হত্যাযজ্ঞের অভিনয়ে হত্যার বাস্তবতা

ছায়াছবি-কথা - ১৭
আগের পর্বে

উনিশ শতকের শেষ দশকের বিপ্লব প্রচেষ্টা নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন ফিলিপিন্সের পরিচালক লাভ ডিয়াজ। ফিলিপিনিয় বিপ্লবের জনক আন্দ্রেস বোনেফাসিওর মৃত্যুকে নিয়ে লিখে ফেলেছিলেন চিত্রনাট্য। প্রায় দুই দশক ধরে বারবার বাধা পেয়ে অবশেষে ২০১৬ সালে মুক্তি পায় সেই ছবি। আ লালাবায় টু দ্য সরোফুল মিস্ট্রি। ছবিটির দৈর্ঘ্য ৮ ঘণ্টা ৯ মিনিট। এত বড়ো ছবি দেখাও এক অন্য ধরণের অভিজ্ঞতা। আখ্যানের পরতে পরতে ডিয়াজ ছুঁয়ে গিয়েছেন স্পেনীয় ঔপনিবেশিকতার ৩৩৩ বছর থেকে পরবর্তীকালে মার্কিন এবং জাপ সাম্রাজ্যের অধীনতা। তারও পরে ফিলিপিন্সের বুকে স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের উদ্ভব, সবই। একদিকে হারানো সংগ্রামীকে খুঁজে বের করার অ্যাডভেঞ্চার, অন্যদিকে এক স্বপ্নাচারীর দেশের গোপন মাটি ছুঁতে ছুঁতে অন্তিমতার দিকে যাত্রা। এভাবেই সমকালকেও চিনিয়ে দিয়ে যান ডিয়াজ।

— এটা প্যারামিলিটারির অফিস ছিল। এটাকে আমি রক্তের দপ্তর বলে ডাকি। এখানে আমি লোক মারতাম। এরকম একটা লম্বা টেবলের ভারী পায়াগুলো ওদের গলার ওপর রাখতাম। তারপর আমরা সিনেমাহলের দিকে তাকিয়ে গান গাইতে গাইতে ঐ টেবলের ওপর চড়ে বসতাম আর বসে বসে শরীর ঝাঁকিয়ে নাচতাম।

— সুদরমন স্ট্রিটের প্রত্যেক চৈনিককে কুপিয়েছিলাম। এশিয়া স্ট্রিটবাসী আমার প্রেমিকার চৈনিক বাবাকেও মেরে দিয়েছিলাম। একটা খোঁদোলে পড়ে গেছিল, একটা ইট দিয়ে মাথার পেছনে মারতেই ভেসে গিয়েছিল।

— এই সেই নদী যেখানে আমরা ঠ্যাং ধরে লাশগুলোকে, আধালাশগুলোকে ফেলতাম। প্যারাশুটের মতো উড়তে উড়তে ওরা জলে পড়ত। তাই সবাই এটাকে ভুতুড়ে নদী বলে জানে।

— আমরা যখন জিজ্ঞাসাবাদ করতাম, ওরা যাই উত্তর দিক না কেন আমরা প্রশ্ন ঘুরিয়ে দিতাম। খবরের কাগজের প্রকাশক হিসেবে আমার কাজ ছিল, যাতে মানুষ ওদের ঘৃণা করে, সেটা দেখা। আমার চোখের একটা ইশারায় একটা লোকের প্রাণ চলে যেত। ওদের মেরে মণ্ডে পরিণত করে আর্মির হাতে তুলে দিতে চাইতাম, কিন্তু আর্মি বলত নদীতে ফেলে দিতে।

— যখন আইন-আদালত আমরাই ছিলাম তখন সুন্দরী কাউকে পেলে না রেপ করে ছাড়তাম না, হোক না কমিউনিস্ট। আর যদি বছর ১৪ বয়েসের কাউকে পেতাম, তাহলে তো একেবারে... সুস্বাদু!

— হিটলারের নাজিদের থেকেও ধর্ষকামী কিছু একটা করতে পারি আমরা।

১৯৬৫-’৬৬ সালে পৃথিবীর বুকে এক ভয়াবহ গণহত্যালীলা চলে, যার সম্পর্কে পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই অজ্ঞাত। এই হত্যালীলার মূল লক্ষ্য ছিল কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য ও সমর্থক মানুষ, গেরোয়ানি (কম্যুনিস্ট পার্টি অনুপ্রাণিত নারী আন্দোলন সংগঠন) মেয়েরা, আবাঙ্গন (জাভার অ-রক্ষণশীল মুসলমান) ও চৈনিক মানুষ।

১৯৬৫-র ৩০-শে সেপ্টেম্বর নাকি কম্যুনিস্টরা ৬ জন সেনানায়ককে খুন করে। আর তার প্রতিশোধস্বরূপ দশ থেকে কুড়ি লক্ষ মানুষকে অভূতপূর্ব নৃশংসতায় মেরে ফেলা হতে থাকে প্রকাশ্য দিবালোকে (এমনকি গ্যাস চেম্বার পর্যন্ত বানানোর প্রয়োজন বোধ হয়নি)। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তথা সি আই এ-র প্রত্যক্ষ মদতে এই হত্যালীলা চলে, যে বিষয়ে সারা পৃথিবীর কেউ প্রায় তেমন কিছুই জানতে পারেনি।

