বন্দুক, উপত্যকা ও রানা পরিবারের গল্প

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ১১

আগের পর্বে

পতু, পতিতপাবন পাঠক। ঠাকুমার ছোটোভাই। ঠাকুমার মায়ের অষ্টম গর্ভের সন্তান তিনি। বেড়ে ওঠা জামশেদপুরে। ঘনিষ্ঠ ছিলেন বিপ্লবী বিনয় বসুর। ঠাকুরদার জ্যাঠতুতো দাদা মানভূমের এসপি অজিত গাঙ্গুলীর থেকে বুলেট চুরি করেই চালান করতেন বিনয় বসুকে। পরে তিনি জানতে পারলেও সমর্থন করেছিলেন এই ঘটনাকে। স্বাধীনতার পরে নিজেকে তিনি জড়িয়ে নিয়েছিলেন শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে। পরবর্তীকালে বামফ্রন্টের মুখ্যসচেতক, শিল্প পুনর্গঠন মন্ত্রীর ভূমিকাও পালন করেছিলেন। তবে ছাপোষা সেই মানুষটি রাজনেতা ছিলেন না। ছিলেন একজন জননেতা।

সালটা ২০০৬-ই সম্ভবত। হ্যাঁ ২০০৬-এর জুলাই। ছেলেকে নিয়ে দিল্লি গেছি অল ইন্ডিয়া স্কুল শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ খেলাতে। যদিও খেলা হবে নয়ডায় অ্যামিটি ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে, সেখানে থাকার সুবিধা নেই, তাই দিল্লিতে। চিত্তরঞ্জন পার্ক থেকে প্রত্যেকদিন দুটি অটো বদলে পৌঁছাতে হয় সেখানে। প্রথম অটো দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ (নয়ডা) সীমানা অবধি যায়। দ্বিতীয়টি আমাদের পৌঁছে দেয় ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে। 

প্র্যাকটিস চলে প্রথম দুদিন। তারপর খেলা শুরু হয়। পুরো ইনডোর রেঞ্জ তখনই আর পুরোটাই বেসমেন্টে। আকাশের শুটিং শুরু হবার আগে এবং পরে, অর্থাৎ মগজ ও মন যখন একটু ফাঁকা থাকে দুঃশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা থেকে — এদিক ওদিক দেখি রেঞ্জের। তাতেই চোখে পড়ে সেই বিরাট হলের একদিকে কিছু সঙ্গীসাথী নিয়ে বসে আছেন তিনি। যশপাল রানা। সেই তাঁকে প্রথম দেখা - কাছ থেকে। যদিও চিনতে কোনোই অসুবিধা হয়নি যেহেতু খবরের কাগজ এবং দূরদর্শনের ছবির দৌলতে আমরা সকলেই চিনি তাকে অনেক আগে থেকেই। 

সেই সময়ে যশপালের সঙ্গে কিছু বিষয় নিয়ে N.R.A.I., অর্থাৎ ন্যাশনাল রাইফেল অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়ার একটা ঠান্ডা লড়াই চলছে। আর তাই এনআরএআই যশপালকে কোনো প্রতিযোগিতা বা অনুষ্ঠানে বিশেষ ডাকে না। তবে তাতে যশপাল রানা দমবার পাত্র নন, যেখানে যাবার তিনি যান, কে কি ভাবল না ভাবল, ডাকল, না ডাকল - এসবের তোয়াক্কা না করেই। 

 

এরপর আগ্রায় জি ভি মাবালাঙ্কার খেলতে পুত্র, কন্যা, পরিবারসহ ১৫ দিনের জন্য। ২০০৭ এর অক্টোবর। শহরের কেন্দ্রে আমাদের হোটেল মিস ফিলা আর শহরের একেবারে বাইরে চাঁদমারি। রোজ হোটেল থেকে যাতায়াত এবং সারাদিন রেঞ্জে থাকা। প্র্যাকটিস ও খেলা তো আছেই, সেই সঙ্গে Weapon mastering, স্পেয়ার ও গুলি কেনা। বিশাল রেঞ্জ আগ্রার। একদিকে এয়ার শুটিং রেঞ্জ, একদিকে অ্যামুনিশান, ওয়েপন চেকিং, টেন্ট অফিস, স্ট্যাট, মেকশিফট্ অডিটোরিয়াম, প্রেস কর্নার ইত্যাদি। আর হ্যাঁ! বিরাট জায়গা নিয়ে ফুড কোর্টও। যেখানে আমরা দুপুরের খাওয়া খেতাম। 

সেখানে লাঞ্চ করতে গিয়েই একদিন পেয়ে যাই সুভাষ রানাকে। যশপালের ছোটো ভাই। পিস্তল স্যুটার এবং তখন কোচও। মেয়ে পিস্তল স্যুটার। তার জন্য কিছু টিপস নেব ভেবে এগিয়ে গিয়ে আলাপ করি। তরতাজা যুবক। সঙ্গীদের যেতে বলে একটি চেয়ার টেনে আমাকে বসতে বলেন। ডাকেন তিতলিকেও। সময় নিয়ে এঁকে, লিখে বুঝিয়ে দেন পিস্তল শুটিংয়ের অনেক খুঁটিনাটি। প্রয়োজনে পরে যোগাযোগ করার জন্য নিজের ফোন নাম্বারও দিয়ে দেন - এমনিই। 

আরও পড়ুন
পি’থ্রি = তিনি পতিতপাবন পাঠক

২০০৮ এর ডিসেম্বরে দেরাদুনে হয় সেকেন্ড অল ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটি শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপ — ইউজিসি গ্রান্ট নিয়ে সেইবারই প্রথম। ওয়েস্ট বেঙ্গল স্টেট ইউনিভার্সিটির তরফে পিস্তল স্যুটার কন্যা দূর্বা গাঙ্গুলি। আমি কোচ, কাম ম্যানেজার। শহরে একটি থ্রি স্টার হোটেলে থাকার ব্যবস্থা আমাদের। কম্পিটিটর কম থাকায় সেও আমার সঙ্গে। 

 

শহরের থেকে অন্তত ১১ কিলোমিটার দূরে ‘যশপাল রানা শুটিং অ্যাকাডেমি’। সেখানেই হবে প্রতিযোগিতা। ‘মায়াঙ্ক’ হোটেল থেকে উত্তরাখণ্ড পরিবহণ দপ্তর আমাদের গাড়ি দিত যাতায়াতের জন্য। পুরো ব্যাপারটার দায়িত্বে ছিলেন বন্ধুবর আর.এস.রাওয়াত। তিনি কোনো অসুবিধা হতে দেননি। 

আরও পড়ুন
রাম-রাজত্ব

সেদিন ইনোগরেশন সেরিমনি। সক্কালেই স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে ইকুইপমেন্ট গুছিয়ে গাড়ি নিয়ে রওনা হয়ে গেছি। শহর ছেড়ে যাওয়ার পরও পাহাড়িপথে আরো প্রায় ৮-৯ কিলোমিটার রাস্তা — কখনো খাদ ঘেঁষে, কখনো জঙ্গল। আবার ছোটো পাহাড়ি নদী টপকে ক্রমাগত চড়াই উঠে হঠাৎই রাস্তাটা ‘নোজ ডাইভ’ দেয়। সেই রাস্তা বেয়ে গাড়ি সমতলে নামতেই অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি আমাদের চারিদিকে কেবলই পাহাড়। অর্থাৎ আমরা পৌঁছে গেছি একটা পাহাড়ঘেরা উপত্যকার মধ্যে। প্রকৃতির ওই ব্যাপ্তিতে জায়গার মাপ বোঝা খুবই মুশকিল — তবে ৩-৪ বর্গ কিমি তো হবেই। পুরোটাই রানা পরিবারের ‘জায়গির’। কুয়াশা থাকলেও আলো আছে সবদিকেই। যদিও সূর্যের দেখা নেই। ক্রমে জানতে পারি এ উপত্যকায় শীতের দিনে সূর্যের দেখা মেলে ১২-১৫টা থেকে ৩-৩০টে পর্যন্ত। তাও ভাগ্য ভালো হলে। 

 

পুরো উপত্যকা জুড়ে সাদা লম্বা লম্বা পাইপের মাথায় নানান রঙের পতাকা টাঙানো হয়েছে — উৎসব উপলক্ষ্যে। একেবারে একপ্রান্তে যশপাল রানা শুটিং অ্যাকাডেমির মূল ভবন— একটি বড় দোতলা বাড়ি। পাকা ছাদ, তার উপর টিনের শেড। তার ঠিক পিছনে প্রায় পাহাড়ের গা ঘেঁষে স্টোর ও কিচেন - বিশাল। ব্যবস্থা বড়ই রাখতে হয়েছে কারণ সারা বছরই ঘুরে ফিরে এখানে ট্রেনিং ক্যাম্প চলে শুটিং, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস, রিভার র্যাহফ্টিংয়ের। তাছাড়া কম্পিটিশন তো আছেই। 

আরও পড়ুন
ক্যাকটাস চর্চার পিতামহ

আর অন্যপ্রান্তে, অর্থাৎ আমরা যেদিক দিয়ে গাড়ি নিয়ে এ-উপত্যকায় ঢুকলাম সেদিকে একটি ছোট্ট সুন্দর বাংলো বাড়ি। আর তার লাগোয়া বিরাট কেনেল। ওই বাড়িটিতেই যশপালের বাবা, তার প্রথম কোচ, উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন বিধায়ক এবং উত্তরাখণ্ডের প্রথম স্পোর্টস্‌ মিনিস্টার এন.এস.রানা থাকেন। আর কেনেলটিতে থাকার ব্যবস্থা ১২টি জি.এস.ডি এবং একটি গ্রেট ডেনের। যদিও সারাদিনই তাদের গোটা উপত্যকা জুড়ে বিচরণ। 

ইনোগরাল সেরিমনি এবং অফিসিয়াল’স মিটিং শেষ হতেই মেয়ে বলে ‘আজ তো আর কিছুই হবে না বাবা। চলো কুকুরগুলোর সঙ্গে আলাপ করি।’ জন্ম থেকে কুকুর নিয়েই বড়ো হয়েছে। তাই অ্যালসেশিয়ানই আমাদের ‘ফ্যামিলি ব্রিড’। না আর করি কিভাবে! উপত্যকা চষে ফেলে আলাপ করা চলে আমাদের। সঙ্গে ছবি তোলা। যে সারমেয়দের জন্য উপস্থিত অনেকেই তটস্থ হয়ে আছে, সহজ হতে পারছে না লোকজন — তাদের সঙ্গে সরাসরি আলাপ করে গলা জড়িয়ে আদরও করছে মেয়েটি, এ ব্যাপারটি এন.এস.রানাও লক্ষ্য রাখছিলেন, আমরা খেয়াল করিনি। এরই মধ্যে হঠাৎ করে দেখা হয়ে যায় পুরানো বন্ধু যশমিত সিংজির সঙ্গে। তিনি বিএইচইউ-র স্পোর্টস ডিপার্টমেন্টের ডিন। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন। ছবিও তুলতে চাই তিতলির সঙ্গে। এই সময়ে ‘ইয়ে ফটো পুরা কাহাঁ হুয়া?’ বলে এগিয়ে আসেন রানা সাহেব। নিজেই ছবির ফ্রেমে ঢুকে পড়ে তিতলি এবং সিংজিকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে বলেন “আব পুরা হুয়া।” আমি শট ফ্রিজ করে দিই। 

এভাবেই আমাদের আলাপ হয়ে যায় তিন ইন্টারন্যাশনাল স্যুটার সন্তানের পিতা, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং-এর বেয়াই এন.এস.রানার সঙ্গে। অমন রাশভারি মানুষ পকেট থেকে বার করে কাজু-পেস্তা দেন, গল্প করে বন্ধু হয়ে যান আমাদের। 

আরও পড়ুন
দরজার কোণে লুকিয়ে থাকা ক্যাকটাসেই ঘায়েল ডাকাত, শখ বাঁচিয়েছিল গোটা পরিবারকে

এরপর 55th ন্যাশানাল শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে পুনাতে। ২০১১ সালের নভেম্বর মাস। পুনা শহরের বাইরে বালেওয়াড়ি স্পোর্টস কমপ্লেক্স, ছবির মতো সাজানো। সব অলিম্পিক ডিসিপ্লিনের আলাদা আলাদা স্টেডিয়াম অথবা অডিটোরিয়াম। সব অডিটোরিয়ামেরই ঢোকার মুখে সেই ডিসিপ্লিনের সিম্বল বানানো রয়েছে স্টিল ফ্রেমে। শুটিংয়ের সেই মহাকুম্ভে কে নেই? আছেন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন অভিনব বিন্দ্রা, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন গগন নারাং, অঞ্জলি ভাগবত, দিপালী দেশপাণ্ডে, কুহেলি গাঙ্গুলি, তেজস্বিনী সাওয়ান্ত, সুমা সিরুর, সমরেশ জঙ্গ্‌ — কেউ সেই মুহূর্তে, কেউ আগের কোনোবারের এশিয় অথবা বিশ্বসেরা। আর এই নক্ষত্রমণ্ডলীর উপর উদাসীন আত্মবিশ্বাস নিয়ে উপস্থিত তিনিও, মহাদেবের মতো— যশপাল, নিজস্ব উচ্চতায়। 

ভারতীয় শুটিংয়ের আকাশে আজ যে নক্ষত্রসজ্জা তা শুরু হয়েছিল ১৯৯৪ সালে হিরোশিমা এশিয়ান গেমসে ১৮ বছর বয়সী এক পিস্তল শুটারের হাতে। সেন্টার ফায়ার পিস্তলে সোনা। ১৯৯৪ সালেই ইতালির মিলানে ৪৬তম বিশ্ব শুটিং চ্যাম্পিয়নশিপে জুনিয়র ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ন হন বিশ্বরেকর্ড করে। তখন থেকে আজ অবধি ৬০০-র বেশি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মেডেল আছে তাঁর। মাত্র ১৮ বছর বয়সে ‘অর্জুন’ পান, পদ্মশ্রী পান ২১ বছরে। তারপর ১৯৯৮-এ ব্যাংকক এশিয়ান গেমস, ২০০২ কমনওয়েলথ গেমস, ২০০৬-এ কমনওয়েলথ গেমস এবং একই বছরে এশিয়ান গেমস। এইভাবেই ১৮ বছর বয়স থেকে ৩০ বছর বয়স অবধি ভারতীয় শুটিং সাইকিতে(মনস্তত্বে) জেতার, জিতে নেওয়ার আত্মবিশ্বাস একার হাতে প্রথিত করে দেন যশপাল। 

 

আরও পড়ুন
ভাষা বাঁচাতে সুদূর মানভূম থেকে হেঁটে কলকাতায় এলেন বাঙালিরা, নেতৃত্বে বাসন্তী রায়ও

যাইহোক, এবার আমরা যদি আবার ফিরে আসি ২০১১ সালের নভেম্বরে পুনার বালেওয়াড়ি স্পোর্টস কমপ্লেক্সে, তাহলে দেখব এক পিতা ও পুত্র দিনের প্র্যাকটিস সেরে পিঠে কিটব্যাগ, এক হাতে রাইফেল ও অন্যহাতে ভিআইএপি এলাঞ্জা টানতে টানতে শিবাজি মহারাজের স্ট্যাচুর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেমস ভিলেজে ফিরে যাচ্ছে। 

কমপ্লেক্সের চওড়া রাস্তায় বাঁক ঘুরেই অবাক! আমাদের থেকে মাত্র ৩০-৩৫ মিটার দূরে সামনে সামনে যাচ্ছেন যশপাল, তাঁর সঙ্গীসাথীদের নিয়ে মজা করতে করতে। একএকটি ডিসিপ্লিনের মেন্টাল সিম্বলের সামনে দাঁড়িয়ে সঙ্গী এক তরুণকে বলছেন ওইরকম পোজ দিতে। তারপর বলছেন, “হচ্ছে না, আবার কর।” এভাবেই এগিয়ে চলেছেন দলবল নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে। 

বহুদিনের ইচ্ছে আলাপ করার। আকাশকে বলি, ‘কিরে? আলাপ করবি?’ আকাশ রাজি হয়ে যায় এক কথায়। এগিয়ে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বলি ‘যশপালজি, আকাশকে সাথ আপকা এক ফটো লুঁ?’

আমাদের চমকে দিয়ে বলেন “অফকোর্স! আ যা ছোটে!” বলে আকাশকে জড়িয়ে ধরে ছবি তোলেন। 

আমি কথা প্রসঙ্গে জানাই যে ওঁর পিতৃদেব এন.এস. রানা সাহেব আমার পরিচিত। “ফির তো আপভি আযাইয়ে।” এই বলে আমার ক্যামেরা বন্ধুর হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমাকেও টেনে নেন পরের ছবিতে।

এভাবেই সে মহাকুম্ভে আমারও কিছু পুণ্যিলাভ হয়ে যায়!

Powered by Froala Editor