আদর্শ রাজা তিনিই, যাঁর কাছে রাষ্ট্র ও শাসকের ফারাক থাকে না কোনো

মহাভারতে রাজনীতি – ১৩

আগের পর্বে

কুন্তিভোজ রাজার কন্যা কুন্তীর সঙ্গে পাণ্ডুর বিবাহের পর হস্তিনার মিত্র হলেন যাদব এবং ভোজরা। সে সময়ে ভারতের সর্বোচ্চ শক্তিশালী রাজ্য মদ্রের সঙ্গেও সখ্য স্থাপনের জন্য পাণ্ডুর দ্বিতীয় বিবাহ মদ্র দেশের সেনাপতি শল্যের ভগ্নী মাদ্রীর সঙ্গে।এই শক্তির সখ্য পেয়েই নিজের ক্ষমতাবান বলে ভাবতে শুরু করেন পাণ্ডু। দিগ্বিজয় অভিযানে যান। কিন্তু মিত্রদের সেইভাবে সহায়তা পাননি তিনি। দিগ্বিজয় থেকে ফিরে এসে হতাশ হয়েই ত্যাগ করেন সিংহাসন। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা দৃষ্টিহীন ধৃতরাষ্ট্রকেই তাঁর অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবেন পাণ্ডু। তারপর পাণ্ডু দুই স্ত্রীকে নিয়ে মৃগয়ায় গেলেন বনে। তবে নিবৃত্তিমার্গ অবলম্বন করেননি তিনি। বনে গিয়েই আরও এক বিপদের সম্মুখীন হলেন পাণ্ডু।

ওদিকে সিংহাসনে বসেছেন ব্যাসপুত্র পাণ্ডুর অগ্রজ ধৃতরাষ্ট্র। জন্মান্ধ হওয়া সত্ত্বেও তিনি পূর্বে অর্ধেক রাজত্বের মালিক ছিলেন, এখন গোটা রাজ্যের নরপতি হিসাবে সিংহাসনে আসীন হলেন। আদর্শ গৃহীর সমস্ত গুণ স্বামী বা মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের ছিল। তিনি শাস্ত্রবিশারদ, ধীর, অমর্ষী, শুচি, মেধাবী, ধারণাযুক্ত, ধর্মকার্যরত, প্রসন্নবদন, প্রজারক্ষাতৎপর। ধৃতরাষ্ট্র প্রজাদের সর্বদা অভয় প্রদান করতেন। শাসক ধৃতরাষ্ট্রের চরিত্রে মাতা, পিতা, গুরু, রক্ষাকর্তা, বহ্নি, বৈশ্রবণ ও যম—এই সাত জনের গুণ ছিল। প্রজার প্রতি অনুকম্পাবশত তিনি তাঁদের সঙ্গে পিতার ন্যায় ব্যবহার করতেন, দুর্গত প্রজাদের সস্নেহে প্রতিপালন করেন বলে তিনি মাতৃস্থানীয়া, অনিষ্ট নাশ করেন বলেন তিনি অগ্নি, দুষ্টের শাসনকর্তারূপে তিনি যম, সাধু ব্যক্তিদের ঈপ্সিত ধন প্রদান করেন বলে তিনি কুবের, ধর্মোপদেশে তিনি গুরু, আপদ-বিপদে রক্ষা করেন বলে তিনি রক্ষক। আদর্শ রাজার সব গুণ ছিল ব্যাসপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের।   

