দুর্যোধনের কথায় চিন্তিত ধৃতরাষ্ট্র, নিষেধ করলেন দ্যুতক্রীড়ায় জড়াতেও

মহাভারতে রাজনীতি -৩৪
আগের পর্বে

ভীষ্মের পরামর্শ অনুযায়ী যুধিষ্ঠির পুরুষশ্রেষ্ঠ সম্মান জানালেন কৃষ্ণকে। এতে রাজাদের অনেকেই ক্ষুব্ধ হলেন। চেদিরাজ শিশুপাল এগিয়ে এসে প্রতিবাদ জানালেন। কৃষ্ণ বুঝতে পারলেন শিশুপালের নেতৃত্বে রাজারা তাঁকে আক্রমণ করতে উদ্যত হবেন। তিনি তখন সুদর্শন চক্র দিয়ে শিশুপালের মুণ্ডচ্ছেদ করলেন। অন্যদিকে একলব্য এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলেন না। কিন্তু দুর্যোধন তাঁকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিলেন। হস্তিনাপুর ফেরার পথে দুর্যোধনের দুঃখের কারণ জানতে চাইলেন শকুনি। দুর্যোধন জানালেন তিনি বসুন্ধরা জয় করতে প্রস্তুত। কিন্তু একলব্য ও শকুনি দুজনেই তাঁকে সম্মুখ সমরে যেতে বারণ করলেন। শকুনি অপেক্ষা করছিলেন যুধিষ্ঠিরের রাজা হওয়ার। কারণ এবার তাঁকে দ্যূতক্রীড়ায় আহ্বান জানানো যেতে পারে। হস্তিনায় ফিরে তিনজন গেলেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের কাছে। শকুনি জানালেন, দুর্যোধনের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন।

শকুনি হো হো করে বলে উঠলেন, মহারাজ চোখের সঙ্গে আপনার শ্রবণেন্দ্রিয়ও কাজ করছে না। আমার ভাগিনেয় দুর্যোধন শোকে-দুঃখে পাণ্ডুবর্ণ ও কৃশ হয়ে পড়ছেন, কোনও শত্রু এই শোকের কারণ, আপনি অনুসন্ধান করুন। 

ধৃতরাষ্ট্র দুর্যোধনকে ডেকে বললেন, হে পুত্র! তোমার এই শোকের কারণ কী? মহৎ ঐশ্বর্য, রাজচ্ছত্র সব তোমাকে দিয়েছি। উত্তম বসন পরিধান করছ, সমাংস অন্ন ভোজন করছ, উৎকৃষ্ট অশ্বে আরোহণ করছ, মহার্ঘ্য শয্যায় নিদ্রা যাচ্ছ, মনোরমা নারীবৃন্দের সঙ্গ করছ, উত্তম বাসগৃহে ক্রীড়া করছ, বিহারস্থানও তো মন্দ নয়; তবুও দীনের মতো শোক করছ কেন?

দুর্যোধন উত্তর দিলেন, আমি কাপুরুষের মতো এই সব ভোগ করছি। এই সব তো সাধারণ মানুষের চাহিদা পিতা! ওদিকে আমার শত্রুরা দিনে দিনে সমৃদ্ধ হচ্ছে আর আমি হীন থেকে হীনতর হচ্ছি; এই সব কারণে বিবর্ণ ও কৃশ হয়ে পড়ছি আমি।

একলব্য বলে, জানেন মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র! যুধিষ্ঠির অষ্টআশি হাজার স্নাতক গৃহস্থের প্রত্যেককে ত্রিশটি করে দাসী দিয়েছেন। লক্ষ লক্ষ লোক তাঁর গৃহে স্বর্ণপাত্রে রোজ ভোজন করে, তাঁর সম্পদ দেখলে আপনার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

ধৃতরাষ্ট্র বুঝতে পারলেন কী কারণে দুর্যোধনের এত শোক। তিনি পুত্রকে কাছে ডেকে তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। 

