আরো সিঙ্কোনা-কাহিনি

সময়ভ্রমণ – ১১

আগের পর্বে

মংপুর এবং মৈত্রেয়ী দেবীর আলোচনাতেই উঠে এসেছিল সিঙ্কোনার কথা। তবে এই সিঙ্কোনার গল্প শুধুমাত্র মংপু-সুরেলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বরং তার সূত্র খুঁজতে গেলে যেতে হবে পেরু আর দক্ষিণ আমেরিকায়। কারণ সিঙ্কোনার আদি বাসস্থান হল পেরু, ইকুয়েডর, ভেনেজুয়ালা সহ আন্দিজের চিরহরিৎ দুর্গম বন। কালক্রমনে ইউরোপীয়দের হাত ধরে প্রথমে ইউরোপ সেখান থেকে মাদ্রাজ, কলকাতায় এসে পৌঁছায় সিঙ্কোনা। ছড়িয়ে পড়ে ভারতের পার্বত্য অঞ্চলে। আর তার চাষ ঘিরেই বদলে যায় ছবি। বাগান ঘিরে গড়ে ওঠে নতুন বসত। সিঙ্কোনার আবিষ্কার এবং তার ভারতে পৌঁছানোর গল্পের পর শুরু হচ্ছে নতুন পর্ব...

ব্রিটিশ সায়েবরা এবং অন্য ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকেরা পৃথিবীর খোলনলচে বদলে দিয়েছিলেন। এক মহাদেশের মানুষকে অন্য মহাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হল, দাস-শ্রমিক, সস্তার শ্রমিক বানিয়ে। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে উনিশ শতকের পুরোটা আর বিশ শতকের অর্ধেকের বেশি জুড়ে পৃথিবীর ইতিহাস ভূগোল সব ওলটপালট হয়ে গেল। শুধু ইতিহাস ভূগোল নয়, পাল্টাল প্রকৃতিও। আধুনিক উপনিবেশকাল শুরু হবার আগে প্রকৃতি একরকম ছিল। মাঠঘাটনদীনালাবনপাহাড় এসবের মধ্যে মানুষ থাকতেন, না-মানুষেরাও। বন কেটে বসত হত, চাষ হত, আবার গ্রামনগর ঢেকে বন ফিরে আসত। বেশি দূরে যাবার দরকার নেই। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা বিজয় এবং পরবর্তী একশো বছরের কোম্পানি শাসনের ইতিবৃত্ত নিয়ে ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের বিখ্যাত লেখা, গ্রামবাংলার রোজনামচা বা অ্যানালস অব রুরাল বেঙ্গল। সে লেখায় হান্টার সায়েব বলছেন কীভাবে কোম্পানি শাসনের শুরুর দিকের মন্বন্তরে একের পর এক গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে, ফিরে আসছে বাঘ-ডাকা গহন বন।

মানুষ পোকার মতো মরছে, ক্ষেত ঢেকে হাহা করছে জঙ্গল, ওদিকে কোম্পানির লাটসায়েব হেস্টিংস খাজনা আদায় করছেন। সায়েবরা তাঁদের উপনিবেশগুলোর প্রকৃতি, মানুষ, না-মানুষ, এসবকে দেখতেন প্রধানত খাজনার চোখ দিয়ে। কোন জমি কত খাজনা দেবে। যদি খাজনাযোগ্য না হয়, জমিতে এমন কিছু করো যা খাজনা বেশি দেয়। তিন চারটে মহাদেশের ইতিহাস ভূগোল প্রকৃতি সব যে বদলে গেল, তার পিছনে খাজনা বাড়ানোর তাগিদটাই ছিল মুখ্য।

মাঝে মাঝে মনে হয়, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে দীর্ঘ দীর্ঘ পাড়ি দেয় যে পাখির দল, তাদের চোখ এই বদলটা দেখছিল কী করে? পরিযায়ী কালো সারসের বা লালচে-বাদামি বালিহাঁসের চোখের মণির পাতায় ছাপ রেখে যাওয়া নিসর্গ-বদলের ছবিগুলোকে পড়া যেত যদি, কত কিছু জানা যেত তাহলে। দুই আমেরিকার পাম্পাস বা প্রান্তর হাসিল করে চাষ শুরু হল, কফির, তুলোর, চিনির, কোকার। এশিয়া আফ্রিকার বনজঙ্গল ঘাসজমি নির্দ্বিধায় ধ্বংস করে কফি, চা, রাবারের চাষ শুরু হল। হিমালয়ের বন নষ্ট করে লাগানো হল চা। যেখানে গ্রাম ছিল, মানুষ ছিল, থাকল না। যেখানে আদিগন্তবিস্তৃত ধূধূ বন্যতা, সেখানে গজিয়ে উঠল শহর, সেনাছাউনি, গ্রাম, বাজারহাট। এক নিসর্গের ওপর অন্য নিসর্গের শাসন। এক ইতিহাসের ওপর চেপে বসা অন্য ইতিহাস। স্থানীয় ভূগোলের ওপর ঔপনিবেশিক ভূগোল।

