পুলিশের ‘বিশ্বাসঘাতকতায়’ গুলিবিদ্ধ রূপা সিং, আনন্দে লাফিয়ে উঠলেন কুইন

দুর্ধর্ষ দুশমন – ৫

আগের পর্বে

মানসিং-এর জীবদ্দশাতেই রূপা এসেছিলেন কলকাতায়। খালাস করেছিলেন এক ডজনের মত লোককে। সেই কথাই বলছিল নরেশ। পরবর্তীকালে দল ভাগ হয়ে যাওয়ার পর রূপা এবং লাখনের দুই দলের দৌরাত্ম্যে দিশেহারা হয়ে যায় পুলিশ। এসএএফ পুলিশের আধিকারিক টি ক্যুইন একের পর এক চেষ্টা করেও নিকেশ করতে পারেননি লাখন সিংকে। শেষমেশ রূপা মহারাজের সঙ্গেই চালেন নতুন চাল। রূপাই খবর দিত লাখনের। ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর ক্যুইন খবর পান লাখনের গ্যাং আমদ এলাকায় ডাকাতি করতে যাবে। অন্যদিকে রূপা যাবে লাখনের গ্রাম নাগরায়। খবর পেয়েই ক্যুইন ৯ ব্যাটেলিয়ন পুলিশ দিয়ে ঘিরে ফেলে সমগ্র অঞ্চল।

৯ ব্যাটালিয়ন পুলিশকে নিমেষে ভাগ করে ফেললেন কুইন। দু’ পল্টন নাগরা গ্রামের দিকে, দু’ পল্টন মহুয়ার দিকে, দু’ পল্টন পুলিশ কালি ওরলির দিকে আর এক এক পল্টন উদ্যোতগড় আর পরোসায় পাঠানো হয়। কুইন নিজে ছয় ব্যাটালিয়নের সঙ্গে মার্চ করেন। আর বেহড় থেকে চম্বলের মধ্যেকার জায়গা ঘেরাবন্দি করে ফেলা হয়। পুলিশ কিছুটা এগোতেই গ্যাং-এর পাহারাদার যাকে আউটপোস্ট বলা হয়, চেঁচাতে শুরু করে দেয় যে ‘ভাগো, পুলিশকে কুত্তে আয়া হ্যায়।’ শুরু হয়ে যায় ফায়ারিং। পুলিশ গুলির আওয়াজকে নিশানা করে ২৮টি গ্রুপ তৈরি করে একের পর এক বেশকিছু ঘেরা বানিয়ে ফেলে। 

গ্যাং তিনদিক থেকে পালিয়ে তিন মাইল পার করে রাজস্থানে পালিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু সবদিক থেকেই পুলিশের ভারী ফায়ারিং হচ্ছিল আর রূপার গ্যাং-এর বাঁচার কোনো রাস্তাই ছিল না। চম্বলের দিকে পালাতে গিয়ে রূপার গ্যাং চম্বলের হাফ কিলোমিটার আগেই অন্য একটি পুলিশ পার্টির মুখোমুখি হয়। পুলিশের জমাদার বালম সিং নিজের রেঞ্জে দেখতে পাওয়া তিনজনের উপর হঠাৎ নিজের টমিগান থেকে গুলিবৃষ্টি করেন। গুলি চলার সঙ্গে সঙ্গেই আর্ত চিৎকার হাওয়ায় প্রতিধ্বনিত হয় আর তারপর সব চুপচাপ হয়ে যায়। রাত হয়ে গিয়েছিল, অন্ধকারের কারণে অপারেশন থামিয়ে দেওয়া হয়। সকালে যখন সন্ধান করা শুরু হয় তো কিছু দূরের জঙ্গলে একটি লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু যখনই তার মুখ দেখা হয়তো টি কুইন নিরাশ হয়ে যান। কারণ লাশটি রূপার নয় বরং তার গ্যাং-এর রাজারামের। কুইনের মন ভেঙে যায়। এত পরিশ্রম, এত পরিকল্পনা তার দীর্ঘদিনের অধ্যাবসায় সবই যেন ভাগ্যলক্ষ্মীর নির্মম পরিহাসে ব্যর্থ মনে হয়। হতাশ কুইন পুলিশ পার্টিকে নিয়ে ফিরেই আসছিল ঠিক তখনই আরও খানিকটা রক্তের দাগ দেখতে পায় তারা। সেই রক্তের দাগ ধরে আরও খানিকটা দূরে গুলিতে ছিন্নভিন্ন আরও একটি লাশ পায় পুলিশ। আর সেই লাশের শনাক্তকরণের পর খুশিতে নাচতে শুরু করে দেন কুইন। কারণ লাশটি আর কারও নয়, মান সিং-এর পর চম্বলের সবচেয়ে বড়ো বাগী রূপার লাশ ছিল।

চম্বলের বেহড়ে গাড়িঘোড়া চলত না, এভাবেই চম্বলের শাখা নদীগুলি পেরিয়ে বাগীদের খোঁজ করত পুলিশ

 

গল্প চলতে চলতেই মহাবীরের নাতি আসে, মিষ্টির প্লেট নিয়ে। গল্প মাঝ পথে থামিয়ে হাত ধুতে উঠি। হাত ধুয়ে ফের মানসিং-এর মন্দিরের চাতালে বসি। খাওয়ারের দিকে মন নেই আমার। কারণ আমার মন জুড়ে তখন শুধুই রূপা। ‘অভিশপ্ত চম্বল’ আর ‘বেহড়বাগীবন্দুক’ এর সেই বিখ্যাত রূপা তখন আমার মন জুড়ে। ভাবতে থাকি, চম্বলের এই বাগী জীবনের সঙ্গে দূর দূর পর্যন্ত কোনো সম্পর্ক না থাকা রূপা কীভাবে জড়িয়ে পড়লেন চম্বলের বাগী জীবনে। নরেশের বাড়িতে আসার আগেই মহাবীর আমাকে নিয়ে গিয়েছলেন পূরণ সিং-এর বাড়িতে। মানসিং-এর চতুর্থ ছেলে সোনবরণ সিং-এর সন্তান পূরণ সিং। বর্তমানে মানসিং-এর উত্তরাধিকারীদের তুলনায় কিছুটা পড়াশুনা জানেন পূরণ। তার মুখেই শুনেছিলাম মানসিংকে মেরে ফেলার পর সরকার মানসিং-এর গড়হি আর প্রায় আটশো বিঘা জমি সিজ করে নিয়েছিল। তেহেসিলদার সিং তখনও জেলে। সোনবরণ, আর রূপা মিলে চালাচ্ছেন দল। সোনবরণ আর সুবেদার মারা যাওয়ার পর অনেক চেষ্টা করে সেই জমি তারা ফেরত পান ১৯৫৯ সালে। সরকারই ভাগ-বাটোয়ারা করে দেয় মানসিং-এর নাতি-নাতনিদের মধ্যে। প্রত্যেকের ভাগে প্রায় দুশো বিঘা জমি। তাদের ভাইদের কেউ বনবিভাগে কাজ করে, কেউ বা বিএসএফে ছিলেন। মানসিং-এর আরেক নাতি জিএম সিং বিএসএফের ডিআইজি হিসেবে অবসর নিয়ে এখন উত্তরপ্রদেশে থাকেন। সোনবরণ সিং যখন মারা যান তখন পূরণ সিং-এর বয়েস ছয় বছর। তিনি মানুষ তার ঠাকুমা মানসিং-এর স্ত্রী রুক্মিণীদেবীর কাছেই।

আরও পড়ুন
চম্বলের দুর্ধর্ষ লাখন সিং-এর চরিত্রে সুশান্ত, মনোজ বাজপেয়ী ছিলেন মানসিং-এর ভূমিকায়

পূরণ সিং, নিজের ঠাকুরদার ছবি হাতে নিয়ে নিজের বাড়িতে

 

পূরণকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম মানসিং-এর প্রিয় শাগরেদ রূপনারায়ণ ওরফে রূপা মহারাজের কথা। পূরণ বলেছিলেন, রূপা তো কবেই মারা গেছে। পাশের গ্রাম মহুয়াতে থাকে তার পরিবার। কিন্তু কারা আছেন সেই পরিবারে তিনি জানেন না। চমকে উঠলাম, স্বয়ং মানসিং যাকে তার বড়োছেলে যশবন্তের জায়গা দিয়েছেন তার পরিবারের সম্বন্ধে কোনো খোঁজই রাখেন না মানসিং-এর উত্তরাধিকারীরা? এটা হতেই পারে না। বুঝলাম কোনো ব্যাপার আছে। সে ব্যাপার বুঝেছিলাম পূরণের বাড়িতে থেকে বেরিয়ে মহাবীরের কথায়। পূরণ সিং-এর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতেই মহাবীর চুপি চুপি আমাকে জানিয়েছিলেন, “রূপার এক বংশধর এখন একটা ডাকাতির দল চালায়। তাই তারা একটু দূরত্ব বজায় রাখেন। ওই পরিবারের ব্যাপারে কাউকে কিছু জানান না। এমনিতে শাদি-বিয়েতে পরিবারের মধ্যে যাতায়াত রয়েছে। অতএব বুঝলাম শুধু মানসিং-এর পরিবার কেন, গ্রামের কাউকে জিজ্ঞাসা করলেও ওই পরিবারের কিছু জানতে পারব না।” 

আরও পড়ুন
কলকাতায় হাজির চম্বলের মাধো সিং, আত্মসমর্পণে সাহায্য চাইলেন জ্যোতি বসুর কাছে

সেদিন রাতেই আমার দেখা হয়েছিল রূপার সেই বংশধরের সঙ্গে। সে রাতেই যখন আমি মহাবীরের বাড়ির উঠোনে ঘুমোচ্ছিলাম। এই ধারাবাহিকের প্রথম কিস্তিতে সেই যে রাতের অতিথির কথা বলেছিলাম, যে আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে যেতে যেতে বলেছিল ‘নয়া পঞ্ছি মালুম হোতা হ্যায়’। আমার মনে এক অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। বুঝতে দিই না নরেশ আর মহাবীরকে। সেই রূপা, চম্বলের উসুলওয়ালা বাগীদের প্রতিনিধি, রবিনহুড মানসিং-এর প্রিয় শিষ্য যে নিজেও অত্যাচারের প্রতিবাদে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বেহড়ে। যে নিজেই ছিল রবিনহুডের মতো, তারই বংশধর এখন শুধুমাত্র পেশার তাগিদে ডাকাতি করছে, শুধু তাই নয় নিজের উসুলওয়ালা পূর্বপুরুষ রূপা মহারাজের সমস্ত উসুল ভেঙে চলেছে। কেন? বারবার এই কেন আমাকে খেয়ে চলেছে ভেতরে ভেতরে।

এভাবেই বাগীদের বিরুদ্ধে কমব্যাট করত সেই সময় পুলিশ

 

আরও পড়ুন
‘নয়া পঞ্ছি মালুম হোতা হ্যায়’ - শ্যেনদৃষ্টিতে তাকিয়ে রূপা ডাকাতের নাতি

হঠাৎ নরেশের কথা আমার চিন্তার জাল ছিঁড়ে আমাকে বাস্তবে নিয়ে আসে। নরেশ বলতে থাকেন চম্বলের জনজীবনে ঘুরে ফিরে বেড়ানো গল্পকাহিনি আর লোকগাঁথায় রূপার মৃত্যুর এই ঘটনা খানিকটা অন্যভাবে বলা হয়ে থাকে। নরেশ জানান সেই লোকগাঁথা অনুযায়ী টি কুইন লাখন সিংকে মারতে ব্যর্থ হওয়ায় রূপাকেই শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। অন্যদিকে রূপার কুইনের উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস ছিল। ফলে টি কুইন ডেকে পাঠানোয় রূপা গ্যাংকে পেছনে ফেলে স্রেফ রাজারামকে সঙ্গে নিয়েই মহুয়া গ্রামে আসে আর সেখানেই চালাকি করে কুইন তার এনকাউন্টার করেন। এই কথা শুনে অজান্তেই আমার ঠোঁটে হাসি খেলে যায়। কারণ চম্বলে প্রতিটি বাগীর মৃত্যুর পেছনে পুলিশের এমন শঠতার কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে। যেখানে এক গ্যাং-এর সঙ্গে অন্য গ্যাং-এর লড়াইতে বাগীর মৃত্যু হওয়ায় সেই মৃত্যুকে পুলিশ নিজেদের কৃতিত্ব বলেই চালিয়েছে বারবার। এই সব বাগীদের ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর হয়ে ওঠার পেছনে পুলিশের হাত কোনো অংশে কম ছিল না। আইনের কাছে সাহায্য চেয়ে না পেয়েই বহু ডাকাত নিজের এবং পরিবারের প্রতি অন্যায় হওয়ার প্রতিবাদ করতে, ন্যায় পেতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চম্বলে। মাধো সিং, পান সিং তোমর, ফুলন দেবী - কে নেই সেই তালিকায়! রূপার মৃত্যুর গল্প যাই হোক, চম্বলের আরও এক আতঙ্ক পুলিশের গুলির নিশানা হয়েছিলেন। এই এনকাউন্টারের সূচনা পেতেই কেএফ রুস্তমজি নিজের টেবিলে থাকা চার্ট থেকে জি-১ গ্যাং-এর নাম কেটে দিয়েছিলেন। আর চম্বলের আতঙ্ক হয়ে ওঠা আরও এক ভয়ঙ্কর বাগী মাটি থেকে উঠে গল্প কাহিনির নদীতে মিশে গিয়েছিলেন।

এখনও এভাবেই পুজিত হন চম্বলের রবিনহুড মানসিং

 

আরও পড়ুন
‘খুন কা বদলা স্রেফ খুন’; মানসিং-হত্যার পর, শপথ নিলেন চম্বলের নয়া ডাকাত সর্দার

গল্প শুনতে শুনতেই নরেশের ছেলে মন্দিরের ভেতরের দরজা খুলে দেয়। চোখে পড়ে একটা বড়ো শ্বেতপাথরের সিংহাসনে মানসিং এবং রুক্মিণীদেবীর শ্বেতপাথরের মূর্তি। আর একদিকে রয়েছে মানসিং-এর সঙ্গে আজীবন ডাকাত দলের সদস্য থাকা তার ছেলে তেহেসিলদার সিং এবং তাঁর স্ত্রীর ল্যামিনেট করা ছবি। অন্যদিকে রয়েছে মানসিং-এর সঙ্গে এনকাউন্টারের মৃত্যু হওয়া সোনবরণ সিং এবং তার স্ত্রীর ল্যামিনেট করার ছবি। নরেশকে প্রশ্ন করি, দাদুকে দেখেছ? মাথা নাড়েন নরেশ। বললেন দাদুর কথা আবছা মনে রয়েছে, কারণ, তার খুব ছেলেবেলাতেই এনকাউন্টারে মারা গিয়েছিলেন মানসিং। তবে তিনি তার আম্মার (মানসিং-এর স্ত্রী) কথা বললেন। বললেন তাদের ভাইয়েরা সবাই এই আম্মার কাছেই মানুষ। দাদু এবং বাবা মারা যাওয়ার পরই রুক্মিণীদেবীই হয়ে উঠেছিলেন পরিবারের মুখিয়া। যতদূর সম্ভব সকলকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কাজে লাগিয়েছেন। পুলিশের কাছ থেকে উদ্ধার করেছেন নিজেদের জায়গা জমি। সেই রুক্মিণী, অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী আনপড়-গাওয়ার রুক্মিণীদেবী। যিনি লেখাপড়া না শিখেও, শুধুমাত্র ব্যক্তিত্বের জোরে তাবড় তাবড় পুলিশকর্তা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতা-মন্ত্রীদের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এবং সেই সমস্ত পুলিশকর্তা এবং নেতা মন্ত্রীরা পরে স্বীকারও করেছেন রুক্মিণীর ব্যক্তিত্ব এবং স্পর্ধা দেখে তারাও স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। এমন ব্যক্তিত্ব বোধহয় মানসিং-এর স্ত্রীকেই মানায়। সেই রুক্মিণীদেবী যিনি নিজের ছেলের শোকে পাগল হয়ে স্বামীকে পাঠিয়েছিলেন প্রতিশোধ নিতে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More