কুকুর-দানব, ভূতুড়ে বাড়ি, নরকের কবিতা

মুকুজ্জের দপ্তর – ১৩

আগের পর্বে

মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের গল্প ‘হলুদপোড়া’। তাতে জোড়া খুন, প্রেতনীর ভর, রোজা, ঝাড়ফুঁক, বাঁশ শুইয়ে গণ্ডি কেটে রাখা— এসব ভৌতিকতারই উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু তারপরেও এই গল্প ভৌতিক কিনা সন্দেহ থেকে যায়। মনের বিকার এবং কুসংস্কার কীভাবে মানুষকে কোণঠাসা করে তোলে, তারই যেন ‘ময়না-তদন্ত’ করেছেন লেখক। কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘গিন্নি মা’ গল্পে ততধিক ভয়াল পটভূমি। গিন্নি মা’র অকথ্য লোভ, মর্বিড জিঘাংসা যাকে হাড় হিম করা এক গল্প করে তুলেছে। পশ্চিমী হরর গল্পের থেকে যার ভয়াবহতা এতটুকুও কম নয়। মুকুজ্জের দপ্তরের ‘টপ ফাইভ’ মনোনয়নের মধ্যেই থাকল এই গল্প।

সাল ১৮৫৭। ভারতবর্ষে সিপাহী বিদ্রোহ তুঙ্গে (একই সঙ্গে বহাল ইংরেজ-বিদ্বেষ, খুন-জখম ও লুঠতরাজ)... পুলিশ সুপার হিকমত উল্লা অভয় জানান প্রবীণ ক্রিশ্চান, পেশায় বিচারপতি ‘টাকার’ সাহেবকে। সদালাপী ‘দোস্ত’-কে সাহেবের জিজ্ঞাসা ছিল,
তোমার ওপর ভরসা রাখতে পারি তো?
খোদা জামিন (ঈশ্বরের দিব্যি)! –বলেন হিকমত।
দুই বন্ধু অতঃপর হাত মেলান অনেকক্ষণ ধরে।

এই সিনারিও অতিদ্রুতই বদলে যায়। শহরের নাম ফতেপুর। এখানেও শুরু হয় সাহেব-বাড়িতে আগুন লাগানো, লুট, নির্বিচার হত্যা। হিকমত উল্লা-ও সদলবলে দেখা দেন টাকারের কাছারিবাড়িতে; উন্মত্ত জনতা তখন ফুঁসছে ধর্মপ্রাণ সাহেবকে টুকরো টুকরো ক’রে ফেলার অপেক্ষায়।
আর তা কেনই বা নয়? ‘আংরেজ ক্রেস্তান’ বেড়াল কুকুর ছাড়া আবার কী! এদের কাছে শপথের কী মূল্য। 

খুন হওয়ার আগে বন্ধ দরজার ওপার থেকে টাকার তাঁর দোস্ত-কে বলে যান, ‘তুমি ঈশ্বরের দোহাই দিয়েছিলে। ...পরকালে তোমাকেও জবাব দিতে হবে।’ 

গজেন্দ্রকুমার মিত্র

 

আরও পড়ুন
‘হলুদপোড়া’... ভূতের ‘ভর’ নাকি যৌন বিকারের ভয়াল দৃষ্টান্ত?

গজেন্দ্রকুমার মিত্র (১৯০৮-১৯৯৪) আসলে লিখতে চেয়েছিলেন ঐতিহাসিক গল্প। আখ্যানের নাম ‘খোদা জামিন!’ লাভের মধ্যে গল্পটি হয়ে দাঁড়িয়েছে রুদ্ধশ্বাস ভৌতিক-কাহিনি, প্রাকৃতজনের ভাষায় বললে লেখাটি এক-কথায়... ঐ-যাকে-বলে... ‘আলাদাই’!


শপথ রাখেননি, বন্ধু হত্যা করেছেন - তবু  লজ্জিত ছিলেন না, ইংরেজ-বিদ্বেষ তাঁর বিবেককে দমবন্ধ ক’রে ফেলেছিল।  হিকমত উল্লা... সেই তিনি কিছুদিন ধরেই হ্যালুসিনেট করছেন একটা বিচিত্র দৃশ্য। ছেলে বউ কেউই দেখতে পাচ্ছে না; কেবল তিনিই শিউরে উঠছেন ঘনঘন।
...দৃশ্যত ব্যাপারটা তেমন কিছু না। একটা কুকুর আর একটা বেড়াল শুধু। কালো, কুচ্ছিত... আর তাদের চোখে অসম্ভব ঘৃণা!  একটা কুঁইকুঁই বা মিউমিউ - কিছুই না, তারা দেখা দিচ্ছে ঘরের আনাচে কানাচে, চুপ ক’রে বসছে এবং তাকিয়ে থাকছে হিকমতের লাল চোখে সটান চারটে চোখ রেখে। 

আরও পড়ুন
সমাজে প্রেস্টিজ বজায় রাখতে আত্মহত্যা করেছিল সেই ভূত!

