মেয়েদের ব্রতপালনের চিরন্তন ধারাই প্রতিফলিত ভাইফোঁটায়

'পথের পাঁচালী’-র অনেক প্রসঙ্গই প্রায় হুবহু ছবিতে ধরে রেখেছিলেন সত্যজিৎ। তার মধ্যে একটা ছিল কিশোরী দুর্গার ব্রতপালন। পুণ্যিপুকুর ব্রত। দস্যি দামাল গেছো মেয়ে, ‘মেয়েলি’ ঘরোয়া কাজকম্মের কোনোকিছুই তার পোষায় না; কিন্তু এই ব্রতটা যতটা সম্ভব নিষ্ঠায় পালন করছে সে। আঁচলের প্রান্ত গলায় পেঁচিয়ে, গড় হয়ে, হাতজোড় করে, প্রার্থনার ঘটা কত! তার সঙ্গে মন্ত্র পড়া, “আমি সতী লীলাবতী, ভাইবোন ভাগ্যবতী!” অপু দূর থেকে দিদির কাণ্ডকারখানা দেখে ভেঙায়। মেয়েলি ব্যাপার তো, খুবই মজাদার ঠেকে তার। তাছাড়া দিদির পক্ষে এত ভক্তি-টক্তি অপুর কাছেও অবিশ্বাস্য। সেও ঠাট্টা করে বলে, “আমি সতী লীলাবতী, ভাইবোন ভাগ্যবতী!” কথাটা হবে, ‘ভাইয়ের বোন’। কিন্তু গাঁয়ের মুখ্যু ছেলেমেয়ে, আদ্ধেক শুনে যা বোঝে তাই বলে। 'ভাই বোন ভাগ্যবতী'!

ছড়া, ব্রতের ছড়া। ব্যাকরণের নিয়ম তাতে কে-ই বা মানবে? মেয়েলি আচার-অনুষ্ঠান সংস্কৃত খটোমটো গুরুমশায়গিরি খুব যত্নে থেকে দূরে রেখেছে নিজেকে। ব্রতের উপাদান হিসেবে মন্ত্রেও, তন্ত্রেও। বাংলার সেকেলে ছড়া বলে- “ও পারেতে লঙ্কাগাছটি রাঙা টুকটুক করে/ গুণবতী ভাই আমার মন কেমন করে।” এই ছড়াটি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন “সেই ঘর, সেই খেলা, সেই বাপ-মা, সেই সুখশৈশব সমস্ত মনে পড়িয়া আর কি এক দণ্ড দুরন্ত উতলা হৃদয়কে বাঁধিয়া রাখা যায়!... ইহার মধ্যে একটি ব্যাকরণের ভুল আছে, সেটিকে বঙ্গভাষার সতর্ক অভিভাবকগণ মার্জনা করিবেন, এমন-কি, তাহার উপরেও একবিন্দু অশ্রুপাত করিবেন।” এই আদর-বিরহ-আহ্লাদ-চোখের জলের ভাষাজীবনে ভাইয়ের 'ভাগ্যবতী' বা ‘গুণবতী’ হতে কোনো দোষ নেই।

গুণবান ভাইয়ের বোন হওয়া যত বড় ভাগ্যের, বোনের ভাই হওয়া তার চেয়েও বেশি। ভাইফোঁটার ভোজন-আয়োজন দেখলে একথা কার না মনে হবে! আরও আশ্চর্য দেখো, নিজের ভাগ্যের বিনিময়েই কি দুর্গা যমদুয়ারকে হেলা করে অপুকে রেখে দিয়েছিল নিশ্চিন্দিপুর-কাশী-কলকাতার জীবনে বাঁচার জন্যে? অপু তা পারল কই?

