‘আমার’ ‘আমার’ বলতে লাগে লাজ...

শ্রুতিমধুর – ৫

আগের পর্বে

‘উঠ গো ভারতলক্ষ্মী’-র মতো আইকনিক দেশাত্মবোধক গানের স্রষ্টা অতুলপ্রসাদের গানে বার বার এসেছে বিচ্ছেদের সুর। তার লিপিতে প্রতিফলিত হয়েছে প্রেমের নির্যাস। মামাতো বোন হেমকুসুমের সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তাঁর বিলেতেই। পরিবার-পরিজন মেনে নেয়নি। তবে সেই সম্পর্কেও ফাটল ধরেছিল বারবার। বারবার হয়েছিল সাক্ষাৎ। যা জ্বালানি হয়েছে তাঁর গানের। মাঝবয়সী যুবক বন্ধু পাহাড়ী সান্যালকে অতুলপ্রসাদ বেশ কিছু গান শিখিয়েছিলেন। তবে তার সুর এবং স্বরলিপি, পরিচিত গায়কির থেকে ভিন্ন।

একটা গান শেষপর্যন্ত কার? যিনি লেখেন, তাঁর? যিনি সুর বাঁধেন, তাঁর? যিনি কণ্ঠে ধরেন, তাঁর? নাকি, এঁদের কারুরই না, যে শোনে, তার? আসলে বোধহয় সবকটাই। অথরের হাতে সর্বস্বটুকু গচ্ছিত রাখা এক বিচ্ছিরি দস্যুপনা। কিন্তু সৃষ্টির তরফের কোনো ‘আমি’-ই শেষমেশ তাকে অধিকারে না রেখে একেবারে ছেড়ে দেবেন শ্রোতার কাছে, এমনটা প্রত্যাশা করা ন্যায্য কিনা, সে বিষয়ে সংশয় আছে। ‘নিজের’ বলে অধিকার জাঁকিয়ে বসতে স্রষ্টার আপত্তি কিংবা দ্বিধা জায়েজ, কিন্তু অথরকে একেবারে ডেড ঘোষণা করে দিয়ে সব বারোয়ারি করে নিলে আমাদের শিল্পপাঠে কিছুটা ভুল তৈরি হতে পারে। যেমন ভুল হয়েছে একাধিক বহুপরিচিত বহুশ্রুত জনপ্রীত গানে, এই গানটিতেও—

“আমি মন্ত্রতন্ত্র কিছুই জানিনে মা,
শুধু যা জেনেছি, সেটুক হল এই,
তোরে ডাকার মত ডাকতে যদি পারি,
 তবে আসবিনে, তোর এমন সাধ্য নেই।”

আজকের পাঠক এ গানের সঙ্গে পরিচিত নন, এটা আমি বিশ্বাস করি না। ভক্তিগীতির প্রতি আপনার তেমন আগ্রহ না থাকলেও এই গান ফি বছর কালীপুজোয় শুনতে আপনাকে হয়ই। কালীপুজোয় বাজাবার জন্যে কয়েকটা বাঁধা গানের সংকলন আছে। সেই সংকলনে এখনও সব্বার ওপরে আছেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। মান্না দে, কুমার শানু বা অনুরাধা পাড়োয়ালরা থাকলেও অবধারিতভাবে শারদধ্বনি ধরে থাকে পান্নালালকে; দেখবেন, নিষিদ্ধ শব্দবাজির বেমক্কা চমকানো আওয়াজকে হঠাৎ কেমন চুপ করিয়ে বেলা সাড়ে দশটায় বেজে উঠবে ওই শ্রীকণ্ঠ, অনেক রাতেও বন্ধ জানলার কাচ পেরিয়ে আপনার ঘরে ঘুরে বেড়াবে ‘শান্ত মিঠে’ মায়া-মায়া এক স্বর। অন্তত মাতৃসঙ্গীতে পান্নালালকে কিছুতেই ছাড়েনি বাঙালি, সমস্ত ব্র্যাকেটের বম্বেকে পিছনে ফেলে পপুলারিটিতে এখনও এক নম্বরে তিনিই। সেই পান্নালালের কণ্ঠে ধরা ছিল উপরে লেখা গানটি।

পান্নালাল ভট্টাচার্য 

 

আরও পড়ুন
জীবনে বাদল ছাইয়া

প্রথম গায়ক তো পান্নালাল, পরে আরও অনেকেই এ গান রেকর্ড করেছেন। কিন্তু এ গানের স্রষ্টা কে? ইউটিউব চালান, সার্চ অপশনে গানের প্রথম পঙ্‌ক্তি লিখলে অন্তত দশ-বারোটি ভিডিও ভেসে উঠবে একবারেই; প্রত্যেকটি ভিডিও-র বিবরণ দেখুন, কোথাও, আই রিপিট, কোত্থাও, গানের স্রষ্টার নাম নেই। কেউ কেউ নাম লেখার দরকারই অনুভব করেননি, কেউ আবার কিছুটা দায় সেরে ফেলার জন্যে যোগ করেছেন ‘প্রচলিত’ বা ‘ট্র্যাডিশনাল’।

শ্যামাসঙ্গীত, বা আরেকটু বড় করে ভাবলে মাতৃসঙ্গীতকে ‘প্রচলিত’ ভাবতে গেলে তার উৎসে যতটা প্রাচীনত্ব প্রয়োজন হয়, একটু দীক্ষিত শ্রোতাই বুঝতে পারবেন, এই গান ততটা প্রাচীনগন্ধী নয়। এর কথা ও সুরের শরীরে নতুন কালের ছাপ লেগে আছে। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে তৈরি এই গান, তখনই রেকর্ড। গেয়েছিলেন পান্নালাল, গাইয়েছিল এইচ এম ভি, আর বেঁধেছিলেন শ্রীদিলীপকুমার রায়।

আরও পড়ুন
‘মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে’...

সেকালে দিলীপকুমার নামটি একটু বেশিই প্রচলিত ছিল, ফলে একই নামের একাধিক ব্যক্তি থাকা অস্বাভাবিক ছিল না। আমাদের সন্দেহ সরিয়ে দেবার জন্যে জানিয়ে রাখি, এই গানের গীতিকার দিলীপকুমার রায় হলেন রজনীকান্ত সেনের দৌহিত্র। বিশ শতকের শুরুর দিক থেকেই বেতার ও গ্রামোফোনে কাজ করছিলেন তিনি, নিজে গান তৈরিও করেছিলেন, তবে আগ্রহ বেশি ছিল রজনীকান্ত-অতুলপ্রসাদ-হিমাংশু দত্ত-নজরুল ইসলামের গান শোনানো আর শেখানোতে। হঠাৎই তাঁর কাছে প্রস্তাব আসে মাতৃসঙ্গীত লেখার। আর প্রস্তাবটি খুবই নির্দিষ্ট ছিল। গায়ক হিসেবে পান্নালাল স্থির হয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর কণ্ঠের পক্ষে উপযোগী কয়েকটি মায়ের গান বেঁধে দিতে হবে, সরাসরি এই প্রস্তাবটিই কোম্পানিকর্তার তরফে রাখা হয় শ্রীদিলীপকুমার রায়ের কাছে। বেশ কিছুটা সময় নিমরাজি হয়ে থাকার পর অবশেষে মত দেন লেখক। গান বাঁধা হয়। আর আমরা জানি, শুধু গান নয়, আসলে ইতিহাস লেখা হয়।

দিলীপকুমার রায়

 

আরও পড়ুন
‘সুর কী সর্বনাশা’!

 ব্রিটিশ ‘কলম্বিয়া’ কোম্পানি যখন ‘এইচ এম ভি’-কে নিজের গানগুলির স্বত্বদান করে পাততাড়ি গুটিয়ে অন্য ছাদের তলায় যায়, তার পরের কথা এসব। ভারতের মাটিতে গ্রামোফোন কোম্পানি (যারা ‘এইচ এম ভি’-র লেবেলে রেকর্ড প্রকাশ করত) তখন এককরকম সর্বেসর্বা। স্বাধীনতার পর বিভিন্ন আঞ্চলিক স্তরে বেসিক গানের একটা নিজস্ব চাহিদা তৈরি হয়। ৭৮ আরপিএম ডিস্কে এপিঠ-ওপিঠ মিলিয়ে দুটি করে গান প্রকাশিত হত সেসময়। ১৯৬০-এর গোড়ার দিকে সেরকম এক জোড়াগানের ডিস্কের জন্যেই লেখা হয় এই গান। সেই রেকর্ডের গায়ে কথা ও সুর-এর নির্মাতা হিসেবে শ্রী দিলীপকুমার রায়ের নাম সযত্নে মুদ্রিত ছিল। সম্ভবত পরে পান্নালালের মাতৃসঙ্গীতের সংকলনেও গীতিকার-সুরকারের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। যাঁদের কাছে পুরনো ‘মায়ের পায়ের জবা’ ক্যাসেটটি রয়েছে, তাঁরা এ বিষয়ে সম্যক তথ্য দিতে পারবেন। কিন্তু আশির দশক থেকে ‘শ্যামাসঙ্গীত’-এর যে এক স্বতন্ত্র বাজার তৈরি করে অডিও সংস্থাগুলি, সেই বাজারে কমার্শিয়ালাইজড ভক্তির শান্তিজলে নাম-টাম ধুয়ে যায়। ফলে, আজ কোনো গায়কেরই মনে পড়ে না তাঁর নাম, বিস্মৃতিপ্রবণ জাতি স্বভাববশত অতি অনায়াসে এতখানি প্রচারিত গানের উৎসকেও মুছে ফেলে। গানের পূর্বপ্রতিষ্ঠিত পপুলারিটি কাজে লাগিয়ে লক্ষ লক্ষ ‘ভিউ’ হয়;- কেউ গলায় গান, কেউ মাউথ অর্গ্যানে সুর বাজান, কেউ গানসহযোগে নৃত্যপরিবেশন করেন, কিন্তু কারুরই আর নাম মনে থাকে না। হাস্যকর ঠেকে যখন দেখি, প্রখ্যাত ক্যাসেট-সিডি কোম্পানি ভক্তিগীতির ভরা বাজারে ‘বম্বে’-মার্কা গায়িকার বিচিত্র উচ্চারণে এই গান বেচে, এবং সুরকার হিসেবে ছেপে দেয় কোনো এক ‘শেখর সেন’-এর নাম। মহা মুশকিল! দুনিয়ার শেখর সেনদেরও কোনো তাপ-উত্তাপ নেই! অবলীলায় ক্রেডিট নিচ্ছে!...

শেখর সেন

 

আরও পড়ুন
‘ধন ধান্য’ : ভুলে ভরা

দিলীপকুমার এই গানের ফরমাশটি প্রথমে সবিনয় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কারণ, এই ধরণের গান লেখার অভ্যাস বা অনুশীলন তাঁর ছিল না। কিন্তু আমরা তো জানি, অভ্যাস না থাকলেও এ গানের ভ্রূণ ছিল তাঁর স্নায়ুজালের মধ্যেই। দিলীপকুমারের মাতামহ রজনীকান্ত সেন বাংলা ভক্তিমূলক গানের আকর, সহজ সচল অধ্যাত্মবোধ, প্রগাঢ় নিবেদন তাঁর গানের প্রতিটি বাঁকে এসে পড়েছে। রজনীকান্তের সেই ভক্তিপ্রাণ সত্তাও আসলে তৈরি হয়েছে তাঁর পূর্বাধিকারীদের মাধ্যমেই। দিলীপকুমারের প্রমাতামহ গুরুপ্রসাদ ও গুরুপ্রসাদের দাদা গোবিন্দনাথ- একজন পরম বৈষ্ণব, আরেকজন ঘোর শাক্ত। গুরুপ্রসাদ প্রকাশ করেছেন বৈষ্ণবপদের বিরাট সংকলন ‘পদচিন্তামণিমালা’, কিন্তু দাদার খারাপ লাগবে ভেবে কদিন পরই আবার শাক্তপদ লিখে এনেছেন, একইরকম সহজতায়। ভক্তির এই সারল্যই তো উত্তরাধিকারসূত্রে বর্তেছে দিলীপকুমারের মধ্যে। পান্নালালের কণ্ঠে তিনি যখন লেখেন, “যদি তোর ও মন্দিরের দ্বারে/ তোমার লাগি কাঁদি অঝোর ধারে/ যদি নয়ন হতে লুপ্ত ভুবন হয় সেই সে অশ্রুতেই/ তবু আমার কাছে আসবি নে, তোর এমন সাধ্য নেই।”—তখন মা-কে একই পঙ্‌ক্তিতে তুই আর তুমি সম্বোধনের মধুর স্ফূর্তি আমায় মুগ্ধ করে। (যদিও প্রসঙ্গত বলে রাখি, এই পঙ্‌ক্তিটি শ্রী রায়ের শিষ্যা শ্রীমতী অর্চনা ভৌমিকের কাছে শিখেছি ‘বসে আমি কাঁদি অঝোর ধারে’ হিসেবে।) স্থায়ী-অন্তরা-আভোগে মা-কে তুই বলে ডাকা, সঞ্চারীতে আবার তুমি, এই অনায়াস চারণ আসলে শাক্তপদাবলীর ইতিহাসসূত্রে আসা, কালীকীর্তনের ধারায় পাওয়া। “আমি যা করি মা, সবই তোমার কাজ,/ আমার আমার বলতে লাগে লাজ/ আমি সকল ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছি চরণতলাতেই”—এই উচ্চারণের আকুতি, আত্মবিলোপী ভক্তি ও সমর্পণের নিবিড় শম্‌ আমায় একইসঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয় রামপ্রসাদী অভিমান আর বৈষ্ণব শ্রীখোল। এই উচ্চারণ যিনি করেন, সেই নিরহং স্রষ্টা যে একান্ত নিজেরই বলে এই গানকে কুক্ষিগত করে রাখবেন না, তা অনুমেয়। অথচ সেই ঔদার্য অপচয়িত হল ‘প্রচলিত’ উল্লেখতাচ্ছিল্যের ঔদ্ধত্যে।

পান্নালাল চলে গিয়েছিলেন এই গান রেকর্ডের কয়েক বছর পরেই। ১৯৬৬ সালে, মাত্র ছত্রিশ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেন তিনি। খুব অভিমান করেছিলেন, যে মা-কে এত প্রাণ ভরে, এত দরদ দিয়ে, এত নিবিড় করে ডাকেন তিনি, সেই মা তাঁর কাছে না এসে দাদাকেই কেন কেবল দেখা দেন! কিন্নরকণ্ঠ দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যও ভক্তিগীতির সুধাময় গায়ক। কিন্তু শ্রোতার সংবেদী মন জানে, পান্নালালের মত অলৌকিক চিরকৈশোর আর কারুর কণ্ঠে বাস করে না। ওই অহংশূন্য ছেলেমানুষি না থাকলে ভক্তি ষোল আনা পূর্ণ হয় না যে। তবু, মন্দিরের দুয়ারে মা-কে ডেকে ডেকে চোখের জলে অন্ধ হয়ে গেলেও মা কিছুতেই সাড়া দিলেন না তাঁকে। খুব অভিমানভরা প্রত্যয় নিয়ে বলেছিলেন, “চিরজীবন রইবি দূরে, এমন সাধ্য নেই”; মা সেই অসাধ্যই যে সাধন করে ফেললেন নিষ্ঠুর হয়ে। এই দুঃখ কি ভোলবার? সহ্য হয়নি তাঁর। তাই নিজেই চলে যেতে চান মায়ের কাছে, বোধহয় ঝগড়া করতেই।

পান্নালালের কণ্ঠে দিলীপকুমার রায়ের আরও একটি জনপ্রিয় গান প্রকাশিত হয়েছিল, -- “আমি সব ছেড়ে মা, ধরব তোমার রাঙা চরণ দুটি, এই তো আমার ব্রত।” চলন শুনলেই অনুভব করতে পারবেন, বিশ শতকের নাগরিকতার চিহ্ন এতে আছে। সেই চিহ্ন ধারণ করেই পুরাতনের চৌকাঠ, ঐতিহ্যের শিকড় ছুঁয়েছে এসব গান। এখন সবই নাকি ‘প্রচলিত’! ‘প্রচলিত’ বলে দায় ঝেড়ে ফেলার মধ্যে যে বিশ্রি অস্বীকরণ, ‘ট্রাডিশনাল’ বলে ‘ট্র্যাডিশন’কেই সচেতনভাবে ভুলিয়ে দেবার যে বেনিয়া অভ্যেস, তাকে প্রশ্ন করা একুশ শতকের বাঙালি শ্রোতার দায়িত্ব। কবীর সুমন লিখেছিলেন “ছিল পান্নালালের শান্ত মিঠে গলায় বুকের বাস্তুভিটে শান্তি পেত”। সেই বাস্তুভিটের মাটি, ইতিহাসের মাটি যদি শুকিয়ে যায়, তবে জল তো দিতেই হবে।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা: শ্রী দিলীপকুমার রায়, শ্রীমতী অর্চনা ভৌমিক, শ্রী শৈলশিখর মিত্র।

Powered by Froala Editor