রাম-রাজত্ব

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ৯

আগের পর্বে

শচীন ব্যানার্জী। শিবপুরের শচীনকাকু। তাঁর ছিল ইমারতি দ্রব্যের দোকান। তবে ইট, বালি, সিমেন্ট নিয়ে ব্যবসা হলেও মন পড়ে থাকত কণ্টকপর্ণীদের দিকে। গোটা পূর্বভারতের ক্যাকটাস চর্চার পথিকৃৎ তিনিই। মাঘের শেষ থেকে ফাল্গুনের শুরুর মধ্যে প্রতিবছর একটা গোটা দিন কাটাতেন আমাদের বাড়িতে। চলত ক্যাকটাসদের Repotting বা টব-বদলের কর্মসূচি। অক্লান্ত ভাবেই সাহায্য করতেন তিনি। তাঁর দৌলতেই আলাপ হয়েছিল দেবী জ্যেঠু, নেড়ুদার সঙ্গেও। ক্যাকটাসকে কেন্দ্র করেই দুইয়ে দুইয়ে পাঁচ মিলিয়ে দেওয়ার পরিপন্থী ছিলেন শচীনকাকু। 

শ্রী রামচরণ মাঝি, নিবাস – গেঁড়ুয়া, পোস্টঅফিস - রাঙ্গাডি, থানা - বলরামপুর, জিলা - পুরুলিয়া। অনেকটা তাঁর কোলে চড়ে আর বাকিটা তাঁর হাত ধরেই কেটেছে আমার শৈশবের বেশিটা সময়। 

আমরা তখন হাওড়ায় ভাড়াবাড়িতে থাকি। প্রথমে চ্যাটার্জি হাট-এ ‘ময়ূরওয়ালা বাড়িতে’ তারপর হাওড়া পঞ্চাননতলায় রমেন্দ্রপ্রসাদ মজুমদার লেনে ছ্যান ঘোষের ফ্ল্যাটবাড়িতে। বাবা গেস্ট-কিন-উইলিয়ামস-এ চাকরি করেন। ফোরম্যান মেল্টিং শপ। ভাইয়ের বয়স এক বছর, আমি প্রায় পাঁচ বছরের। সম্ভবত ১৯৬৫ সাল। বাবাকে তাঁর কোম্পানি যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েলস-এ পাঠিয়েছে মাদার প্লান্ট Brymbo Steel-এ বড় আর্ক ফার্নেসে অ্যালয় স্টিল তৈরি শিখতে, ৬ মাসের জন্য। যাতে তিনি ফিরে এসে হাওড়া শিবপুর ইউনিটে ২০ টনের ফার্নেস বসলে মেল্টিং শপের দায়িত্ব নিতে পারেন। বাড়িতে তখন মা, ঠাকুমা, ভাই, আমি আর রামদা। ঠাকুরদা দেশের বাড়ি থেকে এসে মাঝেমাঝে থাকেন আমাদের সঙ্গে। ভাই ছোটো তাই মায়ের অনেকটা সময় তাকে নিয়েই কাটে। কিছুটা ঠাকুমারও। আমি রামদার জিম্মাতেই সারাদিন। মোটামুটি এই সময় থেকে আমি রামদাকে মনে করতে পারি। 

রামদার বাড়ি আমাদের দেশের বাড়ি অথবা বলা যেতে পারে বরাভূম স্টেশান থেকে প্রায় চোদ্দ কিলোমিটার পথ। রামদার বাবা হাজারি মাঝি, আমাদের হাজারি জ্যেঠু আমার ঠাকুরদার কাছে বলরামপুরের বাড়িতে ছিলেন বহুদিন। তারপর খুব অসুস্থ হওয়ায় বাবার কাছে হাওড়ায় চলে আসেন চিকিৎসা করাতে এবং এখানেই মারা যান। রামদাকে রেখে যান বাবার দায়িত্বে। যাতে ‘বাবুছা’দের সঙ্গে থেকে ভালো আচার-ব্যবহার শেখে, তাই। কারণ রামদার পরিবার স্বচ্ছল গৃহস্থ ছিল বললে বোধহয় কমই বলা হবে। জমি জিরেত, গাই-বলদ, ছাগল-মুরগি ছাড়াও ওদের যা তখনও ছিল, হয়তো এখনও আছে তা হলো একটা গোটা শালবন।

দর্শন সম্বন্ধে বলতে হলে বলি রামদার গায়ের রং মর্গান ফ্রিম্যান বা ডেনজেল ওয়াশিংটনের মতো, গড়ন দোহারা আর মুখটা E.T.-র মতো। কিন্তু শিশু তো গড়ন বা গাত্রবর্ণে ধোঁকা খায় না, সে মানুষের হৃদয় দেখতে পায়। তাই আমি ভীষণই ভালোবাসতাম আর ভরসা করতাম রামদাকে। 

আরও পড়ুন
ক্যাকটাস চর্চার পিতামহ

চ্যাটার্জি হাটের বাড়িতে থাকতে সকালবেলা রামদা, আমি আর টিঙ্কু, আমাদের ডাবল কোট (এখন রাফ কোট বলা হয়) অ্যালসেশিয়ান সকালে মাঠে যেতাম খেলতে। পরে পঞ্চাননতলার ফ্ল্যাটবাড়িতে আসার পর রামদাই আমাকে St. Thomas Church School পৌঁছে দিত এবং নিয়ে আসত। তার সঙ্গেই হাওড়া ময়দান, গোরাবাবুর বাজার, কদমতলা, হাওড়া মিউনিসিপাল পার্ক, রথের মেলা যাওয়া আমার। 

নিয়মিত এইসব যাতায়াতের পথে রামদা নানা কথা বলত আমাকে। সেসব কথায় বলরামপুরের কথা, তার গ্রাম গেঁড়ুয়ার কথা, তার পরিবারের কথা থাকত। তবে সবচেয়ে বেশি থাকতো তার বাবার অসময়ে চলে যাওয়ার কথা। যা সে সেই বয়সে খুব স্বাভাবিক কারণেই মেনে নিতে পারেনি। তখনই ঘিঞ্জি এবং লক্ষ লক্ষ লেদ ও ছোট ঢালাই কারখানার দূষণে দূষিত হাওড়ায় বিকেল শেষ হলে খুব মনখারাপ করা সন্ধ্যা নামত। আমাদের ফ্ল্যাটবাড়ির তিনতলার ছাদে আকাশের দিকে তাকিয়ে শুকনো দু’চোখে কাঁদত রামদা। তখন নিয়মিত এক কিশোর আর এক শিশুকে তার বাবার মৃত্যুর কথা বারবার বলছে। শিশুটির মনে মানুষের শারীরিক অনুপস্থিতির শূন্যতা থেকে মৃত্যুবোধ তৈরি হচ্ছে। মানুষের অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ার ভয়, নিরাপত্তাহীনতা তাকে বিষাদময় করে তুলছে প্রতিদিন। 

আরও পড়ুন
সবুজ দ্বীপের রাজা

যদিও চিকিৎসকদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী তিনি রোগেই মারা গিয়েছেন, রামদা একথা একেবারেই মেনে নেয়নি। তার ধারণা ছিল তার বাবাকে কেউ ‘বান’ মেরেছে এবং তাতেই অসুস্থ হয়ে তিনি মারা গেছেন। রামদার বক্তব্য ছিল তার বাবা, আমাদের হাজারি জ্যেঠু যেহেতু ‘গুণিন’ ছিলেন — তাঁকে ‘ডাইন’রা বান মেরেছে। 

এখানে বোধহয় দু’একটি কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। রাজধানী এবং মফস্বল শহরগুলিতে পরিচিতি না থাকলেও পঞ্চাশ-ষাটের দশকে রাঢ় বাংলায়, বিশেষত বীরভূম, বাঁকুড়া ও পুরুলিয়ার গ্রামগুলিতে ডাইনিবিদ্যা চর্চার রমরমা ছিল। 

আরও পড়ুন
দরজার কোণে লুকিয়ে থাকা ক্যাকটাসেই ঘায়েল ডাকাত, শখ বাঁচিয়েছিল গোটা পরিবারকে

আজকের জনপ্রিয় বিতর্ক বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথাটুকুই শুধু বলি। ঐ সময়ে পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে ডাইনবিদ্যার দুটি ধারা চালু ছিল - একটি, যারা মূলত অশুভ কাজকর্মই করে (এদেরই ‘ডাইন’ বা ‘ডান’ বলা হত) আর দ্বিতীয় ধারাটি একেবারেই বিপরীতধর্মী। তারা মানুষের মঙ্গল করারই চেষ্টা করে এবং ডাইনদের খারাপ কর্মকাণ্ডে বাধা দেয়। এদের গুণিন বলা হত। কাজেই সহজেই অনুমান করা যায় যে ডাইনরা গুণিনদের ঘোষিত শত্রু ছিল। ফলে গণ্ডগ্রামে গুণিনদের খুব সতর্ক জীবনযাপন করতে হত। যেমন তেল মেখে স্নান না করে বাড়ির বাইরে যাওয়া বারণ ছিল। ডাইনদেরও নিষেধ ছিল অনেক কিছুতে। যেমন পিচ রাস্তায় আড়াআড়ি চকের দাগ কেটে দিলে তারা কখনোই সে দাগ ডিঙোবে না। রাস্তা থেকে নেমে পাশ কাটিয়ে যাবে। সাহস করে বলেই ফেলি যে এ ব্যাপারটি আমরাও পরীক্ষা করে দেখেছি। 

 

আরও পড়ুন
ভাষা বাঁচাতে সুদূর মানভূম থেকে হেঁটে কলকাতায় এলেন বাঙালিরা, নেতৃত্বে বাসন্তী রায়ও

আর হবে নাই বা কেন? আমার জেলার পাহাড় ও বন ঘেঁষা গ্রামগুলো তখন প্রায় ‘ডার্ক কন্টিনেন্ট’-এর মতোই। সেসময়ে সেখানে চালু ধারণা হল -

‘পিত্থিমিতে দুয়েইটা সিংহ আছে/ উয়ারা যখন হাঁকায়, ভূমিকম্প হয়!’

আরও পড়ুন
বাঁশের তীর-ধনুক নিয়েই নামলেন প্রতিযোগিতায়, হারিয়ে দিলেন ‘আধুনিক’ শিষ্যকে

‘সিমহলে এত সোনা পাওয়ায় যে উয়ারা সোনার থালায় খায়! খায় আর ফ্যালাইন দেয়। এখনো কেউ পৌঁছিতে পারে নাই উঠিনে। ইন্ডিয়া গবরমেন খুবেই চেষ্টা কইরছে জাহাজ লিয়ে, পেলেন লিয়ে কিন্তুক লাইরলো পৌঁছিতে।’

তো এইসব ব্যক্তিগত দুঃখকষ্ট যা সে কেবল নিকটজনের কাছেই বলত তার বাইরে শ্রীরামচরণ মাঝি কিন্তু এক আদ্যন্ত রসিক মানুষ ছিল সেই কিশোর বয়স থেকেই। পারিবারিক আড্ডায় শোনা, আমি জন্মাবার পর নার্সিংহোমে আমাকে প্রথমবার দেখে বেরোবার সময় রামদাকে তার কাকা (সে কাকাই বলতো খুড়া নয়) অর্থাৎ আমার বাবা জিজ্ঞেস করেছেন: 

“কীরে রাম! ভাইকে কেমন দেখলি?”

তৎক্ষণাৎ উত্তর: “আইজ্ঞাঁ বেবাক সোন্দর, খুবেই অর্ডিনারি!”

অর্থাৎ: দারুণ সুন্দর, এক্সট্রাঅর্ডিনারি! 

এই হল সে। যে কোনো কথা বা শব্দকে নিজের মতো করে বলার এবং সেভাবেই আশেপাশের সবাইকে হাসাবার ও খুশি রাখার সূক্ষ্ম কায়দাটি সে জানত। নিজের দিকে তাকিয়ে হাসার দুর্লভ গুণটিও তার ছিল। 

হাওড়ায় আমাদের পঞ্চাননতলার ফ্ল্যাটবাড়িতে জলি নামে একটি ককার স্পেনিয়াল কুকুর ছিল। বয়স হয়ে যাওয়ায় সকালবেলা রামদা যখন তাকে হাঁটতে নিয়ে যেত, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতেই তার ফোঁটা ফোঁটা হিসু হতে থাকত। প্রত্যেকদিনই ফেরার সময় আমাদের ল্যান্ডলেডি সূচিবায়ুগ্রস্ত ঘোষগিন্নি প্রশ্ন করতেন “হ্যাঁগো রাম, তোমাদের কুকুরটা কি সিঁড়িতে পেচ্ছাপ করতে করতে নামে নাকি? ফোঁটা ফোঁটা জল পড়ে থাকে দেখি সিঁড়িতে।” রামদা রোজই অম্লানবদনে বলে দিত “আরে না না ঠাকুমা। ওতো আমি রোজ সকালে সিঁড়িতে গঙ্গাজলের ছড়া দিই।” বুড়ি শুধু নিশ্চিন্তই নয়, খুশিও হতেন। 

আমরা তখন হাওড়া থেকে সদ্য স্থানান্তরিত হয়েছি উত্তরপাড়ায়। একটি ঘরের পাকা ছাদ, দুটির টালির এবং টালি ঢাকা দুটি বারান্দা, বাগানসহ পাঁচিলঘেরা বাংলো বাড়ি। বাবা রোজ এখান থেকেই ডিউটি যান হাওড়ায় G.K.W.-তে। আর রামদা যায় পঞ্চাননতলায় হরিণঘাটার দুধ আনতে। কাচের বোতলে দুধ আর তার ঢাকা অ্যালুমিনিয়াম পাতের। হাওড়া স্টেশান হয়ে যাতায়াত - রোজ। জনসংখ্যা তখন খুবই কম। কাজেই স্টেশনও বেশ ফাঁকাই থাকত। আর তাই গপ্পে মানুষ রামদাকে টিকিট কালেক্টররা প্রায় সবাই চিনে গিয়েছিল। 

সন ১৯৬৮ থেকে ১৯৭০। চালের খুব আক্রা হল। একই সঙ্গে বন্ধ হল এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চাল নিয়ে যাওয়া। ভীষণ কড়াকড়ি, ধরপাকড়। বাবা-মা বারণ করা সত্ত্বেও রামদা দায়িত্ব নিয়ে নিল হাওড়া থেকে উত্তরপাড়ায় চাল নিয়ে আসার। অবশ্য সংসারেরটুকুই। কিন্তু সেটুকুও নিষিদ্ধ তখন। রামদা প্রথমেই যা করলো তা হলো ক্যাম্বিসের বাজারের থলিতে দুধের বোতলগুলির সঙ্গে বিস্তর শাক ও আনাজ নিয়ে T.C. বাবুদের দিকে তাকিয়ে অথচ যেন লুকোতে চাইছে কিছু এমন ভাব করে দৌড়ে ট্রেন ধরার ভান করলো। বাবুরাও নিরুপায়। তাঁরাও দৌড়ে গিয়ে ধরেন, বলেন “এই রাম কি নিয়ে যাচ্ছো?” রামদা কাঁচুমাচু মুখ করে বলে “বাবু চাল।”

“কই দেখি” বলে T.C.রাও তড়িঘড়ি খুঁজতে লেগে যান থলি। চাল পাওয়া যায় না। এমন করেই চলে কয়েকটা দিন। হপ্তাখানেকের মধ্যেই বদলে যায় থলির ভিতরের জিনিস। যদিও থলির উপরে বিরাজ করে শাক ও আনাজ। T.C. বাবুরা মজা করে বলেন “এই রাম, কী নিয়ে যাচ্ছো?” রাম বলে “আইজ্ঞাঁ চাল”। 

বাবুরা একজন আরেকজনের দিকে চোখ টিপে বলেন, “রাম চাল নিয়ে যাচ্ছে!” তাঁদের নাকের তলা দিয়ে রাম সত্যিই রোজ চাল নিয়ে আসে হুগলির উত্তরপাড়ায়। 

কিশোর রাম এবার যুবক হবে, তাকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। তারপর তার বিয়ে দেওয়া এবং তাকে তার নিজের ঘর, তার গাঁয়ের বাড়িতে ফিরিয়ে দিতে হবে। এসব চিন্তা থেকে বাবা তাকে এক ফার্নিচার তৈরির দোকানে শিক্ষানবিশ হিসাবে ঢুকিয়ে দিলেন, কাজ শিখতে। 

দিন যায়, রামদা কাজ শেখে কাঠের কাজের দোকানে। বাবা একদিন জিজ্ঞেস করেন “কীরে রাম, কাজ কেমন শিখলি?” রামদা জবাব দেয় “হঁ কাকা, খবর হঁয়ে গেল হিল্লী, দিল্লী, ঢাক্কা, মক্কা, নেকড়ে, গেঁড়ুয়া, রাঙাডি।” শেষের তিনটির মধ্যে একটি তার গ্রামের নাম ও অন্য দুটি পাশাপাশি দুটি গ্রাম। অর্থাৎ তার কাজ শেখার খবর ঐসব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। বাড়ির জন্য দু’একটি কাঠের পিঁড়িটিড়ি সে বানাচ্ছিল বটে। আমার একটি রকিং চেয়ারের খুব শখ জেনে বলেছিলো “আইজ্ঞাঁ হামি রকিং চেয়ার বানাতে লাইরবো। তবে হামি তুমাকে একটা রকিং পিঁড়ি বানাইন্দিবো।”

খুব উদযোগ করে নিয়েও এল কাঁচামাল — দুটি সিলিন্ডার শেপের কাঠ নিচে যেগুলি পায়া হলে পিঁড়িটা দুলবে বলে তার ধারণা এবং তার উপরে যে কাঠটি বসার জন্য লাগানো হবে তার জন্য একটি চওড়া তক্তা। কাঠের রলা দুটির উপর তক্তাটি রেখে দেখিয়েও দিলো যে পিঁড়ি পাশাপাশি দুলছে। কিন্তু কাজ শেষ করার জন্য যেই না তাতে পেরেক মারা হল, ব্যস বন্ধ হয়ে গেল পিঁড়ির নড়াচড়া! যা কিনা হবারই ছিল। প্রজেক্ট ফেল করে যাওয়ায় রামদা খুবই হতাশ হয়েছিল। 

 

বাবাও ততদিনে বুঝেছেন রামকে দিয়ে এন্টারপ্রেনরশিপ হবে না। ওর জন্য চাকরি খুঁজতে হবে এবং তাও সরকারি হলে ভালো। সেখানে ও মূলত লোকজনকে আমোদে রাখবে, অ্যামিউজ করবে। শ্রমজীবী হওয়া ওর ধাতে নেই। ও আসলে বুদ্ধিজীবীই। 

সেই মতো ব্যবস্থা হয় এবং পরিচিতি খাটিয়ে রামদাকে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় বলরামপুরের সরকারি এগ্রিকালচারাল ফার্মে। সে খামার সরাসরি বি.ডি.ও.-র অধীনে। রামদার রেডি উইট, তার রসবোধ এবং ইংরাজি বলার নিজস্ব স্টাইলের কথা জানতে পেরে এক মাসের মধ্যে বি.ডি.ও. সাহেব তাকে ফার্ম থেকে নিজের অফিসে বদলি করে আনেন। 

এরপর রামদার বিয়ে দেন তার কাকা। হাজারিজ্যেঠুর কাছে দেওয়া কথা রাখেন সাধ্যমতো। 

রামদাও বলরামপুর বি.ডি.ও অফিস মাতিয়ে রাখে তার উল্টে পাল্টে বলা ইংরাজি দিয়ে। স্যারের ঘরে ঢোকার আগে জিজ্ঞেস করে, “Are you coming Sir? May I busy Sir?” যা কিনা হবে “Are you busy Sir? May I come in Sir?”

রামের ইংরাজিতে আমোদিত B.D.O সাহেব যাঁকে রাম ড্ডি.ড্ডি.ও সাহেব বলে S.D.O. অথবা D.M. সাহেব এলেই রামকে তলব করেন ইংরাজি শোনাতে। রামদাও চালু হয়ে যায় “রানিং ও টপ ইন্ডিয়া গবরমেন সার্ভিস ফট। রানিং টপ!” 

বড়কর্তারা হাসিতে ফেটে পড়েন। রামের ডাক পড়ে আরো বড় আসরে। এমন দীপ্ত-বুদ্ধি, পরিশীলিত রসিকজনের শহুরে শিক্ষিত মানুষদের কাছে এটুকু স্বীকৃতি তো পাওনাই ছিল। 

কাজ শেষে সন্ধ্যা নামলে নগরসভ্যতার দিকে পিছন ফিরে চোদ্দ কিলোমিটার রাস্তা প্রতিদিন সে হেঁটে ফিরে যায় তার গ্রাম গেঁড়ুয়া, তার সংসার, তার শিকড়ের দিকে। কখনো চাঁদের আলোয়, কখনো তারার। 

আমি ভাবি আমার রামদা কেমন আছে? সেকি রোববারান্দা পড়ে?

Powered by Froala Editor