তো নেই আর ভাই রে
জোটটাকে আমাদের ইস্পাত করে গড়ে তুলে নেও হাতিয়ার তাই রে
আজ ছিঁড়ে ফেল দৃঢ় হাতে চক্রান্তের জাল, বিভেদের কুমন্ত্রণা। 

আরও পড়ুন
‘মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে’...

সুব্রত রুদ্রের সম্পাদনায় ১৯৯০ সালে প্রকাশিত ‘গণসংগীত সংগ্রহ’ বইতে বাসুদেব দাশগুপ্তের আরও একটি গান সংকলিত আছে, “ও দরদিয়া সাথী মোদের, মরমিয়া শহীদবন্ধু রে,... ও বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে গেলে যে পথটারই নিশানা, জীবন মরণ পণ করেছি, অযুত তোমার সাথী মোরা, ভুলব না সে ঠিকানা।” শহিদ হয়ে যাওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া সঙ্গী, ফাঁকা হয়ে যাওয়া বন্ধুর ঘর, মাঠে মাঠে লাশ হয়ে যাওয়া পথের সাথী, এই একই বেদনা আর রিরংসা কাজ করেছে সেই গানেও। ক্রোধ এই গানেরও মূল ভাব। রৌদ্ররসের গান এটাও, যাকে সঞ্চারিত করছে ভয়াবহ শোক।

আরও পড়ুন
‘সুর কী সর্বনাশা’!

প্রায় অর্ধশতক পরে দাঁড়িয়ে খুন কেমন হয়, বুঝি। কেমন করে লাল হয়ে ওঠে আমার বন্ধুর বাড়ির পথ, তাও দেখি। বাঁচাটাই আর ‘অত্যাবশ্যকীয়’ নয়। চাল-ডাল-আলু-পেঁয়াজ তো ‘তুশ্চু’ ব্যাপার! ফেটে ফেটে যায় মায়েদের পা, স্লোগানে স্লোগানে ঢেকে যায় দেওয়াল। বুঝতে পারি, কেমন করে তীব্রতম দুঃখ থেকে উঠে আসে তীব্রতম রাগ, কেমন করে দুঃসহ নতি থেকে উঠে আসে স্পর্ধার ফুলকি। গানের যে রেকর্ড আমার কানে বেজেছিল, নব্বই দশকে ডিওয়াইএফয়াই-এর প্রচারগানের অন্তর্গত ছিল সেই গান। দশক পালটায়, চোখ পালটায়, অভিজ্ঞতা পালটায়, পালটে যায় বোধও। যে বামদল-জোটকে ‘বজ্রকঠিন’ করে তোলার ডাক দিয়েছিল এই গান, তার জীর্ণ ধ্বস্ত চেহারা ফ্যাকাশে দেওয়ালে টেনে নিয়ে যায়। নুন দিয়ে পচানো লাশের গন্ধে খসে খসে পড়ে স্মৃতির পলেস্তারা। সাদামাটা কাপড়ে মুক্তো-মুক্তো হাতের লেখায় লাল কালিতে লেখা ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ কিংবা ‘গড়ে তোলো ব্যারিকেড’ ভেঙে যায় হ্যাশট্যাগের মিথ্যে ঢেউয়ে। মুছে যায় রাঙা রাঙা মিথের কাজল। অথচ, গানটা রয়ে যায়। কাল পেরিয়ে, দেশ পেরিয়ে, মারী আর মন্বন্তর পেরিয়ে, থেকে যায়।

আরও পড়ুন
‘ধন ধান্য’ : ভুলে ভরা

তাই আহ্বান, ও সাথী কিষাণ মজদুর ভাই শোন আহ্বান।
তাই আহ্বান দিকে দিকে নয় আর দেরি নয়, সময় তো নেই আর ভাই রে
জোটটাকে আমাদের বজ্রকঠিন করে তুলে নেও হাতিয়ার তাই রে
আজ কালজয়ী সংগ্রাম শুরু করে বন্ধুরে হেঁকে বলো সইব না, সইব না
সাথীদের খুনে রাঙা পথে পথে হায়নার আনাগোনা আর সইব না। 

পেটে ভাত না থাকলে সংস্কৃতির ঢাক কেমন বাজে, তা আমাদের মত গেরস্ত মানুষের পক্ষে বোঝা এখনও অব্দি একটু মুশকিল। তবে যতদিন না অব্দি এই মুশকিলকে আসান করার জন্যে একটুও পা না বাড়াচ্ছি, ততদিন কোনো চিরাগ জ্বলবে না। আলাদিনের দিন গেছে। একেবারেই গেছে। চাষি খেপলে কিন্তু সত্যিই খেতে পাব না। আমাদের কৃষ্টি-কালচার তদ্দিন টিকবে তো?

Powered by Froala Editor