‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে...’

মুছে যায়? – ১২

আগের পর্বে

ঘড়ি বলতেই সুইস মেড। সুইডেনের পরে এই ব্যবসায় আসে জার্মানি, জাপান, ব্রিটিশ, ফরাসি, আমেরিকানদের কথা। সাহেবরাই বেঁধে দিয়েছিলেন ঘড়ি পরার নিয়ম। মেয়েদের বাঁহাতে, ছেলেদের ডানহাতে। লালবাজারের লাগোয়া রাধাবাজারে ছিল সার দিয়ে ঘড়ির দোকান। তবে মারামারিতে কাচ ভাঙা লেগে থাকত হামেশাই। পঞ্চাশের দশকে পরিচিত ছিল পকেট ঘড়িও। মহাত্মা গান্ধীর ট্যাঁকঘড়ি ছিল দেশ বিখ্যাত। টেবিল ঘড়ি বা টাইমপিস চালু হল ষাটের দশকে। উত্তর কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটে ছিল সার দিয়ে ঘড়ি সারাইয়ের দোকান। লাগানো হত প্লাস্টিক প্রোটেক্টর। আশি-নব্বইয়ের দশক থেকে কমে আসে দম দেওয়া ঘড়ির চল, বাড়ে ব্যাটারি চালিত ঘড়ির ব্যবহার। বাজারে চিনা ঘড়ি ছেয়ে যাওয়ায় বন্ধ হল ঘড়ি সারাইয়ের ব্যবসা।

‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে দাঁতের মাজন।’
এই কবিতার লাইন পড়েছিলাম সত্তর দশকে, এক পা ঘরে এক পা জেলে, নয়ত এক পা গোপন শেল্টারে আর এক পা থানা লক আপে রেখে।
‘কালের কবিতা’ সম্পাদনা করেছিলেন কবি দীনেশ দাসের পুত্র শান্তনু দাস। সেই সংকলনেই এই কবিতাটি— ‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে দাঁতের মাজন’ পাঠ করি। সঙ্গে কবি গণেশ বসুর ‘সমুদ্র মহিষ’ও। রাম বসুর ‘পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে’ কি এখানেই পড়ি। ‘আলেকজান্ডার’... ইত্যাদি লাইনের লেখক কবি রুদ্রেন্দু সরকার। রুদ্রেন্দু- কবি রুদ্রেন্দু সরকারের সঙ্গে পরে আলাপ হয় ‘দৈনিক বসুমতী’ অফিসে।

রাম বসু— ‘রামদা’ হয়ে গেছিলেন অল্প আলাপে। কবি ও গদ্যকার। কনিষ্ক নামে উপন্যাস লিখেছিলেন সাঁওতাল বিদ্রোহ নিয়ে, ‘জঙ্গল জ্বলছে’। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম শতবার্ষিকী বছরে সন্ন্যাসী-সাহিত্যিক তারাপ্রণব ব্রহ্মচারী ও রাম বসুর সঙ্গে গেছিলাম বসিরহাট শরৎচন্দ্র শত বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে। সাহিত্যিক ও ‘চিত্রাঙ্গদা’ নামে সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক পরেশ ভট্টাচার্যও ছিলেন সেই সভায়। তখন কদিনের জন্য জেলের বাইরে।
এই সভার উদ্যোক্তা ‘স্বদেশ’ পত্রিকা সম্পাদক পান্নালাল মল্লিক- পালাম ছদ্মনামে যিনি   লিখতেন। 

‘কাস্তে’ কবি দীনেশ দাস পড়াতেন চেতলা বয়েজ হাইস্কুলে। মিলের ধুতি, হ্যান্ডলুম পাঞ্জাবি, ঘাড়ে পাট করা চাদর ফেলা, শীতের দিনে। বারোমাস কাঁধে চাদর রাখতেন কবি সিদ্ধেশ্বর সেন। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ছেড়ে দেন চাদর ব্যবহার। কারণ কলকাতার এক ছিনতাইবাজ ট্রামে তাঁর চাদরটি তুলে নিয়ে যায়। কবি সিদ্ধেশ্বর সেন সোভিয়েত ইনফরমেশন সেন্টারে চাকরি করতেন। সঙ্গে শিল্পী ও লেখক অজয় গুপ্ত আর নবারুণ ভট্টাচার্য।

