পুরুষতন্ত্রের কয়েদ ভেঙে 'মেয়েজন্মের' ফোঁটা

ভাইফোঁটা (Bhai Phonta) এলেই ফ্ল্যাশব্যাকের সাদা-কালো ছবির মতো চোখের সামনে ভেসে ওঠে ছোটোবেলার টুকরো-টুকরো দৃশ্য। দিদি সকালে উঠে স্নান করে, কাচা জামা পরে, কুয়োর পাড়ে দূর্বা তুলছে, ঠাকুর ঘরে চন্দন বাটছে। আর ওর সঙ্গে সঙ্গে এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ঘুরছি আমি। কখনও দূর্বা বাছছি, আবার বেটে রাখা চন্দন কাচিয়ে বাটিতে তুলছি। দিদির পায়ে-পায়ে ঘোরার জন্য বকুনির সঙ্গে সঙ্গে প্রদীপটা বড়ো ঘরে রাখার, ধুপকাঠি জ্বেলে দেওয়ার ফরমাশও জুটছে টুকটাক। আমি তাতেই খুশি। 

তারপর আসত ফোঁটা দেওয়ার সময়‌। আমারও দিদির সঙ্গে সঙ্গে আসনের এপারে থেকে দাদা আর ভাইকে ফোঁটা দিতে ইচ্ছে করত, কিন্তু আমায় গিয়ে বসতে হত আসনের ওপারে। শাঁখের আওয়াজ, উলুধ্বনির মাঝে আমার বুকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামত বিষাদ। শিশিরের জলে কপাল ধুয়ে দিদি চোখ বুজে মন্ত্র বলত, ঠোঁটদুটো নড়ত কেবল। আমি বলতাম - 'দিদি আমিও তোকে ফোঁটা দি? আমায় মন্ত্রটা শিখিয়ে দিবি?'

ও বলত - 'ছেলেরা ফোঁটা দেয় নাকি? এটা বোনেদের মন্ত্র। তুই শিখে কী করবি? তুই কি মেয়ে নাকি?' সে অত্যন্ত কড়াভাবে ভাইফোঁটার নিয়মরক্ষায় তৎপর ছিল। পরে আমি অবশ্য ঠাম্মার কাছে ঐ মন্ত্রটা শিখে নিয়েছিলাম। একটু বড়ো হওয়ার পর আর ভাইফোঁটা নিইনি। নানা অজুহাতে এড়িয়ে যেতাম।

তারপর বহু তেপান্তরের মাঠ পেরিয়ে, ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর দেখা পেয়ে, রাক্ষস-খোক্কোস, দত্যি-দানোর রাজ্য পেরিয়ে আজ আমি আমার স্বরূপ খুঁজে পেয়েছি। আজ আমি অনুপ্রভা! আমার পূর্বাশ্রমের একটি নাম ছিল অচিন্ত্য। সেই কয়েদখানায় কেটে গেছে জীবনের এক দীর্ঘ অংশ! গায়ে শ্যাওলা জমে গেছিল, চোখের পাতা ভারীই থাকত, আয়নায় সেই লাশের দিকে তাকালে করুণা হত আমার আমি-র!

এখন আমি জীবিত। প্রাণের নিজের একটা আলো আছে। শরীরের প্রাণ থাকলে, সেই আলো আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই আমি নিজেই নিজের নাম রেখেছি অনুপ্রভা।

এখন আমি ভাইফোঁটা দিই! আমার ভাইয়েরা কেউ আমার রক্ত সম্পর্কের কেউ নয়। আসলে এই উলটোপুরাণ জীবনের সবটাই চলতি পথের সঙ্গে খাপছাড়া! বিগত প্রায় এক দশক আমার পুরোনো জেলখানাটির সঙ্গে আমার প্রায় কোনো যোগাযোগ নেই। হ্যাঁ, ওই সবাই যাকে নিজের বাড়ি বলে, তার কথাই বলছি আরকি। আমার রূপান্তরিত জন্মের মাঠ, ঘাট, নদী, পর্বত সবই তো ভিন্ন। তাই আমার ভাইয়েরা তাঁরা যাঁরা আমার এই জন্মের এম্বিলিক্যাল কর্ডের সঙ্গে যুক্ত! 

আমার এই জন্মটি নিজেই পুরুষতান্ত্রের কারাগারে যোগমায়ার আবির্ভাবের মতো!

আমি জন্মেই পিতৃতন্ত্রের কংসের উদ্দেশ্য বলে উঠেছিলাম - তোমাকে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে! তারপর বাঁধা পরার আগেই ছু-মন্তর হয়ে গেছিলাম।

তাই আজ পিতৃতন্ত্রের খেলাগুলো খেলতে আমার ভালো লাগে। এক রূপান্তরিত নারীর জীবনে পুরুষ আর নারীর সীমারেখাটাই তো একটা ফুসমন্তর! 'ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা' - ভাই ও আমার আখ্যানে আখ্যায়িত, আমার নিজের জন্ম ও নিজের হাতে নিজের আগের জন্মের গর্ভ থেকে নিজেকে কেটে আলাদা করে। তাই না আমি কিছু প্রমাণ করি না কিছু অপ্রমাণ করতে ধেয়ে যাই। নারী পুরুষের সীমারেখা যেখানে অস্পষ্ট, সমাজের গণ্ডিই যেখানে হালে পানি পায় না, সেখানে লিবারেশন/মুক্তি ব্যতীত আর আছে কী!

গত জন্মে আমার মায়ের পেটের ভাই আছে। তার সাথে ক্ষীণপ্রায় যোগ! আমার গর্ভদাত্রীর সঙ্গে কদাচিৎ কথা হয়। গর্ভদাতার সঙ্গে গত সাত বছরে এক কি দুই দিন দেখা হয়েছিল ! কিন্তু আমি আমার সংসার তৈরি করে নিয়েছি। কিছু বোধ, কিছু বাস্তব, কিছু লড়াই, কিছু প্রেম, কিছু ভালোবাসার মধ্য দিয়ে। তাই আমার ভাইফোঁটাকে ৯৮ শতাংশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে গেলে বিভ্রাট ছাড়া কিছু ঘটবে না! 

"চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’

ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া,

উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ববিধাতৃর"

Powered by Froala Editor

More From Author See More