অভিধান বলে, ‘ধৃতরাষ্ট্র’ মানে ধর্মানুসারে পালিত রাজা। ‘ধৃত’ মানে ধারিত, কৃতধারণ, গৃহীত, স্বীকৃত, স্থাপিত, সংযত। ‘রাষ্ট্র’ হল রাজ্য। শব্দটির ধাতু ‘রাজ্’ ও প্রত্যয় ‘ত্র’। রাজ্ থেকে যিনি ত্রাণ করেন তিনিই রাষ্ট্র। নৈতিক পথে যিনি রাষ্ট্র থেকে উদ্ধার করেন তিনিই ধৃতরাষ্ট্র। এই রাষ্ট্র অবশ্য উপদ্রব, মকরাদি, দুর্ভিক্ষ; মনু যাকে প্রজাপীড়ন বলছেন। প্রজা হল সন্ততি, অপত্য। ঋগ্বেদে আছে, প্র জায়েমহি রুদ্র প্রজাভিঃ। প্রজা হল জন, প্রকৃতি, রাইয়ত—প্রজানাং পরিরক্ষিতা। প্রজা পুত্রসম স্নেহপাত্র—অনুকম্প্যাঃ প্রজা হি বঃ। মহাভারতে মাঝেমধ্যে ‘রাষ্ট্র’ ও ‘রাজা’ একাকার হয়ে গিয়েছে। গৃহ ও গৃহপতির মধ্যে যেমন পার্থক্য ঘুচে যায় অনেক সময় যখন গৃহের মঙ্গল গৃহীর মঙ্গলের সঙ্গে একাকার হয়ে, তেমনি রাষ্ট্র ও শাসকের পার্থক্য ঘুচে যায় যখন শাসক হন আদর্শ রাজা।  

শাসক ও রাজনীতিজ্ঞ ধৃতরাষ্ট্রকে বুঝতে হলে প্রথমেই দেখে নিতে হবে আদিপর্বের অংশাবতরণ অধ্যায়। সেখানে পূর্বজন্মে ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন অরিষ্টার পুত্র হংসনামা গন্ধর্বপতি। গন্ধর্বরা হলেন দেবযোনিবিশেষ। দিব্যগন্ধর্বরা হলেন সূর্যের অশ্বের নিয়ন্তা। আগেই বলা হয়েছে, সূর্যের নিজস্ব আলো বা কিরণ আছে। তিনি নিজের আলোকে উদ্ভাসিত। অপরের নিকট থেকে আলোক বা সম্পদ তিনি কর্জ করেন না অর্থাৎ অন্যের অর্জিত সম্পদে তিনি ভাগ বসান না। অন্য দিকে, চন্দ্র হল আলোকবিহীন। চন্দ্র যে আলো প্রদান করে থাকেন, তা তাঁর নিজস্ব নয়, সূর্যের কাছ থেকে ধার করা। আসলে অন্যের শ্রমের ফসলে ভাগ বসায় চন্দ্র। এই বিষয়টি সূর্যবংশীয় ও চন্দ্রবংশীয়দের মধ্যে রাজনীতি, অর্থনীতি ও দর্শনের বিরাট পার্থক্য গড়ে দেয়। ধৃতরাষ্ট্র চন্দ্রবংশীয়দের মধ্যে সেই রাজা (যদিও তিনি জৈবিক ভাবে সূর্যবংশের কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের বংশধর) যিনি চন্দ্রবংশের রাজনীতি-অর্থনীতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বরাবলম্বী। আবার তিনি পূর্বজন্মে অরিষ্টের পুত্র হংসনামা। ‘অরিষ্ট’ হল অহিংসিত, অনাহত, নির্বিঘ্ন ও শুভ—ন রিষ্ট (হিংসিত)। অরিষ্ট সারা জীবন যুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন। অরিষ্টের পুত্র হংসনামা নামক গন্ধর্ব রাজনীতির যে আদর্শ মেনে চলতেন, তার সারমর্ম হল--পরদ্রব্যগ্রহণের অভিলাষ হল লোভ। বাক্যরচয়িতা, শিবভক্ত, বীণাবাদক, ব্রহ্মার প্রপৌত্র শিবভক্ত রাবণই রক্ষকদের রাজা। রাবণের পিতা বিশ্রবা মুনির আরেক পুত্র কুবের যক্ষরাজ, তিনি গন্ধর্বও বটে— ব্রহ্মার বরে রাবণ যেমন দশগ্রীব তেমনই কুবের হলেন লোকপাল। শিবের পত্নী দশভূজা হয়ে যেমন কর্মশীলা, তেমনই রাবণ শিবের অনুগ্রহে দশানন হয়ে জ্ঞানশীল ও মননশীল। জ্ঞান হল পরম ধন আর লোকপালনের যে সম্পদ তার অধিপতি হলেন স্বয়ং হংসনামার সখা কুবের। রাজনীতির প্রশ্নে ধৃতরাষ্ট্র তাই শিবের অনুগামী, বিষ্ণুর অনুগামী নন। শিবের অনুগামীরা যৌথ সম্পদে বিশ্বাসী ছিলেন, ব্যক্তিমালিকানার বিরুদ্ধে ছিলেন। বিষ্ণুর অনুগামীরা ঠিক তার উলটো। 

‘গন্ধর্ব’ কথাটি গন্ধ বা সম্পর্ক থেকে এসেছে আর সেই সম্পর্ক উৎপাদনের সম্পর্ক। তাঁকে সচল ও সমাজমুখী করার লক্ষ্যে যে বিদ্যার চর্চা হয় তাকে বলে চাক্ষুষী বিদ্যা। আদি পিতা বৈবস্বত মনু এই বিদ্যা পান সূর্যের কাছ থেকে। এই সূর্য কিন্তু জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড নন, তিনি সৌরমণ্ডলের অধিদেবতা সূর্য। সূর্য চাক্ষুষীবিদ্যা দান করেন বিশ্বাবসুকে। বিশ্বাবসু হলেন দেবগায়ক গন্ধর্ব। বিশ্বাবসু আবার ওই শাস্ত্র গন্ধর্বদের দিয়েছেন। ধৃতরাষ্ট্র সেই বিদ্যার অধিকারী। গুরুপ্রদত্ত এই বিদ্যা লাভ করলে ত্রিভুবনের সব কিছু নজরে পড়ে, সম্যকরূপে বোঝা যায় বিশ্বের হাল হকিকত। আর তা বোঝা গেলে বিশ্ব হয়ে ওঠে বসু বা দিব্যস্থান। ছয় মাস এক পায়ে দাঁড়িয়ে এই বিদ্যা লাভ করতে হয়। কেউ যদি সেই শাস্ত্র বিষয়ে জ্ঞানবান হতে চায় তবে তাকে এক পায়ে দাঁড়ানো অভ্যেস করতে হবে। এখানে কোনও দ্বৈত নেই, রাজনীতি ও অর্থনীতির প্রশ্নে বিশুদ্ধ অদ্বৈত পথ ধারণ করতে হবে। 

গন্ধর্বরা বহু ব্রত পালন করে এই বিদ্যা পেয়েছিলেন। আর এই শাস্ত্রের বলে তাঁরা মানুষ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। মানুষ শুধু নিজেরটা চায়। তার সন্তানসন্ততি, পিতামাতাকে সে বঞ্চিত করতে চায়। চাক্ষুষী বিদ্যা শিক্ষা করলে সঙ্কীর্ণ মানুষ প্রজারঞ্জক রাজনীতি ও অর্থনীতিধর্ম বিষয়ে সম্যক জ্ঞানবান হবেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মর্ত্য ও দিব্য ভেদে গন্ধর্ব দু প্রকার। হাহা, হূহূ, চিত্ররথ, বিশ্বাবসু, হংসনামা, গোমায়ু, তুম্বরু, নন্দি প্রভৃতি গন্ধর্ব নামে খ্যাত। হংসনামা দিব্য গন্ধর্ব হলেও ধৃতরাষ্ট্র মর্ত্য গন্ধর্ব। পূর্বজন্ম ও পরজন্মে তিনি একই ব্রত পালন করেন।   

ধৃতরাষ্ট্র ছিলেন ধর্ম, অর্থ ও কামের এক যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এই ত্রিবর্গ রাজ্যের পথ ব্যাপ্ত করে থাকে। যে পথ ব্যাপ্ত করে তাকে শাস্ত্রে অশ্ব বলা হয়। অশ্ব সেই সবের ধারক। এই সব অশ্বের বর্ণ সুন্দর, বেগ মনের ন্যায়; প্রয়োজন অনুসারে সে ক্ষীণ ও অক্ষীণ হতে পারে। এই অশ্ব কখনও বেগভ্রষ্ট হয় না। সূর্যের সপ্তাশ্ব এই প্রসঙ্গে স্মরণ করা যেতে পারে। 

আরও পড়ুন
কুন্তীর উপস্থিতি সত্ত্বেও, কেন মাদ্রীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেন পাণ্ডু?

পূর্বকালে বৃত্রাসুরবধের জন্য ইন্দ্রের বজ্র নির্মিত হয়েছিল। অসুরদের বরাবর দেবতারা ঘৃণা করে এসেছেন। তাঁদের কীভাবে পদদলিত করে দাস বানানো যায়, কীভাবে তাঁদের সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা যায়, তা নিয়ে দেবাসুরের সংগ্রামের ইতিহাস অনেক প্রাচীন। শেষ পর্যন্ত সুধামন্ত্রের মতো গোপন ও শ্রেষ্ঠ সম্পত্তি পাচার হয়ে যায় অসুরলোক থেকে দেবলোকে। অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানীকে ফুসলিয়ে দেবগুরু বৃহস্পতির পুত্র কচ সেই সম্পত্তি অপহরণ করে। বৃত্রাসুরকে খুন করার জন্য নানা রকম অস্ত্র বানিয়েছেন দেবরাজ ইন্দ্র। কিছুতেই কোনও কাজ হয় না। শেষ পর্যন্ত বানালেন বজ্র। সেই বজ্র বৃত্রাসুরের মাথায় পড়ে সহস্রভাগে বিভক্ত হয়। বৃত্রাসুর ধ্বংস হন। কিন্তু ধ্বংস হয়েও তিনি সৃষ্টির কাজে ব্রতী হন। 

বৃত্র দেবতা নন, তিনি হলেন অসুর। যে স্বর্গ ও পৃথিবী আবৃত করে স্থিত সেই বৃত্র। অসুর মানে জীবনদাতা। সে সূর্য আবার হস্তী। তাঁর জনক ত্বষ্টা আদিত্যদের অন্যতম। দেবশিল্পী। তিনিই শিব, তিনিই তক্ষক, তাঁকেই জগতের সূত্রধার বলা হয়। ইন্দ্র মেঘের আড়াল থেকে বৃত্রাসুরের মাথায় বজ্র ছুঁড়ে মারলে বৃত্রের মস্তক হাজার ভাগ হয়ে যায়। জগতে যা কিছু আছে তা ওই মস্তকের অংশ। ব্রাহ্মণের হাত, ক্ষত্রিয়ের রথ, বৈশ্যের দান ও শূদ্রের সেবা ওই সহস্রভাগ থেকে উৎপন্ন। গন্ধর্বদের কাছে যে অশ্ব দেখতে পাওয়া যায়, তা ক্ষত্রিয়ের রথের অংশ এবং তাদের কেউ বধ করতে পারে না। যে রাস্তা ব্যাপ্ত করে থাকে সেই অশ্ব। অমৃত, বাষ্প, বহ্নি, বেদ, অণ্ড, গর্ভ ও সাম—এই সাত উৎপত্তিস্থান থেকে অশ্বেরা আসে। সপ্ত প্রকার অশ্ব আসলে সূর্যের সাত সারথি। সেই বর্ণ যিনি সম্যক ভাবে বোঝেন তিনিই চাক্ষুষী বিদ্যার অধিকারী। গন্ধর্বদেশীয় এই অশ্ব সকল ইচ্ছানুসারে রূপ ধারণ করতে পারে, যত খুশি বেগবান হতে পারে, ইচ্ছানুযায়ী উপস্থিত হতে পারে। ওই ঘোড়ারা মানুষের সব অভিলাষ পূর্ণ করে। রাজনীতি বা দণ্ডনীতিকে ওই অশ্বরা নিয়ন্ত্রণ করে মানুষের কল্যাণের জন্য।

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

আরও পড়ুন
ব্যক্তিগত নয়, যৌথ মালিকানার জন্যই আজীবন লড়াই চালিয়েছেন কর্ণ

Powered by Froala Editor

More From Author See More