মুড়ো, মুন্ডু, কল্লা

মুছে যায়? – ৯

আগের পর্বে

টুকলি, চোতা এগুলো আজ খুব পরিচিত হলেও; সত্তর দশকের গায়ে গায়ে লেগে ছিল শব্দগুলো। এম সেনের নোট, মেডইজি’র হাত ধরে কাগজ চলে আসত পরীক্ষার হলে। হাফ-ইয়ার্লি থেকে অ্যানুয়াল সবেতেই ছিল তার স্বতন্ত্র বিচরণ। পাশাপাশিই ছিল অমিয় স্যারের মতো টুকলি ধরায় দক্ষ গার্ডরাও। তবে তাঁদেরও নাস্তানাবুদ করে ছাড়ত দীপকের মতো ছাত্রেরা। টুকলির পাশাপাশিই ছিল ফিট করা উত্তর-লিখিয়েরা। স্কুল-কলেজ তো বটেই এমনকি মেডিক্যাল পরীক্ষাতেও বাইরে থেকে উত্তর লিখে এনে সাপ্লাই দেওয়ার চল ছিল সত্তরে।

মুড়ো, মুন্ডু, মাথা যাই বলি না কেন, অর্থ প্রায় কাছাকাছি। যদিও মুড়ো বললেই মাছ, খাসি নয়তো পাঁঠার কুর্তিত শির- ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন মুন্ডুটির ছবি চিত্রভাষা মনে পড়ে যায়।
অখন্ড বঙ্গভূমির পূর্ববঙ্গের ঢাকা, ফরিদপুরে একটি অতি চেনা প্রচলিত কথা চালু ছিল -
আড়ের মুড়া ঘেইরত মুড়া
দাও আইন্যা জামাইয়ের পাতে
রুইয়ের মুড়া কাষ্ঠ মুড়া
দাও আইন্যা আমার পাতে...।

এই চেনা ছবিটি পঞ্চাশের দশকে, হিন্দু বাঙালির মধ্যাহ্নভোজনের খণ্ডচিত্র মাত্র। অবশ্যই যারা সম্পন্ন, তাদের বাড়ি কল্পনা করে নিতে পারি বড়, কাঁসার বগি থালায় চুড়ো করা সুগন্ধি গোপালভোগ বা বালাম চালের ভাত। যাকে কখনও কখনও 'অন্ন' বলে উল্লেখ করে থাকেন বিষ্ণুমন্ত্রী-- বৈষ্ণবরা, কৃষ্ণমন্ত্রীরাও। চাল থেকে 'অন্ন' মূলত হয়ে ওঠে ফুটে উঠবার পর। আগুনে শুদ্ধ পাত্রে,  সেই বাসনটি পিতল নয়তো পোড়ামাটির তৈরি।
থাক বালাম, চামরমণি, গোপালভোগ, কাটারিভোগ - এই সব চাউলের কথা। আমরা আবার মুড়োয় ফিরি। সেই যে ছবিটির কথা বলেছিলাম - 

পাশাপাশি আহার-- মধ্যাহ্নভোজনে বসেছেন জামাই বাবাজীবন ও শ্বশুরমশাই। বড়ো খাগড়াই বা বিষ্ণুপুরী কাঁসার থালায় চুড়ো করা ভাত। গরম ধোঁয়া ওড়ানো, তার ভিতর পিতলের ছোট্ট বাটিতে ঘি - হালকা সোনালি-হলুদ গাওয়া ঘি গব্য ঘৃত, ভাতের পাশে নুন লেবুর টুকরো।
আলাদা আলাদা পদ্মকাঁটা খাগড়াই বা বিষ্ণুপুরী যাকে বিষ্টুপুরীও বলা হয়ে থাকে, সেই কাঁসার বাটিতে মাছ, মাংস, ডাল, তরকারি। পায়েস আলাদা বাটিতে৷ সুগন্ধি চালের পায়েস। একসের দুধে এক ছটাক সুগন্ধি চাল, এমন হিসেব পায়েস নির্মাণে। আর খাগড়াই কাঁসার বাহারি, ভারি গেলাসে খাওয়া জল। শীতকালে হলে পায়েসে খেজুড়গুড়, গ্রীষ্মদিন হলে চিনি। 

