আলোর পথযাত্রী

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ১৫

আগের পর্বে

১৯৬৮ সাল। মামাবাড়ির শহর উত্তরপাড়া। নগর সংকীর্তনের চল থাকা সেই অঞ্চলে সকালে আমাদের ঘুম ভাঙত বাঁশির সুরে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা এক অদ্ভুত চরিত্র ছিলেন সেই আড়বাঁশির বাদক মোহিতমামু। আকাশবাণী কিংবা কাননবালার গানের সঙ্গেই বাজিয়েছেন তিনি। ছিল স্টিলের আলমারি তৈরি আর জমি কেনাবেচার ব্যবসা। সন্তানদের মধ্যেও এই সুর বুনে দিয়েছিলেন তিনি। একবার ভোরবেলায় প্রচণ্ড চিৎকার। মোহিতমামুর গলা। জানা গেল গঙ্গাস্নান ফেরত এক যাত্রী বিনা অনুমতিতে গাছের ফুল তুলেছেন তাঁর বাগান থেকে। অদ্ভুত চরিত্রের সেই মানুষটিই চলে গেছিলেন মধ্য পঞ্চাশে। খাটিয়ে নয়, তাঁর শেষ যাত্রার জন্য নিয়ে আসা হয়েছিল এক পালঙ্ক।

এক রঙিন মানুষের কথা। শ্রী মুক্তিপ্রকাশ মুখোপাধ্যায় – আমাদের মুক্তিমামু। হ্যাঁ, আমার পাড়াতুতো মামা, কিন্তু আন্তর্জাতিক মাপের। আদি বাড়ি বর্ধমানে। পড়াশুনা করেছেন পাঁশকুড়ার ব্র্যাডলি ব্র্যাট হাই স্কুলে। তখন থেকেই এক্সেল করেছেন সব কিছুতে, স্কুলে এবং বাইরের জীবনেও। ড্রামাটিক এফিসিয়েন্সি ও ইংলিস কম্পোজিশনে মেডেল জিতেছেন।

বাজাতে পারতেন প্রায় সব বাদ্যযন্ত্র। এমনকি পিয়ানোও। তাঁর ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে একটি ‘ডলসুনো’। পাঠক তো জানেনই যে পিয়ানো যে তিনটি আয়তনে পাওয়া যায় তার ক্ষুদ্রতমটি ‘ডলসুনো’। বড়ো ও মেজো হল যথাক্রমে গ্রান্ড পিয়ানো এবং কটেজ পিয়ানো। সে পিয়ানো তিনি কেবল বাজাতেনই না, তার টিউনিং এবং গায়ের ভার্নিশও করতেন নিজে হাতে। কারুকে ছাড়তেন না। বাজাতে জানতেন না কেবল বেহালা।

সুদর্শন, সুপুরুষ, দীর্ঘদেহী, ভাসা-ভাসা দুটি চোখের মানুষটি দিব্য অন্ত্যমিল লিখতেন। লিখতেন ঘনবদ্ধ গদ্যও। বলাই বাহুল্য যে ছিলেন অসম্ভব রসিকও।

বার্মাশেল-এ চাকরি করতেন যা পরে হিন্দুস্তান পেট্রোলিয়াম হয়ে যায়। তবে সেই সঙ্গে আরো অনেক কিছু করতেন উদ্যমী মানুষটি। বেশ কিছু ব্যবসা ছিল ওঁর। আর ছিল বিভিন্ন দেশের ও সময়ের মুদ্রা সংগ্রহের শখ।

আরও পড়ুন
ঘোর লাগা সেই ভোরবেলায়

এত বড় মাপের মানুষ সম্মন্ধে তো ছোট করে কিছু বলা যায় না। তবে একান্তই যদি বলতে হয় তাহলে বলব: He was bundle of positive energy.

একই পাড়ায় বাস বলে ওঁকে চিনতাম ছোটবেলা থেকেই – মামু বলতাম। কিন্তু জানতাম না।

আরও পড়ুন
এক সংসারী ও এক সন্ন্যাসীর গল্প

 

লেখালিখির সূত্রে যখন ওঁকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম তখন উনি সত্তরোর্ধ আর আমি তিরিশ পেরিয়েছি। বিবাহিত এবং সন্তানের পিতা। অনেক জায়গায় দুজনে একত্রে পাঠে ও অন্যান্য অনুষ্ঠানে গেছি। কিন্তু কখনো আমাদের বয়সের ব্যবধান (যা প্রায় চল্লিশ বছরেরও বেশি) বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি আমাদের বন্ধুত্বে। অত্যন্ত সহজভাবে মিশতেন এবং সে কারণেই আমার তরফেও কোনো জড়তা তৈরি হয়নি কখনো।

আরও পড়ুন
চিত্রকারের বিচিত্র কথা

এমনই একবার শহরের বাইরে কোথাও একটি অনুষ্ঠানে যাচ্ছি দুজনে। পাড়াতেই দেখা করে একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েছি স্টেশানমুখো। হঠাৎ মনে পড়লো যাবার আগে একটা কথা গিন্নীকে বলে যেতে হবে। মামুকে বলায় উনি বললেন ‘অবশ্যই! চলো আমিও যাচ্ছি তোমার সঙ্গে বাড়ি পর্যন্ত।’

পৌঁছে বললেন ‘আমি নিচেই দাঁড়াচ্ছি, তুমি মিলিকে (আমার স্ত্রী) বলে এসো।” এরপর আমি উপরে উঠে যাই। নামার পর আমাকে অন্যমনস্ক বা চিন্তিত দেখে বললেন, ‘ক্যা হুয়া? মিলি নেহি মিলি?’ এমনই ‘রেডি উইট’ ছিল তাঁর।

আরও পড়ুন
বন্দুক, উপত্যকা ও রানা পরিবারের গল্প

ইংরাজি তো বটেই, হিন্দি ভাষাতেও ওঁর দারুণ দখল ছিল।

এই হাস্যরস ও কৌতুক ভরপুর ছিল ওঁর লেখনিতেও। একটি উদাহরণ দেবার লোভ সামলানো গেল না।

মিল শুধু ওজনে

ঘটকের পাল্লাতে হয়েছিল বিয়ে
গোলমাল লেগে গেল দুটো মন নিয়ে।
নোনতা ও ভালোবাসে, ঝালে ওর দৃষ্টি
আমি খেতে ভালোবাসি মুঠো মুঠো মিষ্টি
আমি চাই ভাল বাসা ও ভালবাসতে
ও চায় কাশী যেতে, ভালবাসে কাশতে।
ট্রামে চড়ে ও খুশী, আমি ‘ট্রাম্প’ হাঁকতে
ছবি দেখে ওর মজা, আমি ছবি আঁকতে।
পুরী গিয়ে পুরী খাই, ওর রুচি রুটিতে
ধীর পায়ে চলে ও আমি চাই ছুটিতে।
‘মিল’ মোরা পরি নাকো ‘তাঁত’ পরি দুজনে
দুজনেই দু - দু’মন মিল আছে ওজনে!

অত্যন্ত কৃষ্টিবান ও পরিশীলিত মানুষ তো ছিলেনই সেই সঙ্গে নিজের দিকে তাকিয়ে হাসবার ঔদার্যও ছিল তাঁর। এ ব্যাপারে একটি ঘটনার উল্লেখ থাকা প্রয়োজন। 

মুক্তিমামু এক সময়ে সুকুমার রায়ের বেশ কিছু ছড়া ইংরাজিতে অনুবাদ করেছিলেন। এরপর কী মনে হওয়ায় তিনি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেগুলি শোনাতে চান তাঁকে। সত্যজিৎবাবু সময় দেওয়ায় একদিন খাতা বগলে পৌঁছেও যান মামু, বিশপ লেফ্রয় রোডে। বাকিটুকু ওঁর বয়ানেই শোনা যাক।

“তো বুঝলে আলো, পৌঁছে গেলাম রায়সাহেবের বাড়ি। নিজের খাতাপত্তর নিয়ে। উনি বসতে বললেন, চা খাওয়ালেন, তারপর শোনাতে বললেন লেখাগুলি। আমি তো মহা উৎসাহে একের পর এক শুনিয়ে যাচ্ছি অনুবাদগুলি এবং জিজ্ঞেসও করছি ওনাকে কেমন হয়েছে। উনিও বলছেন ‘ভালোই তো!”

 

এ পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু আমি তখন থামতে পারছি না। বলেই ফেললাম, “এগুলোর মধ্যে বেশ কিছু ছড়া তো আপনিও অনুবাদ করেছেন। তবে বাকিগুলো করেননি কেন? এর উত্তরে উনি বললেন, ‘করলে সেগুলো আপনার মতোই হত তাই করিনি!”

এই গোটা ঘটনাটি তিনি নিজ মুখে বলেছিলেন আমায়। বলতে পেরেছিলেন। কী পরিমাণ রসবোধ ও উদারতা থাকলে এমনটি বলা যায় তা ভেবে অবাক হই আজও।

সত্যজিৎ রায় এরপর ব্যক্তিগত চিঠিতেও মুক্তিপ্রকাশ মুখোপাধ্যায়কে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ছিলেন।

বয়সে অনেক বড়ো এবং সম্মানেও। আমার বাবা এবং মা দুজনেই ওঁকে মুক্তিদাই বলতেন। মায়ের কাছে শোনা একবার জমিতে শেষ-বর্ষার জল না নামায় শান্তিনগর সমিতির দুর্গাপুজো বন্ধ হতে বসেছিল। মনখারাপ নিয়ে পাড়ার ছোটো ছেলেমেয়েরা তাদের মুস্কিলআসান মুক্তিদাকে ধরে কিছু একটা ব্যবস্থা করার জন্য। ওনার নেতৃত্বে ওই কচিকাঁচাদের দলই একদিনে মাটি ও ছাই ফেলে পুজোর জন্য নির্দিষ্ট জমি উঁচু করে ফেলে। এরপর যথা সময়ে, যথাস্থানেই পুজো হয়।

একবার একান্তে ওঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘মামু কীভাবে আপনি বড় করেছেন বুকুদাকে, দিদিকে? ওরা এত ভদ্র, এত বিনয়ী!’ আসলে আমি ওঁর পেরেন্টিং সিক্রেটটি জানতে চেয়েছিলাম।

 

উনি বলেছিলেন, ‘আমি ওদের বলেছি যে নতুন যার সঙ্গেই তোমাদের আলাপ হবে মনে করবে তিনি তোমার থেকে দশগুন বুদ্ধিমান, দশগুন শিক্ষিত এবং দশগুন অর্থবান। তাহলে তোমায় আর কোথাও ঠকতে হবে না।’

বুঝতে পারি অমন কেরিয়ার-সফল মানুষ সফল পিতা হলেন কী করে!
চুরাশি বছর বয়সে প্রায় হাঁটতে চলতেই চলে গেছেন তিনি। শেষ বয়সে রাস্তায় দেখা হলে যখন জিজ্ঞেস করতাম ‘কেমন আছেন মামু?’ উনি বলতেন, ‘এই তুমিই জানতে চাইলে আলো, কেমন আছি? এখন আর কেউ কেমন আছি জিজ্ঞেস করে না। বলে, ‘কেন আছেন?”

আমি নিশ্চিত একথা কেউ নিশ্চয় বলতো না ওঁকে। এ হয়তো ওঁর অনুভবের কথা। কিম্বা নিছকই ওঁর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুক! যা তিনি জীবনের শেষদিন পর্যন্ত বজায় রাখতে চেয়েছিলেন এবং পেরেও ছিলেন।

ওঁর প্রতিবেশকে, এ পৃথিবীকে সারাজীবন ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, পরোপকার, উৎসাহ দিয়ে গেছেন।
সব বাজনা বাজাতে পারতেন, কেবল বেহালা নয়। কেন? চাইলে কি শিখতে পারতেন না? শেখেননি!
সেকি এজন্য যে বেহালায় মূলত দুঃখের সুরই বাজে।
আর উনি তো আলোর পথযাত্রী!

Powered by Froala Editor