‘এখানে তুমি সংখ্যালঘু’

শ্রুতিমধুর – ৯

আগের পর্বে

“সাথীদের খুনে রাঙা পথে পথে হায়নার আনাগোনা আর সইব না”। এমনই এক গণসঙ্গীতের আনাগোনা লেগেই থাকত ছোটবেলায়। ‘খুন’ মানে যে রক্ত সেটা বোঝার বয়স তখনও হয়ে ওঠেনি। হুঁশিয়ার বলে টান দিয়ে শুরু হত সেই গান। তার সঙ্গে দ্রুত লয়ে তালবাদ্য। সঙ্গীতকার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুত্র অমিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিকল্পনা ছিল এই যন্ত্রানুসঙ্গ। সুর বাসুদেব দাশগুপ্তের। কিন্তু এই ‘হিংস্র’ শব্দপ্রয়োগ কেন, তা প্রায় অর্ধশতক পরে এসে বোঝা যায় আজ। তীব্র দুঃখ, তীব্র রাগ থেকেই জন্ম নিয়েছিল তা। বামজোটকে বজ্রকঠিন প্রতিবাদ গড়ে তোলার ডাক দিয়েছিল।

স্টিয়ারিং-এ বসে আছেন ভানু ব্যানার্জী। পাশে গিন্নি রুমা গুহঠাকুরতা। বিয়ে-টিয়ে হয়ে গেছে সেই আগেই, দুই বর-বৌ সংসার খানিকক্ষণ সরিয়ে রেখে নতুন নতুন প্রেম করতে বেরিয়েছেন। বিয়ের পরে প্রেম! হুঁ হুঁ! খুবই আপ্লুত-পুলকিত মুখ করে ভানু গাইছেন- “তুমি আকাশ এখন যদি হতে, আমি বলাকার মত পাখা মেলতাম।” মনে ভীষণ ইচ্ছে, বৌ-ও অমন কাব্যি করে দু-চারটে ভালবাসার বাণী দিক। কিঞ্চিৎ সাধাসাধির পর নজ্জা-নজ্জা মুখে বৌ গাইলেন- “তুমি ময়দা এখন যদি হতে, জলখাবারে লুচি বেলতাম।” মান্না দে-র শ্রীকণ্ঠের স্বপ্নরোমান্স ধড়াস করে ভেঙে পড়ে গেল। আকাশ-বলাকা-পদ্ম-পলাশ-ভ্রমর এইসব সূক্ষ্ম উপমার পাশে কিনা ময়দার নুচি, তেঁতুলের টক, পান্তাভাত আর বিলিতি বেগুন!! অ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স আর কাকে বলে!!

‘আশিতে আসিও না’-র এই কাল্ট-দৃশ্যটির প্রসঙ্গ হাস্যকৌতুকের অন্তর্গত অসঙ্গতি বোঝাতে আমরা পদে পদে টেনে আনি। কিন্তু ভেবে দেখেছি পরে, এই অসঙ্গতি কি খুব স্বাভাবিকই নয়? কোন্‌ আকাশ, কোন্‌ পাখির ঝাঁক, কোন্‌ পুষ্পমধুর কথা বলত সেই মেয়েটি? যার সঙ্গে তার কোনো পরিচয়ই সেভাবে গড়ে ওঠেনি? ছেলেটি ভ্রমর হয়ে পদ্মমধু খেতে চেয়েছে; সোজা কথায়, গ্রহণ করতে চেয়েছে প্রিয়াকে। মেয়েটিও তো ঠিক তা-ই বলেছে। তার উপমার উপাদানগুলো কেবল আলাদা। সে তো তার চেনা পরিসর থেকেই তুলে এনেছে সেসব। যে হেঁশেল তার পরিধি, তার ভেতরকার অবজেক্টগুলিই তার উপমায়নের সম্বল। বক্তব্যে তো একেবারেই অসঙ্গতি নেই।


অসঙ্গতি তবে আছে কীসের সাপেক্ষে? আমাদের কাব্য, শিল্প, সঙ্গীতের বানিয়ে তোলা একটা শব্দভাণ্ডারের সাপেক্ষে। সেই ভোকাবুলারির বিচারে সূক্ষ্ম-স্থূল, চতুর-নির্বোধ, ইন্টেলেকচুয়াল-গ্রাম্য ভেদ করি আমরা। গানের ক্ষেত্রেও সেই শীলিত ভোকাবুলারির মানদণ্ড বিশেষত পুরুষ। তার সংখ্যাগত আধিক্য, সামাজিক আধিপত্য, সাংস্কৃতিক দাদাগিরি একদিকে যেমন মেয়েদের নিজস্ব উপমাজোট প্রায় তৈরিই করতে পারেনি, তেমনি ভাল-খারাপের মাপকাঠি বেঁধে দিয়েছে, যাতে মেয়েদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশটাও মাঝরাস্তায় আটকে যায়।

আরও পড়ুন
‘রক্তে বোনা’ গান...

খুব নির্দিষ্টভাবে, প্রেমের গানের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা তীব্রভাবে অনুভব করি। সোলো হোক্‌ কিংবা ডুয়েট, নারীকণ্ঠের সংখ্যা তো বাংলা গানে একেবারেই কম নয়। কিন্তু আদৌ ‘নারীর কণ্ঠ’ কি শুনতে পেয়েছি সেই গানে? আশি-নব্বই দশক আসার আগে, আধুনিক বাংলা গানে মৌসুমী ভৌমিক নামের একজন আশ্চর্য মানবী আসার আগে পর্যন্ত সেই স্বর কী ভীষণ অস্পষ্ট! এর কারণ কী? প্রথমত, গানের নির্মাতা যাঁরা, বিশেষত গীতিকারদের মধ্যে নারী-পুরুষের বিচিত্র বিষম অনুপাত। গানমেকিং-এর দুনিয়ায় মেয়েদের উদ্ভট সংখ্যালঘুত্ব। বহুদিন পর্যন্ত ভাবতাম, মোহিনী চৌধুরী নিশ্চয়ই কোনো মেয়ের নাম। ভেবে বেশ পুলক হত, ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’, ‘আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড়’-এর মত ঝোড়ো গান লিখেছেন চল্লিশ-পঞ্চাশ দশকের এক নারী। এমনকি, ‘ভালবাসা মোরে ভিখারি করেছে, তোমারে করেছে রানি’ শুনেও ভেবেছিলাম, বাপরে, এ তো রীতিমত রোল রিভার্সাল! পোড়াকপাল, সে ভুল দুম করে একদিন ভেঙে গেল। তারপর থেকে সবকিছু প্রবল সন্দেহের চোখে দেখতে আরম্ভ করলাম। উনিশ-বিশ শতকের কবিতা আর গানের স্রষ্টা হিসেবে মেয়ের নাম দেখলেই প্রথমে তাকে ছদ্মনাম ধরে নিতাম, তারপর বাকি কথা। অনিলা দেবী, এয়ার্কি হচ্ছে? এই কারণেই হিমাংশু দত্তের গানের ক্যাসেটে ‘নিশীথে চলে হিমেল বায়’-এর কথা মমতা মিত্রের দেখে ধরে নিয়েছিলাম, ইনি অবশ্যই পুরুষ। পরে সংশয় কাটিয়ে নিশ্চিত হই। শিখি ‘শ্রাবণরজনী ধীরে ঘন কুন্তল খোলে’-র মত অসামান্য এক গানও। যেখানে প্রাচীন মেঘদূত আখ্যানের সঙ্গে সূক্ষ্ম এক ইন্টারটেক্সচুয়াল সম্বন্ধ গাঁথা হয়। যে মেঘদূতের কথক, কথনের ভরকেন্দ্র অবধারিতভাবেই এক প্রেমিক পুরুষ, তার এইরকম সাট্‌ল্‌ কাব্যিক পুনরুচ্চারণ, ভিন্নপক্ষের কথকের পুনঃকথন চমকে দিয়েছিল আমায়।--

“অতীতে মেঘের মুখে প্রিয়কথা গেছে শোনা/ আজিকার মেঘ কেন নাহি দেয় সান্ত্বনা?”

আরও পড়ুন
‘মলিন মর্ম মুছায়ে’

দেখুন, এই কথক মেঘের মুখে কথা শোনার কথা বলছে, কথা পাঠানো নয়। সেই প্রাচীন যক্ষিণীই এই কথকের পূর্বজা।

কিন্তু সমস্যা হল, এইসব প্রেমের গানের কাব্যিকতা ভারি নিপুণ হলেও সত্যিকারের চাঁছাছোলা মেয়েলি উচ্চারণ না এসে সবকিছুই কেমন অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ে যায়! তোমাকে দেখি, তোমাকে ভালই লাগে, তুমি যে আমার আর আমি যে তোমার, দ্যাখো চাঁদটা কেমন সুন্দর, ইত্যাকার ভাসা-ভাসা চারটে কথা ছাড়া প্রায় কিছুই ধরা পড়ে না। প্রেমের সঙ্গে সহজতায় জড়িয়ে থাকা শরীরী চাহিদা তো দূরস্থ, ১৯৭৪-এ মিঠু মুখার্জীর লিপে বেপরোয়া দুর্দাম গান ‘বেশ করেছি প্রেম করেছি’ গাওয়ানোর জন্যেও একজন শ্যামল গুপ্ত বা গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের দরকার পড়ে।

আরও পড়ুন
“ভরসা যেন পড়ায় এবং...”


কেন আসে না সেই কথা? আদতে, একটি মেয়ে কি সত্যিই একটি পুরুষের শরীরকে ভালবাসতে শেখে? মানে, যাকে বলে, অ্যাডমায়ার করা, তা কতটা করতে পারে সে? তার ধাতে আপাত-নিষ্ক্রিয় একটা অবস্থান আমূল পোঁতা হয়ে রয়েছে। যেন তার ভূমিকা গোলাপবালা-গোলাপবালা ঢঙে প্রশংসিত হওয়া, আহ্লাদি-আহ্লাদি মুখে স্তুতিতে গলে যাওয়া, মানে যেমন করে তাকে পুরুষ দেখতে চেয়েছে। ভাবলে সত্যি অবাক লাগে, পুরুষ কি চায়নি নিজের প্রশস্তি অন্যের মুখে? অতুল্য দুটি ‘ডাগর আঁখি’ তার পানে চাইবে, তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে গভীরভাবে চাইবে, আর সেই ‘চাওয়া’-ময় চাউনি তার উচ্চারণে ঝরে পড়বে, এ কি পুরুষ কোনোদিন ভাবেনি? দুর্ভাগা বেচারা পুরুষ, নারীকে কুক্ষিগত রাখতে গিয়ে সে নিজে এমন এক মধুর অভিজ্ঞতার থেকে যুগের পর যুগ বঞ্চিত হল। এ তো তার একরকম শাস্তিই বটে! ন্যায্য শাস্তি!

আরও পড়ুন
‘আমার’ ‘আমার’ বলতে লাগে লাজ...

পদ্মের মতো পা, কুন্দফুলের মতো দাঁত, আষাঢ়মেঘের মতো চুল, ননীর মতো চামড়া- এই আনতাবড়ি ন্যাকামি-পোশাকের আড়ালেই কিন্তু সারে সারে শুয়ে থাকে গমক্ষেতের ভাঙাচোরা লাশ। লাশ হয়ে যাওয়া সেই মেয়েলি পৃথিবীকে ভুলে গিয়ে ব্যায়লা বাজালে চলবে কেন? সোনার খাটের ঘুমন্ত রাজকন্যা ঘুম ভাঙলেই তার ছিঁড়ে প্রশ্ন করবে- “ইয়ে জ্বল্ কেয়া রহা হ্যায়?”

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
জীবনে বাদল ছাইয়া