অবশ্য আগলে রাখতে পারা নয়, বড় কথা হল আগলে রাখার ইচ্ছেটা। নেপালে যে ভাইটীকা পরব প্রচলিত, তার ব্রতকাহিনিতে সাত ভাইয়ের বোন পারুল নিজের ছোটবেলায় বিয়ে হওয়া বরকে কালান্তকের হাত থেকে বাঁচাতে ছোট্ট প্রাণ নিয়ে লড়াই করে। কখনো সাপের সঙ্গে, কখনো বাঘের সঙ্গে। পারবে কিনা জানা ছিল না, না পারারই সম্ভাবনা ছিল প্রবল। গপ্পের শেষে যদিও সমস্ত ব্রতকথার মত জয়ী হয় সে, তবু জয় যে নিশ্চিত, তা কে জানত! পুণ্যিপুকুর ব্রতে শুধু নিজের বাপ-মা-ভাই বা পরিবারের মানুষকে নয়, নিজের পাড়াগাঁ, অঞ্চল, নিজের দেশজমির সব গাছ, সব জলধারাকে আগলে রাখতে চাওয়া হয়েছে। বৈশাখের পুণ্যিপুকুর ব্রতেরই আরেক রূপ কার্তিকের যমপুকুর ব্রত। ভাইফোঁটার সঙ্গে যুক্ত যম-যমী বা যম-যমুনা উপাখ্যানের রেশ রয়ে গেছে সেখানে। যমী বা যমুনার ইচ্ছেতেই তো মরে যাওয়া যমরাজা আবার ফেরত এসেছিলেন বোনকে দেখা দিতে! আমাদের মানুষজন্মে তা হবার নয়। তাই বলছিলাম, বড় কথা হল আগলে রাখার ইচ্ছেটুকু।

পিসির বাড়ি ভাইফোঁটার উৎসব। বেতের সোফায় উপহার-প্রত্যুপহার হিসেবে কাচের গ্লাসের সেট, আঁকার খাতা, ইমিটেশন গয়নাগাটি ইত্যাদি বিচিত্রধর্মী জিনিসের সঙ্গে একখানা তুলোভরা ঝলমলে মিকি মাউস রাখা আছে। ছোট ঝুঁটিয়াল মেয়ের চোখ প্রথমেই সেদিকে। ফোঁটা দেওয়া হোক্‌ না হোক্‌, মিকিটি তার একান্তই চাই। কনিষ্ঠা হবার দাবি বলে একটা ব্যাপার আছে তো নাকি! কোনোক্রমে মন্তর-টন্তর পড়ে সেটিকে হস্তগত করে তারপর শান্তি! তবে পুতুলের লোভে মন্তরে ভুল হয় না। শুদ্ধ উচ্চারণে জনপ্রতি বার তিনেক আওড়াতেও ধৈর্যে কোনো ঘাটতি নেই তার। কনিষ্ঠার ক্ষুদ্র কনিষ্ঠায় কতটুকুই বা জোর, তবু খামতি হয় না কল্যাণকামনাতেও। কিন্তু কাল যে কলি! প্রার্থনার জোর বা জের, কোনোটাই আর নেই। লিভার পচে গেল দাদার। অটুট, সফল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে আরও দূরে দূরে সরে গেল ভাইবোনেরা। পিসতুতো, মাসতুতো, খুড়তুতো, পাড়াতুতো সম্পর্কেরা কালীপুজোর হাউইয়ের মত কোন্‌ মাঝ-আকাশের অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেল, আর খুঁজে পাওয়া ভার...

পুনশ্চ: ভাইফোঁটা বা রাখিবন্ধনের ঈষৎ নারীদ্বেষী প্রাতিষ্ঠানিক স্বরূপের প্রত্যুত্তরে বোনফোঁটা কিংবা লিঙ্গনির্বিশেষ রাখিবাঁধা উদ্‌যাপনের দাবি বারবার এসেছে। ঠিক যেমন জামাইষষ্ঠীর সঙ্গে বৌমাষষ্ঠী। শাস্ত্রে যা-ই থাক, বিধান যা-ই বলুক, এতে কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি নেই। আমাদের শব্দভাণ্ডারে আরও কিছু শব্দ যোগ হবে, আমাদের সংস্কৃতির শব্দকোষে আরও কিছু নতুন উপকরণ ঢুকে পড়বে। যতক্ষণ এসব আচার-বিচার মানুষের সঙ্গে মানুষের দূরত্ব না বাড়াচ্ছে, ততক্ষণ সকল শোভন, সকল সুন্দর। আর যতক্ষণ মনে রাখতে পারি, অনুষ্ঠান-নির্লিপ্ত থাকাও একটা অধিকার, ততক্ষণ মঙ্গল।

ঋণ:
তন্ময় ভট্টাচার্য; না যাইয়ো যমের দুয়ার
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; লোকসাহিত্য
শীলা বসাক; বাংলার ব্রত-পার্বণ
সুচন্দ্রা ভট্টাচার্য; ব্রতকাহিনি

Powered by Froala Editor