আখের গুড়ের পায়েস হত এই বঙ্গে। সরস্বতী পুজো- শ্রীপঞ্চমীর একদিন ছেড়ে, মাঘি সপ্তমীর ব্রত। সেই অনুষ্ঠান শাশুড়ি মা ছেলের বউদের নিয়ে করতেন। আখের গুড়ের পায়েসের ভেতর ছোট ছোট 'পুলি' তৈরি করে দেওয়া হত। পূর্ব বঙ্গে চালের পায়েস। সিমাই বা সিমুই, সুজির পায়েস এই বঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গে। অখণ্ডবঙ্গের ইসলাম ধর্মের মানুষ যাঁরা আছেন তাঁদের সিমাই বা সিমুই রান্না অনবদ্য। নারকেল দুধের পায়েস করেন তাঁরা, গাই দুধেরও।
ইদানীং হিন্দু, মুসলমান-- সবাই প্যাকেট দুধ ব্রতী। ইদানীং মানে অন্তত তিন দশক। তার আগে হরিণঘাটার বোতলবন্দি দুধ।
হিন্দু মুসলমান সকলেই গরুর দুধ, মোষের দুধ ব্যবহার করেছেন, করতেন, করেন। কিন্তু নারকোল দুধের- নারকোল কোরা থেকে বের করে আনা দুধের জাদু ইসলাম ধর্মের নারীরা জানেন। ঐ তরিকা হিন্দু রমণীদের আয়ত্তের বাইরে। ঈদের লাচ্ছা পরোটা, সিমাই বা সিমুই,  থাক থাক ভাঁজে ভাঁজে তৈরি লাচ্ছা পরোটা, 'বড়ো' ও 'ছোট' গোশত সেইসঙ্গে পক্ষী মাংস-- 'রামপাখি'-- রান্না করা মুরগী-মোরগ। ইসলাম ধর্মাবলম্বী নারীর হাতের গুণে স্রিফ উঙ্গলিয়া চাটতে রহে যাওগে, এই অনুভব তৈরি হতে থাকবে।

আরও পড়ুন
টোকাটুকি, টুকলি, চোতামারা

ময়দা দিয়ে তৈরি হয় চষি। ছোট ছোট পুরনোদিনের শাদা রঙের  শাপবাজি যেন এমন চেহারার চষি তৈরি করেন হিন্দুনারী। ইসলাম কবুল করা বালাদের এই তরিকায় পায়েসের উপকরণ নির্মাণ, আমার অন্তত চোখে পড়েনি। তো চষিরও পায়েস হত পূর্ব ও পশ্চিমবঙ্গে। মেয়েরা চষি বানিয়ে রোদ্দুরে দিতেন, থালার ওপর শুকিয়ে গেলে তারপর তা দিয়ে পায়েস।
পায়েসের মিষ্টত্ব আনানোর জন্য চিনি, গুড়ের বাতাসা, মিছরি, খেজুর গুড় বা খেজুর পাটালির ব্যবহার দুই বঙ্গেই রয়েছি, সেই ১৯৪৭-এর আগে পর্যন্ত। বাস্তুপুজোয় অবশ্য হিন্দু নারীরা আখি বা এখো আরো স্পষ্ট করে বললে আখের গুড় ব্যবহার করতেন।
চাল, সুজি, চষি, সিমাই ছাড়াও লাউয়ের পায়েস হয়৷ কচি লাউ দিয়ে পরমান্ন, আহা কী চমৎকার। শ্রীচৈতন্যদেব পছন্দ করতেন লাউয়ের পায়েস।
কথা হচ্ছিল মুড়ো নিয়ে।
মাছের মুড়ো, বাঙাল শ্বশুর ছড়া সংকেতে তাঁর স্ত্রী জামাইয়ের শাশুড়ি মাতা কে বলছেন কোন মাছের মুড়ো কার পাতে দিতে হবে৷
কচি পাঁঠা বৃদ্ধ মেষ
দধির অগ্র ঘোলের শেষ।
দু লাইনের ছিকুলিটি আমরা জানি অনেকেই। কচি পাঁঠা বা চর্বিদার বৃদ্ধ মেষের মুন্ডুটি ধড় থেকে কেটে দেওয়ার তার ছাল বাকল ছাড়িয়ে রান্না করলে স্বাদে অপূর্ব। একই গুণ কর্তিত খাসির মুণ্ডেও রয়েছে। 