কথা হচ্ছিল ‘কালের কবিতা’ নিয়ে। কবিদের ছবি দেওয়া সেই সংকলনে অনেক অনেক কবিতা। এই সংকলন পরে দে’জ পাবলিশিং থেকে বেরয়।
কবি শান্তনু দাসও শিক্ষকতা করতেন। ওঁর স্ত্রী সীমন্তিনী দাস ছিলেন নাম করা যাত্রা শিল্পী। ‘গঙ্গোত্রী’ বলে একটি সাহিত্য পত্রিকা সম্পাদনা করতেন শান্তনু দাস।
শান্তনু দাস বেশ কয়েকটি গল্প লিখেছেন ‘অমৃত’ সাপ্তাহিকে। তখন মণীন্দ্র রায় ‘অমৃত’ সম্পাদক। ‘অমৃত’ সাপ্তাহিকের মলাটে সম্পাদক হিসাবে নাম ছাপা হয় শ্রীতুষারকান্তি ঘোষের।

আরও পড়ুন
ঘড়িক্কে 'ঘোড়া' ছোটে

কবি অনন্য রায়ের বাবা মণীন্দ্র রায় ‘মোহিনী আড়াল’ কাব্যগ্রন্থের জন্য সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান। তাঁর আর একটি কাব্যগ্রন্থের নাম ‘জামায় রক্তের দাগ’ বেরিয়েছিল সত্তর দশকে। উপন্যাসও লিখেছেন কবি মণীন্দ্র রায়।

আরও পড়ুন
ব্যা-ব্যা-ব্যায়ামাগার – আখড়া

কথা হচ্ছিল দাঁতের মাজন নিয়ে।

আরও পড়ুন
মুড়ো, মুন্ডু, কল্লা

তার আগে দাঁতন বা দাতুইনের কথা বলে নিই। দাঁতন তৈরি হয় নিমের ডাল, বাবুল আর আটকিরের ডাল দিয়ে। দাঁতন বা মেসওয়াক কাছাকাছি গোত্রের। মেসওয়াক অনেকটাই দামি। একটু মোটাও।

আরও পড়ুন
টোকাটুকি, টুকলি, চোতামারা

রমজান মাসে একটু সম্পন্ন ইসলাম ধর্মের মানুষেরা মেসওয়াক করেন, সারাদিনের রোজা ভেঙে ইফতার বা এফতার করার আগে। যাঁরা মেসওয়াক পারেন না, অর্থাৎ কেনাটা ক্ষমতায় কুলোয় না তাঁরা দাঁতনই করেন, মূলত নিম ডাল দিয়ে।

আরও পড়ুন
ছিটকিনি পাইপগান ক্রমশ ক্রমশ...

যে চারটি পূর্ণ কুম্ভ হয় বারো বছর অন্তর অন্তর এবং অর্ধ কুম্ভ ছ বছর বাদে বাদে, সেই ইলাহাবাদ, হরিদ্বার, নাসিক আর উজ্জয়িনী— এই চার জায়গায় পূর্ণ কুম্ভে থেকেছি, মাস মাস ভ’র, সাধুদের সঙ্গে, তাঁবুতে। ইলাহাবাদ কুম্ভে এক এক মাস ‘কল্পবাসী’ হয়ে শরীরে ও মনের ‘শুদ্ধতা’ অর্জন করতে চান বহু মানুষ। যমুনা কূলে, গঙ্গাতীরে ‘পবিত্র’ জীবন যাপন করে।

আরও পড়ুন
চান্দ্রায়ণ

ইলাহাবাদ কুম্ভের বিস্তৃতি, পরিসর সবচেয়ে বড়। গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী-র ত্রিবেণী সঙ্গম। গঙ্গা-যমুনা প্রকাশ্য, সরস্বতী গুপ্ত।