তা বলে... এরাই কেন-? জিজ্ঞাসাটি ছিঁড়ে খুঁড়ে দিচ্ছে তাঁকে। টাকারের মৃত্যুর সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক...?  
অয় খোদা! তিনি তো ভুল কিছু করেননি। উচিৎ শাস্তিই হয়েছে ওর। ঈশ্বরের নামে দিব্যি করেছিলেন... বলেছিলেন - খোদা জামিন! তার কীই বা মূল্য একটা ক্রেস্তান কুকুর বেড়ালের কাছে...
কুকুর আর বেড়ালই তো!... এখনও, এই ঠা ঠা দুপুরেও, নিহত টাকারের হাট-খোলা কাছারিবাড়ি অবধি তাঁকে নিশ্চুপে অনুসরণ ক’রে এসেছে।

সিঁড়ির কোণে কী পড়ে আছে ওটা? দুর্গন্ধে নাক চেপে ধরছেন হিকমত...আঃ! শেয়াল কুকুরে দিনের পর দিন খেয়েছে টাকারের বেওয়ারিশ শব, কঙ্কালটা শুধু রয়েছে... তার মুখ হাঁ, যেন বিদ্রূপ করছে অন্ধকার করাল গহ্বর!
নিজের গল্পের প্রতি বেইমানি করেন নি লেখক। সাজিয়েছেন খুনখারাপি ক্লাইম্যাক্স, অবশ্যই তা এখানে ফাঁস করা হচ্ছে না। ...প্রেমেন্দ্র মিত্রের লেখা ‘গল্পের শেষে’ আখ্যানেও দেখেছি ‘কালো বিড়াল’ মোটিফের ব্যবহার... বিড়াল কুকুর দুটি প্রাণীই এখনকার ভৌতিকতা গেঁথে তুলেছে। মৃত টাকারের প্রেত সরাসরি দেখা দেয় নি, মোচড়টি হয়েছে অনন্য। গল্পটির প্রচার অধিক না-হওয়া আমাদের সাহিত্যের একরকম দুর্ভাগ্যই।    

আরও পড়ুন
বৃক্ষের ‘ভূত’ও অমিল হয়নি আমাদের ভৌতিক সাহিত্যে!

বাজি রেখে কিংবা কৌতূহলের বশে ভূতের বাড়িতে রাত কাটাতে যাওয়া এবং অশরীরী দর্শন – বাঙালি গল্পকারদের অতি প্রিয় ছক। ত্রৈলোক্যনাথ মুখোপাধ্যায়ের ‘ভূতের বাড়ি’ গল্পটি মনে করুন, টম সাহেব ও তাঁর কুকুরের মর্মন্তূদ অভিজ্ঞতা হয়েছিল কুখ্যাত হন্টেড হাউজে। সত্যজিৎ রায়ও এই থিম বারম্বার এনেছেন – যেমন ‘অনাথবাবুর ভয়’ ও ‘কনওয়ে কাসলের প্রেতাত্মা’-র মতো গল্পে।
আমরা আজ যে গল্পটি নিয়ে বিস্তৃত হব তার নাম ‘ডাক্তারের সাহস’, লেখক প্রবোধকুমার সান্যাল (১৯০৫-১৯৮৩)।ঘোর নাস্তিক ও বেজায় ডাকাবুকো একজন ডাক্তার যিনি ‘ভূত নেই’ প্রমাণ করবেন ব’লে শুনছেন না আত্মীয়দের বারণ; রাত কাটাতে ঢুকছেন একটি ‘দোষযুক্ত’ বাড়িতে, সঙ্গে বন্দুক ও পোষা কুকুর টমি। 

প্রবোধকুমার সান্যাল

 

আরও পড়ুন
প্ল্যানচেটে সত্যি সত্যি এলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল... লিখছেন আশাপূর্ণা দেবী

গল্প শুরু হয়েছে আর-পাঁচটা কেজো গদ্যের মতোই এবং দেখতে দেখতে কবিতার সাবলাইম ঘনত্ব অর্জন ক’রে নিয়েছে। শহুরে ডাক্তার রাত বাড়লে টের পাচ্ছেন অশরীরীকে, কিছুক্ষণ যুজছেন এবং হাল ছেড়ে দিচ্ছেন কেননা লড়াই একেবারেই অসম। টম সাহেবের গল্প পাঠকের মনে পড়া আশ্চর্যের কিছু নয়। সেই একই লোম-শিউরে-তোলা নাটক, দুঃস্বপ্ন তুল্য বাস্তব, অদৃশ্য অশুভ শক্তির আবির্ভাব, আত্মসমর্পণ ও ভয়াল পরিণতি দিকে অসহায় যাত্রা।
গল্পের একটুখানি অংশ নিচে দেওয়া হল, 

 শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় ‘জলার ভূত’ নামে একটি ভূতের গল্প লিখেছিলেন। জনৈক শখের শিকারী কুকুরকে নিয়ে পাখি মারতে গেছিলেন উপদ্রুত জলায়, যেখানে এক প্রেত তাঁর প্রাণ নাশে উদ্যত হয়। সেখানে আমরা দেখি, প্রভুভক্ত কুকুর বাঘা মালিককে বাঁচাচ্ছে নিজের প্রাণ দিয়ে; প্রিয় পোষ্যকে শিকারী সখেদ কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছেন। ...প্রবোধকুমারের গল্পে   বদলে যাচ্ছে বিষয়টি, প্রভুভক্ত টমি এখানে ‘টমি দানব’, অশরীরী তার মৃত শরীরকে ভর করেছে; চেনা অস্তিত্ব সর্বনাশা ভাবে মুচড়ে যাচ্ছে এবং জেগে উঠছে অচেনা হয়ে! চেতনা, বুদ্ধি অসাড়-ক’রে-দেওয়া সেই প্রত্যাশিত নরক তৈরি হয়ে যাচ্ছে – যার খোঁজ রাখতেন বোদলেয়ারের মতো ডেকাডেন্ট কবি কিংবা সুররিয়ালিস্টদের দল!  
সফল ভৌতিক গল্প হিসেবেই কেবল নয়, সাহিত্য মূল্যের জন্যেও ‘ডাক্তারের সাহস’ আমাদের চেটো-লাল-করা একটানা হাততালি পাবে। 

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
হেমেন রায়ের ড্রাকুলা, পিশাচ-কাহিনি এবং আরও