২০০১ সালে ‘দ্য গ্লোবালাইজেশন টেপস’ নামক একটি তথ্যচিত্রের কাজে উত্তর সুমাত্রায় যান আমেরিকাজাত ব্রিটিশ তথ্যচিত্র নির্মাতা জোসুয়া ওপনহাইমর। তখন থেকেই কাজ করতে করতে তার কানে আসে এই ভয়ানক গণহত্যার কথা। এভাবেই তার আলাপ হয় আনোয়ার কঙ্গোর সঙ্গে যিনি প্রায় এক হাজার গণনিধন করেছেন নিজে হাতে। ২০০৫ থেকে সাক্ষাৎকার নেওয়া, ছবি তোলা ইত্যাদি করতে থাকেন জোসুয়া, ক্রিস্টিন সিন এবং স্থানীয় একজন মানুষ, প্রাণহানির ভয়ে যার নাম কোথাও প্রকাশ করা হয় না। প্রসঙ্গত, এই ছবির বিভিন্ন বিভাগে কাজ করা কলাকুশলীর নামের তালিকাজুড়ে যে ‘নাম’ সবচেয়ে বেশিবার আছে তা হল—অনাম্নী (অ্যানোনিমাস)। যাইহোক, অতঃপর ২০১১-য় এসে শুরু হয় পোস্ট-প্রোডাকশনের কাজ। অবশেষে ২০১২-য় মুক্তি পায় ‘দ্য অ্যাক্ট অফ কিলিং’ তথ্যচিত্রটি। প্রসঙ্গত ওপনহাইমরের পিএইচডি-র বিষয় ছিল এই গণহত্যায় চলচ্চিত্র, ভূত আর অভিনয়ের প্রভাব।

গণহত্যোৎসবের এই ঘটনা ঘটেছিল আমাদেরই এশিয়া মহাদেশের পূর্বে অবস্থিত দ্বীপপুঞ্জসম্বলিত রাষ্ট্র ইন্দোনেশিয়ায়। ইন্দোনেশিয়া ছিল হল্যান্ড তথা ডাচ ইস্ট ইন্ডিজের অন্তর্গত উপনিবেশ। স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম রাষ্ট্রপতি সুকর্ণ চাইতেন সবাইকে নিয়ে চলতে। নিজে কমিউনিস্ট না হয়েও সাম্যের ধারণার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন তিনি। ১৯৫৫-য় বান্দুং সম্মেলন সংঘটিত হওয়ার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে কোনো মূল্যে সুকর্ণকে ক্ষমতা থেকে সরাতে চেয়েছিল এবং চেয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্দোনেশিয়া (পিকেআই)-কে সমূলে উৎখাত করতে। ১৯৫৮ সালে সে দেশের সেনাবাহিনীকে দিয়ে একবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় তারা। অতঃপর গণহত্যালীলা চালিয়ে সম্পূর্ণ সাফল্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ‘নয়া ফরমান’ (ন্যু অর্ডার) হাতে নিয়ে অন্যতম সেনানয়ক সুহার্ত অভূতপূর্ব ক্ষমতার অধিকারী হন ১৯৬৬-তে। সুকর্ণর দ্বারা প্রচারিত জাতীয় আদর্শ— পঞ্চশিলা-কে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে ভয়ানক এক গুন্ডা-পরিচালিত রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করেন তিনি। পঞ্চশীলা যুবদলকে পরিণত করেন এক মাস্তানির আখড়ায়, যারা হবে জুয়াখেলা-খুন-ধর্ষণ-চোরাচালান সবেতে সিদ্ধহস্ত এবং উগ্র-জাতীয়তাবাদী, নারীবিদ্বেষী ও কমিউনিস্টবিদ্বেষী। পঞ্চশীলা যুবদল এক অ-সরকারি আধাসামরিক সংস্থা, যার মাথায় বসে থাকে ভয়ানক দুর্নীতিগ্রস্থ লম্পট ধনকুবেররা। এরাই সর্বত্র দাপিয়ে বেড়ায়। গণহত্যার ঘটনাকে চিরতরে লোকস্মৃতি থেকে মুছে দিতে উল্টো প্রচারের পথে হাঁটেন সুহার্ত। ১৯৮৪ সালে তৈরি করান ‘ট্রেচারি অফ দ্য সেপ্টেম্বর থার্টিয়েথ মুভমেন্ট/পিকেআই’ নামক এক চলচ্চিত্র, যা হাস্যষ্পদ মিথ্যার এক জাহাজ এবং যা ইন্দোনেশিয়ার প্রতিটি ছাত্রছাত্রীকে দেখানো হয় প্রতি বছর।

ওপনহাইমরের তথ্যচিত্র যখন তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে পঞ্চশীলা যুবদলের এক অনুষ্ঠানে সে দেশের উপরাষ্ট্রপতি জুসুফ কালা বলছেন— “গ্যাংস্টার মিনস ফ্রি মেন এবং আমাদের জাতির এমনই মুক্ত পুরুষ দরকার। কিছু লোককে প্যাঁদানোর জন্য পেশির ব্যবহার খুবই জরুরি। সবাই যদি শুধু সরকারি কাজ করত তাহলে এটা আমলাদের দেশ হয়ে যেত। পঞ্চশিলা তাই সরকারের বাইরে থেকে কাজ করে।” প্রেক্ষাগৃহজুড়ে করতালির ঝড়।

এরকম এক অবস্থার মধ্যে মেদান, উত্তর সুমাত্রা, ইন্দোনেশিয়া ঘুরে ছবি তৈরির কাজ করেছেন ওপনহাইমর। অনেকে সন্দেহ করেছেন। অনেকে সরাসরি হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু সিনেমার নায়ক হওয়ার নেশায় অশিক্ষিত বৃদ্ধ খুনি আনোয়ার প্রায় স্থানীয় রিসোর্স পার্সন সেজে পাশে থেকেছে। আর তাই লেন্স সরাসরি দেখেছে—স্থানীয় পঞ্চশিলা নেতা সাফিত পরদেদে দোকানে দোকানে তোলা তুলে বেড়াচ্ছে। সরাসরি প্রাণনাশের হুমকি দিচ্ছে। আনোয়ার কঙ্গো-সহ অন্যান্য খুনিদের থেকে যা জানতে পারছেন তাই দিয়ে যেন একটা কাহিনিচিত্র  বানাবেন তাদের অভিনয় দিয়ে সাজিয়েই, এমন একটা ছদ্মতার আশ্রয় নেন ওপনহাইমর। আর সেই ছবির চিত্রনাট্য এমনভাবে সাজান যাতে তা অভিনয় করতে গিয়ে, সেসব ফুটেজ দেখতে গিয়ে তাদের নিজেদের মনেই নানা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। আনোয়াররা অভিনয় করে দেখাতে থাকে কীভাবে তারা কমিউনিস্টদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে এলাকাছাড়া করত, কীভাবে অত্যাচার করত, কীভাবে তাদের খুন করত। আনোয়ার অভিনয় করে দেখায় কীভাবে সে গলায় সামান্য অ্যালুমিনিয়মের তার পেঁচিয়ে বিনা খরচে প্রায় বিনা রক্তপাতে একের পর এক কমিউনিস্টকে হত্যা করত। কীভাবে তাদের প্রাণভিক্ষার বিন্দুমাত্র দাম তারা দিত না। শুরুতে এসব ফুটেজ দেখে আনোয়ার ভাবত যে প্রকৃত খুনের সময়ে সে যা করতে, এখানে যেন ঠিকভাবে সেটাই ফুটিয়ে তুলতে পারেনি। ছবির শেষে গিয়ে দেখা যায় খুন করার জায়গায় গিয়ে খুনের কথা বলতে তার বমি পেয়ে যাচ্ছে।

ওপনহাইমরকে আমরা ছবিতে সরাসরি দেখতে পাই না, ঠিকই। কিন্তু তার উপস্থিতি, তার কণ্ঠস্বরকে তিনি লুকোন না। তার ক্যামেরার উপস্থিতিও স্পষ্ট বোঝা যায়। তার এই ছবি তৈরির সাহচর্যে এসে কিছু মানুষ তাদের ভুলগুলো আংশিকভাবে হলেও চিনতে পারেন। এমনকি তার এই ছবি মুক্তি পাওয়ার পর আনোয়ার কঙ্গোকে দিয়ে যুবদল সাংবাদিক সম্মেলনে বলায় যে, ওপনহাইমর তাকে যেমন যেমন অভিনয় করতে বলেছে সে শুধুমাত্র সেটুকুই করেছে ইত্যাদি। এ ধরনের ছবি বানানোর প্রক্রিয়াই একরকমের রাজনৈতিক সক্রিয়তা। সক্রিয়তা সাংস্কৃতিক দিক থেকেও। তাই হয়ত এই ছবি তৈরির প্রক্রিয়াকে আর্টিভিজম বলা যেতে পারে, যা একইসঙ্গে তদন্তমূলক, পর্যবেক্ষণমূলক এবং একইসঙ্গে শৈল্পিকভাবে বাস্তবোদ্ঘাটনকারী। তাইই হয়তো, বিশ্বখ্যাত চলচ্চিত্রকার ওয়র্নর হরজগ এই ছবি নিয়ে যারপরনাই আশান্বিত। ইন্দোনেশীয় ভাষায় ‘দ্য অ্যাক্ট অফ কিলিং’ -এর নাম ছিল—জগল, অর্থাৎ কসাই।

এই তথ্যচিত্রেরই আর এক ভাগ মুক্তি পায় ২০১৪ সালে। সে ছবির বর্ণনা আরও বমনউদ্রেককারী, আরও ভয়াবহ। সে ছবির আলোচনা বারান্তরে করা যাবে।

Powered by Froala Editor