আরও পড়ুন
পান-বিড়ির গুমটি

ইলাহাবাদ কুম্ভেই থাকে পনটুন ব্রিজ। লোহার বড় বড় ‘পনটুন’ দিয়ে বাঁধা সেতু।

আরও পড়ুন
ঋতু, ঋতুবন্ধ – ঋতুসংহার

ইলাহাবাদ ও হরিদ্বার কুম্ভে দেখেছি দাতুইন বা দাঁতনের রমরমা। বালির গায়ে কিছু একটা বিছিয়ে তার ওপর নিমের ডাল কাটা দাঁতন। পাশে রঙ-বেরঙের রুড়ি, আবির, সিঁদুর। মেয়েরা— বিবাহিত হিন্দু নারী কুম্ভ্-নহান— কুম্ভ স্নান সেরে নানা রঙের রুড়িতে নিজের শৃঙ্গার করেন। লাল, হলুদ, গোলাপি, বেগুনি...।

আরও পড়ুন
শুকুত – জিহ্বান্তরে আড়-বেগুন

সত্তর দশকে রাজনৈতিক কারণে বার বার জেলে যাওয়ার সূত্রে দেখেছি নিম দাঁতনের রমরমা। জেল পুলিশরা তো দাতুইন— দাঁতন করেনই। যাঁরা বিচারাধীন বন্দী— আন্ডার ট্রায়াল এবং যাঁরা কনভিকট – সাজা প্রাপ্ত, সকলেই দাঁতন করে থাকেন প্রায়। ব্যক্তিক্রম যে দু-একজন ছিলেন না, এমন নয় কিন্তু ব্যতিক্রম তো ব্যতিক্রমই, সবসময়।

আরও পড়ুন
বর্মা বার্মা বার্মিজ

সত্তর, আশির দশকে হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ-হ্যাঁ-অ্যাঁ-অ্যাঁ করে জিভ ছোলার একটা ব্যাপার ছিল। প্লাস্টিক, স্টিল, পেতল, সবেতেই তৈরি হয় জিভ ছোলা। কেউবা মুখ ধোয়ার সময় মুখের ভেতর, প্রায় গলা পর্যন্ত ডান হাতের তর্জনী-মধ্যমা-অনামিকা-তিনটি আঙুল ঠেসে নিয়ে গিয়ে প্রবলভাবে, বেশ জোরাল শব্দ করে ছুলতে থাকেন জিভ। এই জিভ ছুলে ফেলার ব্যাপারটি গত দশ বছর প্রায় দেখি না। এর পেছনে কোনো ডাক্তারি নিষেধাজ্ঞা আছে কিনা জানা নেই।

আরও পড়ুন
কাতান ব্লেড হয়ে গেলে

টুথপেস্টের পাশাপাশি গুঁড়ো মাজন চলত খুব। টুথপেস্ট বলতে ষাটের দশকে ‘কোলগেট’, ‘কলিনোস’, ‘ফরহ্যান্স’, ‘নিম’ আর ‘বিনাকা’। এই ‘বিনাকা’-ই পরে ‘সিবাকা’ হয়ে যায়। 

‘কোলগেট’-এ খুব ফেনা, ‘কলিনোস’-এও তাই। ‘ফরহ্যান্স’ প্রায় ফেনাহীন। ‘বিনাকা’-তেও ফেনা আছে যথেষ্ট।

‘বিনাকা’ টুথপেস্টের সঙ্গে পাওয়া যেত খুব ছোট্ট, শক্ত শক্ত রঙিন প্লাস্টিকের হাতি, ঘোড়া, গাধা, বাঘ। হয়ত ময়ূর, টিয়াপাখিও। সে বেশ মজার খিলোনা— খেলনা।

ষাট-সত্তরেই আমরা অতি অভ্যস্ত হয়ে উঠলাম অনেকেই ‘বিনাকা’ গীতমালায়। পরে যা একটু একটু করে হয়ে উঠল ‘সিবাকা গীতমালা’।

একশো দেড়শো টাকা থেকে দুশো আড়াইশোর পকেট ট্রানজিস্টার বা বড় ট্রানজিস্টার রেডিওতে ‘রেডিও সিলোন’ থেকে সম্প্রচারিত ‘বিনাকা গীতমালা’। ‘আমিন সাহানি পেশ কর রহে হ্যায়’।

প্রতি বুধবার ‘ভাইয়োঁ অর বহেনোঁ ইয়ে বিনাকা গীতমালা হ্যায়। পেশ কর রহে হ্যায় আমিন সাহানি।’ ঠিকঠাক এরকমই হয়ত বাক্য বন্ধ নয়। কিন্তু তার খুবই কাছাকাছি, ‘আমিন সাহানি পেশ কর রহে হ্যায়।’

তখনও পকেট ট্রানজিস্টার— ছোট পেনসিল ব্যাটারিতে চলা পকেট রেডিও তৈরি করে ‘ফিলিপস’, ‘মারফি’। লোকাল কিছু কোম্পানিও।

বড় ট্রানজিস্টার বানায় ‘ফিলিপস’, ‘মারফি’, ‘বুশ’, ‘নেলকো সোনা’, ‘জি ই সি’, ‘এইচ এম ভি’। চিনা রেডিও তখনও বাজারে আসেনি। দু ব্যাটারি, তিন ব্যাটারির বড় রেডিও। ব্যাটারি রাও বড় বড়— সাদা ‘এভারেডি’, তাকে বলা হত না সাদা ‘এভারেডি’, কিন্তু বডির রং সাদা। সেই সঙ্গে লাল এভারেডি, যা এল একটু পরে পরে। সাদা রঙের এভারেডি সেল টর্চ বা ট্রানজিস্টারের ভেতর বেশি দিন থাকলে ব্যাটারি চুঁইয়ে অ্যাসিড নামে। তাতে টর্চ আর ট্রানজিস্টার— দুটোরই চোদ্দটা বাজে। ইলাহাবাদে তৈরি হয় ‘জিপ’ ব্যাটারি। তাও চলত। কোম্পানির নাম ‘জিপ শেরোয়ানি’। ‘জিপ’ কোম্পানি টর্চও তৈরি করত।

ভূপালে যেমন ‘এভারেডি’-র কারখানা ছিল, ইলাহাবাদে তেমনই ‘জিপ-শেরোয়ানি’র ফ্যাক্টারি। আশির দশকে ভূপালে সেই ভয়ংকর গ্যাস দুর্ঘটনার স্মৃতি, মানুষের মৃত্যু, পঙ্গু হওয়া হয়ত মনে আছে আমাদের অনেকেরই। বা নেইও।

‘জিপ’ ছাড়া ছিল ‘নিপ্পো’ ব্যাটারি। ট্রানজিস্টারের বাজার ‘সন্তোষ’ একটু একটু করে দখল করতে শুরু করে আশির দশকে। সত্তর দশকের অতি সস্তার পকেট ট্রানজিস্টার, ট্রানজিস্টার রেডিও নিয়ে তার যাত্রা শুরু। আশির দশকে সেই দখলদারির রমরমা।

বাঙালি মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত সস্তার ‘সন্তোষ’কে নিজের কেনার আওতায় নিয়ে এল আস্তে আস্তে। পেছতে লাগল ‘ফিলিপস’, ‘মারফি’, ‘বুশ’, ‘নেলকো সোনা’, ‘জি ই সি’, ‘এইচ এম ভি’।

