ছায়াছবি-কথা – ৯
আগের পর্বে
আর্মেনিয়ান ত্রুবাদুর সায়াৎ নোভা। একজন কবি সঙ্গীতকার এবং আশিক। রাজার বোনের প্রেমে পড়ে যাকে হারাতে হয়েছিল রাজদরবারের কাজ। খুনও হতে হয়েছিল ১৭৯৫ সালে। তাঁর জীবনকে ফ্রেমে ধরেছিলেন চলচ্চিত্র জগতের বিতর্কিত চরিত্র সের্গেই পারজানোভ। ১৯৬৯ সালে। তবে সিনেমার নাম পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল ‘দ্য কালর অফ পোমাগ্রনেটস’-এ। আর্মেনিয়ান লোকশিল্প, স্থাপত্য, চিত্রকলার মিশেলে এই সিনেমার ফ্রেম বুনেছিলেন সের্গেই। পশুবলি ছাড়া হিংস্রতার আর কোনো আঁচ না থাকলেও, দর্শকদের একটা অস্বস্তির মধ্যেই রাখে এই সিনেমা। ট্যাবলোর স্বাভাবিকতা বজায় রেখে স্টিল ক্যামেরায় পারজানোভ যেন সায়াতের কাব্যকেই অনূদিত করেছেন এই চলচ্চিত্রে।
আঠেরো শতকের এক ভারতীয় চিত্রশিল্পী, নয়নসুখ, তুলোট কাগজে তুলি-কালি দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছিলেন তার দেখা চারপাশকে। রাজপ্রাসাদের বারমহলকে। লিখিত ইতিহাসের অভাব মেটাতে সেসব ছবিই বর্তমানের কাছে ক্ষেত্রবিশেষে ঐতিহাসিক দলিল। ইতিহাস জানার, ইতিহাসকে পড়ার জানলা সেসব ছবি। বাকিটা মেলাতে হয় লিখিত-গ্রন্থিত পুঁথির সঙ্গে অথবা অন্যান্য ঐতিহাসিক উপাদানের সঙ্গে। এছাড়া নিতেই হয় (যৌক্তিক)-কল্পনার আশ্রয়। আজ তো আমরা জেনেইছি (মেনেইছি?) ইতিহাসও এক আখ্যান। সেই কল্পনা দিয়েই কল্পনা-কীভাবে-করতে-হয় তার আভাস পাওয়া যায় অমিত দত্ত-র ডোগরি ও কাঙরি ভাষায় নির্মিত (তথ্য)ছবি নয়নসুখ (২০১০)-এ।
দ্বিমাত্রিক চিত্রকলার, ত্রিমাত্রিকতার ‘বিভ্রম’ নির্মাণকারী চলচ্চিত্রীয় তরজমা বলা যায় এই ছবিকে। একজন চিত্রকরের শিল্পজীবনকে কেন্দ্রে রেখে এই ছবি। অবনঠাকুর আর্টিস্টের বাংলা তরজমা করেছিলেন রূপদক্ষ। এই ছবিতে এক রূপদক্ষ ভিন্ন মাধ্যমের মধ্যস্ততায় আর এক রূপদক্ষকে দেখছেন, নির্মাণ করছেন। মনে হয় বর্তমানের এক শিল্পী, এক পূর্বজ শিল্পীকে আবিষ্কার করতে চাইছেন স্ব-এর, দেশজ শিল্পের শিকড়-তলাশে। এ এক অতীত নির্মাণকারী শিল্প-প্রয়াস। ইতিহাসের পুনঃকল্পনার ধারণা দিয়েই হয়ত একমাত্র এই ছবিকে খানিক বোঝা যেতে পারে। এ ছবি নির্মাণে প্রত্যক্ষভাবে হাতে ছিল নয়নসুখ ও অন্যান্য সমসাময়িক শিল্পীদের আঁকা ছবি আর ব্রিজেন্দ্রনাথ গোস্বামী লিখিত নয়নসুখ অফ গুলর: আ গ্রেট ইন্ডিয়ান পেইন্টর ফ্রম আ স্মল হিল-স্টেট নামক আকর গ্রন্থ।
নয়নসুখের জন্ম বর্তমান হিমাচল প্রদেশের গুলরে ১৭১০ (অপ্রতিষ্ঠিত ভিন্ন মতে ১৭২৫) সালে। তাঁর পিতা পণ্ডিত সেউ বিখ্যাত চিত্রকর ছিলেন। দাদা মানাকু-ও ছিলেন গুণী চিত্রশিল্পী। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন হিন্দু ধর্মকেন্দ্রিক চিত্রচর্চায় পারদর্শী। পণ্ডিত উদারমনা ছিলেন শৈলীর প্রশ্নে। সেই ঔদার্যকে কাজে লাগিয়ে নিজের চিত্রকলায় নয়ন মিশিয়েছিলেন মুঘল অণুচিত্রের ঠাট। এবং তাঁর শৈল্পিক স্বাতন্ত্রে হয়ে উঠেছিলেন ‘পাহাড়ি চিত্র’ ঘরানার অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। ‘পাহাড়ি চিত্র’ ঘরানার আবার ছ’টি উপবিভাগ-- গুলর, কাঙরা, বাশোলি, চাম্বা, গাড়ওয়াল, বিলাসপুরি। জম্মুর জাসরোটের রাজপুত রাজা মিয়াঁ জরোয়ার সিং আর তার পুত্র বলবন্ত সিং-এর দরবারে ছবি আঁকাই ছিল নয়নসুখের মূল কাজ। (শেষ জীবনে বাশোলিতে থেকে আঁকার শেষ সময়ে তিনি আবার ধর্মকেন্দ্রিক ছবিতে ফিরে গিয়েছিলেন।) তো আঁকতে গিয়ে রাজদরবারে কী কী দেখছেন নয়ন, কীভাবে দেখছেন, কিভাবে সেসব ফুটিয়ে তুলছেন তুলির টানে, মূলত বলবন্ত সিং-এর সঙ্গে কেমন সম্পর্ক হয়েছিল তাঁর-- সেটুকুই এ ছবির বিষয়। আমাদের পড়তে হবে-- কীরকম শৈল্পিকতায় আমাদেরকে এই ইতিহাসের দর্শন করাচ্ছেন এ ছবির পরিচালক, সে দিক থেকে; ইতিহাসের আখ্যানধর্মী চরিত্রকে মাথায় রেখে। জীবনের জঙ্গমতাকে স্থির-পটে ধরেছিলেন নয়ন, আর সেই স্থির-পটকে চলচ্চিত্রের জঙ্গমতায় মুক্তি দিলেন পরিচালক। চলচ্চিত্রের পর্দার ভাষায় মূর্ত হলেন নয়নসুখ।
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/33cd45e24fbff0a82c73f6b45d66c39f74c280ce.jpg)
চিত্রপটে দেখছি দুর্গের ওপর ময়ূর বসে আছে, রাজা হুঁকো টানছেন, নর্তকী নাচ পরিবেশন করছেন, বাদকেরা বাজাচ্ছেন, ইওরোপীয় সাহেবরা নর্তকীদের ধরে টানাটানি করছেন, পশু শিকার করছেন রাজকর্মচারীরা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু শিল্পী একবার দেখেই সেসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এঁকে ফেলেছিলেন! ঘটনাগুলো ঘটার সময়ে সেখানে নয়নসুখ উপস্থিত থেকে সেসব দেখে, মনে রেখেই এঁকেছেন তো বটেই; কিন্তু এমনও হয়েছে যে কর্মচারীদের সাজিয়ে, অভিনয় করিয়ে তার ছবি এঁকেছেন নয়নসুখ। সেসব দুর্গ, প্রাসাদ এখন ভগ্নস্তুপ। তাব’লে মূলানুগ হওয়ার দাবিতে স্টুডিওয় রাজকীয় সেট বানিয়ে ‘আসলের’ স্বাদ দেওয়ার চেষ্টা নেই এই ছবিতে। বরং পরিত্যক্ত প্রাসাদেই অভিনিত হচ্ছে সেই সময়। ইতিহাসের সঙ্গে সহজ সংলাপে যাওয়া যাচ্ছে তাতে। সভ্যতা কতদূর এসেছে সেই ইতিহাস পেরিয়ে তার আঁচ করা যাচ্ছে সহজেই। নয়নসুখ(দের) চিত্রকলা যেহেতু বহুদৃষ্টিকৌণিক বা দৃষ্টিকোণবিরহিত এবং বিমূর্ত চিত্রকলা না হয়ে বরং সমতলে উল্লম্বতায় সাজানো গভীরতা (ডেপথ) দিয়ে নির্মিত আখ্যানের কথা বলে-- ছবি করতে গিয়ে সে দিকটা স্পষ্টত মাথায় রাখেন পরিচালক। অমিত দত্তের ছবির সঙ্গে পরিচিত দর্শকমাত্রেই জানেন এ বিষয়ে তাঁর মননশীল (কনটেমপ্লেটিভ অর্থে) নান্দনিক পারদর্শিতার কথা।
আরও পড়ুন
সায়াৎ নোভা অথবা রক্তবীজের রং
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/31f4b584d4c2d22268ed4ad514986c0ce0976cfa.jpg)
চিত্রকলাশিল্পের মূলে ষড়ঙ্গের উপস্থিতির কথা আমরা জানি। রূপ-রস-ভাবের যে নিত্য খেলা তাকে সুনিপুণ সাবলীলতায় বর্ণিকাভঙ্গের ঠিকঠিক নান্দনিক দরজায় নিয়ে যাওয়াই শিল্পীর কাজ। বর্ণের উপস্থিতিই ঘোষণা করে রেখার অস্তিত্ব। শ্রী গোস্বামীর দেখায়-- নয়নসুখের চিত্রপটের জমিতে রং তেমন থাকেনা; একটা সুক্ষ আনুভূমিক রেখা জমি আর পশ্চাৎপটের মাঝে থাকে; একটা বিশুদ্ধ সবুজ রং দৃশ্যপটকে জরিয়ে থাকে প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলির পটে; কোথাও হুঁকোর সঙ্গে থাকে একটা অতিরিক্ত লম্বা লাল নল; কোথাও একটা গৌণ চরিত্রকে পাশ থেকে দেখা যায়। এইই হল মোটের ওপর নয়নসুখের চিত্রপটের সাধারণ ধরণধাঁচ।
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/6ef8bf4082043969ce3e86d154127577796986c4.jpg)
এই চিত্রপটের কাছে সৎ থেকেই নয়নসুখ ছবিটির নির্মাণ। উত্তর ভারতের মৃৎশিল্প বিষয়ক ছবি তুলতে গিয়ে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক মণি কওল ছুঁয়ে বসেছিলেন স্বয়ং মাটির আত্মাকে ইতিহাস আর পুরাণ সঙ্গী ক’রে, “এক অ-কাহিনীমূলক বাস্তবতায়”। স্পেনের বিখ্যাত স্থপতি আন্তোনিও গাউদিকে নিয়ে ছবি করতে গিয়ে জাপানের আভাঁ গার্দ চিত্রপরিচালক হিরোশি তেশিগাহারা কোনো অভিনয়, আবহকণ্ঠ, কোনো সাক্ষাৎকার ব্যতিরেকে শুধুমাত্র দৃশ্য আর শব্দ দিয়ে এঁকেছিলেন গাউদির কাজ আর তার অনুপ্রেরণার উৎস। এখানে একদিকে চিত্রানুগ থাকতে গিয়ে, অন্যদিকে চলচ্চিত্র মাধ্যমের নিজস্বতা অনুযায়ী নির্মান করতে গিয়ে আঙ্গিকের এক দারুণ মিশেল তৈরি হয় নয়নসুখ ছবিতে। ট্যাবলো ভিভাঁর ঢঙের সঙ্গে মেশে এমন শট যা একইসঙ্গে স্থির এবং গতিশীল। আবার চলচিত্রে যেমন একটা দৃশ্য অনেকগুলো শটে ভেঙে দেখতে পাওয়ার অবকাশ আছে, ঠিক সেভাবেই একটা গোটা চিত্রপটকে ভেঙে ভেঙে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ দেখানো হয় এ ছবিতে। আবার চিত্রপট মোতাবেক শট নিতে গিয়ে ফ্রেমের মাপ, দেখার কৌণিক অবস্থান ঠিক তেমনটাই রাখেন যেমন মূল চিত্রপটে আছে। চিত্রপটের ফ্রেম মোতাবেক ফ্রেমের ব্যবহার এ ছবিতে চোখে পড়ার মতো। পর্দায় স্থান-কাল-পাত্র দেখানোর পরেই নয়নসুখের নির্দিষ্ট একটা চিত্রপটের ছবি, কখনো প্রান্ত (মার্জিন) রেখে, কখনও বাদ দিয়ে, এমনভাবে পাশাপাশি রাখেন পরিচালক, মনে হয় তিনি শুধু ব্যাখ্যা করার কাজটুকুই সাবধানতার সঙ্গে করছেন, অথচ একেবারেই অ-শৈল্পিক যান্ত্রিকতা দিয়ে নয়। শিবের জটা থেকে গঙ্গার উৎপত্তি যখন আঁকছেন নয়নসুখ, একই শটে চিত্রপটের পেছন দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। এমন সহজ অথচ নান্দনিক রূপকের ব্যবহারই ছবিটার মূল অলঙ্কার। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক-- একটা গোটা চিত্রপটে আছে আলাদা আলাদা ঘোড়ায় চেপে তবলা বাদক, তানপুরা বাদক, গায়ক, নর্তকী, রাজা যাচ্ছেন সর্ষেক্ষেতের ভেতর দিয়ে। ঘোড়ার পিঠে তবলা এমনভাবে বাঁধা, যাতে মনে হচ্ছে তিনি বাজাতে বাজাতেই যাচ্ছেন। একইভাবে তানপুরা বাদক বা গায়ক। রাজা একটু দূরে। চলচ্চিত্রে আমরা অভিনেতাদের দেখি ও শুনি বাজাতে বাজাতে, গাইতে গাইতে, হাসতে হাসতে যাচ্ছেন আলাদা আলাদা শটে। প্রত্যেক শটের পর মূল চিত্রপটকে টুকরো টুকরো ক’রে নেওয়া আলাদা আলাদা চরিত্রদের ছবি দেখানো হয়। রাজা যেহেতু একটু দূরে, তার মাঝে সর্ষেক্ষেতেই পরিচালক ঢুকিয়ে দেন একটা কুকুরের শট। অথচ নয়নসুখের আঁকা মূল চিত্রপটে কুকুর আছে বহু দূরে পাহাড়ের কাছে, দু’টো। আঁকায় থাকা দূরের সাধারণ মানুষও চলচ্চিত্রে অনুপস্থিত। চিত্রপটে এক রাজভৃত্যকে দেখা যায় ঘোড়ার পাশে, হুঁকো হাতে। আর ছবির রাজভৃত্যকে দেখা যায় হুঁকো কাঁধে ঘোড়ার পেছনে দৌড়োতে। শুধুমাত্র এই অংশে এমন আরও কিছু মুহুর্ত থাকে, ঠিক যেমন থাকে দাড়ি কাটার দৃশ্যে। এভাবে পরিচালক সেদিনের চিত্রপটে আজ ঢুকে পড়েন তাঁর চলচ্চিত্র-শৈলীর কল্পনা নিয়ে-- চিত্রপটের সম্ভাব্য যৌক্তিক চলচ্চিত্রীয় বিন্যাস হিসেবে অথবা আখ্যানের ভবিষ্যতের ইঙ্গিতবাহী হয়ে। আঠেরো শতকের চিত্রপট, পর্দাপটে জঙ্গমতা পায় একুশ শতকের চলচ্চিত্রের হাত ধ’রে। নয়নসুখের চোখ, ক্যামেরার চোখ আর দর্শকের চোখ এসে মেশে যে দেখায়, তাকে হয়ত ‘অবলোকন’-এর মতো কোন শব্দ দিয়ে পড়া যায় স্পষ্টতরভাবে।
আরও পড়ুন
গমক ঘর
![](https://www.prohor.in//uploads/editor_image/965131b014e51120071cfdb9b52ad95c4f217daf.jpg)
ছবিটার আলোকসম্পাত-পরিকল্পনাকে চিত্রপটানুগতার অর্থে পড়া যায়। শব্দ ও সংলাপের পরিমিত ব্যবহার ছবিটাকে একটা বাড়তি ওজন দেয়। এক বৃদ্ধ-পুরুষ আবহকন্ঠ এমনভাবে প্রযুক্ত হয় যেন মানুষ নয়, গল্প বলার ঢঙে কথা বলছে অভিজ্ঞ সময়। সবে মিলে শ্রদ্ধাশীল একটা দূরত্ব রচনা হয় ছবি আর দর্শকের মধ্যে। কিন্তু ছুঁতে না পাওয়ার অভিমান ‘বিস্তারে’ থাকলেও, যখন রাগ ফিরে এসে তালে প’ড়ে সমে মেশে, তখন তারিফ করতে অসুবিধে হয়না আনাড়ি কানেরও।
আরও পড়ুন
স্বপ্নোন্মাদের মৃত্যু
[উৎসাহী পাঠিকা এই সূত্রে দেখে নিতে পারেন দ্য ম্যুজিয়ম অফ ইম্যাজিনেশন (২০১২) আর ফিল্ড-ট্রিপ (২০১৩) নামক অমিত দত্তের স্বল্পদৈর্ঘের ছবি দু’টো।]
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মধুর রাজ্য