ক্যাকটাস চর্চার পিতামহ

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ৮

আগের পর্বে

বলরামপুর গেলেই বিকালের গন্তব্য হত বেড়মা। গাঙ্গুলীদের ঢিবির ওপরে দাঁড়িয়ে দলমাপাহাড়ের সূর্যাস্ত দেখা ছিল একরকম নেশা। এমনই এক বিকালে ‘প্রায় মরুভুমি’-র মধ্যে বাবা দেখিয়েছিল সুখেনকাকার বাগান। ধূসরের মধ্যে যেন এক সবুজদ্বীপ। বিবিধ গাছপালা থেকে শুরু করে ময়ূর, নীলগাই, হরিণ, খরগোশ, রাজহাঁস কোনো কিছুরই অভাব ছিল না সেখানে। পাঁচ দশক পরেও সুখেনকাকা আজও সেই কয়েক একর জমির ওপর তৈরি বাগান দেখাশোনা করেন। পাশাপাশি এই ৫০ বছরে আশেপাশের গ্রামের মানুষদের জীবনও বদলে দিয়েছেন তিনি।

হ্যাঁ, শুধু বাংলায় নয়, গোটা পূর্ব ভারতে ক্যাকটাস চর্চার তিনিই পথিকৃৎ। শ্রী শচীন ব্যানার্জী।
হাওড়া স্টেশানের দিক থেকে গেলে শিবপুর ট্রামডিপোয় বাস থেকে নেমে রাস্তা পার করে ঠিক উল্টোদিকের গলিটায় সোজা ঢুকে গেলে প্রথম মোড়েই শিবপুর পোস্ট অফিস। ঐ মোড় থেকে ডানদিকে গেলে পোস্টঅফিসের দু’একটা বাড়ি পরেই ব্যানার্জীদের বাড়ি শুরু। প্রাচীন এজমালি সম্পত্তি। ঐ বাড়িরই নানা অংশে অংশীদারদের বাস। যেদিকটায় শচীনকাকুরা থাকেন তারই পাশে প্রয়াত প্রাক্তন সাংসদ অম্বিকা ব্যানার্জীর বাড়ি— সম্পর্কে ওনার কাকা।

প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে শচীনকাকুর অগ্রজ শ্রী শক্তি ব্যানার্জী ছিলেন সেই সময়ের বাংলা সিনেমার (স্বর্ণযুগের) অপ্রতিদ্বন্দ্বী ফিল্ম ফটোগ্রাফার। সাহিত্যিক সমরেশ বসু ছিলেন তাঁর বিশেষ বন্ধু। সেই সূত্রে প্রায়ই আসতেন তিনি বন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিতে। বিশেষত দুপুরগুলোয়। ঐ বাড়িতেই সমরেশবাবুকে প্রথমবার কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। 

শচীনকাকু পেশায় ইমারতী দ্রব্যের ব্যবসায়ী। বাড়িতে ঢোকার মুখেই গোলা, সেখানে ইট, বালি এবং সিমেন্টের বস্তা পড়ে আছে ঢের। গোলার একদিকে একটা ছোট্ট দোচালা টালির ঘরে অফিস। কিন্তু আসল নেশা কণ্টকপর্ণী। কী প্রগাঢ় জ্ঞান মানুষটার, কী অপরিসীম ভালোবাসা ক্যাকটাস সম্বন্ধে। সবটাই হাতেকলমে করে। বাড়ির ছাদে খোলা আকাশের নিচে ঘোর বর্ষায় এমন সব প্রজাতি দেখেছি ওঁর টবে, যা অনেক ক্যাকটাস-বোদ্ধার ব্যাখ্যার বাইরে যাবে। আমরা তখনও ভাবতেই পারি না দুর্লভ ক্যাকটাস, সাকুলেন্ট বর্ষায় প্লাস্টিক বা ফাইবার গ্লাস শেডের বাইরে রাখার কথা। 