বড় মার্কনি সেট— ইলেকট্রিকে চলা রেডিও তৈরি করত ‘ফিলিপস’, ‘মারফি’, ‘জি ই সি’। আরও কোম্পানি ছিল। অলওয়েভ সেট— যা থেকে সমস্ত পৃথিবীর খবর, গান ইত্যাদি ভেসে আসত, বিবিসি, ভয়েস অফ আমেরিকা (ভিওএ), রেডিও মস্কো, রেডিও পিকিং, রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা— এসবই ধরা পড়ে অলওয়েভ সেটে। লোকাল সেটে লাইসেন্স সাড়ে সাত টাকা। অলওয়েভ সেটে লাগে পনেরো বছরে একবার। স্থানীয় পোস্ট অফিসে টাকা জমা দিয়ে ছাপ মারিয়ে আনতে হয়। আমি এটা ষাট দশকের শেষের কথা বলছি। পরে লাইসেন্স ফি ব্যাপারটাই উঠে যায়।

অলওয়েভ মার্কনি সেটের জন্য ছাদের ওপর তার খাটিয়ে এরিয়ালের ব্যবস্থা করতে হত। তার নয়ত সরু তারের তৈরি লম্বা নেট জাতীয় কিছু। সেটাকেই টাঙিয়ে দেওয়া ছাদের ওপর। সেই বিদ্যুতে চলা মার্কনি— অলওয়েভ সেট রেডিওর এরিয়ালে পাখি— কাক-চিল এসে বসলে বিপত্তি, সম্প্রচারে বিঘ্ন ঘটে। বিশ্বকর্মা পুজো বা সরস্বতী পুজোয় ‘ভো কাট্টা’ হয়ে যাওয়া মাঞ্জা সুতো সমেত কাটা ঘুড়ি এরিয়ালে জড়ালেও ব্রডকাস্টিংয়ে অসুবিধা হয়। শব্দ থর থর থর থর থর থর, থরানি। আর বজ্রপাত হলে, বাজ পড়লে তো গেল, রেডিওর চোদ্দটা বেজে। পুড়ে-টুড়ে একসা।

অলওয়েভ মার্কনি সেটের ভেতর আলো জ্বলে। কাঁটা ঘোরে। ভেতরে বাঘের মাথার সাইজের স্পিকার। আমার পিতৃদেব আমরনাথ রায় দশো টাকা, হ্যাঁ মাত্রই দুশো টাকা দিয়ে রেডিও— অলওয়েভ মার্কনি সেট তৈরি করান রঘুবাবুকে দিয়ে। কি সেই রেডিওর দাপট। মহালয়া, অনুরোধের আসর, এমাসের গান, সবিনয় নিবেদন, মজদুর মণ্ডলী, পল্লীমঙ্গল আসর, সবটাতেই। মজদুর মণ্ডলীর পরিচালক ছিলেন সত্যচরন ঘোষ আর পল্লীমঙ্গল আসরের পরিচালক ছিলেন সুধীর দাস। শুক্রবার শুক্রবার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর মহাভারত পাঠ। আর ছিল শুক্রবার রাত আটটায় রেডিও নাটক। 

রবিবার সকাল নটায় সঙ্গীত শিক্ষার আসর, পরিচালনায় পঙ্কজ কুমার মল্লিক, সেই সঙ্গে সঙ্গে সাড়ে নটা থেকে দশটা শিশুমহল, পরিচালনায় ইন্দিরা দেবী— সকলের ইন্দিরাদি – ‘ছোট্ট সোনা বন্ধু ভাই, আদর আর ভালোবাসা নাও...’ ইত্যাদি। সেই সঙ্গে গল্পদাদুর আসর, বিদ্যার্থীদের জন্য। বিবিধ ভারতীতে কলকাতা গ-এ জয়মালা, ‘ফৌজিভাইদের জন্য’, বিশেষ জয়মালা, মন চাহে গীত, ভুলে বিখরে গীত, গুলদস্তা। কলকাতা খ-তে— ক্যালকাটা বি-তে রবিবার ‘কলিং অল চিলড্রেন’।

দীপনারায়ণ মিঠোরিয়া ছিলেন একজন হিন্দি ঘোষক। তাঁর কন্ঠবাদনে বার বার শুনি ঝুমরি তালাইয়ার নাম। তখন খুব জানতে ইচ্ছে করত ঝুমরি তালাইয়া ঠিক কোথায়?

