প্ল্যানচেটে সত্যি সত্যি এলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল... লিখছেন আশাপূর্ণা দেবী

মুকুজ্জের দপ্তর – ৯

আগের পর্বে

পৃথিবীর পপ-কালচারে ড্রাকুলা, ভ্যাম্পায়ারের জনপ্রিয়তা ভাবনাতীত। সত্যজিৎ রায়ের ‘বাদুড় বিভীষিকা’ এমনই এক নমুনা। তবে হেমেন্দ্রকুমার রায়ের সৌজন্যে বাংলা পেয়েছে বহু ড্রাকুলা-সাহিত্যকে। অন্য ভাষা থেকে অনুবাদ নয় বরং নিজস্ব অ্যাডাপটেশন সেগুলি। তাঁর লেখার প্লটে জায়গা পেয়েছে বারবার শ্মশান। দীনেন রায়ের লেখা পিশাচকাহিনিগুলিতেও বিলিতি প্রভাব দেখা যায়। শবদেহে প্রেতের ‘ভর’ রোমহর্ষক করে তোলে পাঠককে। তারপর...

যে বৃত্তান্তের নাম ‘মানুষের মতো মানুষ’ তার অর্ধেক চরিত্র যদি মানুষ না হয় তাহলে বিপদ থাকছেই। ...মানুষ নয়, তবে তারা কী – এই প্রশ্ন আসবে জানি এবং জবাব হচ্ছে – মানুষের পরে ‘যা’- তাই; অলরেডি চন্দ্রবিন্দু বসে গিয়েছে যেখানে। ...ঘটনা তেমনই; আশাপূর্ণা দেবী (১৯০৯–১৯৯৫) – যিনি কলম ধরলেন বলে আমরা কেউ কেউ ‘তাও ভাগ্যিস!’ বাঙালি ঘরে জন্মেছি বলে বেঁচে গেলাম – বৃত্তান্তের মূলে আছেন তিনিই।   

সময় – স্বাধীনতা-উত্তর পয়লা বৈশাখের একটি রাত,  স্থান - হাট ন্যাদোশপুর বলে এক গ্রাম, যার অর্ধেকটা জুড়ে বহাল ঐ-যাদের-নাম-নিতে-নেই তাঁদের মোচ্ছব। কয়েক বছর আগে মড়ক লেগে গাঁ উজাড় হয়ে গেছিল যে খবর  কান পাতলে শোনা যাবে এখনও। ...খুব ছোটবেলায় এখানে মামাবাড়ি বলে ঘুরে গেছেন এবং তারপর আর আসা হয়নি এমনই এক ক্যালকেশিয়ান অধুনা-প্রবীণ অধ্যাপক সেই ‘হাট ন্যাদোশপুর’-এর ফাংশনে সভাপতি হয়ে এসে কীরকম ও কতখানি ঘোল খেলেন, তারই যত্নশীল কমেন্ট্রি হচ্ছে ‘মানুষের মতো মানুষ’। উপন্যাসখানি পড়তে পড়তে  বেধড়ক হাসি পাবে, পেতেই থাকবে... এবং তারপর আস্তে আস্তে ঠিকই শুকোতে থাকবে মুখ, রাতে আলো জ্বালিয়ে শোওয়াই মনে হতে থাকবে সবচেয়ে ভালো ব’লে। পরীক্ষা প্রার্থনীয়।  

গেরস্থ ঘরের খুঁটিনাটি বর্ণনায় আশাপূর্ণা দেবীর সিদ্ধি পাঠকেরা দস্তুর মতো জানেন এবং মানেন; ‘ওনারা থাকবেনই’ উপন্যাসেও অতি অন্তরঙ্গ সব সাংসারিক ডিটেল দেওয়া হয়েছে। তফাৎ খালি এখানে ‘জীয়ন্ত’দের বদলে সংসারটি ‘ওনা’দের। ঘোরানন্দ ও তার পিসিমা, অতিথি দুই ব্রহ্মদৈত্য, চ্যাংড়া ভূত-সমাজ - এদের আসর আরো চাঙ্গা হয় পিসিমার সার্ভ করা স্পেশাল ‘মানবিক’ চায়ের মৌতাতে (বলে রাখা উচিৎ চায়ের কেটলিটি রেল-স্টেশনের গুমটি দোকান থেকে অদৃশ্য ও তুলনায়-কিছু-দীর্ঘতর হাত বাড়িয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল)। 

ভূতেদের আবাসন-সংকট নিয়ে চমৎকার কাজ দেখা গেছে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’-এ, যাকে হালফিলের বাংলা ছবির মধ্যে ব্যতিক্রম বলেই ধরতে হবে। ‘ওনারা থাকবেনই’ লেখাতেও দেখছি বাসা খুঁজতে গিয়ে হয়রান ভূতেরা, অধিকাংশ জঙ্গল কাটা যেতে এবং পোড়োবাড়ি হরদম ভাঙা পড়ায় তাদের ক্রাইসিস থাকবার ঠাঁই... লেখিকার ক্যারিশমায় যা অবিস্মরণীয় হয়ে আছে। টেনশনের চূড়োয় পৌঁছয় আখ্যান, যখন কলকাতা থেকে প্লেয়ার এনে এ-গ্রামের ছোকরাদের ফাঁপরে ফেলে দিয়েছে পাশের গ্রাম... প্রেস্টিজ রাখতে তাদেরই হয়ে ‘অশৈলী’ ফুটবল খেলে ভূতেরা জিতিয়ে দেয় হারা ম্যাচ। এখানে বলে রাখি, শক্তিপদ রাজগুরু-র ‘পটলা এন্ড কোং’ সিরিজের একটি গল্পেও মানুষী ম্যাচে ভূতেদের ফুটবল খেলার এমনই এক কেচ্ছা বিবৃত আছে।

আরও পড়ুন
হেমেন রায়ের ড্রাকুলা, পিশাচ-কাহিনি এবং আরও

বরাবরের এক্সপার্ট-আড্ডাবাজ ‘নান্টুপিসে’ বেপাত্তা ছিলেন বেশ কিছু বছর, সহসা একদিন তাঁর প্রফুল্ল আবির্ভাব ঘটে কলকাতার একটি একান্নবর্তী পরিবারে (উপন্যাসের নাম ‘চারা পুঁতে গেলেন নান্টুপিসে’) । তামাশায় গল্পে টিটকিরিতে বেদম ভরে ওঠে দিনগুলি। বাড়ির খুদেরা বায়না জুড়ে দেয় – নান্টুপিসে এবারে যে প্ল্যানচেট শিখে এসেছেন সেটি একবার ক’রে দেখাতে হবে। পিসে এককথায় রাজি, ‘কাকে ডাকতে চাও বলো’ দরাজ প্রস্তাব শুনে উল্লাস ওঠে, ‘রবীন্দ্রনাথ’ - ‘রবীন্দ্রনাথ’! সেই মূল্যবান সংলাপ একটু শোনা যাক,

- গুরুদেব, আপনি এসেছেন?
- না এসে পারি! ডাকাডাকি করলে তো আমি...
- ক্ষমা করবেন গুরুদেব। এই বালকেরা ধরেছে আপনার কণ্ঠ শুনবে বলে...
- বালকেরা? তবে তো হুকুম মানতেই হবে। কী শুনতে চাও বলো! 

আরও পড়ুন
বাংলা গল্পে আতঙ্কের উৎস যখন ‘উইচক্রাফট’ ও ‘কালো বিড়াল’

বালকেরা তখন আত্মহারা। এই তো সেই স্বর, তারা যা শোনে পঁচিশে বৈশাখের দিন রেডিওতে... ‘তবু মনে রেখো’ কিংবা ‘শুকনো পাতা ঝরার বেলায়’... তাদের বাক্য স্ফূর্ত না হতেই আরো শোনা যায় সেই ঐতিহাসিক গলা,
- বালকদের বোলো তারা যদি সত্যিই আমায় একটু ভক্তি-শ্রদ্ধার চোখে দেখে তাহলে রবীন্দ্র সঙ্গীত যেন শিখতে না বসে। আর অত্যাচার সহ্য হচ্ছে না।
স্বর থেমে যায়।

বালকদের আরো দাবিতে এবার ডাকা হয় নজরুলকে। তিনি (কিংবা সেই স্বর) এসে জানাচ্ছেন ‘বাংলাদেশ-মাত-করা’ গানের কদর কমে-যাওয়ার-আফশোস; নান্টুপিসের সঙ্গে তাঁর সংলাপ –

আরও পড়ুন
অশুভ ‘বস্তু’, অভিশাপ ও তন্ত্র বারেবারেই এসেছিল বিভূতিভূষণের গল্পে

-     কবি, আপনি এখন কথা বলতে পারেন!
-     না পারলে বলছি কী ক’রে? এইসব উজবুকরাই আজকাল আমার ভক্ত নাকি? ধেৎ!

পিসে অকুতোভয়। এবার ডাকা হয় দেশবন্ধু সি আর দাশকে। তিনি এসে তরুণ সমাজের চরিত্র গঠন নিয়ে এইসা লেকচার দিতে থাকেন, বালকেরা হাঁফ ছাড়তে পারলে বাঁচে। এরপর তারা পিসেকে ধরছে, ‘মহাপুরুষদের থাক পিসেমশাই, আপনি আমাদের ‘এমনি’ লোকেদের ডাকতে শেখান!’
কিছুদিন গেলে আবিষ্কৃত হবে যে নান্টুপিসে... হ্যাঁ, তিনি, আর কিছু নন স্বয়ং একজন ‘প্রেত’, যার সঙ্গে পুরো পরিবারটি এ ক’দিন হৈ-হল্লা ক’রে সময় কাটিয়েছে, এক সঙ্গে খেয়েছে, ঘুমিয়েছে। ফের বেপাত্তা হলে কী হবে, এবারের মতো এসে যে ‘চারা’টি তিনি পুঁতে দিয়ে গেলেন তা ক্রমেই বেড়ে উঃঠছে ও ছমছমে ডালপালা গজাতে থাকছে। ও-দিককার মেম্বাররা (প্রপিতামহ, প্রপিতামহী... বহুদিন হল যাঁরা...) ঘনঘনই উঁকি দেবেন এবং না ডাকলেও সেই উঁকিঝুঁকিতে কোনও কমতি হবে না... বাড়িটি বিশেষ তীর্থ হয়ে দাঁড়াবে বললেও বাড়িয়ে বলা হয় না অতএব। 

আরও পড়ুন
বাংলার ভূতের গল্পে ননসেন্স ছড়াও জাঁকিয়ে বসেছিল দিব্যি

এভাবেই, অতঃপর চলতেই থাকে জাদুকাঠি, গল্পের পর গল্প... বলে শেষ করা যাবে না যেহেতু সত্যিই এর শেষ নেই। ‘পুনর্জন্মের দাম’ লেখাটি ভাবুন, যেখানে দেবদূত ও যমদূতকে ‘বাটা কোম্পানি’র জুতো প্রেজেন্ট করার লোভ দেখিয়ে ছেড়ে-রাখা শরীরটা ফের বাগিয়ে নেন বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ; নিয়মভঙ্গ হয়ে গেলে যখন ছেলে ন্যাড়ামাথায় খেতে বসেছে, শ্বশুরকে ঘরে ঢুকতে দেখে আতঙ্কিত বধূ ছিটকে ফেলে মাছের বাটি... ‘আহা বউমা, এত ভালো মুড়োটা নষ্ট করলে!’ – ব’লে চুকচুক আক্ষেপ; কিংবা... ‘স্বপ্নের রেলগাড়ি’ গল্পের বাতিকগ্রস্ত নায়ক কীভাবে যেন হয়ে ওঠেন নিজেরই অপচ্ছায়া ও অন্যদের কাছে মূর্তিমান অসোয়াস্তি, ‘লোকটার ছায়া পড়ছে না?... তবে কি...’ ফিসফিস গুজগুজের মাঝেই যিনি নির্বিকার ভাবে ‘গোড়ালি ঘুরিয়ে হাঁটা’-টা প্র্যাকটিস ক’রে যেতে থাকেন; বা ধরুন ‘চার বুড়োর আড্ডা’ গল্পে  আড্ডাধারী ‘বুনো’ জলে ডুবে পঞ্চত্ব পেলেও  মায়া কাটাতে পারে না তাই আড্ডাখানায় হাজির হয়ে খিকখিক হেসে বলে, ‘ভাবিস না, আড্ডা ভাঙবে না। আসবো রোজ!’ ...  ‘নিজে বুঝে নিন’ গল্পেও বহাল থাকে দুর্ধর্ষ হিউমার... শ্রীশ্রীরামচন্দ্রকে নিয়ে যখন জাতীয় অ্যালার্জি কবুল করছে নিশিরাতের আগন্তুক - সেই অমর পাঞ্চলাইনটি মনে করিয়ে দিয়ে যাই – ‘কাকে ডাকার কথা বলছ?’ ‘আজ্ঞে ও নামটা ঠিক মুখে আসে না কত্তা। নিজে বুঝে নিন!’ ...অর্ধশতক পেরিয়ে হেঁশেলের পঞ্চব্যঞ্জন রান্নার মতোই লা-জবাব হয়ে থাকে আশাপূর্ণা-র ভৌতিক আখ্যান।

Powered by Froala Editor