কেএফসি বা ম্যাকডোনাল্ড নয়, এ-দেশে ফাস্টফুডের কাণ্ডারি এক ভারতীয়ই

ফাস্টফুড বলতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে ম্যাকডোনাল্ড বা কেএফসির ছবি। এমনকি দুই সংস্থার ক্ষেত্রেই বৃহত্তম বাজারের তালিকায় প্রথম পাঁচের মধ্যেই রয়েছে ভারতের নাম। কাজেই কেএফসি বা ম্যাকডোনাল্ডের জনপ্রিয়তা নিয়ে নতুন করে বলার নেই কিছুই। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই দুই সংস্থাই ভারতে তাদের ব্যবসার পশার ছড়িয়েছে নব্বই-এর দশকে। অথচ, এ-দেশের মানুষরা তারও বহু আগে থেকেই পরিচিত ফাস্টফুডের (Fast Food) স্বাদের সঙ্গে। আর তার নেপথ্যে রয়েছেন এক ভারতীয়ই। 

দীপক নিরুলা (Dipak Nirula)। ১৯৭৭ সালের কথা। ভাই ললিতের সঙ্গে যৌথভাবে দিল্লির বুকে আশ্চর্য এক রেস্তোরাঁ খোলেন দীপক। যেখানে অর্ডার দিলেই, চোখের পলকে ক্রেতাদের সামনে এসে হাজির হয় খাবার। অপেক্ষার বালাই নেই কোনো। সবটাই তৈরি হয়ে আছে আগে থেকে। স্বাভাবিকভাবেই দিল্লিতে সে-সময় রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল ‘নিরুলা’স’-খ্যাত এই রেস্তোরা। অবশ্য তখনও ভারতীয়দের শব্দভাণ্ডারে ‘ফাস্টফুড’ কথাটি জায়গা করে নেয়নি। 

তবে দীপক নিরুলাকেই এই ব্যবসার কর্ণধার বলা হলে খানিক ভুল হবে। আসলে রেস্তোরাঁর ব্যবসার সঙ্গে নিরুলা পরিবারের সম্পর্ক বহু প্রাচীন। ১৯৩৪ সালে এই ব্যবসা শুরু করেন লক্ষ্মীচাঁদ ও তাঁর ভাই মদন গোপাল নিরুলা। ‘হোটেল ইন্ডিয়া’-খ্যাত সেই রেস্তোরাঁ কাম পানশালায় প্রাথমিকভাবে মিলত ভারতীয় খাবার। পরবর্তীতে সাহেব ও অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের আকৃষ্ট করতে হাঙ্গেরিয়ান পদ নিয়ে খোলে তাঁদের দ্বিতীয় আউটলেট ‘লা বোহেমা’। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে চাইনিজ খাবারের সঙ্গেও ভারতীয়দের পরিচয় করান নিরুলা ভাতৃদ্বয়। 

এটা যে-সময়ের কথা হচ্ছে তখন দীপক নিরুলা নিতান্তই কিশোর। অবশ্য বাবা-জ্যাঠার তৈরি এই ব্যবসার হাল ধরতে হবে তাঁকে— এ-যেন ছিল তাঁর ভবিতব্য। ১৯৭৪ সালে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্টে স্নাতক ডিগ্রিলাভের পর ভারতে এসে দোকানের হাল ধরেন দীপক। সে-সময়ই তাঁর নজরে পড়ে বিষয়টা। রেস্তোরাঁয় বসে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে করতে খানিকটা বিরক্তই হন অধিকাংশ ক্রেতা। কিন্তু ক্রেতার অর্ডার অনুযায়ী পদ তৈরিতে যে সময় লাগবেই। তবে উপায়?

ফাস্টফুডের মধ্যে দিয়েই এই সমস্যার সমাধান খুঁজেছিলেন দীপক। বিদেশে পড়াশোনা করার ফাস্টফুডের সঙ্গে ভালোই পরিচয় ছিল তাঁর। ব্যবসার পরিধি এবং জনপ্রিয়তা বাড়াতে বিদেশি এই মডেলকেই আপন করেন নেন তিনি। এ-দেশিয় বাজারে সে-সময় তাঁর প্রতিযোগীও ছিল না কোনো। কারণ তখনও পর্যন্ত ভারতের বাজার ক্লোসড ইকোনমি। অর্থাৎ, বিদেশি সংস্থারা শিকড় বিছায়নি এ-দেশের মাটিতে। সে যাই হোক। প্রসঙ্গে ফেরা যাক। গ্রাহকদের কাছে দ্রুত পরিষেবা পৌঁছে দিতেই দিল্লিতে খুলেছিল ‘হোটেল ইন্ডিয়া’-র নতুন আউটলেট। অবশ্য ‘নিরুলাস’ নামে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে এই রেস্তোরাঁর ব্র্যান্ডিং করেন তিনি।

তবে শুধু দ্রুত পরিষেবাই নয়, পিৎজা, বার্গার, লাটে, চকোলেট ফাজ-এর মতো খাবারের সঙ্গেও ভারতীয়দের পরিচয় করিয়েছিলেন তিনি। তাঁর দৌলতেই খুলেছিল ভারতের প্রথম আইসক্রিম পার্লার। বলতে গেলে বাবা-জ্যাঠার তৈরি ব্যবসাকে এক নতুন মোড় দিয়েছিলেন তিনি। বিপ্লব এনেছিলেন ভারতের রেস্তোরাঁ-জগতে। চলতি মাসেরই ৭ তারিখ প্রয়াত হন ভারতীয় ফাস্টফুডের কাণ্ডারি দীপক নিরুলা। ইতি পড়ে ভোজনরসিকতার এক আশ্চর্য অধ্যায়ে!

নব্বই-এর দশকের পর থেকে ভারতীয় বাজারে ক্রমশ মার্কিন ফাস্টফুড সংস্থাদের আধিপত্য বাড়তে থাকায় খানিকটা হলেও বর্তমানে ম্লান হয়েছে ‘নিরুলাস’-এর জৌলুষ। তবে এখনও দিল্লির বুকে বহু মানুষের প্রথম পছন্দ ‘নিরুলাস’-ই…

Powered by Froala Editor

More From Author See More