সমাজে প্রেস্টিজ বজায় রাখতে আত্মহত্যা করেছিল সেই ভূত!

মুকুজ্জের দপ্তর – ১১

আগের পর্বে

ভৌতিক গল্পের একটা অংশ হয়ে গেছে গাছও। গাছের সঙ্গে যেমন মানুষের মৃত্যুর কোনো যোগ থেকেই সে অংশ হয়ে উঠেছে ভৌতিকতার। তেমনই মৃত গাছকেও ‘অপচ্ছায়া’ হিসাবে দেখিয়েছেন প্রমথনাথ বিশী। গাছকে ভৌতিক বস্তু হিসাবে উপস্থাপন করেছেন ইমদাদুল হক মিলন-ও। আবার বাংলার বিগত শতকের মড়ক ও মন্বন্তরকে ভয়াবহতায় মিশিয়ে তাতে রোমহর্ষক করে তুলেছেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। যেখানে গল্পের নায়ক আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিল এই ঘটনাকে।

মুকুজ্জের দপ্তরে দুই দাদাকে আজ পেয়েছি, আহ্লাদের অবধি আমাদের দেখে কে!
প্রথমজন গড়ের মাঠে গোরা সার্জেন্ট ঠেঙিয়ে চ্যাম্পিয়ন ও অদ্বিতীয় স্কুল-ফাইনালী। দ্বিতীয়জন ব্রেজিল-ফেরত ফুটবলার – মায় বিলেত-ঘুরে-আসা যাঁকে মেমসায়েবরা কত সাধাসাধি করেছেন ‘ম্যারি মী!’ আকুতি জানিয়ে।

পাঠকেরা - যাঁরা এতেও দুজনকে চিনলেন না (আছেন কেউ?) তাঁদের আর কী বলি। গদ্য লিখবার পেটেন্ট জ্বালা,  আবছা না রেখে সমস্তটাই এখানে খোলসা ক’রে বলার নিয়ম।  ...দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ও নাক টেনে অতঃপর জানাই, এই ‘দাদা’রা হচ্ছেন ভজহরি মুখোপাধ্যায় ও প্রদীপ নারায়ণ দত্ত (টেনি ও পিনডি নামেই অধিক প্রসিদ্ধ); শুধু গণ্ডার-মেরে ভাণ্ডার-লুটের কিস্যা ছাড়াও এনাদের মুখে মুখে তুলনাতীত দু’টি কাহিনি শোনা গেছিল – আদ্যোপান্ত যেগুলি নাম-নিতে-নেই ঐ-যাকে-বলে...‘ভূতের’।

নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় (১৯১৮-১৯৭০)

টেনিদা উবাচে কাহিনির নাম ছিল ‘দশাননচরিত’। আ-মরি বাংলা ভাষার যিনি আরেক মহান দাদা, বাহাত্তর নম্বর বনমালী নস্কর লেনের সেই ঘনশ্যাম দাস, তাঁরই পদাঙ্ক মেনে পটলডাঙা-র টেনি মুকুজ্জেও কয়েকটি গুল-গপ্পো ছেড়েছিলেন, ‘দশাননচরিত’-ও তাই।  স্থান - চাটুজ্জেদের রোয়াক, শ্রোতা – প্যালারাম বাঁড়ুজ্জে। ...গপ্পের নায়ক দশানন – যিনি মহাপুরুষ ব’লে প্রাতঃস্মরণীয় হবেন এবং যাঁর নামের মানে হচ্ছে রাবণ (তুলসীদাস কৃত ‘রামচরিতমানস’-এর প্যারোডি খেয়াল করুন!) ...সেই তিনি পূর্বাশ্রমে ছিলেন – না, না, ততটাও খারাপ কিছু নয়; তবে, ঐ, হ্যাঁ – কলকাতা শহরের একজন পকেটমার। 

এই গল্প - পকেটমার কী করিয়া মহাপুরুষ হইলেন – তারই বৃত্তান্ত।  
সোঁদরবনে ব্রিটিশ পুলিশ নির্বাসন দিয়ে গেলে বেচারা দশানন আর কী করবে, রাত কাটাতে উঠবি-তো-ওঠ, উঠেছে এক ভূতুড়ে কেল্লাতেই। সুবে-বাংলার একদা মনসবদার ও সিরাজদৌল্লার অতি ঘনিষ্ট (এবং নবাবি ধনরত্নের রক্ষকও বটে) জবরদস্ত খাঁ – আজও সেই কেল্লার মালিক।
গল্পে-যা-হয় তাই, সেই রাতেই ‘তেনা’র সাক্ষাৎ পাচ্ছে দশানন এবং ‘তিনি’ জোব্বার পকেট থেকে এক থাবা মণিমুক্তো বের ক’রে তাকে দেখিয়ে আবার জোছনার আলোয় ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছেন। 

আরও পড়ুন
বৃক্ষের ‘ভূত’ও অমিল হয়নি আমাদের ভৌতিক সাহিত্যে!

আর দশানন? পরদিনই দৈব ক্রমে এক জেলেডিঙিতে আশ্রয় পেয়ে সোজা দেশে ফিরে গেল, তারপর দানধ্যান করতে লাগল, পুকুর কাটল, অতিথিশালা বানাল, মহাপুরুষ হয়ে গেল...