তথাকথিত 'প্রান্তিক', 'অপরজনেরা' পাঁঠা, খাসি বা ভেড়ার মুন্ড উপভোগ করেন, তাড়িয়ে তাড়িয়ে খান। ষাটের শেষ দিকে একটা বড়সড় খাসি বা পাঁঠার মুড়ো দেড় টাকা বড়জোর। সেই কল্লা অবশ্য একেবারে পুঁচিয়ে কাটা, অ্যাতটুকু অতিরিক্ত মাংস নেই তাতে। হিন্দিভাষী মানুষরা একে বলেন 'মুড়ি'।
ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে হাওড়ার বালিতে বালি বাজারে একটা বড়সড় ঘেড়ো কাতলার মুড়ো চার আনা - পঁচিশ নয়া পয়সা। বিগ সাইজ রুইয়ের মুড়োতেও তাই। মাছের মুড়োর রাজা কাতলা। তারপর রুই। ইলিশের মুড়ো একমাত্র পুঁইশাকে, বেগুন আর কুমড়োর সঙ্গে দিলেই জমে গেল।
খাসি বা পাঁঠার মুড়ো থেকে বার করা ঘিলু, রন্ধনের পর অমেত্ত যেন। ব্রেন চপের মূল উপাদানও এই পন্টক 'ঘিলু'। 'পণ্টক' শব্দটি নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা থেকে ধার করলাম৷ নারায়ণবাবুর লেখনী যুক্তি - কন্টক থেকে কাঁটা, তাহলে পণ্টক থেকে পাঁঠা৷ 

আরও পড়ুন
ছিটকিনি পাইপগান ক্রমশ ক্রমশ...

বাংলাদেশে দেখেছি জাহাজ-স্টিমার ঘাটায় রান্না করা পাঁঠার মুন্ডু। বেশ কষান, ঝাল ঝাল। দর্শনেই বুঝা যায়। বোঝা যায় নয়, বুঝা যায়। এই স্টিমার যাত্রা বরিশাল থেকে ঢাকা।
ইলাহাবাদের কর্নেলগঞ্জ বাজার অনেকটাই বাঙালি ভিড়ে ঠাসা। ইলাহাবাদের জর্জ টাউন, টেগোর টাউন, মুঠঠি গঞ্জ, অ্যালেনগঞ্জ - কর্নেলগঞ্জ, ছাড়া এই সব এলাকাতেও প্রতিপত্তি বাঙালিদের। তাঁরা কেউ জজসাহেব, কেউ ব্যারিস্টার, বড় ভকিলসাব - উকিল সাহাব বা ডাগদার বা ডাক্তার বাবু, অধ্যাপক, অফসর, ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মানুষজন, প্রফেসর সাব, এ জি অফিসের বড় অফসর- অফিসার - সব এখানে।
কর্নেলগঞ্জে মাছের বাজারটি চমৎকার। সেখানে যমুনার কালি আড় - কালো আড়, বোয়াল, বাঁশপাত্তি, টেংরা-ট্যাংরা-রেকদার, বুজুরি ট্যাংরা - যা এখন বিষক্ত রাসায়নিক সারের প্রকোপে প্রায় অদর্শন পর্যায়ে। কারণ বুজুরি ট্যাংরা যে যে জলায় মেলে এ বঙ্গে, তার আশেপাশে বিষের প্রয়োগ কৃষিজমিতে ঢালাও

ফলে ইলাহাবাদে আড়কেও টেংরা বলে। ইলাহাবাদের কয়েক কিলোমিটার দূরে ফাঁপামৌয়ের হাটে খুব টাটকা তরকারি এবং মাছ পাওয়া যায়। এছাড়াও বোয়াল, রুহু মাচ্ছি - রুই মাছ, কাতল - কাতলা। বড় সাইজের রুই, কাতলা লখনউ থেকেও আসে। নবাব ওয়াজিদ আলি শাহর স্মৃতি ঝুমঝুম লখনৌয়ের গোমতী নদী থেকে৷ আর পাওয়া যায় কালবাউশ বা কালবোশ, কখনও মৃগেল। 

আরও পড়ুন
চান্দ্রায়ণ

চিংড়ি মাছ ইলাহাবাদে 'ঝিঙা মাচ্ছি'। তখনও, আমি ১৯৬৭-৬৮ সালের কথা বলছি, কি তার একটু পরেও, 'পাও ভর' - আড়াইশো গ্রাম মাছ বা অন্য জিনিস চান খরিদ্দার দোকানির কাছে।

বাঙালিদের সম্বন্ধে ইলাহাবাদে যা চালু ছিকুলিটি শুনেছি, তা এরকম -
ধোতি পহনে ঢিলি ঢালি
ভাত উড়াওয়ে থালি থালি
সড়ি মছছি পিলপিলা ভাত
বঙ্গালি মারে লম্বা হাত
সড়ি বা সড়া অর্থে পচা। পিলপিলা মানে সরু। অন্য অন্য হিন্দি শব্দের অর্থ আশা করি করে দিতে হবে না।  

আরও পড়ুন
পান-বিড়ির গুমটি

ইলাহাবাদে মছছি বাজার - মাছের বাজারেই মিট - খাসি, পাঁঠার মাংসের  দোকান। ঝটকা, জবেহ বা জবাই করা পাঁঠা বা খাসির মুন্ডু একটা তিন টাকা বড়জোর - ১৯৬৭-৬৮ সালে। কলেজি -কালিপোক - গুরদা কেটে নেওয়া পাঁঠার বিভিন্ন অংশের নাম। কলেজি - কালিপোক অর্থে মেটে, যা দিয়ে চমৎকার মেটে চচ্চড়ি। ১৯৬৭-৬৮তে ইলাহাবাদ কর্নেল গঞ্জ বাজারে পাঁঠার মাংস, খাসিও তিরিশ টাকা এক কিলো৷ 

পাঁঠার অণ্ডকোষটিও স্বাদু খাদ্য হিসেবে অত্যন্ত লোভনীয়। 

আরও পড়ুন
ঋতু, ঋতুবন্ধ – ঋতুসংহার

মাছের মুড়ো সবচেয়ে ভালো ও স্বাদু কাতলার। তারপর রুই। আড়, বোয়াল, ভেটকির মুড়ো সেই অর্থে জিরো৷ বড় ভেটকির কাটা, বা মুন্ডু বা মুড়ো দিয়ে কাঁটা চচ্চড়ি হতে পারে। নিউ মার্কেটে - হগ সাহেবের বাজারে মুড়ো সত্ত্বেও ভেটকির কাঁটা, মুড়ো বিক্রি হত ষাট দশকে, সত্তর দশকেও। সরু, লম্বা, পাতলা, ধারালো ছুরিতে ভেটকির ফিলে বার করার পর কাঁটা, আহা কি যে তার স্বাদ চচ্চড়ি করলে। গা মাখা মাখা, কষা। এই কাঁটার দাম দশ টাকা বড়জোর।

সেই কাঁটা ষাট দশকে আট-দশ টাকা। ষাট দশকে বালি বাজারে কচ্ছপের মাংস ছ'আনা-- সাইত্রিশ নয়া পয়সা কিলো। মূলত ওড়িয়ারা কচ্ছপ কেটে বিক্রি করেন। মাংস, কচকচে বাদি, তেল, ডিম। ডিলিশাস৷ ষাট দশকে খাসির মাংস এক কিলো পাঁচ সিকে - এক টাকা চার আনা। 

কাটা পোনা আড়াই,  তিন টাকা কিলো। কাতলাও তাই। কাতলা -রুইয়ের মুড়ো দিয়ে ঘন মুগ ডাল। আদা-জিরে বাটা, তেজপাতা, গরম মশলা - থেঁতো করে। কি যে তার স্বাদ!

হিন্দু বাঙালি বিয়েবাড়ির সকালের খাওয়ায় ছ্যাঁচড়া অবধারিত। তবে কাতলা, রুইয়ের তেল, পোঁটকা। কুমড়ো, বেগুন, পুঁই শাক আছে সঙ্গে।

বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ে মানসাঙ্ক করাতেন রেণুবাবু৷  মানসাঙ্ক মুখে মুখে কষতে হয়। তখন শ্রুতিলিখনের ক্লাসও ছিল৷ মাস্টার মশাই পাঠ্য বই থেকে দেখে দেখে পড়তেন। ছাত্র - ছাত্রীরা লিখত। মানসাঙ্ক, শ্রুতিলিখন - সবই ষাট দশকে, প্রাইমারি- প্রাথমিক বিভাগে।

মানসাঙ্ক করতে গিয়ে রেণুবাবু জানতে চাইতেন, এক পোয়া পোনা - কাটা পোনার দাম বারো আনা হলে একসের কাটাপোনার দাম কত? ততদিনে সের, পোয়া, ছটাক উঠে গেছে। গজ, ফুট, ইঞ্চি বাতিল৷ ফুটো পয়সা, পাই পয়সা,  আধলা- আধ পয়সা, এক পয়সা,  ডাবল পয়সা, আনি দো আনি, সিকি - চার আনা, আধুলি - আট আনা, টাকা - পুরো এক টাকা সবই প্রায় বাতিল৷ তবু রেণুবাবু ক্লাসে প্রায় সব সময়ই ঝিমোতে ঝিমোতে কাটা পোনা, পাকা পোনার কথা বলেন। কত আর মাইনে তখন প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, প্রাইমারি টিচারদের। তাও নিয়মিত মাইনে হয় না! বালি জোড়া অশ্বত্থতলা বিদ্যালয়ে প্রাইমারি সেকসানে গোপালবাবু, শরৎবাবু - শরৎ সরকার, বিজয়বাবু, রেণুবাবু, নন্দবাবু, রাজমোহনবাবু। হেড স্যার শশীভূষণ মহাপাত্র।

রেণুবাবুর স্বপ্নে কি পাকা পোনার পেটি? হয়ত কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই। হয়তো কেন, নেই-ই। গায়ের রং ময়লা। মাথার চুলে পাটের ফেঁসোর রং। মলিন ধুতি, হাফশার্ট, ছিটের। ঘোলা দৃষ্টি আগলান ঘোলাটে চশমা। পায়ের জুতোয় তাপ্পি৷ গালে পাকা দাড়ি, দু-এক দিনের না কাটা। দু চোখে ঘুম ঘুম ঝিমুনি।

সে যাক গে, আবারও ফিরি মুড়োয়। ইলিশ মাছের মুড়ো স্বাদু। পুঁইশাকে অন্যতম সুখজাগানিয়া আইটেম।

ইলিশের মুড়ো আর ল্যাজা দিয়ে পাকা তেঁতুলের অম্বল, আহা! পুঁটি মাছ, শোল মাছ দিয়েও টক হয়। মেদিনীপুরে শুকনো আমচুর আর শোল দিয়ে আম শোল। দে'জ পাবলিশিংয়ের কর্ণধার সুধাংশুশেখর দে-র 'ধর্মপত্নী' রীতাঞ্জলি দে, আমাদের অতি আদরের টুকু, অসাধারণ রাঁধেন এই আমশোল।

পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে একবার এত ইলিশ উঠেছিল গঙ্গায়, যে মাছ প্রচুর সস্তা হয়ে গেল। কারণ, তখন তো আর বাড়ি বাড়ি এত ফ্রিজের ব্যবহার নেই। শোনা যায় ইলিশের মুড়ো মাটির নীচে পুঁতে দেওয়া হল রান্না করতে গেলে তেল লাগবে বেশি, এই ভয়ে।

গলা কাটা পাঁঠাকে 'ভাঙা পাঁঠা', মাছকে 'পাচ' বলা জনৈক এখন অনেক কিছু লেখেন টেখেন। তাঁর স্মৃতিতেই কালীঘাটে কালিমন্দিরের দেবীকে উচ্ছুগগু - উৎসর্গ করা মাংস- বলি দেওয়া পাঁঠার মুন্ডুর সঙ্গে গলাও থাকে৷ অর্থাৎ মুড়োর সঙ্গে অনেকটা মাংস। 'বৃথা' মাংস নয়। আগেকার বহু ব্রাহ্মণ পরিবারে 'বৃথা' মাংস খাওয়ার চল ছিল না। যা বাজারে ক্সাইয়ের হাতে কাটা মাংসের কল্লায় - মুড়োতে একেবারেই থাকে না। কালীঘাটে কালীমন্দিরে বলি দেওয়া পাঁঠার থিকথিকে এঁটুলি। সেই কালো, শক্ত এঁটুলিরা জ্যান্ত থাকে। মুড়ো কিনে এনে লোম বেছে পরিষ্কার করে তারপর রান্না, অবশেষে খাওয়া। 

গলদা চিংড়ির মুন্ডু বা মুড়ো বেশ রসদার, রসনদারও। রান্নার পর, ছাঁকা তেলে ভেজে তার মস্তিষ্ক গভীরে জমে থাকা সুস্বাদু, হলুদ হলুদ ঘিলু - ঘি, কী যে চমৎকার খেতে!

হিন্দু বাঙালি মুড়িঘণ্ট, মুড়োঘণ্ট নির্মাণে বেশ দড়। সেখানেও কাতলা মাছের মুড়ো, সেউ রান্নার তরিবত আলাদা রকমের। জিভের তার ডেকে আনতে, স্বাদ বোধের যে রসনা বিন্দুরা আছে, তাদের উসকে দিতে মুড়ি ঘণ্টের বিকল্প খুব কমই আছে।
মুড়িঘণ্ট ঠিকঠাক হলে উড়ে যাবে একথালা ভাত শুধু এই মুড়ো + ঘণ্ট = মুড়িঘণ্ট দিয়ে।
কাতলা বা রুইয়ের বড় মুড়োয় বড় বড় আলু কেটে গরম মশালা, তেজপাতা, আদা-জিরে কাটা দিয়ে সে এক অতি চমৎকার ডালনা। কী তার সোয়াদ।
ভাবলেই তো রসসিক্ত হয় রসনা, আজও।

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor