বুঁমিকাকার জন্মগুলো

ছায়াছবি-কথা – ১৫
আগের পর্বে

একটা আবহাওয়া, একটা দৃশ্য ও কিছু শব্দকে নিয়ে শুরু হয় সিনেমা। এই তথ্যচিত্র একজন শিল্পীকে নিয়ে। শিল্পী পরমজিতের জীবন নয়, তাঁর ছবির শৈলীই অমিত দত্তের ‘সেভেন্থ ওয়াক’ ছবির উপজীব্য। চিত্রনাট্যকার শ্রী দত্তের কাছে এ এক বড় চ্যালেঞ্জ। এর আগে কোনো জীবিত শিল্পীকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানাননি তিনি। সিনেমার পরতে পরতে দেখিয়ে গিয়েছেন শিল্পীর মানসপট। ৭২ মিনিটের সংলাপহীন সিনেমায় রং-চামচের শব্দ বা চারকোল ঘষার খসখসই সবকিছু বলে যায়। পরমজিতের চিত্রশিল্পের প্রক্রিয়াকে তুলে ধরা হয়েছে সিনেমার যান্ত্রিক কৌশলে।

বুঁমিকাকার জীবনের শেষ কয়েকটা দিন। কাকার কিডনির সমস্যা চলছিল। চিকিৎসাও। কিন্তু সেই অসুখে মারা যাওয়ার বদলে, বলা ভালো, কাকা মৃতদের দেশে চ’লে গেল। জ্ঞানতই চলে গেল প্রায় বলা যায়। নিরুদ্বেগ, নিরুত্তাপ, নিরুচ্চার চলে যাওয়া। কাকা, আর পাঁচজনও যেভাবে ভাবে, জানত যে সে তার কৃতকর্মের ফলেই রোগভোগ করছে। যেহেতু কাকা তার খামারে অনেক পোকা মেরেছিল, রাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর তরফে কম্যুনিস্ট বিপ্লবীদের হত্যা করেছিল-- তাইই নাকি তাকে শারীরিক যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছিল! তবে মারা যাওয়ার আগে সে তার হারানো প্রায় সমস্ত অতীতের সান্নিধ্য পেয়েছিল।

থাই(ল্যান্ডের) পরিচালক আপিচ্যাটপং উইরাশেথাকুল-এর ষষ্ঠ কাহিনিচিত্র আঙ্কল বুঁমি হু ক্যান রিকল হিজ পাস্ট লাইভজ (২০১০)। ‘প্রিমিটিভ’ নামক এক প্রকল্পের অন্তর্গত মাল্টিচ্যানেল ভিডিও আর্ট ও মিক্সড মিডিয়া ইন্সটলেশন হিসবে আ লেটার টু আঙ্কল বুঁমি এবং ফ্যানটমস অফ নাবুয়া প্রদর্শিত হয় ২০০৯ সালে। তারই পরবর্তী অংশ হিসেবে নির্মিত হয় এই ছবিটা। ছবিটা ১৯৮৩ সালে একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী কর্তৃক লিখিত বই “আ ম্যান হু ক্যান রিকল হিজ পাস্ট লাইভজ” - অনুসৃত পথে নির্মিত।

ছবিটার চিত্তাকর্ষক বিষয় হচ্ছে ছবিটার এবং ছবিটার চরিত্রদের গতি। ছবিটা যে অচঞ্চল গতিতে চলতে (এগোতেও) থাকে, সেটাই ছবিটার মূল নান্দনিক-রাজনীতি। তবে তার চেয়েও চিত্তাকর্ষক সম্ভবত সবকিছুকেই খুব সাধারণভাবে নেওয়া। প্রচলিত ধ্যানধারণায় যা কিছু অপ্রচলিত, অপ্রথাগত, কিম্ভূত-- সেসবকিছুকে গ্রহণ করার এক অতি স্বাভাবিক ভাব ছবিটার অলঙ্কার। এই বিচিত্রতার অন্তর্ভূক্তি যাতে অনায়াস হয়, সে বিষয়ে সমানুভূতিশীলভাবে সচেতন এই ছবি। এখানে ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান সব এসে নিশ্চুপে মিশছে এক মোহনায়। ছবি তোলায়, সম্পাদনায় এই সাধারণ, স্বাভাবিক ভাবটা এমন একটা ছন্দ নির্মাণ করে যা আখ্যানের শরীরজুরে নির্ভার ভেসে বেড়াতে সক্ষম।

আরও পড়ুন
সপ্তম চরণ

“জঙ্গল, পাহাড়, উপত্যকার দিকে তাকালে জন্তু বা অন্য প্রাণী হিসেবে আমার পূর্ব জীবনগুলো আমার সামনে ভেসে ওঠে”-- এই লিখিত ঘোষণা দিয়ে শুরু হয় ছবি। একটা পালাতে চাওয়া মোষকে দেখি আমরা। তারপর দেখি অদৃষ্টপূর্ব একটা প্রাণী। পূর্বজন্ম, পূর্বজীবন, উত্তরজীবন আমরা নানা ধরণের ছবিতে দেখেছি। আপিচ্যাটপঙেরই ২০০৬-এর ছবি সিনড্রোমস অ্যান্ড আ সেঞ্চুরি-তে পূর্বজীবনের কথা এসেছিল, সিমেটরি অফ স্প্লেন্ডর (২০১৫)-এ এসেছিল অশরীরি আত্মাদের উপস্থিতি। আঙ্কল বুঁমিতে পূর্বজীবন আসে স্মৃতির এমন এক ভাষ্যে যা ভবিষ্যৎকে হয়ত পথপ্রদর্শন করে ভুলে-না-যেতে-দেওয়ার শক্তি দিয়ে। কিডনির অসুখে অসুস্থ বুঁমিকাকা, তার ভাইপো আর শালির সঙ্গে রাতের খাবার টেবলে থাকার সময়ই আবির্ভূত হন কাকার স্ত্রী হুয়ায়, যিনি ১২ বছর আগে গত হয়েছেন। প্রাথমিক সামান্য জড়তা পেড়িয়ে বেশ সহজভাবেই সবাই তাকে গ্রহণ করে তার সঙ্গে কথা বলতে থাকে। কিন্তু এমন নয় যে বহুদিন বাদে প্রিয় মানুষকে ফিরে পেলে যে বিহ্বলতা অনুমেয়, তার লেশমাত্রও বর্তমান। ঠিক যেন জীবনের ও-পাড় সংলাপ চালাচ্ছে এ-পাড়ের সঙ্গে। এই সহজ মেশা প্রশ্ন জাগায় এ-পাড়ের মানুষদের রক্ত-মাংসের বাস্তব উপস্থিতি সম্পর্কে। গুলিয়ে যায় প্রথাগত স্থান-কাল প্রেক্ষিত। হুয়ায়-এর মৃত্যুর ৬ বছর পর তাঁদের ছেলে বুনসং অদৃশ্য হয়ে যায়। সেও হঠাৎ আবির্ভূত হয় সারা দেহ বিশালাকার কালো লোমে ঢেকে, রক্তাভ লাল চোখ নিয়ে। তাকেও চেয়ারে বসিয়ে খাবার অনুরোধ জানানো হয়। তার সঙ্গেও চলতে থাকে সহজ সংলাপ। স্থিরচিত্র পরিস্ফুটন করতে গিয়ে ‘সত্য আবিষ্কৃত’ হয়ে বুনসং-এর চোখে পড়েছিল বাঁদর-ভূত। (আন্তোনিয়নির ব্লো আপ (১৯৬৬) ছবির কথা মনে প’ড়তে পারে।) তাদেরই খুঁজতে হন্যে হয় সে। তেমনই এক বাঁদর-ভূতের সঙ্গে সঙ্গমের ফল তার বর্তমান চেহারা।

আরও পড়ুন
ধর্মীয় মৌলবাদ এবং চলচ্চিত্র

পুরনো ফটো অ্যালবাম খুলে হুয়ায়কে দেখতে দেয় বুঁমি। হুয়ায় নিজের সৎকারের স্থিরচিত্র দেখেন। মৃত্যু কি এক প্রকার স্থির হওয়া? (অস্থিতির সম্ভাবনা না থাকলে স্থিতি অর্থহীন-- এমন প্রশ্নে না গিয়েই আলোচনা চালাই) সময় যেখানে স্থির, সেখানে চিত্রের স্থিরতার অর্থ কী! স্থিরচিত্র যেমন এক অতীতের কথা বলে, ঠিক তেমনই এক সময়-মুহুর্ত থমকে থাকে সেই ফ্রেমে। সিনড্রোমস অ্যান্ড আ সেঞ্চুরি ছবিতেও স্থিরচিত্র আসে। কিন্তু সেখানে স্থিরচিত্র ছিল ফ্রেম-জোড়া। অর্থাৎ পর্দার দৃশ্যটাকে একটা স্থির (ফ্রিজ) শটের মতো লাগার কথা কি (যেহেতু জানি কাহিনী/চলচ্চিত্র দেখছি এবং চলমান শব্দ শোনা যাচ্ছে)! বুঁমিকাকারা সবাইমিলে একটা গুহায় যায়, যে গুহা, কাকার মতে, মাতৃজঠরের মতো এবং যেখানে নাকি সে জন্মেছিল। বুঁমিকাকা আগামী সময় বিষয়ক স্বপ্ন দেখেছিল গত রাত্রে। মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে সেই স্বপ্নের কথা বলে বুঁমিকাকা। সেই “আগামী সভ্যতায় কর্তৃপক্ষ যে কোনও মানুষকে অদৃশ্য ক’রে দিতে পারে। তারা অতীত-মানুষদের ওপর আলো ফেলে, যেই তাদের ছবি পর্দায় ফুটে ওঠে অমনি তারা অদৃশ্য হয়ে যায়”। বুঁমিকাকার বলা স্বপ্নের সময়ে পরপর দশটা স্থিরচিত্র আসে, সম্পূর্ণ পর্দা জুড়ে। যদিও স্থিরচিত্রের এই ব্যবহারকে আপিচ্যাটপং নিজেই “ক্লিশে” বলেছেন। ক্রিস মার্কার-এর লা জেতে (১৯৬২)-র উদাহরণ (যদিও এর পরে স্থিরচিত্র জুড়ে আরও ছবি নির্মিত হয়েছে) তাঁর চেতনাতেও বর্তমান। বরং অ্যান্ডি ওয়রহল-এর এম্পায়র (১৯৬৪)-এর প্রভাব সম্ভবত তাঁর ওপর বেশি। স্থিরচিত্রের এই উপস্থিতি চলচ্চিত্রীয় সময় ধারণাকে সমস্যায়িত ক’রে তোলে। আলোকচিত্রে ধ’রে রাখা স্মৃতিকে এমন স্থিরতার ইঙ্গিতবাহী করে দেখার অর্থ কী! নাকি অনাগত কালকেই স্থৈর্যের পরীক্ষায় ফেলেন তিনি! দশটা স্থিরচিত্র দেখানোর সময়ই সম্ভবত পরিচালক সবচেয়ে প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক মন্তব্য/ইঙ্গিতগুলো করেন। এই স্থিরচিত্রগুলোর বেশিরভাগে সেই সমস্ত বিপ্লবীদের দেখা যায়, যাদের কোনও প্রতিনিধিকে আমরা দেখেছি আ লেটার টু আঙ্কল বুঁমি-তে। থাই আর্ট: কারেন্সিজ অফ দ্য কনটেম্পোরারি নামক গ্রন্থের লেখক স্থিরচিত্রের এই অংশটাকে “রাষ্ট্রীয় অত্যাচারের শিকার আক্রান্তদের চঞ্চল আত্মা” হিসেবে পড়েন। শেষ ছবিটায় দেখা যায়-- একটা প্রায়-বৃত্তাকারে বাঁকা পথ, আর সেই পথে একাধিক বৃত্ত-ছাপ। পূর্ব-উত্তর মিলিয়ে যে সমগ্র জীবন-ধারণা, তার ইঙ্গিত রেখে যাওয়া হয় কী! আঙ্কল বুঁমি-তে ক্যামেরা সবকিছুকেই যথেষ্ট দীর্ঘ সময় নিয়ে দেখে, কখনও একটাই কোণ থেকে, ঈষৎ দূরত্ব নিয়ে। স্থিরচিত্র আর চলচ্চিত্রীয় ধীরতা এমন এক ভাষা তৈরি করে যা চলচ্চিত্রের মূল একক-- ফ্রেম-এর পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে যেন বা। দৃশ্যাবলির চলমানতার সঙ্গে সত্য অথবা আখ্যানের যে সম্পর্ক, তাকে অস্থির করে তোলে।

আরও পড়ুন
দিনলিপি

ছবিতে রাখা স্থিরচিত্র

 

কাচস্বচ্ছ ঝর্ণার জলে নিজের প্রতিবিম্বিত রূপকে সুন্দর লাগে রাজনন্দিনীর। আভরণমুক্ত হওয়ার বদলে তিনি সেখানেই খুঁজে পান কাঙ্ক্ষিত রতিসুখ। অপার্থিব সঙ্গম দৃশ্য রচিত হয় মাগুর মাছের সৌজন্যে। ঠিক কোনগুলো যে বুঁমির পূর্বজীবন, তা পার্থিব স্পষ্টতায় মূর্ত হয় না। অথবা পূর্বের ছায়ায় বর্তমানই হয়ত মূর্ত হয় প্রকৃত প্রস্তাবে।

আরও পড়ুন
উৎসবে শ্রমজীবন

Powered by Froala Editor