নেড়ি কুত্তা

ছায়াছবি-কথা – ১০

আগের পর্বে

২০১০ সালে নির্মিত ডোগরি এবং কাঙরি ভাষার ছবি ‘নয়নসুখ’। অষ্টাদশ শতকের বিখ্যাত চিত্রশিল্পী নয়নসুখকে নিয়েই এই ছবি যেন দ্বিমাত্রিক চিত্রকলার ত্রিমাত্রিকতার বিভ্রম। তবে ইতিহাসের এই আখ্যান তৈরি করতে গিয়ে স্টুডিয়োয় রাজকীয় সেট বানাননি পরিচালক অমিত দত্ত। বরং ভগ্নপ্রায় দুর্গ, প্রসাদই হয়ে উঠেছে ফ্রেমের অংশ। যেখানে ক্যামেরার চোখ, দর্শকের চোখ এবং নতনসুখের চোখ এসে মিশে যায় কোথাও। ইতিহাসের প্রেক্ষাপটকে করে তোলে জীবন্ত।

শাই মিং লিয়াং-এর দশম পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি স্ট্রে ডগজ (২০১৩)। তাইওয়ানের দ্বিতীয় নব তরঙ্গের চারজন প্রধান চলচ্চিত্র নির্মাতার অন্যতম লিয়াঙের জন্ম মালয়েশিয়ায়। তাইওয়ানে চ’লে আসতে হয় কুড়ি বছর বয়সে। এই ছেড়ে আসাটা স্থায়ী ছাপ রেখে গেছে তাঁর মনে। স্ট্রে ডগজ ছবিতে তিনি এক গৃহহীন পরিবারের দৈনন্দিনতার আখ্যান রচনা করেন, কিন্তু একেবারেই ‘বাসস্থানের সমস্যা’ বিষয়ভিত্তিক (ইশ্যু) ছবি আকারে নয়। তাঁর ২০০৬ সালের ছবি আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু স্লিপ আলোন-এ গৃহহীনতাকে আশ্রয়ের খোঁজে নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। যদিও তাঁর দ্বিতীয় ছবি ভিভ ল্যামো (১৯৯৪) থেকেই গৃহহীন মানুষের যাপনচিত্র ফিরেফিরে এসেছে তাঁর ছবিতে।

স্ট্রে ডগজ শুরু হয় চার মিনিট লম্বা একটা শট দিয়ে। প্রতিটা দৃশ্যের জন্য বরাদ্দ মূলত একটা কি বড়জোর দু’টো করে শট-- এভাবেই চলতে থাকে ছবি। ক্যামেরা মূলত স্থির থেকে, নড়াচড়া করে ততটুকুই, যতটা নড়লে একটা চরিত্রের নড়াচড়াকে অনুসরণ করা যায় প্রয়োজনে। লিয়াঙের ছবির সঙ্গে পরিচিত মাত্রই জানেন যে তাঁর ছবিতে দৈনন্দিনতা এমন পুঙ্খানুপুঙ্খতায় অথবা সহজতায় ধরা দেয়, যে বাস্তবকে ঠেকে অতি-বাস্তব। প্রতিনিয়তের সাধারণ কাজকর্ম পুনরাবৃত্ত হয়ে চলে। মনে হয় গত তিরিশ বছর ধ’রে লিয়াঙ একটাই মাত্র ছবি বানাচ্ছেন। ছবির ক্রমে হয়তো পাঁচ কি দশ বছর আগে তাঁরই বানানো কোনো ছবির এক চরিত্রের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল আজকের ছবির আর এক চরিত্রের, ঘটে এমনটাও। তাই অন্তর্বয়ান (ইন্ট্রাটেক্সচুয়লিটি) দিয়ে মূলত পড়তে হয় তাঁর ছবিকে। শুধুমাত্র একই অভিনেতা-অভিনেত্রী নয়, মঞ্চসজ্জা থেকে এমনকি বিভিন্ন সরঞ্জাম (প্রপ) পর্যন্ত বেশ কিছু ছবিতে একই, এমনকি একই জায়গায় থেকে যায় লিয়াঙের ছবিতে। চরিত্রদের নামও জানা যায়না অধিকাংশ ক্ষেত্রে, বিশেষত তাঁর এই শতাব্দীর ছবিগুলোতে। আন্তর্বয়ানের (ইন্টরটেক্সচুয়লিটি) প্রসঙ্গ আসে তখন, যখন ত্রুফোর ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ কি চ্যাপলিনের লাইমলাইট-এর উল্লেখ আসে তাঁর ছবিতে। প্রসঙ্গত বলা যায়, ফরাসি নব-তরঙ্গ দ্বারা লিয়াং কিছুমাত্রায় অনুপ্রাণিত।

স্ট্রে ডগজ ছবিতে দেখা যায় এক নামহীন মধ্যবয়সী পুরুষ (যথারীতি লিয়াঙের অভিনেতা লী কাং-শেং) মেট্রোপলিটন শহরের ব্যস্ততম রাস্তার ধারে রিয়ল এস্টেটের বিজ্ঞাপন হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন। তাঁর এক ছেলে ও এক মেয়ে সারাদিন ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। রাতে তাঁরা খেয়ে নেন কোথাও একটা বসে, তারপর রাস্তার ধারের কোনও এক শৌচালয়ে গা-হাত-পা ধুয়ে শুতে যান পরিত্যক্ত জলাধার লাগোয়া এক ঘিঞ্জি ঘরে। বাচ্চা দুটোর মা অথবা মা-স্থানীয় কেউ (এই ‘মা’ চরিত্রে তিন জন অভিনয় করেন) কাজ করেন কোনো এক শপিং মলে। তিনি মলের শৌচালয়ে মাথা ধুইয়ে দেন মেয়ের। আইসক্রিমও দেন। ঠাণ্ডা হাওয়া আর বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে লী বিড়বিড় করতে থাকেন দ্বাদশ শতাব্দীর কবিতা-- “…আমার শোষণ কাদা আর ধুলো ছাড়া আর কিছুই না/… সাম্রাজ্যের প্রজাদের দুঃখ শেষ হবে কবে…”। বিড়বিড়-স্বর ধীরে ধীরে বদলে যায় বিলাপের সুরে। তার চোখ-নাক দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তে থাকে।

 

লিয়াঙের ছবির সঙ্গে পরিচিতরা জানেন তাঁর ছবিতে যে কোনো দৈনন্দিন কাজকর্ম, যেমন - খাওয়া (সিগারেট হোক বা খাবার), স্নান, মল-মূত্রত্যাগ, ঘুম কী সাবলীল সহজতায় কিভাবে ফিরেফিরে আসে। এখানে খাওয়া মানে খাওয়া, গোগ্রাসে হোক বা ধীরে, প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত খাওয়া, এমনকি সেটা জল হলেও। বাথটবে শুয়ে থাকা মানে শুয়ে থাকা। ‘গতানুগতিক’ চলচ্চিত্রের ঢঙে চলচ্চিত্রীয়-সময়ের সঙ্কোচন বা প্রসারণের ধারণা দিয়ে ছবি করেন না তিনি। তাঁর ছবিতে সবই এখন, এই মুহূর্তে, এভাবেই। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে যৌনক্রিয়ার প্রশ্নে তাঁর চলচ্চিত্রীয় বাস্তবতা পর্নোগ্রাফিক বাস্তবতায় পৌঁছোয়। ঐন্দ্রজালিক অভিজ্ঞতার সঙ্গে যে শব্দটা আমাদের সবচেয়ে কাছের তা হল তাৎক্ষণিকতা। লিয়াঙের ছবিতে চলচ্চিত্রীয় ঐন্দ্রজালিক মুহূর্ত তৈরি হয়, একটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর ‘নাটকীয়তাহীন’ শট, যখন শট পেরিয়ে এমন ‘সত্য’ বলে মনে হতে থাকে যা আমাদের সাধারণ চলচ্চিত্রীয় অভিজ্ঞতায় বিরলতম। এমন নিবিষ্ট-দেখা নিজগুণেই ‘নাটকীয়’ হয়ে ওঠে, হয়ত। লিয়াং বলেন-- তিনি চাননা পাঁচটা সিগারেটের শেষাংশ দেখিয়ে প্রমাণ করতে যে তাঁর নায়ক কত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করছেন। অপেক্ষা যদি লম্বাই হয় তাহলে দর্শককেও পাঁচটা সিগারেট শেষ করার সময় পর্যন্ত ছবির সঙ্গে থেকে সেই অপেক্ষা অভিজ্ঞতা করতে হবে, মনে করেন তিনি। কোনো কিছু ঘটার জন্য সাধারণত আমরা অপেক্ষা করে থাকি। লিয়াঙের ছবিতে অপেক্ষা করতে হয় কোনো কিছু না ঘটার জন্য। এখানে অনেকটা সময় লাগে ‘কিছুই না ঘটতে’। কিন্তু এভাবে দীর্ঘ (কীসের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ?) সময় ধ’রে দেখার জন্য গতানুগতিক রীতিতে প্রাকৃতিক নিসর্গদৃশ্যের আশ্রয় না নিয়ে বরং ফাস্টফুডি শহরের মধ্যেই থাকে লিয়াঙের ক্যামেরা। বিশ্বখ্যাত পণ্ডিত জিল দল্যুজ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর এক জাতীয় আধুনিক চলচ্চিত্রকে ‘টাইম ইমেজ’ দিয়ে পড়েন, ‘মুভমেন্ট বা অ্যাকশন ইমেজ’-এর অন্যপাড়ে (যেহেতু তাঁর মতে চলচ্চিত্র রেপ্রেজেন্টশন নয়, বরং ইভন্ট)। এই কাল-প্রতিমার কালিক-বাস্তববাদই (ড্যুরেশনাল রিয়লিজম) লিয়াঙের ছবিতে ‘কাট’-এর সম্পাদনারীতিকে প্রত্যক্ষ ক’রে তোলে। লিয়াং নিজ গুণেই অত্যর (রচনাকার)-এর আসন পান। তাঁর তৃতীয় ছবি থেকে শুরু করে সমস্ত ছবির শেষে খোদাই করে দেন নিজের স্বাক্ষর, চিত্রশিল্পীর ঢঙে।

আরও পড়ুন
নয়নসুখ

রাতের বিছানায় ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়েছে কিনা দেখতে চোখ খুলে তার ঘুমন্ত মেয়ের পাশে শোয়ানো শুকনো বাঁধাকপির খেলনাকে দেখতে পায়, হতাশ মদ্যপ লী। পরম মমতায় সেই খেলনাকে আদর করতে থাকে সে। তারপর হঠাৎ খেলনার মুখে বালিশ চাপা দিয়ে তার ওপরে সমস্ত শক্তি দিয়ে চেপে বসে। কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তির পর বালিশ সরিয়ে খোবলাতে শুরু করে বাঁধাকপিটাকে। ছিন্নভিন্ন করতে থাকে দাঁত-নখ দিয়ে। তারপর সমস্ত বাঁধাকপিটাকে গোগ্রাসে চিবিয়ে গিলতে থাকে। একটা সময়ের পর খেলনাটার অবশিষ্ট অংশটাকে জড়িয়ে ধ’রে কান্নায় ভেঙে পড়ে লী। এই গোটা ঘটনাটা এক দৃষ্টে ক্যামেরাটা দেখে চলে পলকহীনভাবে, নিশ্চুপে। ছেলেমেয়েরা ঘুমিয়ে থাকে পাশে, একই বিছানায়। এমন হিংস্রতা অথবা হিংস্র দৃশ্য লিয়াঙের দ্য ওয়েওয়ার্ড ক্লাউড (২০০৫) ছাড়া আর কোনো ছবিতেই নেই সম্ভবত।

দেখা স্বপ্ন মুখের ভাষায় বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা যেভাবে বাস্তব জীবনের যৌক্তিক পারম্পর্য দিয়ে সাজিয়ে বলি, সেভাবে কিন্তু প্রকৃত অর্থে আমরা স্বপ্ন দেখি না। এই লেখার ক্ষেত্রেও সেই সীমাবদ্ধতাই কাজ করছে। তাই, মনে হচ্ছে যেন একটা যৌক্তিক কাঠামো মেনে বাপ-মা-ছেলেপুলে সম্বলিত প্রথাগত পারিবারিক-গপ্পো-বলা গতানুগতিক ছবির মতোই এখানে চরিত্রদের পরিচায়িতকরণ কি চরিত্রদের বিকাশ হচ্ছে। এমন বিভ্রম সৃষ্টি শুধুই বর্তমান লেখকের অজ্ঞতাপ্রসূত। একথা ঠিক যে তাইওয়ান বা চীনের সমাজ-রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ইতিহাস-বর্তমান লিয়াঙের ছবির প্রেক্ষাপট, কিন্তু সেটাকে যে নির্বিকার অথচ সমানুভূতিশীল আঙ্গিকে তিনি ধরেন সেটাই তাঁর ছবির মূল স্থানাঙ্ক। তাঁর ছবির প্রতিটা শট স্বতন্ত্র। (অর্থাৎ) একটি শটের সঙ্গে পরের শটের স্থানিক-কালিক সম্পর্ক প্রথমিক প্রস্তাবে অব্যক্ত থাকে। তাঁর ছবিতে বাস্তবের সঙ্গে অবলীলায় মিশে যায় আকাঙ্খা। সেই যুক্তিতেই স্ট্রে ডগ ছবিতে লীকে শুয়ে থাকতে দেখি সেই রিয়ল এস্টেটের ফ্ল্যাটের বৈভবের শয্যায়, যার প্লাকার্ড নিয়ে রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এমনকি পেচ্ছাপ-পায়খানাও করতে হয় সেই এস্টেটের পাশের জলায়। কেউ কেউ এই ছবিকে মহাপ্রলয়োত্তর (পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক) বাস্তবতার উদাহরণ হিসেবেও পড়েছেন। শহরে পানীয় জলের অভাব থাকে। অথচ মুষলধারে বৃষ্টি অথবা জলের অপচয় কি জলজনিত বিড়ম্বনা বন্ধ থাকে না, লিয়াঙের ছবিতে।

আরও পড়ুন
সায়াৎ নোভা অথবা রক্তবীজের রং

ব্যস্ত শহরের পরিমন্ডলজাত একটা একঘেয়ে শব্দ সমস্ত ছবিটা জুড়ে হয়ে চলে। আর এক পরিত্যক্ত বাড়ি যার “দেওয়ালের ফাটা দাগগুলো বলিরেখা”, সেখানে শুয়ে মা সেই ইশপের গল্প মেয়েকে বলেন যেখানে ব্যাঙেরা ঈশ্বরের কাছে একটা রাজা চেয়েছিল। ঈশ্বর পাঠিয়েছিল একটা কাঠের লগা, যেটা নড়েও না চড়েও না। এমন রাজা ব্যাঙেদের না-পসন্দ্‌ হওয়ায় ঈশ্বর পাঠালেন এক সারসকে, যে ব্যাঙেদের ধরে ধরে টপাটপ খেয়ে ফেলতে লাগল। যেখানে শুয়ে এই গল্প হচ্ছে, সম্ভবত, সেই বাড়িরই এক চাতালে জড়ো হয় গাদা খানেক নেড়ি কুত্তা। গৃহহীনা, গৃহহীনেদের মা সেই কুকুরদের খাওয়ান। বৃষ্টির রাতে গাছে উঠে কোন সন্তানকে খোঁজেন তিনি!

স্ট্রে ডগজ-এর শেষ দুটো শটের প্রথমটার দৈর্ঘ ১৪ মিনিট, দ্বিতীয়টার ৭ মিনিট। লী আর চেন নিঃশব্দ-নিশ্চুপে দাঁড়িয়ে থাকেন পাহাড়-নুড়িপাথর-আঁকা এক দেওয়ালের সামনে। মৌখিক ভাষার প্রয়োজনকেই কি প্রশ্ন করে বসছেন লিয়াং! হয়ত তিনি বলবেন শুধুমাত্র খেয়েদেয়ে বেঁচে থাকতে এত কথায় কাজ কী! নেড়ি কুত্তাদের জীবনে কী আর কথা লাগে! কিন্তু হায়, মিতভাষী লিয়াং ‘অর্থহীনতার পরপার’ থেকে বলবেন-- তাঁর অভিনেতা লী-এর মুখটা ভালো লাগে, তাই তিনি এই ছবিটা করেছেন।

আরও পড়ুন
গমক ঘর

Powered by Froala Editor