রেডিও সিলোন থেকে ভেসে আসা ‘বিনাকা’ বা ‘সিবাকা’ গীত মালায় আমিন সাহানি সাহেবের কণ্ঠস্বর অসামান্য। এই তো কিছুদিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন তিনি।

দাঁতের মাজন, দাতুইন বাঁ দাঁতন দিয়ে শুরু করেছিলাম। ‘সাধনা দশন’ নামে একটি গুঁড়ো মাজন খুব চলত ষাটের দশক, সত্তরেও। খবরের কাগজে খুব বড় বড় বিজ্ঞাপন দেখতাম ‘সাধনা দশন’-এর। তখন দৈনিকের পাতা জোড়া রেডিও-র বিজ্ঞাপনও— ‘মারফি’, সেই সঙ্গে এক শিশুর অসামান্য মুখশ্রী। ছেলে বা মেয়েটিকে কখনও কৃষক, কখনও রাজনৈতিক নেতা, কখনও সৈনিক বেশে ক্যালেন্ডারে দেখি। বড়, রঙিন ক্যালেন্ডার। দৈনিক সংবাদপত্রের পাতা জুড়ে বিজ্ঞাপন হত ‘ফিলিপ্স’ আর ‘বুশ’ রেডিওর। বিজ্ঞাপন থাকত বাইসাইকেলেরও। ‘ফিলিপ্স’, ‘হারকিউলিস’, ‘অ্যাটলাস’, ‘সেন র্যা লে’-র। আসানসোলে তখন ‘সেন র্যা লে’-র বড় কারখানা।

জরুরি অবস্থা উঠে যাওয়ার পর টানা জেলবাস থেকে বেরিয়ে আমার এক বন্ধু কাম কমরেড গুঁড়ো মাজনের ব্যবসা শুরু করেন। চকখড়ি গুঁড়ো, ফটকিরি, গোলমরিচ-গুঁড়ো, আরও আরও কী সব যেন মেশানো হত এই মঞ্জন বা মাজন তৈরিতে। ততদিনে ইলাহাবাদের অতি বিখ্যাত ‘অকসি’-র লাল দন্ত মঞ্জন দেখা হয়ে গেছে। গুঁড়ো, লাল রঙের। ‘অকসি’র অতি বিখ্যাত মঞ্জন খুব নাম করা। আমার বন্ধু কাম কমরেডের তৈরি মাজন অফ হোয়াইট। এক কৌটোর দাম পঁচিশ নয়া পয়সা— চার আনা। নিজেই ‘মাল’ তৈরি করান তিনি। সাপ্লাই দিয়ে আসেন দোকানে দোকানে। সেটা ১৯৭৮ সাল।

একটু মোটা কাগজের তৈরি নস্যির ডিবের থেকে সামান্য বড় কাগজের ডিবে। অনেকটা হোমিওপ্যাথি ওষুধের শিশি ঢেকে দেওয়ার ডিব্বা যেমন, তার থেকে সামান্য চওড়া।

এই কাগজ-কৌটো আবার তৈরি হত অন্য জায়গায়।

সাইকেলে করে দোকানে দোকানে মাজন পৌঁছাতেন সেই বন্ধু কাম কমরেড। কিন্তু সেই ব্যবসা বেশি দিন চলেনি। কেউ নেয়না লোকাল মাজন। ক্রমশ ‘মাল’ জমে যায়। পুঁজি ঘোরে না, মূল ওঠে না মানে ফেরত আসে না। ফলে ব্যবসায় লালবাতি। ‘লাটে ওঠা’, বা ‘গণেশ ওল্টানোও’ বলে একে, প্রচলিত কথায়।

এই বন্ধু কাম কমরেড মাজনের পরে ডট পেনের রিফিল তৈরির কারখানা করলেন বাড়িতেই। বউয়ের হাতের ব্রোঞ্জের চুড়ি বাঁধা পড়ল। লাল, সবুজ, নীল, কালো রিফিল। কিন্তু সে ‘কারবারও’ জমল না একেবারেই। ফলে ব্যবসার ঝাঁপে লাঠ। ‘পুঁজিপাটা বেলেঘাটা’ হয়ে গেল অচিরেই।

