বনপথ ধরে--মাহালদি নদী, শুকনা-সেভকের জঙ্গল

সময়ভ্রমণ – ১৪

আগের পর্বে

সাহেবদের বসতিস্থাপনের আগে স্থানীয়দের জন্য যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিলই পাহাড়ে। আদি পথ।জোসেফ ডালটন হুকারের লেখায় তার উল্লেখ মেলে। ১৮৩৮ সাল নাগাদ কলকাতা থেকে রংপুর হয়ে পাহাড়ে পৌঁছাতে সময় লাগত প্রায় ৬-৭ দিন। সেসব রাস্তা অত্যন্ত দুর্গম। কোথাও বন-জঙ্গল কেটে বার করে নেওয়া সরু পথ। ফলে সাহেবরা শুরু করলেন নতুন পথ বানানো তৈরি হল কার্ট রোড। যা এখন পড়ে আছে নির্জনেই। আরও তলায় বিকল্প রাস্তা তৈরি হয়ে যাওয়ায় গুরুত্ব কমেছে তার। পাঙ্খাবাড়ি থেকে দার্জিলিং যাওয়ার পথনির্মাণ শেষ হয় ১৮৪২ সালে। দৈর্ঘ্য চল্লিশ মাইল। কার্সিয়াং থেকে এগলে ডাউহিল। তার উত্তরে চিমনি। তারপর বাগোড়া। এই সব বনগ্রাম এখনও পথ-হারিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট।

বাগোড়া, লাটপাঞ্চারের কথা এসেছে। বাগোড়া থেকে অসংখ্য যে সব জানা এবং কম-জানা পথ বন পাহাড়ের গোলকধাঁধায় মিলিয়ে গেছে, তাদের কোনো-কোনোটা ধরে এগুলে মাহালদি নদীর বনাচ্ছাদিত গিরিখাত আর শুকনা-সেবকের পুরোনো জঙ্গলে পৌঁছোনো যায়। এ অঞ্চলের বেশির ভাগ নামের মতো, মাহালদিও লেপচা শব্দ। অর্থে, যে নদী কুঁজো হয়ে চলে, বেঁকে যায়। বাগোড়া-লাটপাঞ্চার পথের মাহালদিরাম বলে জায়গাটার নিচের কোন একটা পাহাড় থেকে  মাহালদি নিচের দিকে নামছে, নামার পথে হঠাৎ বাঁক নিচ্ছে, কখনো বাঁয়ে, কখনো ডাইনে। নিচে গিয়ে নাম বদলে যাবে নদীর। লেপচা মাহালদি হয়ে যাবে মহানদী কিম্বা নিতান্তই বাংলা মহানন্দা। নদীর গিরিখাত উপত্যকা ঘিরে যে বন এখনো পর্যন্ত টিঁকে আছে, তার নাম হয়ে যাবে মহানন্দা বন, মহানন্দা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য। ওই বনে বন্য প্রাণ বাঁচিয়ে রাখা হয় বলে অভয়ারণ্য। 

অভয়ারণ্য-টন্য অনেক পরের ব্যাপার। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে সিকিম হিমালয়ে ব্রিটিশ সায়েবদের পা পড়ল যখন, নানান অভিযান, যুদ্ধবিগ্রহ আর ঝগড়াঝাঁটির পর সিকিমের রাজার হাত থেকে দার্জিলিং পাহাড়ের মালিকানা চলে এল সায়েবদের কাছে, মাহালদি নদীর নিচের দিকের বনকে বলা হতো শুকনার জঙ্গল কিম্বা সেভকের জঙ্গল। মাহালদির গিরিখাত যেখানে তরাইয়ের সমতলে মিশে যায়, সেখানে শুকনা, বনের পশ্চিম দিকে। বনের পূর্বে তিস্তা নদী। তিস্তা যেখানে সমতলে নামছে, নেমে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে সেভক, বনের পশ্চিম দিক। যতদূর জানা যায়, ১৮৬৫-তে ভারতীয় বন দপ্তরের পত্তন হবার পর নতুন আইন তৈরি করে শুকনা-সেবকের মধ্যবর্তী এলাকার বনের দখল নেয় সায়েবরা। দখল নেওয়া বনকে ডাকা হতো শুকনা-তিস্তা রিজার্ভ নামে। রিজার্ভ মানে সংরক্ষিত। সায়েব সরকার দ্বারা সংরক্ষিত, সেখানে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ। 

মাহালদি আর রঙ-ন্যিয়োর(তিস্তা) মাঝের পাহাড়ে লেপচাদের বসবাস ছিল, ধরে নেওয়া যায়। শুকনা-তিস্তা অর্থাৎ শুকনা-সেভক রিজার্ভের নিচের দিকটায় বাস করতেন মেচ বা মেচিয়ারা। আইন করে রিজার্ভ তৈরি মানে সে বনে লেপচা, মেচিয়া ইত্যাদি নেটিভদের বাস ওঠা। ১৮৬৫ থেকে ১৮৭৮ এর মধ্যে দফায় দফায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, পুরোদস্তুর 'বন আইন' বানিয়ে বনে কার অধিকার কার অনধিকার এসবের নিষ্পত্তি করা হয়ে গেল। পাহাড়ের লেপচারা আর নিচের মেচিয়ারা ছিলেন বনে থাকা মানুষ, তাদের ঘরবাড়ি চাষবাস জীবনযাপন সবকিছুর সঙ্গে বন জড়িয়ে। লেপচাদের ক্ষেত্রে যেমন, মেচ বা মেচিয়াদের ক্ষেত্রেও কিছু সায়েবদের সহানুভূতি ছিল। সরকারি রিজার্ভ বন থেকে তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল বটে, কিন্তু অনেককেই আবার অন্যত্র জমিজমা দিয়ে বসানো হয়েছিলো নতুন করে। লেপচাদের কথা বলেছি, আরো বলতে হবে। মেচদের কথাও। আজকের সময়টা এমনভাবে, এতটাই বদলেছে, পুরোনো মানুষজন কথাবার্তা বনবাদাড় সব মরা কাঠের গায়ে শুকনো বেরঙ ছত্রাক বা ভাঙা সিংদরজার ক্ষয়ে যাওয়া লোহার ওপরে লাগা লালচে মরচের মতো তুচ্ছ, বাতিল, অকিঞ্চিৎকর, কে খোঁজ রাখে, কে-ই বা মনে করে। 

কথা কথা টেনে আনে। মাহালদির খরস্রোতে যেভাবে অন্য নীল সবুজ ধারা এসে মেশে, এক আখ্যানে বহু আখ্যান মিশে যায়। এই লেখক যে সব গল্পকথা বলতে চাইছে, সেটা আসলে যতটা তার, ততটাই অন্য অনেকেরও। বই ছাপা হবার আগের কালে বই সবাই মিলে বসে পড়া হত, তারও আগে গল্প ছড়াত মুখে মুখে। আমাদের এদিককার গল্পগুলো বেশিরভাগই হারিয়ে গেছে। প্রতিদিন হারাচ্ছে মরে যাচ্ছে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে উদ্ভিদ প্রাণী নদী মাঠ মাটি নিসর্গ কথাবার্তা কাহিনী সম্প্রদায় ভাষা। আজ যা চোখে দেখা যাচ্ছে আগামী দশ কুড়ি বছর কেন দু দশ মাসেও তা থাকবে তো? কোন নিশ্চয়তা নেই। মাহালদি নদীর, শুকনা-সেভকের যে গল্প করতে বসেছি, সেগুলো একসময় সত্যি ছিলো। এখন আছে কিনা কে জানে? মাহালদি, গুলমা, পঞ্চানই আর নন্দীখোলার সাদা-রুপোলি বালির চরে, লাটপাঞ্চারের বিজন বনে, চকলং খোলার গভীরে শেষ হাঁটাহাঁটি ঘোরাঘুরি সে প্রায় বছর কুড়ি আগে। তার মধ্যে কতকিছু হলো, পাহাড়ে কত ধস নামলো, কত ঝর্ণা মরে গেলো, বন চিরে যাওয়া ছোট মিটারগেজ রেললাইন বড় ব্রডগেজ হল, কত ছোটবড় হাতী সে নতুন বড় লাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে মরে গেলো, বনের গা ঘেঁষে, প্রায় মধ্যেই আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হল তিস্তাকে। কিছুই তো আগের মতো থাকে না।

আরও পড়ুন
পথের কথা: ওল্ড মিলিটারি রোড

শিলিগুড়ি শহরের একটু বাইরে গেলেই শুকনা সেভকের বন শুরু হয়ে যায়। পুরোনো তিস্তা ভ্যালি রোড, এখনকার দশ নাম্বার রাজমার্গ সেই বন ফুঁড়ে যাচ্ছে। বাইরে থেকে বদল বোঝা যায় না। পথের দুপাশের শালের বনে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে নতুন চকচকে সবুজ পাতা আসে, বর্ষায় বনের নিচের তলায় লতাগুল্ম হিলহিল বাড়তে বাড়তে জমাট হয়ে যায়, প্রতিটি ক্ষীণকায়া ঝোরায় জল আসে। বনের মধ্যে বনবিভাগের পুরোনো আপিস একইরকম, এক জায়গাতেই। কাঠের বাড়ি, সবুজ রং করা। সাত মাইল, যেখান থেকে বন শুরু হচ্ছে। আট মাইল, যার ধার দিয়ে ঘোড়ামারা যাবার বনপথ। দশ মাইল, যেখানে পুরোনো সমরডাঙা টঙিয়া গ্রাম উঠে এসেছিলো। দশ মাইলের বন অফিসের উল্টোদিকে বনে ঢোকার গেটবন্ধ পথ। দশ মাইল থেকে জারুল আর সেগুনের বন ভেঙে একটুখানি গেলেই ডানদিকে বাঁদিকে পুরো এলাকাটাই ঝাঁ করে নেমে যাচ্ছে তিস্তায়। নদীর মূল স্রোত এখন দূরে সরে গেছে, তাছাড়া কালিঝোরায় বাঁধ পড়ার পর থেকে এক ঘোর বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময় জলই থাকে না সেরকম। দশ মাইল ছাড়িয়ে একটু গিয়েই বনের মধ্যে ডানহাতি পথ চলে যেত পুরোনো সেভক বনবাংলোয়। এলাকার অন্য বাংলোগুলো আগুনে পুড়েছে, সেভক নয়। সেভক বাংলোটাকে সরকারি ভাবে ভাঙচুর করে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাও সে বছর তিরিশ তো হবেই। বড় বড় শালগাছের ছায়ায় ঢাকা ফিকে সবুজ একতলা বাড়িটার কথা ভুলে যাওয়া স্বপ্নের মতো মনে পড়ে। বাংলোর ঠিক নিচে তিস্তা। নদীর পাড়ে বুনোদের নুন খাওয়ার জায়গা করা। সল্ট লিক। তার রঙও সবুজ। সিমেন্টের চাতালে গর্ত মতো করা, সেখানে নুন রাখা হতো। নুন চাটতে আসতো যে সব দুর্ভাগ্য হরিণ বনশুয়োর কিম্বা চিতাবাঘ বাঘ, ওপর থেকে জোরালো, চোখ-ধাঁধানো সার্চলাইটের আলো ফেলে তাদের গুলি করে মারা হত(নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টোপ গল্পটা মনে পড়ে?)। এতে দোষ হত না। শুকনা-তিস্তা রিজার্ভে লেপচা মেচিয়াদের প্রবেশ বারণ ছিল। সায়েবদের শিকারে বারণ ছিল না। শিকার মানে সেসময় স্পোর্টস, খেলা। শিকারযোগ্য প্রাণীদের বলা হত গেম। ১৯৪৯-এ শুকনা-সেভক বনকে যখন প্রথম অভয়ারণ্য বানানো হয়, তার পোশাকি নাম ছিলো মহানদী গেম স্যাংকচুয়ারি। ১৯৭৬-এ নাম বদলে রাখা হয় মহানন্দা বন্য প্রাণী অভয়ারণ্য, ওয়াইল্ড লাইফ স্যাংকচুয়ারি। 

দশ মাইলের পর আসবে সেভক বাজার। বাজার বলতে গুটিকত ছোটবড় দোকান, হোটেল। নন্দীখোলা নদী এসে তিস্তায় পড়ছে সেভকে। সেভক শব্দটি আসলে সু-ভক। রং(লেপচা) ভাষায় সু মানে এক ঝলক ঠান্ডা হাওয়া। ভক মানে ঘন, গাঢ়। তিস্তা যেখানে পাহাড়ের ঘেরাটোপ থেকে ছাড়া পেয়ে সমতলে ছড়িয়ে পড়ছে, সেখানে ঘন ঠান্ডা হাওয়া দেয়। তা থেকে সুভক, সেভক বা সিভক। সেভকের কাছাকাছি যে তিস্তা উপত্যকা, তার সঙ্গে এক পুরোনো পাহাড়ি দানবের গল্পও জড়িয়ে আছে, জানাচ্ছেন ওয়াডেল। রিসলে সাহেবের বিখ্যাত সিকিম গ্যাজেটিয়ারের অংশ হিসেবে প্রকাশিত এল এ ওয়াডেলের সমধিক বিখ্যাত লামাইজম ইন সিকিম বইটির মধ্যে এই গল্প পাওয়া যায়। পাহাড়িরা প্রত্যেক নদীতে, গাছে, গিরিশৃঙ্গে দেবতা কিম্বা দানো খুঁজে পেতো। সেভকের দানোটি আসলে কাঙ-ছেন-সো-ঙ্গা(কাঞ্চনজঙ্ঘা) পাহাড়ের স্যাঙাত, তার নাম ইয়াব্বুদ, অর্থে কালোবাবা শয়তান। কাঙ-ছেন-সো-ঙ্গা যতটাই ভদ্র সভ্য, ইয়াব্বুদ ততটাই গোলমেলে বদ গোছের, সে যাতায়াত করে দক্ষিণ বাতাসে ভর করে। তাকে সন্তুষ্ট করতে গেলে আস্ত ষাঁড় বলি দিতে হয়, ষাঁড়টাকে মেরে তার ছাল ছাড়িয়ে তার ওপরে নাড়িভুঁড়ি, মগজ, হৃৎপিন্ড সব সাজিয়ে দিতে হয়। পুরুতরা মাংসটা পায়, বাকিটা ইয়াব্বুদ। গরিব লোকদের ক্ষেত্রে মুরগি বলি দিলেই চলে। 

আরও পড়ুন
সিঙ্কোনার আরো গল্প

কালোবাবা শয়তান ইয়াব্বুদের ডেরায় ইদানিং দক্ষযজ্ঞ চলছে। পাহাড় ফুঁড়ে বিশাল সুড়ঙ্গ হচ্ছে, সেখান দিয়ে ট্রেন যাবে সিকিম অবধি, এমনকি সিকিম হয়ে তিব্বত সীমান্ত অবধি। লাসা থেকে ছুম্বি উপত্যকা পর্যন্ত রেললাইন পেতে ফেলেছে চীন, এ পক্ষেও পাতা দরকার। ট্রেন লাইনের কাজ চলছে, ওদিকে রাস্তাও চওড়া হচ্ছে ক্রমাগত। পাহাড়ের ঠিক নিচে যে মিটারগেজ লাইনটা দিয়ে সারাদিনে সাকুল্যে একটা দুটো গাড়ি যেতো বছর কুড়ি আগে অবধি, সেটা দিয়ে এখন দিনরাত গাড়ি ছুটছে তো ছুটছেই। সেভকের ছোট ছোট দোকানগুলো বদলে গিয়ে বড় বড় রেস্তোরাঁ হয়েছে, সেখানে শিলিগুড়ি থেকে কাতারে কাতারে লোক ফুর্তিটুর্তি করতে আসে। নন্দীখোলা আর তিস্তার সঙ্গমে দাম্বুশ সব ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে, নদীর গা খুবলোনো, বালি পাথর তোলা হয়। এসব হচ্ছে বটে, তবে ইয়াব্বুদ লোকটি সুবিধের নয়, এদিকে ষাঁড় মুরগি বলির রেওয়াজও উঠে গেছে। সেভক বাজার থেকে করোনেশন ব্রিজ অবধি তিন কিলোমিটার পথে অন্তত চারটি কালীমন্দির, শিবমন্দির, হনুমানমন্দির ইত্যাদি হয়েছে। করোনেশন ব্রীজ আসবার আগের বাঁকের মুখে পাহাড় জুড়ে বড় কালীমন্দির, সেখানে ভক্তদের আনাগোনা লেগেই আছে। এসবের ফল কিনা জানা নেই, ফি বর্ষায় যখনতখন পাহাড় ধসে পড়ে, রাস্তা ভেঙে বহু নিচের নদীতে চলে যায়। বেশি বৃষ্টি হলে ওপরের বাঁধে জল আটকে রাখা যায় না, নদী ভর্তি করে মাটিগোলা জল দৌড়োয়, দুপাশের পাহাড় ভাঙতে ভাঙতে। ডানদিকের ভাঙন বাড়তে বাড়তে এতদূর পৌঁছেছিল যে দশ মাইল গ্রাম ছুঁয়ে ফেলছিলো প্রায়। বাঁধ দিয়ে ঠেকানো হয়েছে কোনোক্রমে, সে বাঁধ কতদিন টিকবে কে জানে!

সেভক বাজার, করোনেশন ব্রিজ ছাড়িয়ে কালিঝোরা বাজার। বাজার আসার খানিক আগে কালিঝোরা নদী তিস্তায় পড়ছে। ঠিক তার একটু ওপরেই বাঁধ পড়েছে, ওপারের পাহাড় ভেঙে কেটে ফালাফালা করে দেওয়া হয়েছে। চেনা যায় না। বাঁধ ছিল না যখন কালিঝোরা বড় শান্ত, নিঃঝুম। বর্ষার জল নামলে তিস্তা জুড়ে সাদা বালির চর, এত নরম যে পা ডুবে যায়। শরতে চর ঢেকে বড় বড় কাশ। শরৎ হেমন্তের দিকে এগুত, তিস্তার জলও নীল হয়ে উঠত। সেই নীল জলে এসে পড়ত কালিঝোরার কালচে  তিরতিরে ধারা। শীতে ফুর্তিবাজ মাইক-বাজানো পিকনিকওলাদের ভিড় হত বটে, তবে সে আর কদিন। বছরের বেশির ভাগ সময় কালিঝোরা তার নদী পাহাড় নির্জনতা নিয়ে একা। তিস্তার পাড়েই পুরনো বাংলো। সায়েবি আমলের কাঠের বাড়ি, সেকালে যেমন হত। সে বাড়িতে অনেকে রাত কাটিয়েছেন। কালিঝোরা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয় জায়গা ছিল, অনেকবার এসেছেন, থেকেছেন। বেড়ানো নিয়ে একাধিক লেখায় জ্যোৎস্নাস্নাত কালিঝোরার রূপবর্ণনা করেছিলেন শক্তি, মনে আছে। 

আরও পড়ুন
আরো সিঙ্কোনা-কাহিনি

কতকাল আগের কথা সব। কালিঝোরার পুরোনো বাংলোটা পুড়ল সম্ভবত ১৯৮৭তে। যারা পুড়িয়েছিল তাদের সঙ্গে পরে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হয়। কালিঝোরা বাজারের বাসিন্দা এই তরুণদের মনে হয়েছিল বাংলো পুড়িয়ে ভাঙচুর করে পাহাড়ে গোর্খারাজত্বের শুভসূচনা হবে। যে নেতারা ওদের উস্কে এসব করিয়েছিলেন তারা কে কোথায়। এই ছেলেরাও পরে বেশ কয়েকবার দল বদলায়। তিস্তায় বাঁধ পড়ার কথা চলছে, প্রথমে খানিক আন্দোলন ইত্যাদি করে এরা প্রায় সবাই দল বেঁধে বাঁধপন্থী উন্নয়নপন্থী হয়ে গেলো, কিছুতেই আটকানো গেল না। এদের অনেকের পরে শ্রীবৃদ্ধি হয়েছে, গায়ে গত্তি লেগেছে, শুনতে পাই। ওই পথে গেলে কালিঝোরায় থামি না, কারুর সঙ্গে দেখাসাক্ষাতও হয় না।

কালিঝোরা নদীর সরু গভীর গিরিখাতের পাশে পাশে লাটপাঞ্চার যাবার মটরপথ। কিছুদূর চড়াই উঠলেই দেখা যায় নদীর ওপারের পাহাড় ঘন সবুজ বনে ঢাকা। মহানন্দা অভয়ারণ্যের উত্তরের সীমা কালিঝোরা নদী। নদী ধরে বনপাহাড়ের ভিতরে ঢুকলে এক বন্য প্রপাতের দেখা পাওয়া যায়। স্থানীয়রা তার নাম দিয়েছিলো কমলা ফলস। বনের অনেক ভিতরে, হাতির আবাস। শিবরাত্রিতে লোকজন পুজো দিতে যেত। এখন যাওয়া যায় না, বনদপ্তরের নিষেধ। 

আরও পড়ুন
সিঙ্কোনা-কাহিনি

কালিঝোরার গিরিখাত ছাড়িয়ে পাহাড়ের আরো ওপরের দিকে উঠলে কারমাট টঙিয়া। বহুদিন ধরে পুরো পাহাড়টাই এখানে ক্রমাগত নিচের দিকে নামছে। গ্রাম পেরুলেই বিশাল ধস, ধসের ওপর দিয়েই রাস্তা। কোনোরকমে গাড়ি যায়। কারমাট পাহাড় জুড়ে ফুলঝাড়ুর চাষ হয়। ফুলঝাড়ু বলতে এক ধরনের ঘাস, আমলিশু। স্থানীয়রা বলেন, কুচো। ধসে পড়া, বসে যাওয়া পাহাড়ের গায়ে কারমাটের হতদরিদ্র বাসিন্দারা কুচো ফলান, কিছু শাকসবজি করেন, ভুট্টা লাগান। কুচোর ফুলে দাদন দেওয়া থাকে শিলিগুড়ি বাজারের মারওয়াড়ি ব্যবসায়ীদের। সে ফুল একসঙ্গে বেঁধে ঝাড়ু তৈরি হয়, আমাদের বাড়ি আসে, অন্যত্র চালান যায়। কারমাটের মানুষ অপেক্ষা করেন পরের ধস কবে নামবে, কবে তাঁদের ঘরবাড়ি মাটিপাথরের সঙ্গে খাদের নিচে তলিয়ে যাবে। গ্রাম ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে চাইছেন সবাই। সরকারি বনদপ্তর জায়গা দিচ্ছে না। 

কারমাট ছাড়িয়ে কিছু পথ গেলে সিঙ্কোনাবাগান শুরু। সিটঙ-এর ঘরবাড়ি, সিঙ্কোনাগুদাম, পিছনে ফেলে লাটপাঞ্চার বাজার হয়ে বাঁহাতি পথ গিয়েছে লাটবাংলোর দিকে। লাটবাংলো ও তৎসলগ্ন বন-আপিস ছাড়িয়ে একটু গেলেই ঝোলি টঙিয়া। টিলামতন অনুচ্চ পাহাড়ের গায়ে ছড়িয়ে থাকা ছোট্ট গ্রাম থেকে নির্মেঘ উজ্জ্বল দিনে বাঁ পাশের পাহাড়ি বন, নিচের তরাই এমনকি শিলিগুড়ি শহর অবধি দেখা যায়।   বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরের ওপর সূর্য ওঠে টকটকে লাল, ভোর হয়। শুনেছি পিছনে তাকালে দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘাও। 

আরও পড়ুন
ন হন্যতে : মৈত্রেয়ী, মংপু ও রবীন্দ্রনাথ

ঝোলি থেকে পায়ে হাঁটা পথ নামথিং পাহাড়ের পিছন ঘেঁষে, মানা খাসমহল বন হয়ে, মানা বাগানে সিটঙ সেলফু বাগোড়া রাস্তায় গিয়ে পড়ে। অনেক বছর আগে সে পথে হাঁটবার সময় মানার বনে বড় কাঠবিড়ালি দেখেছিলাম। মালয়দেশীয় বড় কাঠবিড়ালি। কালো, লোমশ, বড় ফোলা ল্যাজের কাঠবিড়ালিগুলো খুব কিট কিট টিক টিক করে ডাকতে পারে আর এ গাছ ও গাছ লাফাতে পারে। স্থানীয়রা বলে কালা। মানার বন এখনো আছে কিনা জানি না। 

লাটবাংলো আর ঝোলি থেকে একাধিক পথ গভীর বনের মধ্যে ঢুকছে। বার কয় সেই সব পথে যাবার সুযোগ হয়েছে। লাটপাঞ্চারের পাহাড়ি বন দার্জিলিং অঞ্চলের আদিম অরণ্যের শেষ চিহ্নবৎ। পরপর বেশ কয়েকটা বনে-ঢাকা পাহাড়চুড়ো নিচের নদী উপত্যকায় নেমে গেছে খাড়া। একটা চুড়োর নাম রাজা, একটা রানি। রাজার মাথায় চড়ে নিচে তাকালে মাথা ঘোরে। প্রায় সাড়ে তিনহাজার ফুট নিচে গুলমা নদীর উপত্যকা। গুলমা নদী থেকে লাটপাঞ্চার পর্যন্ত সোজা উঠেছে বনে ঢাকা যে পাহাড়, তার নাম গুলমা ভ্যালি। পাহাড় এতই দুরারোহ, বন এত নিবিড় দুর্ভেদ্য যে যেতে গেলে অভিযান করতে হয়। বনকর্মী বা স্থানীয়রা কেউই ওই অঞ্চলে বড় একটা যান না। ওপরের রাজারানি চুড়োয় স্থানীয় লেপচারা বছর তিরিশ আগেও পুজো দিতে যেতেন। এখন কি হয় জানি না। ওই অঞ্চলের লেপচারা নিজের ভাষা ভুলেই গেছেন একরকম, ঘরেও কথাবার্তা হয় নেপালিতে। 

লাটপাঞ্চার গুলমা ভ্যালির যে পাহাড়ি বন, কেতাবি ভাষায় তাকে বলা হয় নিম্ন মধ্য পাহাড়ের বন, লোয়ার মিডল হিল ফরেস্ট। শুকনা-সেভক বনে কাঠ কাটাকাটি শুরু হয় উনিশ শতকের মাঝামাঝি। সম্ভবত দুর্গমতার কারণেই পাহাড়ি বনগুলো বেঁচে গিয়েছিল। প্রথম গোর্খা আন্দোলনে পাহাড় জুড়ে ধুন্ধুমার গাছ কাটা চলছে, লাটপাঞ্চারের বনেও হাত পড়েছিল। নব্বইয়ের গোড়ায় ওই অঞ্চলে ঘোরাঘুরি সবে শুরু হয়েছে, শোনা যেতো দারচিনি গাছ শেষ হয়ে যাচ্ছে। সত্যি দারচিনি নয়, ওই রকম অন্য গাছ। সায়েবরা বনদপ্তর বানিয়ে, বনের দখল নিয়ে যখন গাছ মাপছেন, শুকনা-সেভকের বনে তখনো প্রাকৃতিক রাবার গাছ পাওয়া যেত। দ্রুত তা অবলুপ্ত হয়। 

বনের মধ্যে রাজা চুড়োর পথ থেকে বেঁকে গেলে লাটপাঞ্চারের গুহা দেখা যায়। বন এত ঘন, চোখ চলে না। পথ যেখানে শেষ হয়ে যায় সেখান থেকে ওপরে তাকালে দেখা যায় একটা বিশাল পাথরের চাতালের মাঝামাঝি সার সার গোল গর্ত। ওপরে নিচে বন, মাঝখানে গুহাগুলো। তার ভিতরে কি আছে কি নেই কে বলবে। 

লাটপাঞ্চার থেকে হাঁটা পথ নামছে চিপলে নদীতে। চিপলে, মানে সরু। দার্জিলিং যাবার বড় রাস্তা হিলকার্ট রোড থেকে সিপয়ধুরা আর নরবুঙ চা বাগানের ভিতর দিয়ে সায়েবি আমলের পুরোনো পথ চিপলে অবধি গেছে। সে পথ এতটাই সরু আর খাড়াই যে শক্তপোক্ত ফোর হুইল ড্রাইভ জিপগাড়ি ছাড়া অন্য কিছু যেত না। এক একটা বাঁকে পিছনে এসে আবার যেতে হত। নিমা নামের এক স্বভাব-মত্ত(উন্মত্তও বটে) ঝাঁ ঝাঁ করে সেই পথে আমাদের চিপলে নিয়ে গিয়েছিল। নামাওঠার রুদ্ধশ্বাস সময়টুকু বাদ দিলে বাকি পথ মনোরম। চিপলেখোলা ধরে ধরে মাহালদি অবধি যাওয়া হয়েছিল। নদীর বালিতে ছড়িয়ে ছিলো নানাবিধ বুনোচিহ্ন। থাবার দাগ, খুরের গর্ত, শুকনো আধা শুকনো বিষ্ঠা। চারপাশের বন থেকে বনঝিঁঝির কর্কশ ডাক। বসন্তের ভর দুপুর, এখানে ওখানে শিমুল আর মাদারের লাল দেখা যাচ্ছে। চিপলে প্রায় শুকনো, মাহালদিতে গিয়ে জল পাওয়া গেলো। এই সব বনের গহনে ঢুকে পড়তে পারলে মনে হয় কিচ্ছু বদলায়নি, বাইরের পৃথিবী তোলপাড় তছনছ হয়ে যায়নি, সময়ের ভিতর-গহ্বর থেকে রহস্যঘন গূঢ় সঞ্চারণে বেরিয়ে আসছে কুঁজো হয়ে চলা মাহালদি, তার পাড়ে শ্বাপদসঙ্কুল আদিম অরণ্য, মানুষ সেখানে নিতান্তই প্রাণী, প্রভু নয়, লুটেরা দস্যু নয়। 

মাহালদি নদী ধরে বনের ভিতরে, আরো ভিতরে যেতে হবে। চিপলে অবধি এখন প্রশস্ত রাস্তা, চিপলের সঙ্গে মেশা পার্বত্য স্রোতস্বিনীর নতুন নাম হয়েছে শিবখোলা। একটা রঙচঙে শিবমন্দিরও হয়েছে। লোকে হামেশা সেখানে পিকনিক করতে, পুজো দিতে, আস্ত ও ভাঙা মদের বোতল এবং রাশিরাশি প্লাস্টিক ফেলে আসতে যায়। তা যাক। আমাদের বনভ্রমণ জারি থাকবে।

Powered by Froala Editor