ভারতবর্ষে চা আর সিঙ্কোনার আবাদ শুরু হয় প্রায় সমসময়ে। সিঙ্কোনার ক্ষেত্রে সায়েবরা অবশ্য খাজনা নয়, মানবকল্যাণের কথা বলছেন বারবার। কত লোক ম্যালেরিয়ায় ভুগে বেঘোরে মারা যাচ্ছে, তাঁদের বাঁচাতে গেলে সিঙ্কোনার যোগান চাই। আন্দিজের বনে সিঙ্কোনা কমতে কমতে বিলুপ্তপ্রায়, তার জন্য নতুন বাসা জোগাড় করো। ফলে মারখ্যাম, স্প্রুস, ক্রস, গাছশিকার, সে গাছ ভারতে পাঠানো। মানবকল্যাণের জন্য ব্রিটিশ ভারতে সিঙ্কোনার চাষ চাই, এরকম একটা কথা চালু হয়ে গেল। কথাটা অর্ধসত্য কিম্বা সর্বৈব মিথ্যা। সিঙ্কোনা থেকে কুইনাইন পাওয়া যায়, কুইনাইন ম্যালেরিয়ার একমাত্র ওষুধ, এ পর্যন্ত ঠিক। উনিশ শতকের গোড়াতেই এই ঠিক কথাটা জানা হয়ে গিয়েছিল। ম্যালেরিয়াতে তৎকালীন ব্রিটিশ উপনিবেশগুলোতে  হুহু করে লোক মারা যাচ্ছিলই। অথচ আন্দিজে অভিযান পাঠাতে এত দেরি হল কেন? ১৮৩৫-এ সাহারানপুরের বট্যানিকাল গার্ডেনের অধ্যক্ষ ডক্টর ফর্বস কোম্পানি বাহাদূরকে চিঠি লিখে বলছেন, নীলগিরি এবং খাসিয়া পাহাড়ে সিঙ্কোনা লাগানো হোক। ১৮৪৭-এ, ৫৩-য় এবং ৫৬-য় তিনি আবার সরকারকে চিঠি লেখেন। ১৮৫০-এ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কলকাতাস্থ প্রধান চিকিৎসক বা অ্যাপথেকারি জেনরল ডক্টর গ্র্যান্ট এই একই প্রস্তাব দেন। ১৮৫২-য়, কলকাতা বট্যানিকাল গার্ডেনের অধ্যক্ষ ডক্টর ফ্যালকনের প্রস্তাব, ভালো জাতের সিঙ্কোনার চারা এবং বীজ নিয়ে আসার জন্য কোনো শিক্ষিত গাছ-সংগ্রাহকের নেতৃত্বে দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে অভিযান দল পাঠানো হোক। কোম্পানি সরকার এ প্রস্তাব খারিজ করে। এর তিন বছর পর ফ্যালকনের উত্তরসূরি, কলকাতা বট্যানিকাল গার্ডেনের অধ্যক্ষ, ডক্টর টি থমসন, একই প্রস্তাব দেন। ডক্টর টি অ্যান্ডারসন, যাঁর হাত ধরে দার্জিলিং পাহাড়ে সিঙ্কোনা চাষ এর বছর কয়েক বাদেই শুরু হবে, থমসনকে সমর্থন করেন। ভারতের মেডিক্যাল বোর্ড বিস্তারিত সভাবিবরণী লিখে থমসন ও য়্যান্ডারসনের মতে সায় দেয়। এত সবের পর, ১৮৫৮-য়, দক্ষিণ আমেরিকা অভিযানের পক্ষে সরকারি সম্মতি মেলে, ১৮৬০-এ মারখ্যাম আন্দিজে পৌঁছোন। ১৮৬২-তে মারখ্যামের বইটা ছাপা হয়।

আরও পড়ুন
সিঙ্কোনা-কাহিনি

লুসিল ব্রকওয়ে, জাহিন বাবর ও নন্দিনী ভট্টাচার্যের গবেষণাকাজ থেকে জানা যাচ্ছে, ১৮৫৭-র সিপাহি বিদ্রোহ পরবর্তী সময়ে, ভারতে ব্রিটিশদের সংখ্যা বেড়ে যায়। কোম্পানির শাসন শেষ, রাণীর শাসন শুরু, ভারতে অনেক বেশি সংখ্যায় গোরা সৈন্য মোতায়েন করা দরকার। সেই সঙ্গে ফরমান, নেটিভদের সঙ্গে বিন্দুমাত্র মেলামেশা চলবে না, সপরিবার ভারতে আসতে হবে। সদ্য ভারতে আসা ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী, এবং তাঁদের পরিবারের লোকজন ম্যালেরিয়ার ধাক্কা সামলাতে পারছেন না। ওদিকে পেরু বা বলিভিয়া থেকে সিঙ্কোনার ছাল কিনতে জলের মতো অর্থব্যয় হচ্ছে। ১৮৪৯ থেকে ৫৩ পর্যন্ত এই চার বছরেই  সিঙ্কোনা বাবদ ৫৪ হাজার পাউন্ড স্টার্লিং খরচা হয়েছে। মিউটিনির পরে সে খরচা বহুগুণ বেড়ে যাওয়ার কথা। মানবকল্যাণ এবং ভারতের গরিব নেটিভদের চিকিৎসার প্রয়োজনের চেয়ে অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল ভারতে কর্মরত ব্রিটিশদের জীবন বাঁচানো। যা কুইনাইন ভারতে তৈরি হত, তার সিংহভাগ যেতো সেনাছাউনিতে আর ব্রিটিশ রাজপুরুষ ও তাঁদের পরিবারের কাছে। পরে পোস্টাপিস থেকে কুইনাইন সালফেট বিক্রি করার ব্যবস্থা হয়। কিন্ত দেশীয় মানুষদের মধ্যে কজন পোস্টাপিস খুঁজে সেখান থেকে কুইনাইন কিনতে পারতেন? শুরুর দিকে, নেটিভদের জন্য সাধারণত পাঠানো হত লাল ছালের সিঙ্কোনা থেকে পাওয়া নিম্নমানের কুইনাইন গুঁড়ো, যাকে বলা হত ফেব্রিফিউজ। নেটিভ এবং ব্রিটিশদের জন্য যে আলাদা মানের কুইনাইন নির্দিষ্ট ছিল, তা জানা যাচ্ছে ও'ম্যালির দার্জিলিং গ্যাজেটিয়ার থেকেও।

আরও পড়ুন
ন হন্যতে : মৈত্রেয়ী, মংপু ও রবীন্দ্রনাথ

উপনিবেশ রক্ষা, সাম্রাজ্য বাড়ানো এবং ঔপনিবেশিকদের স্বাস্থ্যের প্রয়োজনে ভারতে সিঙ্কোনার চাষ শুরু হল ১৮৬১ নাগাদ। ততদিনে জাভার বনে হলুদ ছাল সিঙ্কোনার চাষ পুরোদমে শুরু হয়ে গেছে। মারখ্যামের দলের আনা চারা বীজ পৌছেছিল নীলগিরি এলাকায়। দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ফিরে মারখ্যাম নিজে নীলগিরি ও লাগোয়া পশ্চিমঘাট পর্বতমালার বনপাহাড়ে ঘুরে ঘুরে সিঙ্কোনা চাষের উপযুক্ত এলাকা খুঁজে বার করার চেষ্টা করেন। যে-কোনো মাটিতে, যে-কোনো আবহাওয়ায়, যে-কোনো উচ্চতায় সিঙ্কোনা বাঁচবে না। যে প্রাকৃতিক নিসর্গের অংশ সিঙ্কোনার যে প্রজাতি, ঠিক সেই রকম নিসর্গ খুঁজে বার করতে হবে। ভালো জাতের ঝোপ-সিঙ্কোনা আন্দিজে হয় ন'হাজার ফুটের ওপরে ঠান্ডা ফাঁকা জায়গায়, ফলে কাছাকাছি উচ্চতার উপযুক্ত এলাকা খুঁজে পেতে হবে। অন্য প্রজাতিগুলো ঘন অরণ্যের গাছ, সেগুলো যেখানে হয় সেখানে সারাবছর বৃষ্টি, কুয়াশা, ভেজা গরম। ফলত ভারতবর্ষের বনেও ওইরকম জায়গা পাওয়া দরকার।

আরও পড়ুন
মংপু, সুরেল ও ‘পাহাড়ী’ রবীন্দ্রনাথ

নীলগিরিতে সিঙ্কোনা চাষ শুরু হল ১৮৬১তে। দার্জিলিং-এ দক্ষিণ আমেরিকার গাছ পৌঁছোয়নি। ফরাসি দলের আনা বীজ থেকে বানানো কিছু গাছ অনেক হাত ঘুরে কলকাতার এসে পৌছেছিল, সেগুলো বাঁচেনি। কলকাতার বট্যানিকাল গার্ডেনের অধ্যক্ষ, ডক্টর থমাস য়্যান্ডারসন গাছ বীজ আনতে জাভা রওনা হয়ে গেলেন। ১৮৬১তেই। ফিরে এলেন, ৪১২টা চারা নিয়ে। উটকামন্ডে কিছু চারা রেখে বাকিটা কলকাতায় নিয়ে আসা হল। মোট ২৪৯টা লাল-ছাল, ফ্যাকাশে ছাল এবং হলুদ-ছালের চারা নিয়ে অ্যান্ডারসন দার্জিলিং পৌঁছলেন ১৮৬২-র মার্চে। ঠিক হয়েছিল, সিঞ্চল পাহাড়ের চুড়োর(যাকে এখন আমরা টাইগার হিল বলে জানি) একটু নিচে সিঙ্কোনার নার্সারি বানানো হবে। বানানো তো হবে? কিন্তু কী করে? ১৮৬৩-র এক রিপোর্টে অ্যান্ডারসন দার্জিলিং-এ সিঙ্কোনা চাষের আদিবৃত্তান্ত বলেছেন। দার্জিলিং থেকে সিঞ্চলের চুড়ো অবধি পৌঁছতে গেলে পথহীন আদিম বনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। লেপচারা কুকরি দিয়ে বন কেটে পথ করে নিচ্ছিল। সিঞ্চল পৌঁছে দেখা গেল সেখানে কিছুই নেই :

আরও পড়ুন
বনের মধ্যে আরো : টঙিয়া, এফ ডি হোল্ডিং আর ইয়েসলু

'কলকাতা ছাড়ার আগে ভেবেছিলাম গিয়ে দেখবো, চারা বানানোর স্থায়ী ঘর, মালির ঘর, কুলিদের কুঁড়ে, সব তৈরি হয়ে গেছে। গিয়ে দেখলাম কিচ্ছু নেই। এসব বানাতে গেলে যে জিনিসপত্র লাগবে তা আনতে গেলে পথের দরকার। বন পাহাড় কেটে আট মাইল লম্বা ঘোড়া চলার মতো পথ বানাতে হবে আগে। অন্তত দু' বছরের আগে কাজ শেষ হবে না। কাজ চালানোর মতো কোন অস্থায়ী ঘরবাড়িও নেই। সিঞ্চলের ঠান্ডা চুড়োয় কিছু ব্যারাক আছে বটে, কিন্তু সেখানে কনজার্ভেটরি বানাতে গেলে কাঁচ নিয়ে আসতে হবে চারশো মাইল দূরের কলকাতা থেকে। মাটির টবও দার্জিলিং এ বানানো হয় না, ফলে সেগুলোও কলকাতা থেকে আনাতে হবে। দুজন বাঙালি মালি নিয়ে আসা হয়েছিল, তারা তিন মাসের মধ্যে কলকাতা ফিরে যাবার জন্য জেদ ধরলো। এখানে বাগানের কাজ জানা শ্রমিকও নেই, ফলে ইউরোপীয় মালিকেই নিজের হাতে সব কাজ করতে হচ্ছে।'

আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ি অঞ্চলের টঙিয়ায়

১৮৬৩ নাগাদ কলকাতা থেকে মালপত্র এসে পৌঁছল। ততদিনে সিঞ্চল থেকে নার্সারি সরিয়ে আনা হয়েছে দার্জিলিং এর ঠিক নিচে লেবঙ-এ। আশপাশের সব জমিতে চা বাগান বসানোর কাজ শুরু হয়ে গেছে। সিঙ্কোনার চাষের জন্য জায়গা পাওয়া গেল রংবি উপত্যকায়, দার্জিলিং থেকে বারো মাইল দূরে, যাবার পথ নেই। বন কেটে কোনোরকমে পথ বার করা হল, লোকলস্কর আর হাজার আড়াই সিঙ্কোনা চারা নিয়ে অ্যান্ডারসন সেখানে পৌঁছলেন ১৮৬৪-র জুনে।

আরও পড়ুন
নীলপাহাড়ির খোঁজে

রংবি নামটা পাওয়া যাচ্ছে য়্যান্ডারসনের রিপোর্টে এবং জর্জ কিং-এর লেখা এ ম্যানুয়াল অফ সিঙ্কোনা কালটিভেশন ইন ইন্ডিয়ায়। কিং এর লেখা বইটি বহুদিন হয় বিস্মৃত। অথচ ভারতে সিঙ্কোনা চাষের ইতিহাস এবং প্রাগেতিহাসের অমূল্য আকর এই বই। কিং নিজে দার্জিলিং হিমালয়ের সিঙ্কোনা চাষের দায়িত্বে ছিলেন। রংবি উপত্যকার বর্ণনা দিয়েছেন কিং: উচ্চতা ৪৪১০ ফুট। সিঞ্চলের প্রধান গিরিশিরা থেকে বেরিয়ে আসা একটা লম্বা বাহুর দক্ষিণ-পূর্ব ঢাল। সে ঢালের নিচের দিকটায় বন পরিষ্কার করে স্থানীয়রা ভুট্টা আর যব ফলাত। এখনো অবধি(১৮৮০ সালে কিং এর বই ছাপা হচ্ছে) ঢালের ওপরের দিকটা বড়ো বড়ো গাছের অনাঘ্রাত অনাবিষ্কৃত বনে ঢাকা। সে সব গাছের গুঁড়িতে পুরু মসের আবরণ, ফার্ন, অর্কিড, উজ্জ্বল বেগোনিয়া ফুল। নিচের তলায় আরো ফার্ন, লতাগুল্ম, এমন কি সিঙ্কোনা গোত্রেরও কিছু গাছ। বেশি ভেজা জায়গাগুলোয় বুনো কলা, দুর্ভেদ্য বেতঝোপ। কিং জানাচ্ছেন, রাংবি ঢালের ওপরের দিকটা প্রায় সারাবছর ঘন কুয়াশায় ঢাকা থাকে। বিকেল সন্ধ্যায় সেই কুয়াশা ঢাল বেয়ে নিচে গড়ায়। ওপরের দিকে শীতে বরফও পড়ে। হিম হয়। মাঝে মাঝে এত জোরে ঝড় আর শিলাবৃষ্টি হয় যে সিঙ্কোনার পাতা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

রাংবি নামটা এখন চালু নেই। মংপু সুরেল ছাড়িয়ে, কালিখোলার সদানীরা খরস্রোত পর্যন্ত পৌঁছোবার কিছু আগে, বনের মধ্য দিয়ে একটা পথ নেমেছে রংগু নদীর দিকে। ওম্যালির গ্যাজেটিয়ারে বলা আছে রঙয়ো উপত্যকা। একবারই সে পথে গিয়েছিলাম। বন শেষ হয়ে গেলে সিঙ্কোনা ঝোপের মধ্য দিয়ে উৎরাই পথ বহু নিচে নেমে গেছে লালঙ গ্রাম পর্যন্ত। গ্রামের আগে সিঙ্কোনা বাগিচার পুরোনো বাংলো। সিঙ্কোনার গল্প ঘাঁটতে গিয়ে মনে হচ্ছে ওই বাড়িটাতেই য়্যান্ডারসন থাকতেন, তাঁর পরে কিং। আরো পুরোনো নতুন ঘরবাড়ি, ছাল শুকোনোর জায়গা। নদী অবধি যেতে গেলে হাঁটতে হয়, যাওয়া হয়নি।

বড় রাস্তায় উঠে মংপু যাবার পথে সুরেলের আগে রিশপ বা রেশপ। মংপু থেকে পথ নেমেছে অনেক নিচে রিয়াং উপত্যকায়। রিয়াং নদী পেরুলে সিটঙ, সে পথ ধরে আরো গেলে লাটপাঞ্চার। আর একটা পথ রাম্বিবাজার, তিস্তা হয়ে চলে গেছে কালিমপঙ এলাকার সিঙ্কোনা বাগানগুলোর দিকে। সিঙ্কোনার গল্প শেষ হয়েও শেষ হতে চায় না, দার্জিলিং কালিম্পং-এর সিঙ্কোনা এলাকা নিয়ে আলাদা করে বলতে হবে।

Powered by Froala Editor