তরাই-মোরাং : নিসর্গ, মানুষ, যুদ্ধবিগ্রহ

সময়ভ্রমণ – ১৭

আগের পর্বে

ইংরেজরা আসার আগে একেবারেই অন্যরকম ছিল তরাইয়ের চেহারা। ঔপনিবেশিক শাসকরা যেমন সেখানকার ভূগোল লিপিবদ্ধ করেছে, তেমনই বদলেও ফেলেছে। জঙ্গল থেকে কাঠ লুট করেছে, আবার জায়গায় জায়গায় বসতিও গড়ে তুলেছে। আজকে আমরা তরাইয়ের যে ইতিহাস জানি, তার বেশিরভাগটাই ইংরেজদের হাতে তৈরি। কিন্তু তার আগেও নাগরি অঞ্চলের পরিচিতি ছিল। যোগাযোগ ছিল বাংলার সঙ্গেও। বাঙালি ব্রাহ্মণরাও সেখানে বসবাস করতেন। কোচবিহারের রাজত্ব এবং নেপালের কিরাত রাজত্বের কথা বাদ দিলে হারিয়ে গেছে প্রায় সবই। গোর্খারাও ভুলে গিয়েছেন নিজেদের ইতিহাস।

ইংরেজরা চলে গেছে বহুকাল। পাহাড়ের গোড়ার যে এলাকাটাকে তারা দার্জিলিং তরাই বলে ডাকত, ল্যাজামুড়ো চষে ফেললেও সেখানে এখন কোনো সায়েবের সন্ধান পাওয়া যাবে না। যতদূর জানি, নব্বইয়ের শুরু অবধি সবেধন নীলমণি এক স্কচ সায়েব টিঁকে ছিল। বাগডোগরা বাজার ছাড়িয়ে জাতীয় সড়ক ৩১ বিহার দিনাজপুর মালদা মুর্শিদাবাদ হয়ে কলকাতার দিকে যাচ্ছে, সে পথে খানিকদূর গেলে গয়াগঙ্গা বলে একটা চা বাগান আছে। তরাইয়ের শেষ সায়েব প্ল্যান্টার সে বাগানে ম্যানেজারি করত। বলছি বটে প্ল্যান্টার, আদতে ব্যাপারটা সেরকম ছিল না। গয়াগঙ্গা বাগানটা নিতান্তই দিশি, বংশ কৌলীন্য বলতে কিছু নেই। কথা উঠতে পারে, বাগানের আবার বংশকৌলীন্য কি? সায়েবদের শাসনকালে সবকিছুতে জাত-বেজাত, সায়েব-নেটিভ ভাগ হতো। পুরো সায়েবশাসিত বাগান, সায়েবগোছের ধনী বাঙালি মালিকানাধীন বাগান, এদের জাত আলাদা। প্ল্যান্টার বা বাগানমালিকদের সংস্থার নাম দিয়ে সেটা বোঝা যেত। সায়েবদের সংস্থার নাম ছিলো ইন্ডিয়ান টি অ্যাসোসিয়েসন, সংক্ষেপে আই টি এ। কলকাতার ডালহৌসির অফিসপাড়ার খাস জায়গায় তাদের অফিস আজ পর্যন্ত আছে। তরাইয়ের আই টি এ-কে বলা হত টি বি আই টি এ, তরাই ব্রাঞ্চ বা তরাই শাখা। বাগডোগরা থেকে নকশালবাড়ি যাচ্ছে যে পথ, তা থেকে ডানহাতি কেটে গেলে টি বি আই টি এ-র পুরোনো সায়েবি আমলের অফিস। অফিস, ক্লাব একসঙ্গে। বাংলোবাড়ির সামনে প্রশস্ত লন, ফুলবাগান। দেয়ালের গায়ে, বাড়ির চালে লতিয়ে উঠেছে উইস্টেরিয়া। এখনো যত্নে রাখা, ছবির মতো। দিশি বাগানগুলোর মালিকদের সংস্থার নাম টেরাই ইন্ডিয়ান প্ল্যান্টার্স য়্যাসোসিয়েসন, সংক্ষেপে টিপা। টিপার অফিস দেখে ভক্তিশ্রদ্ধা হয় না, মাটিগাড়ার ঘিঞ্জি বসতি পার করে ছিরিছাঁদহীন একতলা একটা বাড়ি, রং-চটা ধূসর দেয়াল। গয়াগঙ্গার সায়েব ম্যানেজারের সন্ধান দিয়েছিলেন টিপার তৎকালীন সেক্রেটারি। 

একাধিকবার গয়াগঙ্গা যাওয়া হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে, লালমুখো স্কচ সায়েবের নাম ছিলো ম্যানসন। খুঁজে খুঁজে তাকে বার করেছি দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। তার বয়স তখনই সত্তর ছাড়িয়েছে, অনর্গল নেপালি বলতে পারে, বাড়িতেও নেপালির চল ছিল। হওয়ার কথাও, 'হোম কান্ট্রি'র সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ নেই, সে বিয়েও করেছিল নেপালি পরিবারে। ম্যানসনের বড় ছেলে গয়াগঙ্গার ছোট সায়েব বা য়্যাসিস্টান্ট ম্যানেজার ছিলো, দেখে সায়েব-টায়েব কিছু মনে হয়নি। তাকে নিয়ে লিখতে চাই শুনে ম্যানসন বলেছিল, তুমি তো এই যাচ্ছ, আর আসবে না। লেখা-টেখাও হবে না। অনেকবার তাকে আশ্বস্ত করে বলতে হয়েছিল, না না আসব, এই যে তরাইয়ে তুমি শেষ সায়েব প্ল্যান্টার, সে গল্প লোককে জানানো দরকার। 

ম্যানসনের কথা মিলে গিয়েছিল। গয়াগঙ্গায় ফেরা হয়নি, তার সঙ্গে দেখা করাও যায়নি। অর্ধসমাপ্ত সেই গল্পটা বলবার সুযোগ হল এতদিন পর। ম্যানসন জানতেও পারবে না, তবু বলা। সায়েবরা থাক না থাক, তরাই নিয়ে কিছু বলতে চাইলে সায়েবদের কথা আসতে বাধ্য। তার একটা কারণ, শিলিগুড়ি থেকে পশ্চিমে বাগডোগরা নকশালবাড়ি পানিঘাটা হয়ে মেচি, উত্তরে দাগাপুর শালবাড়ি হয়ে শুকনা, পুবে বৈকুণ্ঠপুরের শালজঙ্গল হয়ে তিস্তা, দার্জিলিং তরাইয়ের যে নিসর্গটা এখন দেখতে পাই, তার প্রায় পুরোটাই সায়েবদের তৈরি। পালাজ্বর, কালাজ্বর এবং হাতী-বাঘ-গন্ডার অধ্যুষিত যে পোড়ো, বাসের অযোগ্য ভূমিকে সায়েবরা এড়িয়ে চলতে চাইত, ১৮৫০ থেকে ১৮৮০-র মধ্যেই সে ভূমির উপনিবেশপূর্ব ইতিহাস-ভূগোল আগাপাছতলা বদলে গেল। ইতিহাস-ভূগোল বদলাল মানে নিসর্গও বদলাল। যে গাছপালা বনজঙ্গলে তরাই ঢাকা ছিলো তারা নিজের জায়গায় থাকল না, যে মানুষেরা তরাইয়ের আদি বাসিন্দা ছিলেন, তাঁরা নতুন সায়েবি নিসর্গের নিচে চাপা পড়ে গেলেন। 

শিলিগুড়ি থেকে নকশালবাড়ি হয়ে ঝকঝকে নতুন রাজপথ নেপাল তরাইয়ে ঢুকছে, সে পথের দুদিকে, পুরোনো মাঠঘাট ক্ষেতখামার গাঁবসত হাসিল করে নতুন দালানকোঠা উঠছে তো উঠছেই। একসময়ের নিঃঝুম মফস্বল শহর শিলিগুড়ি দানবের মতো হাঁ করে ক্রমাগত আশপাশের জমিজিরেত গিলছে। নির্জন নদীতীর, চা বাগানের জমি, বনের পাশের ফাঁকা মাঠ, পাহাড়ের ঠিক নিচের পাথুরে ডাঙা, কিচ্ছু বাদ থাকছে না। যেখানে শহর হচ্ছে না, সেখানে কাঁটাতারে ঘেরা সেনাছাউনি, কোথাও মিলিটারি, কোথাও সীমান্তরক্ষী বিএসএফ, এস এস বি। সায়েবরা নেই, এক্কেবারে, কোত্থাও নেই, অথচ নিসর্গবদলের সায়েবি প্রক্রিয়া চলছেই।

আরও পড়ুন
তরাই-মোরাং : ভূগোল-ইতিহাসের সন্ধানে

সায়েবরা আসার আগে নিসর্গবদল ঘটত না, এমন নয়। আদি প্রাকৃতিক বনজঙ্গলে জুমিয়ারা চাষ করতেন, থাকতেন। বন কাটা হত, বনে আগুন লাগত। বনের চেহারা বদলাত। এক চাষের জায়গা থেকে অন্য চাষের জায়গায় মানুষ যেতেন, নতুন গ্রামও তৈরি হত। অথচ তরাইয়ের আদি জুমিয়া বাসিন্দা যে মেচ এবং ধিমালরা, তাঁদের ভাষায় গ্রামের কোন প্রতিশব্দ ছিল না, চাষবাসেরও না। চাষকে মেচরা বলতেন বন কাটা বা পোড়ানো। জুমচাষের জন্য যে নিসর্গবদল ঘটতো, তার ছন্দ ছিল প্রাকৃতিক। বনের, মাটির, আবহাওয়া-জলবায়ুর চরিত্রে সে ছন্দ মিশে থাকত, প্রকৃতির নিয়মের বাইরে মানুষ যেতে পারতেন না। চাইতেনও না। 

যুদ্ধবিগ্রহ এবং অন্যান্য কারণেও নিসর্গ বদলাত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আসার আগে তরাই অঞ্চলে যে চিরস্থায়ী রাজনৈতিক শান্তি বিরাজ করতো, এমনটি আদৌ নয়। বুকানন-হ্যামিলটনের গোর্খা রাজত্বের বৃত্তান্ত থেকে জানা যাচ্ছে, আঠেরো শতক জুড়ে, হয়তো বা তার আগে থেকেই পূর্ব নেপালের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যুদ্ধবিগ্রহ চলছিলো। পুবে তিস্তা থেকে পশ্চিমে কানকেয়ি নদী অবধি পুরো ওপর-পাহাড় ছিলো লাপ-চা(লেপচা) রাজত্বের অংশ। কানকেয়ির ওপার থেকে কোশি নদী অবধি ওপর-পাহাড়, কোশি থেকে মেচি পর্যন্ত পাদশৈল এলাকা এবং নিচের মোরাং(এখনকার নেপালের তিনটে জেলা, মোরাং, ঝাপা আর সুনসারি) ছিলো আদি কিরাত রাজত্বের অংশ। সতেরো শতকের মাঝামাঝি, সেন রাজারা, যাদের রাজধানী ছিলো বিজয়পুরে(এখনকার ধারান শহর), কোসি থেকে মেচি পর্যন্ত মোরাং এলাকার দখল নেয়। ওপর-পাহাড় সেসময় ছিল সিকিম বা লেপচা রাজত্বের মধ্যে। ১৭৬৮ থেকে যুদ্ধ চালিয়ে ১৭৭৪-এ আনুষ্ঠানিকভাবে গোর্খারা এই এলাকার দখল নেয়। এলাকা বলতে ওপর পাহাড় এবং মোরাং, দুটোই। মেচির এপারের যে মোরাং, সেখানেও গোর্খারা ঢুকে আসে, তিস্তা পেরিয়ে দুয়ার এলাকাতেও পৌঁছে যায়। ওপর-পাহাড় থেকে গোর্খাদের তাড়া খেয়ে সিকিম রাজা তিব্বতে পালিয়ে যান। বুকানন-হ্যামিলটন যে সময়কার কথা বলছেন, ১৮০৮-৯ নাগাদ সিকিম রাজত্ব ছোটো হতে হতে কার্যত তিস্তা এবং রঙ্গিতের মধ্যের এক ফালি জমিতে আটকা, সে জায়গাটাকে ডাকা হতো গানধাওক বলে। সিকিম রাজার প্রবল পরাক্রান্ত লেপচা সেনাপতি ছাংজেদ ছথুপ, ওরফে আথিংপোই, ওরফে শত্রাজিৎ নিজের লোকজন নিয়ে গানধাওক ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখান থেকে হানাদার গোর্খাদের সঙ্গে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন। সিকিম রাজত্বের উত্থানপতন ও সে রাজত্বে লেপচাদের ভূমিকা নিয়ে রিসলের সিকিম গ্যাজেটিয়ারে বিশদ বিবরণ আছে। সেসব গল্প অন্যত্র করা যাবে। 

আরও পড়ুন
তরাইয়ের অরণ্যে

কোম্পানির লোকজন তরাইয়ে ঢুকে পড়ার প্রাকমুহূর্ত অবধি জলাজঙ্গলে ঘেরা, বড় বড় ঘাসে ভর্তি এই অঞ্চলে শান্তি বলতে কিছু ছিল না। মেচ, ধিমাল আর রাজবংশিরা ছিলেন সিকিমের প্রজা, সিকিম রাজাকে তারা কর দিতেন। বছরে অন্তত তিনবার রাজকার্যে তাদের বেগার খাটতেও হত। সিকিম রাজা চলে গিয়ে গোর্খা রাজা এলেন, তাঁরা তাঁকেও কর দিতে থাকলেন। জুমিয়াদের স্থায়ী চাষ এলাকা ছিল না, ফলে জমি মেপে কর ধার্য করার সুযোগও ছিল না। পাহাড়ে লেপচা আর লিম্বু, তরাইয়ে মেচ আর ধিমালরদের কর ধরা হত দা বা নিড়ানি দিয়ে। যতগুলো দা, তত কর। গাঁ বা মণ্ডল, অর্থাৎ গ্রামপ্রধানের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করত চৌধুরিরা। চৌধুরি বলতে কর-সংগ্রাহক, এবং জমিদারস্থানীয় মাতব্বর, দূরের রাজার খাস প্রতিনিধি। ১৮৩৯ সাল, পাহাড়ে ওঠার জন্য পাঙ্খাবাড়ি রোড বানানোর কাজ সবে শুরু হয়েছে। রাস্তার কাজের জন্য নিচ পাহাড় ও তরাই থেকে মেচদের নিয়ে আসতো বীর সিং চৌধুরি(সব সময় ঠিকঠাক লোক অর্থাৎ কুলি এসে পৌঁছোত না, গণ্ডগোল লেগেই থাকত)। দার্জিলিং তরাই তখনও সিকিম রাজাকে কর দেয়। ক্যাম্পবেলকে বীর সিং জানাল বালাসন থেকে মহানন্দা পর্যন্ত মোরাং এলাকার যাবতীয় মেচ, ধিমাল আর দু চার ঘর গারো(?) প্রজা নিয়ে সে রাজা বদলাতে চায়। রাজা বদল মানে সে আর সিকিম রাজাকে কর দেবে না, কোম্পানি রাজাকে দেবে। এই প্রস্তাবে সায় দিয়ে, বীর সিং এর প্রচুর প্রশংসা করে ক্যাম্পবেল কোম্পানিকে যে চিঠি লেখেন, তার উত্তরে কোম্পানি বলে, উত্তম প্রস্তাব, বীর সিং আসতেই পারে। তবে তার আগে দেখতে হবে বীর সিং এর এলাকা থেকে আদায়তসিল কী হয়, রাজার কাছে কিছু বকেয়া আছে কিনা, বীর সিং যে প্রজাদের কথা বলছে তাদের মধ্যে কেউ ইতিমধ্যেই কোম্পানির এলাকায় বাস করছে কিনা। সেইমতো বিশদ খবর নিয়ে ক্যাম্পবেল দ্রুত বিস্তারিত হিসাব পেশ করেন। বীর সিংয়ের এলাকা থেকে মোট বার্ষিক আয় ৯৫৯ টাকা মতো, যা থেকে চৌধুরীর আর মণ্ডলদের(ক্যাম্পবেল বলছেন 'মন্ডিল') বখরা বাদ দিলে থাকে ৬৯২ টাকা মতো। ক্যাম্পবেল যে হিসেব দেন তাতে দেখা যায় ঘর পিছু দুটো দা হিসেবে কর ধার্য হচ্ছে। গ্রামে মোট যে কর উঠছে, তার ১২ থেকে ২৫ শতাংশ পাচ্ছে মন্ডলেরা। 

ক্যাম্পবেলের হিসাব ১৮৩৯-এর। আট বছর পর, ১৮৪৭-এ, হজসনের, অর্থাৎ ব্রায়ান হাটন হজসনের প্রসিদ্ধ অন দি কোচ, বোরো য়্যান্ড ধিমাল ট্রাইবস(কোচ, বোরো এবং ধিমাল জনজাতি সম্পর্কে) প্রকাশিত হচ্ছে। সেকালের সায়েব রাজকর্মচারী বা সিভিল সার্ভেন্টদের অনেকেই বহু গুণের আকর ছিলেন, তাঁদের মধ্যেও হজসন উজ্জ্বল নক্ষত্রসম। দীর্ঘকাল নেপাল ও দার্জিলিং-এ কাটিয়েছেন, হিমালয়ের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন, ভাষা শিখেছেন। ভাষাতত্ব এবং নৃতত্ব থেকে উদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণীবিদ্যায় তাঁর অনায়াস বিচরণ ছিল। একাধিক উদ্ভিদ ও প্রাণীর নামের সঙ্গে আবিষ্কারক হিসেবে তাঁর নাম যুক্ত হয়ে আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একনিষ্ঠ সমর্থক হওয়া সত্বেও হজসনের জাত-গোঁড়ামি ছিল না, মেহেরুন্নেসা নামক এক কাশ্মীরি মহিলার সঙ্গে তাঁর দীর্ঘদিনের সহবাস ছিল। 

আরও পড়ুন
বনপথ ধরে--মাহালদি নদী, শুকনা-সেভকের জঙ্গল

তরাই-এর আদি বাসিন্দাদের নিয়ে হজসনের লেখাটায় চোখ বুলোনো ছিল। ভালো করে পড়তে গিয়ে দেখলাম এ লেখার জাত আলাদা। সায়েবরা নেটিভ বর্বরদের দেখছে, জানছে, তথ্য সংগ্রহ করে লিখে রাখছে, ঔপনিবেশিক বয়ানের এই সাধারণ ধারায় হজসনের লেখাটাকে ফেলা যাবে না। বিশেষত মেচ আর ধিমালদের প্রকৃতি-নির্ভর জুমিয়া জীবনযাত্রার যে অমূল্য ছবি হজসন গভীর মমতা, এমনকি শ্রদ্ধার সঙ্গে লিপিবদ্ধ করেছেন, তাঁর সঙ্গে তুলনীয় অন্য ঔপনিবেশিক ভাষ্যের কথা মনে পড়ছে না। সায়েবমাত্রেই স্থানীয়দের বর্বর, জংলি, অশুদ্ধ, ইতর, এসব ভাবতেন না, গায়ের রং আর শরীরের গঠন দিয়ে মানুষের ভালোমন্দ বিচারও করতেন না। এল এ ওয়াডেলের কথা আগে বলেছি, লেপচা এবং তিব্বতিদের নিয়ে যাঁর লেখা এখনো পড়া যায়। এর উল্টোদিকটায় অবশ্য কট্টর উপনিবেশপন্থী সায়েব রাজপুরুষেরা ছিলেন। দার্জিলিং অর্থাৎ সিকিম হিমালয়ের যে অঞ্চল নিয়ে কথা হচ্ছে, সেখানকার বাসিন্দাদের নিয়ে প্রথমদিকের সায়েবি বয়ানে একদিকে শ্বেতমাহাত্ম্য অন্যদিকে ব্রাহ্মণ্যবাদের গুণকীর্তন। বুকানন-হ্যামিলটনের লেখায় স্থানীয়দের দেখা হচ্ছে হিন্দু শাসকদের চোখ দিয়ে, কে শুদ্ধ, কে অশুদ্ধ, কে আচার পালন করে কে করে না, কে গোমাংস যথা নিষিদ্ধ কুখাদ্য খায়। হবার কথাও। কোম্পানির লোকজন যখন বাংলা দখল করছে, দিল্লির মুঘল সম্রাট এবং মুঘলদের ভাঙা রাজত্বের বিভিন্ন টুকরোয় যে সব মুসলিম শাসকেরা ছিলেন, সায়েবদের পয়লা নম্বর শত্রু ছিলেন তাঁরা। মুসলিম বিরোধী দিশি বয়ান বলতে হিন্দুদের, অর্থাৎ হিন্দু ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়দের। মোটামুটি তেরো শতক থেকে উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ ক্ষত্রিয়রা নেপালে ঢুকতে থাকেন, স্থানীয় আদিবাসীদের প্রকৃতিধর্ম এবং বিভিন্নধর্মী বৌদ্ধবাদের ওপর ব্রাহ্মণ্যধর্ম চেপে বসতে থাকে। তরাই-মোরাং য়ের সেনরাজা, তিস্তার ওপারে এপারে কোচ রাজত্ব, তার আগের খ্যেন রাজত্ব, আরো পূর্বদিকে গেলে আহোম রাজত্ব, কচারি রাজত্ব, জয়ন্তিয়া রাজত্ব, মণিপুর এর সবগুলোতেই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাব ছিল। তরাই-মোরাং এবং পূর্ব হিমালয় অঞ্চলের ক্ষেত্রে আঠেরো শতকের গোর্খা বিজয়যাত্রা সে প্রভাবকে গভীরতর করে, পুরোনো সংস্কৃতি ইতিহাস জীবন, শাসকদের আমদানি করা ব্রাহ্মণ্যবাদী আধিপত্যের তলায় প্রায় চাপা পড়ে যায়। 

তরাই-এর জুমিয়া সমাজজীবন ধ্বংস হয়ে যায় ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং সায়েবশাসনের যুগপৎ আক্রমণে। আঠেরোশো সাত থেকে আঠেরোশো চোদ্দ অবধি কোম্পানি-অধিকৃত বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যে তথ্য সংগ্রহ করে   বুকানন-হ্যামিলটন কোম্পানির কর্তাদের কাছে জমা করেছিলেন, তার ওপর ভিত্তি করে মন্টগোমারী মার্টিন একটি বই তৈরি করেন ১৮৩৮-এ। দি হিস্ট্রি, য়্যান্টিকুইটিস, টোপোগ্রাফি য়্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্স অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া নামের এই বইয়ে দেখা যাচ্ছে, ১৮০৭ নাগাদ পূব-পশ্চিমে রংপুরের বিস্তৃতি ছিল এদিকে তিতলিয়া থেকে ওদিকে গোয়ালপাড়া। এই বিস্তীর্ণ এলাকার প্রধান জনগোষ্ঠী ছিলেন কোচেরা। বুকানন-হ্যামিলটন অবাক হয়ে দেখেছিলেন কোচেরা কেউ আর নিজেদের কোচ বলে পরিচয় দেন না, এমনকি কোচ শব্দটাকেই অপবিত্র, ঘৃণ্য বলে মনে করা হয়। কোচ ভাষাতে কথাও কেউ বলেন না, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সবাই কথা বলেন এক ধরণের ভাঙা বাংলায়। আদি কোচ ভাষায় কথা বলা মানুষদের খুঁজে পাওয়া গিয়েছিলো গোয়ালপাড়ার কাছে, তাঁরা নিজেদের পরিচয় দিতেন পানি-কোচ বলে। পানি-কোচেরা ছিলেন জুমিয়া, তাঁরা বনেই থাকতেন, প্রকৃতি-উপাসনা করতেন। ১৮৩৯-এ ক্যাম্পবেল এবং ১৮৪৬-এ হজসন মেচদের নিয়ে লিখছেন, তখনো অবধি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম বলতে তাঁদের কিছু নেই, ধর্ম নিয়ে মানুষজন ভাবেনও না খুব একটা। ধিমালরাও তথৈবচ। মেচ এবং ধিমাল, এঁদের নিজস্ব আদিদেবতা এবং সৃষ্টিপুরাণ ইত্যাদি ছিল বটে, কিন্তু হজসনের মনে হয়েছিলো সে সব দেবদেবী আসলে অন্য কিছুর নামান্তর। যেমন ধিমালদের আদি দেবতা ওয়ারঙ-বেরাং, যার মানে 'প্রাচীনেরা', বা দেবতাদের বাবা মা। এঁরা দুজন বিবাহিত, পুরুষের নাম পছিমা, নারীর নাম তিমাই ভেল তিমাঙ। হজসনের বক্তব্য ছিলো তিমাই ভেল তিমাঙ নিশ্চিতভাবেই তিস্তা নদী। পছিমা বলতে ধরলা নদীকে বোঝানো হতে পারে। মেচদের আদি ও প্রধান দেবতা বাথো, তাঁর স্ত্রী মইনন বা মইনঙ। প্রত্যেক মেচ পরিবারের বাড়ির উঠোনে একটা করে সিজ গাছ লাগানো থাকতো। বাথোর পূজো দেওয়া হত সেই গাছে। হজসন লক্ষ্য করেছিলেন মেচ আর ধিমালদের মধ্যে কালি আর শিব যথা হিন্দু দেবদেবীর পূজার প্রচলন হচ্ছে। 

আরও পড়ুন
পথের কথা: ওল্ড মিলিটারি রোড

হিন্দু রীতিনীতি ধর্ম-অভ্যাস দ্রুত জুমিয়া সমাজে ঢুকে আসে। ১৮৭২-এ ডাল্টনের বিখ্যাত ডেস্ক্রিপটিভ এথনোলজি অব বেঙ্গল প্রকাশিত হচ্ছে। সে বইয়ে মেচ এবং ধিমালদের সম্পর্কে নতুন তথ্য কিছু নেই। ১৮৯২-তে রিসলের(ডব্লিউ ডব্লিউ রিসলে, সিকিমের গ্যাজেটিয়ার যিনি সংকলন করেছিলেন সেই রিসলে আর এই রিসলে এক নন) মহাগ্রন্থ ট্রাইবস য়্যান্ড কাস্টস অব বেঙ্গলের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হচ্ছে। ১৮৪৬-এ হজসন হিসাব করেছিলেন তরাইয়ে আনুমানিক ১৫০০০ ধিমালের বাস। ১৮৭২ আর ১৮৮১-র জনগণনার উল্লেখ করে রিসলে জানাচ্ছেন, ধিমালদের সংখ্যাটা যথাক্রমে ৮৭৩ এবং ৬৬২। বাকিরা কোথায় গেলেন? রিসলের বক্তব্য, ধিমালরা প্রায় সবাই হিন্দু এবং রাজবংশী হয়ে গেছেন। তারা ধিমাল পরিচয় বহন করতে চান না, নিজেদের পদবী বলেন মৌলিক(সম্ভবত ওটা মল্লিক হবে--তরাইয়ে যে কটি ধিমাল পরিবার অদ্যবধি টিঁকে আছেন, সবাই মল্লিক পদবি ব্যবহার করেন)। রিসলে দেখেছিলেন, পুরোনো দেবদেবীর কথা ধিমালরা ভুলে গিয়েছেন পুরোপুরি, নদী বা আকাশ বা নক্ষত্র এ সবের কিছুই আর উপাস্য নয়। ঘরে ঘরে হিন্দু দেবদেবী ঢুকে এসেছেন। 

বুকানন-হ্যামিলটনের গোর্খা ইতিহাস নিয়ে বইটা থেকে জানা যায়, বালা-কঙ্গিয়ার(সম্ভবত বালাসন) নদীর পাড়ে দিমালি(অথবা সিওমালি) বলে একটা বাজার ছিল, সেখানে একজন লেপচা কর-সংগ্রাহকের কাছারি ছিল, তাকে সাহায্য করত চারজন বাঙালি মুন্সী। নিচের ব্যাপারীরা নিয়ে আসত নুন, তামাক, সুতির কাপড়, ছাগল, মুরগি, শুয়োরছানা, লোহা, মাঝেমাঝে প্রবাল। তারা নিয়ে যেতো ষষ্ঠিমধু, তুলো, মৌচাক-ভাঙা মোম, কম্বল, ঘোড়া, কস্তুরী, ষাঁড়ের লেজ, চিনা ফুলছাপ রেশম আর গণ্ডারের সিং। 

দিমালি বা সিওমালি জায়গাটাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বালাসন নদীর পাড়ে শিমূলবাড়ি বলে একটা চা-বাগান অবশ্য আছে। সেখানে এখনো বড় হাট বসে, বেচাকেনা হয়। ওই পথ চলে যাচ্ছে বালাসন নদী পেরিয়ে পানিঘাটায়। পানিঘাটা থেকে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে আড়াআড়ি পশ্চিমমুখো গেলে বেলগাছি চা-বাগান হয়ে আর একটা পথ গিয়েছে লোহাগড়ের দিকে। হুকারের হিমালয়ান জর্নলে লোহাগড় এলাকার কথা আছে। একটু এগুলেই মেচি নদী, কোম্পানির রাজত্বের সীমা। মেচির আগে আসবে মানঝা নদী, প্রায় সারাবছর শুকনো থাকে। যখন জল আসে, পাড় ভেঙে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। এই এলাকায় এখন ছোটনাগপুরী আদিবাসীদের বাস। অনেক বছর পর বেলগাছি বাগানের ভিতর দিয়ে লোহাগড়ের দিকে যাচ্ছি। আকাশ ধোঁয়াটে, মেঘলা। গোল লাল চাকার মতো সূর্য, একবার মাত্র দেখা গেলো। শীতের ছোট বিকেল, বেলগাছি ছাড়িয়ে পথ উঁচুতে উঠছে, ডানহাতে শুকনো মানঝা নদী, বাঁ দিকে বনে ঢাকা পাহাড় মেচি নদীতে নামছে। লোহাগড় মোড় আসার আগে হিলেখোলা নদীর শীর্ণ জলধারা। মানঝার ওপারের টিলাপাহাড় জংগলাকীর্ণ। লোহাগড়ের দিকে যাব, সাইকেল থামিয়ে এক আদিবাসী শ্রমিক দাঁড় করালেন। তাড়াতাড়ি ফিরে যান, রাস্তায় অনেক হাতি। 

নকসালবাড়ি হয়ে বাগডোগরার বড় রাস্তা ধরতে ধরতে সন্ধ্যা নামল। বড় রাস্তা বলতে এশীয় মহাসড়ক, তা দিয়ে যেতে গেলে কর দিতে হয়। নকসালবাড়ি, হাতীঘিসা, স্কুলডাঙ্গি, আলোয় ঝলমল করছে। ডানহাতে টুকরিয়াঝাড়ের বন। আরো ভিতরে গেলে বুড়হাগঞ্জ। এই সব জায়গা নকসালবাড়ি কৃষক বিদ্রোহের জন্য বিখ্যাত। দার্জিলিং তরাইয়ের শেষ ধিমালরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই অঞ্চলে বাস করেন। বন্ধু রূপক মুখোপাধ্যায় দীর্ঘসময় ধরে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক কাজ করেছেন, খবর দিলেন তরাইয়ে এখন সাকুল্যে হাজার খানেক ধিমাল আছেন। তাঁদের মধ্যে ধিমাল ভাষায় কথা বলেন মাত্র ৩৭৫ জন। এই তথ্য যিনি দিয়েছেন, গর্জন মল্লিক, প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক, তাঁকে একবার দুবার দেখেছি। ছোটখাটো মানুষ, ধিমালদের তফসিলি উপজাতি হিসেবে সরকারি স্বীকৃতি আদায়ের জন্য অনেকদিন ধরে এঘাটে ওঘাটে ঘুরছেন। পেলে সম্প্রদায়ের লোকজনের চাকরির সুবিধা হয়। 

শিলিগুড়ি আসার পথে বালাসন নদী, মহানন্দা নদী পেরুতে হল। অন্ধকার নেমেছে, কিছু দেখা যায় না। গেলে দেখা যেত, যতদূর চোখ যায়, নদীর বুক খুবলোনো, বড়ো বড়ো গর্ত। হলুদ রঙের মাটি কাটার মেশিন গোঁগোঁ শব্দে পাথর তুলছে, লড়ঝড়ে ট্রাকে বোঝাই হয়ে সেই পাথরবালি শহরে যাচ্ছে। ধিমালরা কেন, নদীকে কেউই আর দেবতা মনে করেন না আজকাল।

Powered by Froala Editor