‘মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে’...

শ্রুতিমধুর - ৩

আগের পর্বে

বাংলার গানদুনিয়ায় উল্লেখ যোগ্য এক জুটি হল দিলীপকুমার রায় এবং নিশিকান্ত রায়চৌধুরী। অন্তরঙ্গ বন্ধু হলেও বয়সে দিলীপকুমারের থেকে বছর বারোর ছোট ছিলেন নিশিকান্ত। ১৯৩৪ সালে শান্তিনিকেতনের পাঠ চুকিয়ে নিশিকান্তের চলে যাওয়া পন্ডিচেরিতে অরবিন্দের আশ্রমে। দিলীপকুমার সেখানে হাজারো গান শোনাতেন তাঁকে, বিশ্লেষণ করতেন। আর সেসবের মাঝেই পন্ড হয়ে যেত তাঁর কাজ। দিলীপকুমারকে নিয়ে তাই লিখেছিলেন ‘কর্মনাশা’। প্রথমে বাউল গান লেখাও সেই দিলীপকুমারের হাত ধরেই। তবে আশ্চর্যের ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে অন্য গায়কদের গাওয়া দিলীপকুমারের গানের যে ক’টি রেকর্ড রয়েছে ইন্টারনেটে। তার সবগুলিতেই বদলে গেছে সুর, স্বরলিপি। একমাত্র কবীর সুমনই সেই স্বরলিপি অনুসরণ করে গেয়েছিলেন সেই গান।

চড়া দাগের খলনায়কদের একটা চোখ রাঙানো-গোঁফ পাকানো ইমেজ জনমানসে থাকে। বাংলার ইতিহাসে তেমনি এক ভিলেন হলেন কার্জন। ১৯০৫ সাল। লর্ড কার্জন ঘোষণা করেছেন বাংলা দু টুকরো করে দেবার কথা। ক্ষোভে উত্তাল বাঙালি। জন-আবেদন কীভাবে কোনো রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তকে আঙুল তুলে শুধু প্রশ্নই করে না, বদলাতে বাধ্য করে, তার এক ঐতিহাসিক নজির রেখে গিয়েছিল ওই কাল। তবে একটি তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক ফলাফলই ওই জনতরঙ্গের একমাত্র অবদান নয়, বরং বাঙালি ইতিহাসে আরও দীর্ঘমেয়াদি এক ছাপ রেখে যায় তা। ওই আন্দোলনের অভিঘাত থেকেই তৈরি হয়েছিল কিছু গান। একশো-পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে। গানগুলো তাদের প্রয়োজন বা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে কি? সম্ভবত না।
তবে, কিছু আক্ষেপ রয়ে গেছে।

বর্তমান পূর্ববাংলার রাজশাহীর এক অল্পবয়েসি উকিল। কিন্তু ওকালতির চাইতে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে গল্পগুজব আর সুযোগ পেলেই গান, এ-ই তাঁর বেশি পছন্দ। গান করা শুধু নয়, গান বাঁধারও উৎসাহ প্রবল। একটা অদ্ভুত সহজাত প্রতিভাও আছে তাঁর। কবিগান, কীর্তনগানের আসরের সঙ্গে ছেলেবেলা থেকে পরিচয় ছিল বলেই বোধহয়, কেউ কোনো বিষয় নিয়ে গান লিখতে ফরমাশ করলে কিছুক্ষণের মধ্যেই নাকি তৈরি করে ফেলতে পারতেন তিনি। বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলনের জোয়ার যখন ভিজিয়ে দিচ্ছে বাংলার তরুণমনের মাটি, তখনই, এক বন্ধু তাঁকে বলেন, মেসের ছেলেরা চাইছে একটা গান তুমি লেখো, সুর দাও, ওরা গাইবে। যদিও তার একটু আগেই কলকাতা এসে পৌঁছেছেন, পথশ্রান্তি আছে। তাতে কী! গান তো হতেই হবে! কয়েক ঘন্টার মধ্যে লেখা হয়ে গেল গানের প্রথম দুটি স্তবক, সুরও হয়ে গেল এমনকি। কিন্তু মাত্র এটুকু? মিছিল করতে করতে ছেলেরা যাবে, আরো বাড়াতে হবে যে গান! আপাতত এটুকু প্রেসে অক্ষর কম্পোজ করা হোক্‌, ততক্ষণে বাকিটা লেখা হয়ে যাবে—বসুমতী পত্রিকার অফিসে দাঁড়িয়ে আশ্বাস দিলেন লেখক। হলও তাই। গোটা গানটাই লিখে ছাপানো শেষ হল। ছাপাখানার মালিক বন্ধুটি তো বেজায় খুশি। বিকেলবেলা বিডন স্ট্রিটে আরেক সুহৃদের বাড়িতে বসে চা খেতে খেতে তিনিই শোনেন, এক দঙ্গল ছেলের মিছিল গাইতে গাইতে আসছে। তাদের মুখে সেই গানটিই, যা কয়েকঘণ্টামাত্র আগে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই’—রাজশাহী থেকে এসে বন্ধু অক্ষয়কুমার সরকারের মেসে বসে যা লিখেছিলেন রজনীকান্ত সেন, ছাপিয়েছিলেন জলধর সেন, মিছিলে যা গাওয়া হয়েছিল। মুহূর্তের মধ্যে মুখে মুখে ছড়িয়ে গিয়েছিল যে গান। যে গান এখনও রয়ে গেছে বাংলার মানুষের কানে আর মনে। যে গান গতকালও বেজেছে, হয়ত পাড়ায় পাড়ায় পতাকা তুলে নয়, কিন্তু টিভিতে, ফেসবুকের পর্দায়।... 


 

আরও পড়ুন
‘সুর কী সর্বনাশা’!

কিন্তু, সত্যিই কোন্‌ গান বলুন তো? ‘মায়ের দেওয়া মোটা কাপড়’ যে গানের প্রথম পঙ্‌ক্তি হিসেবে আপনি শুধু পড়েন না, শোনেনও, সেই গানটিই বেঁধেছিলেন তো রজনীকান্ত?
জীবদ্দশায় নিজের মাত্র তিনটি ছাপা বই দেখে যেতে পেরেছিলেন রজনীকান্ত- ‘বাণী’, ‘কল্যাণী’ আর ‘অমৃত’। তার মধ্যে ‘অমৃত’ তাঁর মৃত্যুর বছর ১৯১০-এই বেরোয়। রোগশয্যায় শুয়ে আরও কিছু বইয়ের কাজ করেছিলেন তিনি, তবে প্রথম বইদুটি একেবারেই তাঁর সুস্থ জীবনকালের সবল পরিশ্রম ও অনুশীলনের ফসল। ১৯০২ সালে, রজনীকান্তের ৩৭ বছর বয়সে ‘বাণী’ প্রথম মুদ্রিত হয়। স্বদেশি-আন্দোলনের সময়ে মজুমদার লাইব্রেরি থেকে বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ বেরোয় সেকালে লেখা সাতটি স্বদেশি গান যোগ করে। কিন্তু রাজদ্রোহের ‘অপরাধে’ এই সংস্করণ বাজেয়াপ্ত হয়, এবং ১৯০৭-এ তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় সেই সাতটি গান বাদ দিয়ে। পরে, রজনীকান্তের সমস্ত গানের বইতেই ‘বাণী’ মুদ্রিত হয় দ্বিতীয় সংস্করণের ভিত্তিতেই, অর্থাৎ স্বদেশি গানসহ। সাহিত্য সংসদ থেকে প্রকাশিত, বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘রজনীকান্ত কাব্যগুচ্ছ’ (২০০০)-এ এই গানটি রয়েছে, ‘বাণী’-র মধ্যেই। এবং সেই পাঠ অনুযায়ী, মুদ্রিত গানের নিচে তার রাগকাঠামো হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে ‘মূলতান’। একটু মনে করে দেখুন তো, যে সুরে গানটি বারবার শুনেছেন, তাতে গানের একেবারে প্রথম লাইনটি কীরকম স্বরমালায় আছে! একাধিক অনুষ্ঠান ও আলোচনাসভার অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিতভাবে বলছি, সিংহভাগ মানুষ বলেন, তাঁদের কাছে প্রথম পঙ্‌ক্তির সুর হয়ে আছে <সা-শুদ্ধ গা-শুদ্ধ মা-পা-শুদ্ধ নি-সা> এই ছকে। কোনো পাণ্ডিত্য থেকে নয়, ন্যূনতম স্বরজ্ঞান ও সঙ্গীতের পাঠ থাকলেই বুঝবেন, এটি বেহাগ রাগের ছক। যাঁরা রাগের পাঠ নেননি, কিন্তু বাংলা গান ঢের শুনেছেন, তাঁরা মিলিয়ে দেখুন তো, রবীন্দ্রনাথের ‘দীপ নিবে গেছে মম’, অতুলপ্রসাদ সেনের ‘বঁধুয়া, নিদ নাহি আঁখিপাতে’, কিংবা রজনীকান্তেরই ‘তুমি অরূপ স্বরূপ সগুণ নির্গুণ’ এইসব গানের কথা। সুর মিলছে তো? এগুলি সব বেহাগে বাঁধা। অবশ্য, এই প্রসঙ্গে এতগুলি কথা বলেও মনে করিয়ে দিই, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুলপ্রসাদ সেন, দিলীপকুমার রায়, বা নজরুল ইসলামের মত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম ছিল না রজনীকান্তের। কিন্তু বেহাগকে মূলতান লিখবেন, এমনটা সম্ভব নয়। বাগেশ্রী, হাম্বীর, ভৈরবী, বেহাগ, সমস্ত রাগের উল্লেখই আছে তাঁর গানের নিচে; এবং শুনলে বোঝা যায়, কখনো কখনো মিশ্রিত হলেও মোটামুটি কাঠামোটি মূলরাগানুগ। অথচ, এতদিনের এত ‘পরিচিত’ ‘বহুশ্রুত’ ‘জনপ্রিয়’ গানটির ক্ষেত্রে এতখানি বদলে যাওয়া একটা সুর শুনে চলেছি আমরা।

কিন্তু কেন? কারণ, ‘জনপ্রিয়’ ব্যাপারটা মারাত্মক গোলমেলে। এই বেহাগের সুরে ১৯৮০-র দশকে গানটি রেকর্ড করেছিলেন শ্রীমতী রুমা গুহঠাকুরতা-পরিচালিত ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যার ‘স্বদেশী যুগের গান’ অ্যালবামে। সেসময় কয়েক দশকের পুরনো গানগুলি নতুন করে গাইবার একটা চল তৈরি হয়েছিল। দুঃখের বিষয়, এই গানটি মূল সুরে এল না। ১৯১০-এ মৃত্যুশয্যায় রজনীকান্ত বলেছিলেন নিজের এই গানের জনপ্রিয়তার কথা, ১৯১৩-তে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেছিলেন এই গানের ‘উন্মাদক’ আবেদনের কথা, জনস্মৃতি এতই দুর্বল যে, ৭-৮ দশকেই গানের কাঠামোটি হারিয়ে যায়? শুধু রাগ বা দু-তিনটি স্বর বদলে যাওয়া নিয়ে কোনো অসুবিধে নেই, কিন্তু গানের ভাবের সঙ্গে সুরের সামঞ্জস্য যে একান্ত প্রয়োজন! এ গান এক আহ্বান জানাচ্ছে, যে আহ্বান মিছিলের শ্লোগানে পরিণত হতে পারে, শৌর্য তার সম্পদ। কিন্তু তার অন্তরে রয়ে গেছে গভীর আক্ষেপ, গূঢ় বিষাদ আর গ্লানি, ‘দীন দুখিনী মা’-এর ক্রন্দন। সুরে এই দুয়ের মিলন না ঘটালে তা তো যথাযথ হতে পারে না। ‘স্বদেশী যুগের গান’-এর রেকর্ডটি শুনে দেখবেন, বেহাগ সুর তো বটেই, অত্যন্ত উদ্দীপক-উত্তেজক ছন্দে, অতিদ্রুত লয়ে গাওয়া, শ্বাসস্থানও অসম্ভব সংকুচিত! ভারি চিত্তাকর্ষক হলেও তা কিছুটা বিক্ষেপ ঘটায় গানের বাণী ও ভাবের। রজনীকান্ত সেনের দেওয়া সুর কিন্তু তখন চর্চিত ছিল, স্বরলিপিও ছিল, অথচ তাঁরা জানিয়েছিলেন, তাঁরা ব্যবহার করেছেন মনোরঞ্জন সেন-কৃত একটি স্বরলিপি। 

আরও পড়ুন
‘ধন ধান্য’ : ভুলে ভরা


কে এই মনোরঞ্জন সেন?
একটা মজার গল্প বলি। এই ভদ্রলোকের পরিচয় অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমি প্রথমেই অদ্ভুত এক তথ্যের মুখোমুখি হই। ১৯৩০ সালে চট্টগ্রামের জালালাবাদ পাহাড়ে পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে যে সব তরুণ আত্মাহূতি দিয়েছিলেন, তাঁদের তালিকায় একটি নাম মনোরঞ্জন সেন। আর পুলিশের খাতা অনুযায়ী, তাঁর বাবার নাম রজনীকান্ত সেন। অবশ্যই ইনি কান্তকবি রজনীকান্ত নন। কিন্তু এই অদ্ভুত সমাপতনটি আমায় যারপরনাই চমৎকৃত করেছিল। এবার আমাদের মনোরঞ্জন সেনের কথায় আসি। স্বাধীনতা-উত্তর কলকাতায় মধ্যবিত্ত শিল্পচর্চার যে ধারা বইত, সেই ধারাতেই তৈরি হয়েছিল গান, নাচ, আবৃত্তি, চিত্রকলা ইত্যাদির অনেক স্কুল। তেমন একটি গানের স্কুল ‘বাসন্তী বিদ্যা বীথি’ চালাতেন এই মনোরঞ্জন সেন, কান্তকবির দৌহিত্র শ্রীদিলীপকুমার রায় ওই স্কুলে সাময়িকভাবে গানও শিখিয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে ‘কান্ত-গীতি-মাল্য’ নামে রজনীকান্তের গানের একটি স্বরলিপি প্রকাশ করেন তিনি, তাতে ‘মায়ের দেওয়া’ গানটি অন্তর্ভুক্ত নেই, তবে নিশ্চয় কোনোভাবে স্বরলিপিটি পৌঁছয় শ্রীমতী গুহঠাকুরতাদের কাছে। এই বেহাগের সুর কি একদম মনোরঞ্জনের স্বকপোলকল্পিত? এ তথ্য খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তমনা ব্লগে ২০১৫ সালে লেখক-গবেষক নিলয় নীলের একটি ছোট লেখা দেখলাম, সেখানে তিনি বলছেন, এই গানটির দুটি সুর; একটি রজনীকান্ত সেনের, দ্বিতীয়টি জলধর সেনের। কোনো তথ্যসূত্র নেই বলে আমি এ নিয়ে সন্দেহগুলো ব্যক্ত করছি। প্রথমত, যখন সুর হয়েছে, তখন, এবং বিকেলের পদযাত্রাতেও সুরসহ গানটি শুনেছেন জলধর সেন। তিনি নিজেই একটা অন্য সুর বানাবেন কেন? দ্বিতীয়ত, সম্পাদক-লেখক-পরিব্রাজক জলধর সেনের সমগ্র সাহিত্যজীবনে কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস ইত্যাদি প্রভূত পরিমাণে থাকলেও তিনি গানে সুর দিতেন, এমন কিছু জানতে পারিনি। নিলয় নীল তবে কীসের ভিত্তিতে এই তথ্য দিলেন, তা আজ আর জানার কোনো উপায় নেই, কারণ ২০১৫ সালেই মৌলবাদীদের হাতে নিহত হন তিনি।

অর্থাৎ, মনোরঞ্জন সেনের স্বরলিপির সুরের উৎস কী, তা এখনও অমীমাংসিত। তবে তা যে মূল সুর নয়, সে বিষয়ে সংশয় নেই। 

তাহলে মূল সুর কোনটি? মূল সুরে গানটি রেকর্ড করেছেন নীলা মজুমদার, সুভাষ চৌধুরী-পরিচালিত ‘ইন্দিরা’ শিল্পীগোষ্ঠী, অবশ্যই শ্রীদিলীপকুমার রায়-প্রতিষ্ঠিত ‘মধুরা শিল্পীগোষ্ঠী’, এমনকি পরে ক্যালকাটা ইয়ুথ কয়্যারও; যন্ত্রে এই সুরটি রেকর্ড করেছেন স্বনামধন্য শিল্পী ভি বালসারা। এই সুরের গড়ন কেমন? প্রথমেই বলার, না, এটিও মূলতানে বাঁধা নয়। ‘মূলতান’ বা ‘মূলতানী’ ভারতীয় রাগসঙ্গীতের অতিপরিচিত একটি রাগ। টোড়ি ঠাটের অন্তর্গত এই রাগে মুখ্যত গা কোমল স্বরে আর মা তীব্র স্বরে (বা কড়িতে) গাওয়া হয়। অবরোহণে রে আর ধা লাগে বটে, তবে তারাও শুদ্ধ স্বরে নয়, কোমলে। ফলে আবার একটু মনে করিয়ে দিই, রজনীকান্তের শাস্ত্রীয় রাগশিক্ষা ছিল না, তাঁর দেওয়া মূলতানের মূল তান আর রাগসঙ্গীতের মূলতান এক নাও হতে পারে। রজনীকান্ত সেনের বড় মেয়ে শান্তিলতার বড় ছেলে শ্রীদিলীপকুমার রায়। তিনি চোখে দেখেননি নিজের দাদামশাইকে, কিন্তু মা শান্তিলতা, যিনি রজনীকান্তের সমস্ত গানের প্রথম ছাত্রী, যাঁকে হাসপাতালে মৃত্যুশয্যায় শুয়েও হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান শিখিয়ে গেছেন রজনীকান্ত, সেই শান্তিলতা দেবীর সূত্রেই দাদামশায়ের গানের সঙ্গে সাক্ষাৎ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁর। একটা সময়ের পর প্রয়োজন ও চাহিদা অনুভব করে এই সুরস্মৃতির ভিত্তিতেই শ্রীদিলীপকুমার রায় রজনীকান্তের অনেকগুলি গানের স্বরলিপি তৈরি করেন। প্রথমে জিজ্ঞাসা প্রকাশনী থেকে ‘কান্তগীত-লিপি’ (১৯৬৯ ও ১৯৭৫) নামে, পরে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত অ্যাকাডেমি থেকে ‘কান্ত-কবির গান’ (১৯৯৬ ও ১৯৯৮) নামে সেগুলি প্রকাশিত হয় দুই খণ্ডে। দুটি বইয়েরই দ্বিতীয় খণ্ডে এই গানের স্বরলিপি রয়েছে। সেই স্বরলিপিতে ও স্বরলিপি-নির্ভর মধ্যলয়ের গায়নে মূলতান নয়, কিছুটা কাফির চলন পাওয়া যাবে।


পঞ্চাশ দশক থেকেই বাংলার বেতারজগৎ ও রেকর্ডিং জগতে সক্রিয় ছিলেন শ্রীদিলীপকুমার রায়, কান্তগীতি ছড়িয়ে দিচ্ছেন শিষ্যবৃত্তে, বেতারে, অথচ বহু গানেরই ভিন্ন ভিন্ন সুর তৈরি হতে সেই সময়েও দেখছিলেন তিনি। তা নিয়ে আক্ষেপ ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর স্বরলিপির বইগুলিতে। একটির ছবি সঙ্গে দিলাম, বয়ানটি মন দিয়ে লক্ষ করবেন।

 

রজনীকান্ত সেনের বিচিত্র ছাড়পত্র,তাঁর অতিরিক্ত সারল্য, বিনয় ও ঔদার্য এমন পরিবর্তনগুলির পিছনে দায়ী তো বটেই। রবীন্দ্রনাথের মত সাংগঠনিক ক্ষমতা বা ইচ্ছে কোনোটাই তাঁর ছিল না। কিন্তু সারল্যের সুযোগ নেওয়া বা ঔদার্যের অপব্যবহার করা তো আমাদের পক্ষে অনুচিত।

এ গানের আরও একটি সুর আছে। ১৯৭১-এ বাংলা ছবি ‘মহাবিপ্লবী অরবিন্দ’-তে আরতি মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ধরা থাকে সেই সুর, যা দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। হেমন্তবাবু সেকালে বাংলা ছায়াছবি ও বেসিক গানজগতের একরকম ‘ডন’। নিজে রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ-নজরুলের গান গেয়েছেন, কখনো সফল, কখনো কম সফল হয়েছেন। কিন্তু ১৯৭১ সালে একটা বহুপ্রচলিত কান্তগীতিকে নিজে সুর দেবার ঠিক কী যুক্তি বা প্রয়োজন ছিল, এ সত্যিই আমার বুদ্ধির অতীত। নাহয় স্ক্রিপ্টের খাতিরে একটা নতুন করুণ গান বানিয়েই নেওয়া হত!


ক্যালকাটা কয়্যারের উচ্চকিত সুরের এক্কেবারে উল্টোদিকে এই গান অতিধীর লয়ে, অতিবিষণ্ণ সুরে। ফলে, ‘দীন দুখিনী মা’-এর কান্না যদি বা সেখানে এল, হারিয়ে গেল ‘মায়ের নামে’ করা সেই ‘প্রতিজ্ঞা’-র ওজন। হারিয়ে গেল ওই আশ্চর্য সমন্বয়টি। রজনীকান্ত ঘটিয়েছিলেন বিষাদ আর উদ্দীপনার মিলন, করুণরস আর বীররসের, শোক আর উৎসাহের এক অপূর্ব সমাহার। আমরা হারিয়েই ফেললাম সেই কোমল-তীব্র-শুদ্ধের দুর্দান্ত সরলকঠিন দাম্পত্য। এই ইতিহাসই রজনীকান্তের জন্যে বরাদ্দ ছিল? ভাবলে বড্ড মনখারাপ হয়, অসুস্থ অবস্থায় রায়বাহাদুর দীনেশচন্দ্র সেনের কাছে গিয়ে নিজের প্রথম বইদুটির স্বত্ব বিক্রি করার জন্যে গুরুদাস লাইব্রেরীকে চিঠি লিখে দিতে বলছেন রজনীকান্ত। কথা তখনই প্রায় বুজে এসেছে, তবে চারশো টাকা তো অনেক টাকা, তা দিয়ে অন্তত চিকিৎসার বেশ খানিকটা হয়ে যাবে; তারপর সেরে উঠলে আবার অনেক বই লেখা যাবে নাহয়, সাহেব ডাক্তার দেখবে বলে কথা, সেরে তো যাবেই তাঁর ক্যান্সার!... কিন্তু সেরে আর ওঠা হল না...

জনস্মৃতি ও জনশ্রুতি থেকে মূল সুরের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে হাহুতাশ করা আমার উদ্দেশ্য নয়। রজনীকান্ত যে অঞ্চলের মানুষ, যে কৃষ্টির জলহাওয়া তাঁকে লালন করেছে, তাতে চারণগানের ঐতিহ্য তো অতিপুরাতন। ‘মুখে মুখে ফেরা মানুষের গান’-ই সেখানে স্বাভাবিক, হয়ত স্বরলিপি লেখাকে প্রত্যাখ্যানই করেছিলেন তিনি, কোনো এক জাতিস্মর গায়কের মত। কিন্তু এখন কি ফিরে যাওয়া যায় না সৃষ্টির কাছাকাছি? মূল সুর না জানায় শ্রোতাদের একেবারেই দোষ দেওয়া যায় না, দায় আমাদের সকলের। তবে যেসব গায়ক মূল সুর জেনেও তা ব্যবহার করেন না, তাঁদের নিয়ে বড় ক্ষোভ হয়। কী জানেন, সুর-তাল-ছন্দ-লয় এসব অনেক পরের কথা। আসল কথা হল গানটিকে মনের মধ্যে দেখা। ওই বিষাদ, উৎসাহ, দুঃখ, বিস্ময়—সবকিছুর অন্দরে রয়েছে একটি প্রত্যয়। পরজীবিতাকে ছুঁড়ে ফেলে শিরদাঁড়া সোজা করে চলতে পারার আত্মবিশ্বাস। যে গান নিজের গর্ভে ধরে থাকে ‘আত্ম’-কে, তা গাইতে গিয়ে কেবলই ‘পরের দোরে ভিক্ষে’ করলে চলে? গানের অপমান হয় যে তাতে! সঙ্গীতের দর্শনটিই ভেঙে যায়!... আমরা কি ‘এমনি পাষাণ’?... স্ব-এর অধীন থাকতে যাঁরা শেখালেন, তাঁদের নাহয় আরেকটু সম্মান দিই, সুযোগ আছে এখনও। চলুন না!...

তথ্যঋণ: ‘কান্তকবি রজনীকান্ত’। নলিনীরঞ্জন পণ্ডিতের এই জীবনীগ্রন্থটি আমার সম্পাদনায় ‘পরম্পরা প্রকাশন’ থেকে পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।

তথ্য-সহায়তা: আচার্য দিলীপকুমার রায়, অর্চনা ভৌমিক, শ্রীনন্দা মুখোপাধ্যায়, শ্রীমন্তী গুপ্ত, সত্রাজিৎ গোস্বামী, বসুমিত্র মজুমদার, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক ঘোষাল।

Powered by Froala Editor