আরও পড়ুন
প্ল্যানচেটে সত্যি সত্যি এলেন রবীন্দ্রনাথ, নজরুল... লিখছেন আশাপূর্ণা দেবী

অ্যাঁ! বলে কী? ...প্যালারামকেই কেবল দোষ দিই কেন। শুনে বাকিরাও আঁতকে উঠবেন এবং মোক্ষম প্রশ্নটি ছাড়বেন – ‘পয়সা পেলে কোথায়?’
‘আরে গাধা!’ টেনিদা দাঁত কিড়মিড়িয়ে তখন বলবেন, ‘পকেট থেকে একখাবলা মণিমুক্তো তুলে নিয়ে ছিল যে! ...ঐ থেকেই ওর চরিত্র শুধরে গেল।’
ভূতের পকেট মেরে; হ্যাঁ। ...কলকাতা শহরে জনশ্রুতি ছিল যে সেরা পকেটমার হিসেবে দশানন মেডেল পেতে পারে, যে-জন্য আর দেরি না ক’রে ব্রিটিশরা তাকে ব্যাঘ্রসঙ্কুল বনে ছেড়ে এসেছিল এবং আশ্বাস জানিয়েছিল, ‘যাও, বাঘের পকেট মারিটে চেষ্টা করো। যদি পারো তবে টোমায় ইনাম ডিবো!’

আরও পড়ুন
হেমেন রায়ের ড্রাকুলা, পিশাচ-কাহিনি এবং আরও

বাঘের না হোক, ভূতের পকেট মারার আইডিয়া বাঙালির ব্রেন ছাড়া কোত্থেকেই বা বেরোবে?

আরও পড়ুন
বাংলা গল্পে আতঙ্কের উৎস যখন ‘উইচক্রাফট’ ও ‘কালো বিড়াল’

আশুতোষ মুখোপাধ্যায় (১৯২০–১৯৮৯)

 

আরও পড়ুন
অশুভ ‘বস্তু’, অভিশাপ ও তন্ত্র বারেবারেই এসেছিল বিভূতিভূষণের গল্পে

এবং পিনডিদাও ছেড়ে কথা কইবেন না টেনিকে। তাঁর গল্প কৌতুক আর ভয় দুটোকেই গতরজব্দ করেছে। ‘পিনডিদার মানবিক ভূত’ নামক আখ্যানে প্রদীপ নারায়ণ দত্ত তাই স্যাঙাৎদের কাছে...‘আহা, ভূত বলে কি মানুষ নয়’ এবং ‘জানিস, ভূত কত ডিগনিফায়েড হতে পারে?’ তারই একটি মর্মন্তুদ দৃষ্টান্ত পেশ করছেন। 


আরও পড়ুন
বাংলার ভূতের গল্পে ননসেন্স ছড়াও জাঁকিয়ে বসেছিল দিব্যি

বিদেশ বিভূঁই বলে কথা। তার ওপর থাকতে হচ্ছে একটি কুখ্যাত হন্টেড কাসল-এ। প্রতিবেশিনী মেম, ভাইঝি জুলি আর পিনডি রাত কাটাতে গিয়ে ভয়ানক সব উপদ্রব দেখেন এবং ভিরমি না খেয়ে বুদ্ধি খাটিয়ে মোকাবিলা করে যান। তারই একটি অংশে আমরা দেখছি কনকনে ঠাণ্ডা জলে চান করিয়ে দেওয়া হচ্ছে উপদ্রবকারী ভূতকে। তারপর সব এক্কেবারে চুপ।  

আরও পড়ুন
‘স্কল’, ‘স্কেলিটন’ কিংবা মজলিশি ভূতেরা – ত্রৈলোক্যনাথ থেকে উপেন্দ্রকিশোর

পরদিন ভোরবেলা। ...পিনডিদা বাগানে এসে দেখতে পান এক ছায়াময় সাহেব বেজায় হাঁচছে। বোঝা যায় – ইনিই সেই ‘ভূত’। মানুষকে ভয় দেখাতে এসে অ্যায়সা নাকাল হয়েছে মাইকেল (ভূতের নাম), অশরীরী সমাজে আর মুখ দেখানোর জো নেই। তাই, পিনডি-কে সাক্ষী রেখেই সে... আজ্ঞে, আত্মহত্যা করতে মনস্থ করেছে। 

আরও পড়ুন
দীনেন রায়, রবীন্দ্রনাথ থেকে প্রভাত মুকুজ্জের হাড়কাঁপানো অশরীরী

ঠিকই পড়ছেন, ভূতেই আত্মহত্যা করছে। ভূত মরে কী হয় এরকম বোকা বোকা প্রশ্ন যেন করবেন না (কী আর হবে, ‘মানুষ’ হয়!) - বুকে ক্রুশচিহ্ন এঁকে লাফিয়ে পড়লেই ভূতের লীলাখেলা শেষ।

আরও পড়ুন
পাঁচকড়ি দে-র ‘সাইকো’ – অলৌকিক নাকি অবাস্তবে-থাকা মনের পাগলামির গল্প?

যা মানুষে পারতে পারে, ভূতে কেন পারবে না? সুতরাং মাইকেলের ভূত (সর্দিতে যিনি এতক্ষণ নাক টানছিলেন) কাঙ্ক্ষিত লাফটি দেন এবং কাসল-এর ভূতুড়ে বদনামও সেই থেকে ঘুচে যায়। ভূতের প্রেস্টিজ রক্ষার তাজ্জব ঘটনার সাক্ষী থাকেন পিনডি, যে-কেচ্ছাটি পাড়ার চ্যাংড়াদের কাছে তিনি ইতোমধ্যে বিশদ করেছেন। 

আরও পড়ুন
বাংলা-র সবচেয়ে পুরোনো ভূতের গল্পটি কি আছে রূপকথার বইতেই?

চাইলে এমনকি ভূতের গল্পকে কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়, তারই নজিরবিহীন সাক্ষ্য যাঁরা রেখেছেন; টেনি ও পিনডির বকলমে আসল যে দাদা-রা, সেই নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় এবং আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে ‘মুকুজ্জের দপ্তর’ আজকের মতো দণ্ডবৎ জানাচ্ছে।   

Powered by Froala Editor