ছায়াছবি-কথা - ১৮
আগের পর্বে
২০০১ সালে একটি তথ্যচিত্রের কাজ করতে গিয়ে নতুন একটি ছবির পরিকল্পনা নেন জোসুয়া ওপনহাইমর। তাঁর পিএইচডি-র বিষয় ছিল ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যায় চলচ্চিত্র এবং অভিনয়। সেই গণহত্যার ইতিহাস সম্পর্কে আরও বিশদে জানার সুযোগ পান তিনি। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতে থাকেন নানা সাক্ষাৎকার। ১৯৬৫-৬৬ সালের সেই গণহত্যার ইতিহাস ততদিনে প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে। মার্কিন মদতপুষ্ট ইন্দোনেশিয়ার সেনাবাহিনীর হাতে প্রায় ১০-২০ লক্ষ কমিনিস্ট প্রাণ হারান কয়েকমাসে। সেইসঙ্গে মাফিয়া ডনদের অবাধ স্বাধীনতা দেয় সরকার। এই সমস্তকিছু নিয়েই ২০১২ সালে মুক্তি পায় ওপনহাইমারের তথ্যচিত্র ‘দ্য অ্যাক্ট অফ কিলিং’।
শাহরবানু সাদাত। জন্ম ইরানের তেহরানে। বংশ পরিচয়ে আফগান। চেয়েছিলেন পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়তে। কিন্তু ফ্রান্সের আতেলিয়ার্স ভারাঁ পরিচালিত, কাবুলে আয়োজিত, তথ্যচিত্র বিষয়ক কর্মশালায় যোগ দিতে গিয়ে কাজ হয়ে দাঁড়ালো ছবি বানানো। সদ্য তিরিশে পা দিয়েছেন এই আফগান মেয়ে।
আনোয়ার হাশিমির অপ্রকাশিত পঞ্চধ্যায়ী ডাইরির প্রথম দু’টি অধ্যায় নিয়ে দু’টি ছবি নির্মাণ করেছেন সাদাত। প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি— উলফ অ্যান্ড শিপ (২০১৬)। পরের ছবি দ্য অরফ্যানেজ (২০১৯)। দু’টি ছবিই কান চলচ্চিত্র উৎসবের ডিরেক্টরস ফোর্টনাইট বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছিল।
আফগান অঞ্চলের এক প্রত্যন্ত পাহাড়ি উপত্যকার একটা গ্রামজীবনের রোজনামচা বলা যেতে পারে প্রথম ছবিটাকে। সেই গ্রামের ছোটোরা ভেড়া চড়াতে যায় উপত্যকার আনাচেকানাচে। সঙ্গে চলতে থাকে তাদের শিশুসুলভ খেলাধুলো-আড্ডা-ঝগড়া-মারপিট। বড়োদের থেকে শোনা পরনিন্দা-পরচর্চার কথা চালাচালিও হয় সেখানে। পাথর দিয়ে গুলতি ছোঁড়া— ছেলেদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা সেখানে। তার মধ্যে সবচেয়ে কসরতের, গুলতির দড়িটা পাকানো। কিন্তু এসবে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মাঝেমধ্যেই নেকড়ের পেটে চলে যায় দু-একটা ভেড়া। এমন কিছু ঘটলে দুটো বিষয় হয়। এক—বড়োদের বকুনি। দুই—নানা ধরনের পুরনো লোকশ্রুতির মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা।
আরও পড়ুন
হত্যাযজ্ঞের অভিনয়ে হত্যার বাস্তবতা