এই ডটপেন রিফিলের মূল ত্রুটি ছিল গরমের সময়ে তো বটেই, অন্য অন্য ঋতুতেও ব্যাক ফ্লো করে রিফিলের নিচের ফুটো দিয়ে গলগল করে বেরিয়ে আসত ভেতরে ঢোকান কালি। ফলে শার্টের, পাঞ্জাবির, বুক পকেটের কোণ একেবারে রঙিন। 

পঞ্চাশ, ষাটের দশকে দেখেছি কালির পেন— ফাউন্টেন পেন বা ঝরনা কলমের কালি লিক করে মাস্টারমশাইদের ফুল শার্ট, পাঞ্জাবির বুক পকেট অনায়াসে রঙিন করে দিচ্ছে। সেই সমস্যা খানিকটা মিটেছিল ডটপেন আসার পর। কিন্তু লোকাল মেড রিফিলে এই রঞ্জক বৃত্তি থেকেই গেল।

এই বন্ধুটির রিফিল কারখানা বাড়িরই এক চিলতে জমিতে। তাঁকে কিছুদিন আগে পর্যন্ত লোকাল থানায়, সপ্তাহে দু দিন হাজিরা দিতে হত। সেই থানার এ এস আই, কনস্টেবলরা এসে মুঠো মুঠো রিফিল তুলে নিয়ে যেত। পয়সা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই নেই। এই তথ্যটি আমাকে সেই বন্ধু কাম কমরেডই দিয়েছিলেন। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না। 

রিফিল কারখানা উঠে গেলে এই মানুষটি ছোট, বড় চিরুনি এনে দোকানে দোকানে সাপ্লাই দেওয়ার কাজ করতেন। ছোট বড় নানান সাইজের, বিভিন্ন কোম্পানির চিরুনি। তার মধ্যে ‘যশোরের চিরুনি’, মাথার চুলে জড়িয়ে থাকা উকুন বাছার কাঁকই, কাঠের এবং প্লাস্টিকের, মেদিনীপুরের মোষের সিং থেকে তৈরি কংঘি— হিন্দিতে কংঘিই বলে চিরুনিকে। বাড়িতে চিরুনি তৈরির কারখানা করার স্বপ্ন তিনি দেখতেন। বাস্তবে তা হয়নি।

সেই ব্যবসা চলল না যখন, তখন তিনি সাইকেলে চেপে বাড়ি বাড়ি চায়ের পাতা, গুঁড়ো চা, হাফ-ডাস্ট চা ফেরি করতে থাকলেন। তাও শেষ পর্যন্ত জলে গেল। ততদিনে ‘বিনাকা’ টুথপেস্ট ‘সিবাকা’ হয়ে গেছে আর সেই পেস্ট কিনলে ছোট ছোট খেলনা জন্তু, পাখির বদলে পাওয়া যাচ্ছে সোনালী রঙের চেন। 

মায়ের কাছে গল্প শুনেছি তাঁরা ‘দেশে’ মানে অখণ্ড বঙ্গের ফরিদপুরের আকসা ভোজেশ্বরের বাড়িতে নুন-শর্ষের তেলে দাঁত মাজতেন। নয়ত ঘুঁটের ছাই বা উনোন ভাঙা মাটি গুঁড়ো করে তৈরি করান নিজেদের তৈরি— ‘হোম মেড’ দাঁতের মাজন। দাঁতে অসুবিধা হলে পেয়ারা পাতা ফুটিয়ে তার জল, ঠান্ডা করার পর কুলকুচি।

‘মাংকি ব্র্যান্ড’ কালো দাঁতের মাজন দেখলাম, বাজারে এল আশির দশকে। ততদিনে ‘সাধনা দশন’ অনেকটাই পিছিয়েছে। ‘দন্তমুক্তা’ বলে একটি লোকাল প্রোডাক্ট দাঁতের মাজন দেখেছি। ষাট, সত্তর, আশির দশকে ‘কোলগেট’-এর গুঁড়ো মাজন, যা আসত কোটো বন্দি হয়ে, নজরে পড়েছে। মেজেওছি। সুন্দর স্বাদ এই মাজনে।

শুরু করেছিলাম দাঁতন, দাতুইন বা দন্ত মঞ্জন দিয়ে।

টিউববন্দি টুথপেস্ট ফেনাদার না হলে ভালো লাগে কি? ফ্লোরাইড, আহা, ফ্লোরাইড। দূর করে নিঃশ্বাসের দুর্গন্ধ। মুখের কু-বাস।

আমাদের বাল্যকালে প্রচুর ফেনা ‘কোলগেট’-এ। ‘কলিনোস’-এও মোটামুটি ফেনাদার আভাষ। কিন্তু মোটেই ফেনা নেই ‘ফরহ্যান্স’-এ। ‘নিম’ আর ‘বিনাকা’-য় ‘কোলগেট’-এর তুলনায় কম ফেনা অনেক। 

দাঁতমাজা পেস্টের থুতু মিশ্রিত ফেনা খায়নি, এমন বালক-বালিকা আছে নাকি? সেই ‘বালক’- বালিকারা এখন অনেকেই প্রৌঢ় প্রায়। কি স্বাদ, কি স্বাদ ‘কোলগেট’ আর ‘কলিনোস’-এর ফেনায় ফেনায়। ঢোঁক চিপলেই তৃপ্তি। আহা, মালটি ন্যাশনাল- বহুজাতিক, বহুজাতিক।

‘নিম’ পেস্টের ফেনা খাওয়া যায় না, কারণ স্বাদে তেতো। বেঙ্গল কেমিক্যালে তৈরি সেই ‘নিম’ নাকি সত্যিকারের নিম-নির্যাস দিয়ে তৈরি। তাই অ্যাত্ত অ্যাত্ত তেতো।

টুথপেস্টের ফেনা খাওয়া ছাড়াও এমনি পেস্টও খেয়ে দেখেছি। বেশ স্বাদু, মনোহর। বিশেষ করে ‘কোলগেট’। মালটি ন্যাশনাল কিনা। আর ‘ফরহ্যান্স’, ‘কলিনোস, ‘নিম’ এসব কী আর পাওয়া যায় নাকি। যেমন ‘ফরহ্যান্স’ টুথব্রাশ নেই। ‘বিনাকা’ টুথব্রাশ, ‘সিবাকা’ টুথব্রাশ, তাও তো গরহাজির বহুদিন। ‘অজন্তা’ও নেই। এখনও তো বাজারে ‘কোলগেট’, ‘ওরাল বি’, ‘সোনোডাইন’, ‘জনসন এন্ড জনসন’-এর বেবি টুথব্রাশ। বেবি টুথব্রাশ ‘কোলগেটে’র-ও হয়।

মাজন বলতে ‘কোলগেট’, ‘পেপসডেন্ট’, অনেক দামি ‘অ্যাময়’। ‘অ্যাময়’-এর টুথব্রাশও হয়। টুথব্রাশ হয় ‘পেপসডেন্ট’-এরও। ‘বাবুল’-এর মাজন, ‘পতঞ্জলি’র মাজন, ‘ডাবর’-এর লাল দন্ত মঞ্জন— এসব পাওয়া যায় বাজারে। টুথব্রাশের কথা উঠলেই মনে পড়ে নাকের নিচে ‘মাছি’, ‘বাটার ফ্লাই’ বা ‘টুথব্রাশ’ গোঁফের ‘মহান’ ফুয়েরারের কথা। অ্যাডলফ হিটলার অ্যাডলফ হিটলার, যার পদধ্বনি আমাদের দেশেও ইদানীং অতি তীব্র। আর এই ‘টুথব্রাশ’ গুঁফো হিটলারকে কি ভেংচি না ভেংচে ছিলেন চার্লি চ্যাপলিন, তাঁর ‘গ্রেট ডিকটেটর’ ছবিতে।

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor