মেলাবেন, তিনি মেলাবেন

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ২১
আগের পর্বে

Cacti and Succulent Association of India-র সক্রিয় সদস্য তো বটেই, সেই সংঠনের মুখপত্র Xero News প্রকাশনাতেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল শৈলেন মুখার্জির। আমাদের শৈলেন জ্যেঠু। চাঁপদানির জমিদার ছিলেন শৈলেন জ্যেঠুরা। ছিল জাহাজের ব্যবসা। স্বল্পভাষী, নিরহংকার শৈলেন জ্যেঠুর শখ ছিল বাগানের। মধ্যমগ্রামে তাঁর তৈরি বাগানবাড়িতে ছিল কেরলিয়ান ডোয়ার্ফ নারকেল গাছ থেকে শুরু করে কেনটুকি ব্লু ঘাস সবকিছুই। আর ছিল দুটো ম্যাকাও। মৃত্যুর আগে তিনি লোক-মারফৎ অনুরোধ করেছিলেন সেই ম্যাকাও দুটি ও বাগানের দুর্মূল্য দুটি গাছের দায়িত্ব যেন নিই আমি। তবে সম্ভব হয়নি তা আর। সেই স্মৃতিচারণার পর আজ নতুন পর্ব...

হে ঈশ্বর আর একটু সময় দিন। এই ধরুন বছর বিশেক। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে একটু হই হই করে বাঁচি। একটু বুক ভরে নিঃশ্বাস নিই। কেউ জিজ্ঞেস করলে ‘কেমন আছো?’ আগের মতো ‘এই চলে যাচ্ছে’, নয়। বুক ঠুকে বলি, ‘হ্যাঁ ভালোই আছি।’

 আপনি তো অন্তর্যামী! জানেনই যে এটা কেবল মৃত্যুভয় নয়। এটা হঠাৎ করে সময় কমে আসার ভয়। অসম্পূর্ণ কাজগুলি নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ার ভয়। এমনিতেই ৬০ বছরে পৌঁছে মন মোটামুটি তৈরি হয়ে যায় ‘জয় অজানার জয়!’ বলার জন্য। আর আমি তো বিজ্ঞান লেখক। বিজ্ঞানের যুক্তি অনুযায়ী যে মুহূর্তে আমার সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়েছে — আমার প্রয়োজন ফুরিয়েছে পৃথিবীর কাছে। বায়োলজিক্যাল ডেথ হয়ে গেছে আমার।

 কিন্তু ওই যে, নগেন্দ্র কুন্ডু প্রাথমিক বিদ্যাপীঠের বন্ধু-বান্ধবীদের আবার জড়ো করে নিয়ে রি-ইউনিয়ানটা এখনও করা হয়নি। হাওড়ার সেন্ট থমাস চার্চ স্কুল নামক কনভেন্ট থেকে স্থানান্তরিত হয়ে আসা শিশুটিকে ৬৭-৬৮-র মফঃস্বলে যে বান্ধবরা আশ্রয় দিয়েছিল। প্রথম চোখ মেলে ভেবেছিলাম, “তুমি বুঝি মোর বাংলা?” পরে তাই “আমার জীবন ধন সাধের সাধনা” হয়ে গেল। পার্থ, দেবাশীষ, দীপঙ্কর, সমীর, চন্দ্রশেখর, উত্তরা, গৌতম, মায়া, সুজাতা, ভারতী, শাশ্বতী, কুন্দকলি সবাইকে নিয়ে সেই বহুচর্চিত বাংলা  গানটিই আবার গাইতে চাই গলা ছেড়ে না হোক, মনে মনেই ‘মোরা ভোরের বেলা ফুল তুলেছি, দুলেছি দোলায়/ বাজিয়ে বাঁশি গান গেয়েছি বকুলের তলায়।” কিংবা আমাদের ভূগোল শিক্ষিকা লীলা দিদিমণি ও ইতিহাস শিক্ষিকা উদিতা দিদিভাইয়ের শেখানো বর্ষার গান “বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা আষাঢ় তোমার মালা”। সেদিন যদি প্রখর রোদ অথবা নিদারুণ শীতের দিন হয় তবুও আমাদের হৃদয় জুড়ে অঝোরে বৃষ্টিপাতই হবে — আমি নিশ্চিত জানি।

এমনিতে যে জীবন আপনি আমাকে দিয়েছেন, তা নিয়ে কোনো অনুযোগ জানানোর সুযোগ রাখেননি আমার জন্য। আর সামান্য-জন আমিও যেভাবে তা যাপন করে এসেছি তা নিয়ে বিশেষ কোনো অনুতাপ বা আফশোসও বোধ করি না।
কিন্তু ওই যে লাস্ট ফর লাভ! সে যে আরও চায়— আরও— আরও।

আরও পড়ুন
রক্ত যখন নীল

‘আমাদের সময় দারুণ ছিল। তোরা তো কিছুই পেলি না।’ না, এমতের সঙ্গে আমি একেবারেই একমত নই। প্রত্যেকের ছেলেবেলাই তার নিজের মতো করে সুন্দর। তবে যেটুকু দাবি অবশ্যই করব তা হল আমাদের সময়টা সত্যিই অন্যরকম ছিল। সে এক দারুণ মায়াবী মফঃস্বল! ভোরে নগর সংকীর্তন, দুপুরে মাথায় করে বয়ে নিয়ে যাওয়া বক্সে বুড়ির-চুল বিক্রি আর শীল কাটাও-এর দীর্ঘ ডাক। গরমের ছুটির দুপুরগুলোয় বন্ধ জানলার খড়খড়ির ভিতর দিয়ে ঢুকে পড়া সূর্যকিরণে মেঝের উপর বাগানের আমগাছটার উল্টো ছায়া — টোটাল ইন্টার্নাল রিফ্লেকশান। আর স্কুল খোলা থাকলে ছুটির পর বাড়ি ফেরার পথে রাস্তার সমস্ত নুড়ি পাথরগুলি পায়ের বুটজুতো দিয়ে লাথি মারতে মারতে বাড়ি ফেরা। চার্চ স্কুলের নিবিড় নৈঃশব্দের পর নগেন্দ্র কুন্ডু বিদ্যাপীঠের প্রবল কলরোল ও কাড়া-নাকাড়া ধ্বনির মধ্যে খাবি খেতে থাকা আমার জন্য ত্রাতা ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা হাসিরাশি দেবরায়। ভীষণ ভালোমানুষ। অত্যন্ত স্নেহ করতেন আমাকে। আর আমার অসহায় অবস্থা দেখে একটু যেন প্রশ্রয়ও দিতেন। 

বন্ধুদের মধ্যে আমার পাশে সর্বপ্রথম এসে দাঁড়িয়েছিল যে দুজন, তারা ক্লাসের সবচেয়ে দুষ্টু দুটি ছেলে — দেবাশিস ও সমীর। দেবাশিস ব্যানার্জী ও সেখ সমীরুদ্দিন। ওদের দুজনেরই বাড়ি মুসলমান পাড়ায়। আমাদের শান্তিনগর থেকে গঙ্গা বা জি.টি. রোডের দিকে যেতে গেলে রামলাল দত্ত রোড পার করলেই মুসলমান পাড়া। পাল সুইটস থেকে যে রাস্তাটি সোজা বাবর আলি ডাক্তারের বাড়ির দিকে যাচ্ছে সে পথেই ওদের দুজনের বাড়ি। আর ঐ রাস্তার মোড় থেকে বাঁ দিকে ঘুরলে ঠিক দুটো বাড়ি পরে বাড়ি আমাদের মুস্তাফামামুর। তাঁকে আমার ভীষণ মনে পড়ে। তিনি পুরনো এবং নতুন দু’রকম বই-ই চমৎকার বাঁধাতে পারতেন। এ.টি. দেব-এর ডিক্সনারি বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন, বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন ‘হে যুদ্ধ বিদায়’ নামে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘এ ফেয়ারওয়েল-টু আর্মস’-এর বঙ্গানুবাদ।

আরও পড়ুন
অম্বুদা— যিনি একাই তিনশো

 ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, সুঠাম স্বাস্থ্যের অধিকারী মানুষটির মুখভর্তি বসন্তের দাগ ছিল। চোখে লালচে ফ্রেমের (বোধ হয় গ্যাটাপার্চার) চশমা পরতেন। বাড়িতে লুঙ্গি পরলেও অফিস যেতেন শার্ট-কাটের পাঞ্জাবি ও ধুতি পরে। হাতে একটি মোটা সুতির কাপড়ের ব্যাগ থাকত। উত্তরপাড়া স্টেশান থেকে ওঁর বাড়ি ফেরার পথে আমাদের বাড়ি পড়ত। অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে প্রায়দিনই আমাদের বাড়ি আসতেন। বাবার সঙ্গে গল্প করে চা খেয়ে বাড়ি ফিরতেন। মা-বাবা মুস্তাফাদা ডাকতেন। আমরা বলতাম মুস্তাফামামু। কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। দর্শনে এবং চরিত্রে ছিলেন বেশ টানটান মানুষ। তবে তাঁর কথা আজ নয়।

আজ সমীরের কথা - আমার বাল্যবন্ধু সেখ সমিরুদ্দিন। দরজিগিরি ওদের পারিবারিক পেশা। পুরনো উত্তরপাড়ায় ওদের ড্রাই ক্লিনিং ও শাল রিপেয়ারিং-এর দোকান ছিল। সে দোকান আর নেই। সমীরের বাবা সেখ সামশের আলির কৈশোরেই তার বাবা, অর্থাৎ সমীরের ঠাকুর্দা (ওরা দাদা বলে উল্লেখ করে) সেখ ইসলাম মারা যান। তিনি খুবই দক্ষ এবং নামি দরজি ছিলেন। উত্তরপাড়া রাজবাড়িরও দরজি ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুন
আমাদের কাকাবাবু

সমীরের মুখে শোনা সে সময় উত্তরপাড়ার রামঘাটে ঠাকুরবাড়ির বজরা ভিড়ত বেশ কয়েকদিনের জন্য এবং তখন পিরেন, ‘আলখাল্লা, পাঞ্জাবি ইত্যাদি তৈরি করানোর জন্য সেখ ইসলামের ডাক পড়ত। এইভাবে যাওয়া আসায় সেখ ইসলামের কিশোর পুত্র সেখ সামশের আলি গুরুদেবের চোখে পড়ে যান। রবীন্দ্রনাথ তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে চান আশ্রমে। কিন্তু ইসলাম ছেলেকে গুরুদেবের সংগে ছেড়ে দিতে রাজি হননি। এসব কথা সমীর তার পারিবারিক সূত্রে জেনেছে।

সমীরের টেলারিং শপ - সামসন টেলার্স এবং আমার স্কুল বিদ্যাভবন দুইই পাড়াতেই হওয়ায় গত পাঁচ দশকে আমাদের দেখা সাক্ষাতে ভাটা পড়েনি কখনোই। অর্ধশতাব্দিকালেরও বেশি সময়ের এই সম্পর্কে আমরা পরস্পরের বড় মানসিক আশ্রয় হয়ে উঠেছি বলেই মনে হয় আজ। নিষ্পাপ, নিষ্কাম শৈশবেই কেবল এমন বন্ধুত্ব তৈরি হয় বোধ করি। তারুণ্যে এবং পরেও কাজের সূত্রে আমায় শহর এবং রাজ্যের বাইরে থাকতে হয়েছে কয়েকবার। ইতিমধ্যে আমি সংসারী হয়েছি। দেখা হলেই সমীরকে বলতাম, ‘কিরে বিয়ে থা করবি না? সংসার করবি কবে?’ সে হেসে বলত ‘আরে করব, করব!’ আমি বিরত থাকতাম তখনকার মতো।

আরও পড়ুন
দি.দা. - তিনি দিগম্বর দাশগুপ্ত

 আমরা তখন মধ্য চল্লিশে, একদিন চেপেই ধরলাম ওকে ‘কীরে বিয়ে করলে কর, এরপর আর কবে করবি?’ জবাবে সমীর ঐদিন আমাকে যা বলেছিল আজও তা কানে গেঁথে আছে। সে বলেছিল, ‘বুঝলি গৈরিক, মুসলিম মেয়েরা এখনও বেশি দূর পড়াশুনা করে না। আর হিন্দু আমায় মেয়ে দেবে না। তাহলে আমি আমার অল্প পড়াশুনা নিয়ে ছেলেমেয়ে মানুষ করব কীভাবে?’ এই দুঃখ নিয়ে সমীরের আর বিয়ে করা হল না।

 আমাদের সাপ্তাহিক মোলাকাতে পঞ্চাশ বছরের অতীত স্মৃতির কুয়াশা, রোদ, বৃষ্টি, ঝড় ঠেলে এসে দাঁড়ায় ভোম্বল মাস্টারমশাইয়ের শেখানো গানঃ
নওজোয়ান, নওজোয়ান, বিশ্বে জেগেছে নওজোয়ান
কোটি প্রাণ, একই প্রাণ, একই স্বপ্নে মহীয়ান
তুচ্ছ ভয়, সঙ্কোচের, রক্তপিপাসু দানবের
একতার হিম্মতে, শান্তি শপথে বলিয়ান!

 আর আমাদের স্কুলের সরস্বতী পুজো! ছাত্র-ছাত্রীরাই ঠাকুর আনতে যেতাম। সঙ্গে একজন, দুজন দিদিভাই এবং মাস্টারমশাই যেতেন। তারপর ঠাকুর সাজানো,পুজোর আয়োজন, এমনকি লুচি তরকারি তৈরি পর্যন্ত আমাদেরই করতে হত। করতামও খুশি মনেই। তরকারি বান্ধবীরা বানাত। লুচির দায়িত্ব ছিল আমার আর সমীরের। প্রত্যেক বছর সরস্বতী পুজোর লুচি ভাজতাম আমি আর সমীর - গৈরিক গঙ্গোপাধ্যায় আর সেখ সমীরুদ্দিন। না কারুর কোনো সমস্যা হয়নি। না আমাদের, না ঠাকুরের, না সমাজের। এমনও সময় ছিল। এমনই সময় ছিল।

 এই কিছুদিন আগেও মনে হত নিজের বিশ্বাসে থিতু থাকাই যথেষ্ট। কিন্তু চারিপাশ এত দ্রুত এত বলতে যাচ্ছে যে এখন সমাজের উপর বিশ্বাস না হারালেও ভরসা যে কমে আসছে তা অস্বীকার করা যাচ্ছে না।

 তাই বলছি ভগবন্‌, শেষ ভরসা আপনিই। এই রামের দেশকে দয়া করে রাবণের গ্রাস থেকে বাঁচান!

Powered by Froala Editor