দুর্যোধন পিতাকে জানালেন, মহারাজ, আমার মাতুল মহাজ্ঞানী শকুনি দ্যুতক্রীড়ায় পাণ্ডবদের আহ্বান করতে চান, আপনি অনুমতি দিন।

আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরের রাজলক্ষ্মী-কে তুলে দেবেন দুর্যোধনের হাতে, প্রস্তাব শকুনির

ধৃতরাষ্ট্র জবাব দিলেন, ভালোই তো, খেলাধূলা খুব ভালো জিনিস।

একলব্য বলল, মহারাজ, এই পাশাখেলা হবে দান রেখে! পাণ্ডবদের ঐশ্বর্য হরণ করাই এই খেলার উদ্দেশ্য।

ধৃতরাষ্ট্র চীৎকার করে উঠলেন, কী জুয়াখেলা হবে?

আরও পড়ুন
শুরু হবে রাজসূয় যজ্ঞ, কৌরবদের কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করলেন যুধিষ্ঠির

দুর্যোধন বললেন, শান্ত হন মহারাজ। পাশা, যুদ্ধ সব তো এক। দ্যুতক্রীড়া হবে বালকদের ক্রীড়ার ন্যায়, সে তো শোভন নয়। আপনি অনুমতি দিন।

ধৃতরাষ্ট্র জানালেন, আমি এক্ষুনি তা পারব না। আগে বিদুরের সঙ্গে পরামর্শ করি, তাঁর উপদেশ মতো আমি চলি। তিনি দূরদর্শী ও ধার্মিক।

একলব্য জ্বলে উঠল, ধার্মিক! তা বটে! নইলে কি আর আমার সঙ্গে অত সুন্দর আচরণ করেন! মহারাজ, বিদুর বারণ করবেন। পাণ্ডবরা পরাজিত হোক, তিনি তা চান না কারণ তিনি ওই পক্ষের।

আরও পড়ুন
জরাসন্ধকে একা পেলে তবেই হত্যা, পরিকল্পনা আঁটলেন কৃষ্ণ

ধৃতরাষ্ট্র একলব্যকে বললেন, বড়দের সম্মান দিয়ে কথা বলো নিষাদপুত্র।

একলব্য জবাব দিলেন, আপনি-আজ্ঞে করেই তো বলছি। যখন আমার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে নেওয়ার ষড়যন্ত্র করেন ভীষ্ম-বিদুর-দ্রোণেরা, তখন স্নেহ-মায়া-মমতা-মনুষ্যত্ব কোথায় ছিল তাঁদের যে সম্মান জানাব!

দুর্যোধন বললেন, তুমি থামো নিষাদ! আমি মরি, পিতা বিদুরকে নিয়ে সুখে থাকুন।  

আরও পড়ুন
যুধিষ্ঠিরকে কীভাবে রাজা বানানো যায়? নারদের কাছে পরামর্শ চাইলেন সহদেব

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, বালাই ষাট, আমি থাকতে তুমি কেন মরবে পুত্র! আমি বলছিলাম ধর্মের কথা!

একলব্য বলল, ক্ষত্রিয়ের ধর্ম যুদ্ধ করা। পাণ্ডবদের সঙ্গে পাশা না খেলে ক্ষত্রিয়ের ধর্ম অনুযায়ী যুদ্ধ করলে আপনি অনুমতি দেবেন হে ধৃতরাষ্ট্র?

শকুনি জানালেন, যার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ নেই সে করবে যুদ্ধ? 

একলব্য উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আসুন দেখি কে লড়বে আমার সঙ্গে আমার সঙ্গে। তার পর দুর্যোধনের উদ্দেশে জানালেন, হে রাজেন্দ্র! আমরা ওদের আক্রমণ করে খাণ্ডব বনের উপর গড়ে ওঠা সভা কেড়ে নেব; তার পর আবার রচনা করব অরণ্য। তবে একটা শর্তে, ভীষ্ম-বিদুর-দ্রোণের সংস্পর্শ আপনাকে ত্যাগ করতে হবে।

ধৃতরাষ্ট্র বললেন, ওহ, আবার যুদ্ধের কী দরকার! অনর্থক রক্তপাত হবে তাতে। দুর্যোধনের ওই রকম সভা দরকার তো? শিল্পীদের ডাকো, মনোরম সভা নির্মাণ করুক! হে পুত্র দুর্যোধন, তুমি পৈতৃক রাজ্য পেয়েছ, তাও এত শোক করছ কেন?

দুর্যোধন চুপ করে রইলেন।

একলব্য বললেন, পাণ্ডবসভায় দুর্যোধন কী রকম বিড়ম্বনা আর উপহাস ভোগ করেছিল তা যদি আপনি দেখতেন তাহলে বুঝতেন শোকের কারণ কী! 

ধৃতরাষ্ট্র উচ্চারণ করলেন, যুধিষ্ঠির তো দুর্যোধনের উপর বিদ্বেষ করে না! তাঁর যেমন অর্থ, মিত্রবল আছে তেমনি দুর্যোধনেরও আছে। তবে ভ্রাতার সম্পত্তি হরণ করার বাসনা কেন! ধর্মের পথে থাকো পুত্র, অধর্ম থেকে নিবৃত্ত হও। ওই লোভ আর বিদ্বেষ হল অধর্ম। আমি বিদুরকে ডেকে পাঠাচ্ছি, সে যা বলার বলুক।

দূত গিয়ে বিদুরকে ডেকে আনল। সব কথা শুনে তিনি বললেন, কলি তিন জায়গায় প্রবেশ করে—স্বর্ণ, বেশ্যাখানা ও জুয়ার আসরে। দুর্যোধন ও তাঁর মাতুল কলিকে আমন্ত্রণ করে ডেকে আনছেন। এর ফলাফল হবে মারাত্মক—ক্ষত্রিয়নাশের আর বাকি নেই। আমি স্পষ্ট চোখে অহিত দেখতে পাচ্ছি। 

একলব্য বললেন, হে দাসীপুত্র! তবে তো রাজার স্বর্ণমুকুট ফেলে দিতে হয়, নগরের দক্ষিণপ্রান্তে যে গণিকালয় আছে তাকে অগ্নিদগ্ধ করা প্রয়োজন। 

বিদুর নীরব হয়ে বসে রইলেন। ধৃতরাষ্ট্র একটু চিন্তা করে বললেন, নিষাদপুত্র যথার্থ বলেছেন। বিদুর, তুমি শীঘ্রগামী রথে চড়ে ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে ডেকে আনো। দৈব চায়, দ্যুতক্রীড়া হোক। 

বিদুর মনের দুঃখে বিড়বিড় করতে লাগলেন, পুরুষকার নেই, আছে কেবল দৈব-বীজ; সঙ্গে বদমাইশি। 

তার পর ভীষ্মের কাছে চলে গেলেন।

সকলে নীরব। একলব্য সেই স্তব্ধতা ভাঙলেন এই বলে, যুধিষ্ঠির কী বলেন তার জন্য অপেক্ষা করা যাক!

অম্বিকানন্দন ধৃতরাষ্ট্র পুত্র দুর্যোধনকে ডেকে বললেন, আমি পুনরায় বলছি যে দ্যুতক্রীড়ায় যেও না। বিদুর বলছেন তাতে অহিত হবে। দেবগুরু বৃহস্পতি দেবরাজ ইন্দ্রের কাছে যে গূঢ়শাস্ত্র বলেছিলেন তার সবটাই বিদুর জানেন। তাই তাঁর উপদেশ মান্য করো। দ্যুতক্রীড়ায় ভেদ হবে, ভেদ হলে রাজ্য নষ্ট হবে। উদ্ধব যেমন বৃষ্ণিবংশের শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রজ্ঞ তেমনি কুরুবংশের প্রধান হলেন বিদুর।  

একলব্য বলল, বিদুর যদি শ্রেষ্ঠ শাস্ত্রজ্ঞ হবেন তবে তিনি দেবব্রত ভীষ্মের কাছে কোন কূটকৌশলের জন্য গেলেন!

ধৃতরাষ্ট্র জানালেন, ভীষ্ম আমাদের মধ্যে প্রবীণ তাই তাঁর কাছে যে কোনো সমস্যায় যাওয়া কুরুবংশের রীতি। তিনি আমাদের সদুপদেশ দেন।

একলব্য প্রশ্ন করে, আমার বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ কেটে নেওয়ার হুকুম বুঝি সদুপদেশ ছিল?

ধৃতরাষ্ট্র বলেন, সে ঘটনা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো নিষাদপুত্র। আজ তুমি হস্তিনার দয়াতে ভালো খাদ্য উত্তম পরিধান তো পাচ্ছ!

দুর্যোধন বললেন, ভালো খাওয়া আর ভালো পরা জীবনের সব নয় পিতা। একলব্যের সঙ্গে অন্যায় ও অধর্ম হয়েছিল। আমার প্রতিও সেই ষড়যন্ত্র করছেন দাসীপুত্র বিদুর ও গাঙ্গেয় দেবব্রত। সাধারণ রাজলক্ষ্মীতে আমি সন্তুষ্ট নই, যুধিষ্ঠিরের উজ্জ্বল রাজলক্ষ্মী আমার চাই। আকাশে দুটি চন্দ্র থাকে না, একটিই থাকে। শুনুন, বৃহস্পতি বলেছেন, রাজার আচরণ সাধারণের থেকে পৃথক। খেয়েদেয়ে রাজা সন্তুষ্ট হন না, হন সাধারণ মানুষ। জয়লাভ ক্ষত্রিয়ের বৃত্তি, ধর্মাধর্ম সেখানে গৌণ; তবে তো রাজপদ ছেড়ে দিয়ে সন্ন্যাসী হয়ে যেতে হয়! বৃত্তি সমান হলে শত্রু হয়, যেমন ভীষ্ম-বিদুর-দ্রোণ অর্জুনকে শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর বানাবেন বলে অধর্মকে আশ্রয় করে একলব্যের প্রতিভাকে হত্যা করেছেন।  

একলব্য ধৃতরাষ্ট্রকে জিজ্ঞাসা করেন, মহারাজ! যুদ্ধ, রক্তপাত, হত্যা চান; নাকি শান্তিতে ফয়সালা?

শকুনি এবার মুখ খোলেন, সেনার সম্মুখীন না হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে পাশা খেলে যদি জয়-পরাজয় ঠিক হয় সে তো অতি উত্তম। যুধিষ্ঠির সম্মত হলে সেটিই হিত হবে। ধৃতরাষ্ট্র ও বিদুর কেন বাধা দিয়ে অহিত ডেকে আনছেন তা আমি বুঝতে পারছি না। সমস্তটা যুধিষ্ঠিরের উপর ছেড়ে দিন। 

একলব্য বলেন, সারিধর্ম অনুসারে রাজধর্মের শুরুতে শত্রুদের সঙ্গে সামের কথা ভাবতে হয়।

দুর্যোধন খেঁকিয়ে ওঠেন, কীসের সাম? যে কেউ এসে রাজ্যের ভাগ চাইলে তাকে দিয়ে দেব নাকি! আজ ওরা পাঁচখানা গ্রাম চাইছে কেন, তুমি কী ভেবেছ যে ওরা পাঁচটি গ্রাম নিয়ে সন্তুষ্ট থাকবে! পাঁচ খানা গ্রাম দিয়ে দিলে ল্যাঠা যদি চুকেই যেত, দিয়ে দিতাম। ওরা বহিরাগত, এখন ছুঁচ হয়ে ঢুকবে; তার পর একদিন ফাল হবে পাণ্ডবরা।

Powered by Froala Editor

More From Author See More