“কাশ্মীরি নেকড়ে দু’পায়ে হাঁটে। চেহারা ষাঁড়ের মতো। ঘোড়ার মতো কেশর। সে বড়লোক আর নিষ্ঠুরদের শত্রু। প্রতি রাতে সে তাদের একজনকে শিকার করে নিজের গুহায় নিয়ে যায়। একদিন রাতে সে এক জাঁতাকলের মালিক, যে গম চুরি করত, তাকে নিতে এসেছিল। আটার ধুলোয় ক্ষুধার্ত নেকড়ে তাকে দেখতে না পেয়ে রুটি সেঁকতে শুরু করেছিল। যেই সে রুটিটার ছাল ছাড়িয়েছে অমনি এক সবুজ পরী সেখান থেকে বেরিয়েছে। অমনি মালিক সেদিকে দৌড়ে গেছে। তারপর তাদের মধ্যে অনেক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি হয়েছে। শেষে মালিকটা ছালটাকে উনুনে ছুঁড়ে দিয়েছে। সবুজ পরী হেরে গেছে। তাই তাকে তার স্ত্রী হতে হবে। কিন্তু পরীটা কিছুক্ষণ পরেই তার কাছ থেকে পালিয়ে যায়। মালিকটা মানুষের গম চুরি করত, তাই ঈশ্বর তাকে ভালোবাসা দিয়েও কেড়ে নিয়ে শাস্তি দিল।”
আরও পড়ুন
বিষাদময় রহস্যের এক ঘুমপাড়ানি গান
এই সমস্ত লোকশ্রুতি, লোকশ্রুতির চরিত্র, লোকজনদের ঘিরেই এই ছবি। নিরাভরণ পাহাড়ি উপত্যকা, তার জনপদ, তার নদী, তার চরাচর ধরা আছে প্রায় তথ্যচিত্রের ঢঙে তোলা সাদাতের এই ছবিতে। (কান চলচ্চিত্র উৎসবের সময়ে এক সাক্ষাৎকারে সাদাত বলেছেন যে, সাধারণত আফগানিস্তানে তিনি শুটিং করতে পারেন না, তাই দলবল নিয়ে কাজাকস্তানে গিয়ে ছবি তোলেন।) খুব সাধারণ মিজঁ-সিন-নির্ভর এই কাহিনিচিত্রের আখ্যান খুবই শিথিল চরিত্রের। বরং বলা যায় কিছু দৃশ্য পাশাপাশি রেখে দেওয়া হয়েছে, যেগুলো ভীষণ ন্যূনবাদী, প্রাত্যহিকের কিছু ঘটনা দিয়ে জোড়া যায় হাল্কাভাবে। তবে এমন একেবারেই নয় যে কার্যকারিতার সাধারণ সূত্র ছাপিয়ে এ আখ্যান রচিত।
আরও পড়ুন
বুঁমিকাকার জন্মগুলো
আরও পড়ুন
সপ্তম চরণ
এখানকার ভেড়াদের যেমন নেকড়েদের হাত থেকে বাঁচতে পালাতে হয়, ঠিক তেমনই এই উপত্যকার বাসিন্দারাও হয়তো কিছুদিন আগেই মাত্র এখানে এসেছে তাড়া খেয়ে। ঠিক যেভাবে ছবির একদম শেষাংশে সবে গড়ে তোলা আস্তানা-ঘরদোর-ঘরকন্নার জিনিস ফেলে রেখে হঠাৎ তাদের আবার ভেড়ার পালের মতো পালাতে দেখি ‘বন্দুকধারী’ নেকড়েদের ভয়ে।
সে অর্থে বলতে গেলে কিশোর-কিশোরীরাই এই ছবির মূল চরিত্র। তাদের মধ্যে এক কিশোরের নাম কুদরত। পরের ছবি দ্য অরফ্যানেজ-এর মূল চরিত্রের নাম কুদরাতোল্লাহ। এবারে তার বয়েস কুদরতের চেয়ে হয়ত দু’চার বছর বেশি। (অভিনেতার বাস্তব নাম কুদরাতোল্লাহ কাদরি।) এবার আর গ্রামীণ উপত্যকা নয়। এবার শহর। সে অমিতাভ বচ্চনের ভক্ত। বলিউডি ছবি দেখে আর চাবি বিক্রি করে। রাতের আস্তানা বলতে একটা পরিত্যক্ত গাড়ি। সময়টা ১৯৮৯ সাল। তখন আফগানিস্তানে সোভিয়েতপন্থী পিপল্স্ ডেমক্রেটিক পার্ট অফ আফগানিস্তান-এর সরকার। কুদরাতোল্লাহ ছবি দেখার পাশাপাশি ছবির টিকিট ব্ল্যাক করতে শুরু করে এবং ধরা পড়ে সোজা চালান হয় অনাথাশ্রম নাম্নী সংশোধনাগারে।
সেখানে সমবয়সী আরও অনেকেই থাকে। বয়সে একটু বড়োরা র্যাগিং করলেও, কর্তৃপক্ষ খুবই স্নেহবৎসল। খাওয়াপরার চিন্তাহীনভাবে আনন্দেই কাটে ওদের। ওরা নদীতেও স্নানে যেতে পারে। ওরা টিভি দেখে, টিভিতে আফগান-সোভিয়েত সৌহার্দের খবর শোনে। কুদরাতোল্লাহ আগে কখনো স্কুলে যায়নি, কিন্তু এখানে স্কুলে পড়তে হয়। থাকা-খাওয়ার এত উত্তম বন্দোবস্ত পেয়ে রাষ্ট্রপতি নাজিবুল্লাহর খবর তার মনে ধরে কিনা জানা নেই কিন্তু ক্লাসের সহপাঠিনীকে দেখে সে শক্তি ছবির অমিতাভ বচ্চন হয়ে পড়ে। স্মিতা পাতিলের চরিত্রে সহপাঠিনী। “আরে জানে ক্যায়সে কব কাহাঁ/একরার হো গয়া/হাম সোচতেহি রহে গয়ে/অওর পেয়ার হো গয়া”।
এমনকি ওদের মস্কো পর্যন্ত বেড়াতে নিয়ে যাওয়া হয়। ওদের দেখানো হয় লেনিনের সংরক্ষিত মরদেহ। ওরা ওখানে দাবা খেলে, এমনকি কম্প্যুটারের বিরুদ্ধেও। এমনকি ওদের মধ্যে কেউ আবার হারিয়েও ফেলে কম্প্যুটারকে। একদিন ওরা নদীতে গিয়ে একটা আগুন লেগে যাওয়া সোভিয়েত ট্যাঙ্কার দেখতে পায়। সেখান থেকে পায় এক বাক্স কার্তুজ। সেটাকে হস্টেলের ঘরে নিয়ে এসে পরীক্ষানিরীক্ষা চালাতে যেতেই বিস্ফোরণ। একটা কার্তুজকে গলার হারের লকেট করে পরে যে দোস্তের সঙ্গে সে জয় আর ভিরু সাজতে চেয়েছিল—সে শেষ।
এই হস্টেলের সুপারভাইজারের চরিত্রে যিনি অভিনয় করেছেন, তিনি আনোয়ার হাশিমি। তাঁরই অপ্রকাশিত ডাইরির পাতা থেকে তো সাদাত বানাচ্ছেন এই ছবিগুলো। যাইহোক, তারপর হঠাৎ একদিন মুজাহিদিনরা আসার খবরে রাতের অন্ধকারে সমস্ত নথিপত্র পুড়িয়ে ফেলে তারা। সকালে মুজাহিদিনরা এলে বোর্ডারদের বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিলেন সুপারভাইজার। কুদরাতোল্লাহর মধ্যে জেগে উঠল বলিউডি নায়কসত্তা। মসিহা-শহেনশা–কুদরত কিশোর কুমারের গানের তালে তালে সমস্ত দুষ্টু লোকেদের ঢিসুম ঢিসুম করে মেরে ফেলল।
আফগানিস্তানে তৈরি অথবা আফগানিস্তানি ছবির ইতিহাস এখনও সে অর্থে কৈশোর পেরোয়নি। অন্যান্য ধরনের ছবি তোলার কাজ আগে কিছু মাত্রায় হলেও, প্রথম আফগান ছবি তৈরি হয় ১৯৪৬ সালে। সামান্য কয়েকটা সিনেমা ঘরে বলিউডের ছবি চলে, অথবা হলিউডি র্যাম্বো থ্রি-র মতো ছবি। ইরানের বিশ্বখ্যাত পরিচালক মহসেন মখমলবাফের কান্দাহার (২০০১)-এর মতো আফগানিস্তানের বাইরে তৈরি হওয়া হাতে গোনা দু-একটি ছবি ছাড়া আফগানিস্তানকে আমরা চলচ্চিত্রে এখনো সেভাবে পাইনি। আফগান চলচ্চিত্র সংস্থা ১৯৬৮ সালে তৈরি হলেও আফগান ছবির নিজস্ব ভাষা খুঁজে পাওয়ার উপযুক্ত পরিবেশ আজও আফগানিস্তানে তৈরি হয়নি। অদূর ভবিষ্যতে সে সুযোগ আসবে এমন আশাও ক্ষীণ। কিন্তু নয়া-ঔপনিবেশিক শক্তি আর ধর্মীয় গোঁড়ামির তালেবানি নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে থাকা শাহরবানু সাদাতরাই কী সমকালের ম্যাজিক-লণ্ঠন নয়!
Powered by Froala Editor