সম্পর্কে আমার পিসির দেওর। সেই সূত্রেই প্রথম আমাদের বাড়িতে আসা। কিন্তু তারপর খুব দ্রুতই তিনি আমাদের ক্যাকটাসতুতো কাকা হয়ে যান। আমাদের সপরিবার এই ক্যাকটাস মহাযজ্ঞের অংশীদার হয়ে যাওয়ার কৃতিত্ব অথবা দায় — সেও তো তাঁরই। সারা বছরই যাতায়াত থাকলেও ‘মাঘ শেষ থেকে ফাল্গুন শুরু’ এই সময়ে শচীনকাকুর একদিন সারাদিনের জন্য আমাদের বাড়িতে আসা ছিল নিশ্চিত। যা ক্যাকটাস এবং সাকুলেন্ট-এর repoting-এর মরশুম। অর্থাৎ বৎসরান্তে গাছের নতুন টবে, নতুন মাটিতে স্থানান্তরিত হবার সময়। 

আরও পড়ুন
সবুজ দ্বীপের রাজা

সেই সময়ে repoting যেন আমাদের বাড়িতে একদিনের মহোৎসব! শিবপুর থেকে শচীনকাকু উত্তরপাড়া এসে যেতেন সকাল ৮টার মধ্যে। সাড়ে আটটা - ন’টার মধ্যে চা ও জলখাবার শেষ হয়ে যেত সবার। তারপরই যজ্ঞ শুরু। বাড়ির ছাদে বড় কয়লার উনুনের উপর লোহার বড় কড়াই চাপিয়ে ঠাকুমা মাটি ভাজতেন, মাটি থেকে ফাংগাস অর্থাৎ ছত্রাক দূর করতে। ছাদের রেলিঙের গায়ে একদিক ধরে চূড়া করে করে রাখা হত বিভিন্ন মাপের খোলামকুচি, পেটা-ছাদ ভাঙা (যাকে আদর করে বৃহৎ অট্টালিকা চূর্ণ নামে ডাকা হত), কাঁকর, বালি, পাতাসার, বনমিল, স্টেরামিল ইত্যাদি। নতুন খালি টবের পাশাপাশি রাখা হত গাছ সমেত পুরানো টব (যাদের টব বদলানো হবে)। এরপর ছিল পুরানো টব থেকে গাছশুদ্ধ মাটি ঝেড়ে নতুন টবে সার দিয়ে বসানো। 

মা, বাবা, আমি, ভাই, আমরাও সবাই মিলে লেগে পড়তাম কাজে। চিলেকোঠায় ঠাকুরঘরের বাইরে এক ছোট বারান্দা, সেখানে বসে থাকত পরিবারের আরেক সদস্য রিনটিন। সিঙ্গল কোট (যাকে এখন স্মুদ কোট বলা হয়), সেভেন জেনারেশান পেডিগ্রি অ্যালসেশিয়ান। বংশ মর্যাদার কারণেই বোধহয় সে সবার চেয়ে উপরে বসতো এবং কান খাড়া করে কাজ দেখতো আমাদের। 

আরও পড়ুন
দরজার কোণে লুকিয়ে থাকা ক্যাকটাসেই ঘায়েল ডাকাত, শখ বাঁচিয়েছিল গোটা পরিবারকে

Repoting-এর পুরো ব্যাপারটায় নজরদারি করতেন শচীনকাকু। আর তাও করতেন নিজে শারীরিকভাবে সম্পূর্ণ সামিল হয়েই। বাবা, মা, ঠাকুমা এবং আমরা দু’ভাই তাঁকে সহযোগিতা করতাম পুরোমাত্রায়। তা সত্ত্বেও মোটাসোটা ফর্সা মানুষ শচীনকাকু ঘেমে উঠতেন বারবার। তবে উৎসাহে খামতি হত না একটুও। হাফহাতা গেঞ্জীর হাতা দিয়েই কপালের ঘাম মুছে আবার কাজে লেগে পড়তেন মেশিনের মতো। আর বারবার বলতেন ‘তুমি যদি গাছকে ভালোবাসো তাহলে গাছও তোমায় ‘Enjoy’ দেবে।’

মাঝে মধ্যাহ্নভোজের বিরতি দিয়ে কাজ শেষ করতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। মুখ-হাত ধুয়ে আরও একপ্রস্থ চা-জলখাবার খেয়ে পাজামা-গেঞ্জির উপর তাঁর পেটেন্ট টেরিকটের ঘিয়ে রঙের পাঞ্জাবিটা চাপিয়ে বাড়ি রওনা হতেন শচীনকাকু। আমরা তাঁকে এগিয়ে দিয়ে আসতাম রেলস্টেশান পর্যন্ত। বাড়ি থেকে স্টেশান অব্দি যাওয়ার পথেই পরিকল্পনা হত পরবর্তী ক্যাকটাস অভিযান কার বাড়িতে এবং কবে করা হবে। 

আরও পড়ুন
ভাষা বাঁচাতে সুদূর মানভূম থেকে হেঁটে কলকাতায় এলেন বাঙালিরা, নেতৃত্বে বাসন্তী রায়ও

সত্যি! নিজে নিয়ে গিয়ে আলাপ করিয়ে দিয়েছেন কতো ক্যাকটাস-স্বজনের সঙ্গে। হাওড়া বকুলতলার এডওয়ার্ড নার্সারিতে প্রতাপদা এবং তারই পাশে গোল্ডেন নার্সারিতে সন্তুদার সঙ্গেও পরিচয় তাঁর হাত ধরে। হাওড়া ময়দান স্টেশান থেকে মার্টিন রেলে চড়ে মাকড়দায় দেবীজ্যেঠু (শ্রী দেবীদাস চৌধুরি)র বাড়ি প্রথমবার যাওয়া— সেও তো ওঁরই সঙ্গে। ওঁরই সূত্রে আলাপ বাজে-শিবপুরের নেড়ুদার সঙ্গে। যিনি তিনতলার ছাদে নার্সারি করেছিলেন। এও সম্ভব! উনি অবশ্য ক্যাকটাস এবং সাকুলেন্টের সঙ্গে অরনামেন্টাল ফোলিয়েজ বা বিভিন্ন রকম পাতাবাহারও করতেন। নেড়ুদা বয়সের তুলনায় বাঙালি হিসাবে খুবই স্বাস্থ্যবান ছিলেন। অনুজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, টাকমাথা মানুষটি খুব উজ্জ্বল ও রঙিন ফ্লোরাল ডিজাইনের ‘হাওয়াই শার্ট’ পরতেন। আমরা তাঁকে আড়ালে ‘পাবলো নেড়ুদা’ বলতাম। তবে সেসব অন্য গল্প— অন্য দিন। এঁদের ছাড়াও আরো অনেক ক্যাকটাসপ্রেমীর সঙ্গে পরিচিত, কখনো ঘনিষ্ঠ হবার সুযোগও হয়েছে শ্রী শচীন ব্যানার্জীর সৌজন্যেই। আজকের দিনে আমরা যখন অধিকাংশ সময়ে মানুষে মানুষে যোগ করতেই চাই না, উনি তখনই দুই আর দুইয়ে পাঁচ করতে চেয়েছিলেন। 

প্রায় ৩৮ বছর পর এই তো সেদিন এক পারিবারিক অনুষ্ঠানেই আবার দেখা শচীনকাকুর সঙ্গে, তাঁর পাড়াতেই। আর কী আশ্চর্য! সেই ঢোলা পাজামা আর ঘিয়ে রঙের টেরিকটের পাঞ্জাবিতে একগাল হাসি নিয়ে প্রায় সেই একই রকম আছেন তিনি। দেখামাত্র উষ্ণ আলিঙ্গন। মাথার চুলে অল্প পাক ধরেছে মনে হল। কিন্তু তাঁর স্বপ্নালু দু’চোখে আজও কী ক্যাকটাস ঘোর!

আরও পড়ুন
বাঁশের তীর-ধনুক নিয়েই নামলেন প্রতিযোগিতায়, হারিয়ে দিলেন ‘আধুনিক’ শিষ্যকে

Powered by Froala Editor