পি’থ্রি = তিনি পতিতপাবন পাঠক

ধূলায় ধূলায় ঘাসে ঘাসে – ১০

আগের পর্বে

রামচরণ মাঝি, আমাদের রামদা। দেশের বাড়ি থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে ছিল তাঁর বাড়ি। ছোটবেলায় তাঁর কোলে চড়ে আর হাত ধরেই কেটেছে আমাদের দুই ভাইয়ের। পরবর্তীকালে রামদা চলে এসেছিল আমাদের হাওড়ার বাড়িতে। বুদ্ধিদীপ্ত রামদা টিকিট চেকারদের চোখে ধুলো দিয়েই নিয়ে আসত চাল। ৬৮-র সেই অস্থির সময়েও। তবে ‘ডাইনি’, ‘গুণিন’-এ বিশ্বাসী রামদা ছিলেন বাস্তবে একজন আদ্যপ্রান্ত রসিক মানুষ। বাবা বুঝেছিলেন এন্টারপ্রেনরশিপ হবে না ওঁর দ্বারা। পরবর্তীতে বিডিও অফিসে কাজ নেন রামদা, সেখানেই অফিসারদের মাতিয়ে রাখতেন। কিন্তু এখন কেমন আছেন তিনি সত্যিই জানতে ইচ্ছে হয়।

ছিরে, বিরে, শান্তিরাম
তবে জানবি বালিগ্রাম
আমার ঠাকুমার মুখে শুনেছি এ ছড়া। এই নাকি বালিগ্রাম বা বালি’র পরিচয়। এমন ছড়া ছিলো আমাদের শহর উত্তরপাড়ার জন্যও:
গাড়ি, ঘোড়া, টাকার তোড়া
তবে জানবে উত্তরপাড়া।

এসব ছড়া ছাড়াও বিস্তর ‘দাঁত কথা’ তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল। বালিগ্রামেরই মেয়ে তিনি। পাঠকপাড়ার। বড়লোকের মেয়ে। প্রথম সন্তান। তাঁর ছেলেবেলায় দুধ খাবার জন্য আলাদা গরু ছিল, আমবাগানে আলাদা আমগাছ, হাজারি নারকেলের গাছ ইত্যাদি। ছিলেন গৌরী পাঠক, আমাদের বাড়িতে এসে হলেন গৌরী গাঙ্গুলি। তাঁর পিতৃদেবের নামে রাস্তা রয়েছে – ফকির পাঠক লেন। জি.টি.রোড লাগোয়া গঙ্গায় ঘাট রয়েছে পরিবারের নামে – পাঠক ঘাট।

তবে আজকের কথা তাঁকে নিয়ে নয়, তাঁর আদরের ছোট ভাই পতুকে নিয়ে। ঠাকুমা ছিলেন বাবা-মায়ের প্রথম সন্তান আর পতু মায়ের অষ্টম গর্ভের। সে কারণেই নাম দেওয়া হয়েছিলো পতিতপাবন। বাবার মৃত্যুর পর জন্মেছিলেন – যাকে Posthumas Child বলা হয়। বিষয় সম্পত্তি নিয়ে জ্ঞাতি শত্রুতার ভয়ে আমার বাবার দিদিমা বা আমার ঠাকুমার মা যাই বলিনা কেন, তাঁর কনিষ্ঠ সন্তান পতুকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর বড়মেয়ে ও জামাইয়ের কাছে রেখে বড় করার জন্য। আমার ঠাকুরদা ও পরিবার তখন জামশেদপুরে। 

গাঙ্গুলিরা তখন একান্নবর্তী। ঠাকুরদারা ছয় ভাই, তাঁদের বৌ ও বাচ্চাদের নিয়ে বাড়ি ভর্তি লোকজন। বিষ্টুপুর বুলেভার্দে জামশেদপুরের প্রথম ডিপার্টমেন্টাল স্টোর ‘গাঙ্গুলি ব্রাদার্স’। রিগাল সিনেমা হলের নিচে ‘রিগাল বার’। সুখেন্দু বিকাশ গাঙ্গুলির গালার বড় ব্যবসা। তো সেই জমজমাট গমগমে একান্নবর্তী এবং একান্তই ভর্তি পরিবারে বড় হতে থাকলেন ‘পতু’, পতিতপাবন পাঠক। পড়তেন জামশেদপুরের K.M.P.M. স্কুলে। ওখান থেকেই ম্যাট্রিকুলেশান পাশ করেন। 

আরও পড়ুন
রাম-রাজত্ব

গাঙ্গুলিরা থাকতেন বিষ্টুপুরেই ‘M’ রোডে ৭৪ ও ৭৬ নম্বর বাড়ি দুটি মিলিয়ে। সে বাড়ি প্রায় ধর্মশালাই ছিল। ওঁদের বাড়ির ঠিক দুটো রাস্তা পরে ‘O’ রোডে বাড়ি ছিলো বিজয় বোসের। তিনি ছিলেন বিহার ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশানের প্রেসিডেন্ট এবং বিনয় বোসের বড়দা। হ্যাঁ! বিপ্লবী বিনয় বোস! বিনয় মাঝেমধ্যেই দাদার কাছে এসে থাকতেন। তাঁদেরই আরেক ভাই বিনোদ বোস ভালো বক্সার এবং বক্সিং কোচ ছিলেন। 

আরও পড়ুন
ক্যাকটাস চর্চার পিতামহ

দুই পরিবারে যথেষ্টই যোগাযোগ এবং যাতায়াত থাকায় পতু/পতিতপাবন প্রায়ই ওঁদের বাড়ি যেতেন। এভাবেই বিনয় বসুর ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েন। ঐ সময়ে আমার ঠাকুরদা (পতুর জামাইবাবু)-র জ্যেঠতুতো দাদা অজিত গাঙ্গুলি (যিনি তখন S.P. মানভূম) নিয়মিতই কাজের সূত্রে জামশেদপুর আসতেন এবং ভাইয়েদের বাড়িতেই উঠতেন। আর এই সুযোগে ছেলেমানুষ পতিত বিনয়দার নির্দেশে অজিতদার বুলেট চুরি করে বিনয়দাকে দিয়ে আসতেন। এক সাক্ষাৎকারে পতিতপাবন ঐ বিষয়ে বলছেন, “পুরো ব্যাপারটাই অজিতদা জানতে পেরে যান এবং আমাকে বলেন বুলেটের গায়ের নম্বরগুলো তুলে ফেলতে। পুলিশ অফিসার হয়েও স্বদেশীদের প্রতি এই গোপন সমর্থন আমাকে মুগ্ধ করেছিল এরপরই রাইটার্সে ‘অলিন্দ যুদ্ধ’ (৮ই ডিসেম্বর ১৯৩০)। আমাদের বাড়ি সার্চ হয়, এবং আমাকে ধরে নিয়ে যায়। ছেড়েও দেয় কিছুদিন পর।”

আরও পড়ুন
সবুজ দ্বীপের রাজা

১৯৩৪ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন টাটানগর থেকেই। তারপর ১৯৩৬-এ ফিরে আসেন বালিতে মা সাবিত্রী দেবীর কাছে। ১৯৩৭-এ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ পান। ’৪৪-এ জেলা কমিটির সদস্য। ১৯৪৯-এ পার্টি নিষিদ্ধ হওয়ায় গ্রেফতার হন। ক্রমাগত জড়িয়ে নেন নিজেকে শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গে। লেবার ট্রাইবুনাল নিয়ে লাগাতার পড়াশোনা করে নিজেকে এ বিষয়ে এক বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেন। বালি নির্বাচন কেন্দ্র থেকে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার বিধায়ক হন। দু’বার হন মন্ত্রী। ১৯৮২ সালে পরিষদীয় মন্ত্রী ও বামফ্রন্টের মুখ্যসচেতক হন। ১৯৯১-এ হন শিল্প পুনর্গঠন মন্ত্রী। 

কী রকম যেন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের বায়োডাটার মতো লাগছে, তাই না? আর রাজনৈতিক নেতারা যে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ‘ছাপোষা ভালোমানুষের পো’ হন না – এ তো আমরা মেনেই নিয়েছি। তবে কাছ থেকে দেখেছি বলে জানি এ মানুষটির চরিত্রে আরো অনেকগুলি অন্য দিক ছিল। আর তাই বোধহয় তিনি রাজ-নেতা থেকে জননেতা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন। 

আরও পড়ুন
দরজার কোণে লুকিয়ে থাকা ক্যাকটাসেই ঘায়েল ডাকাত, শখ বাঁচিয়েছিল গোটা পরিবারকে

দারুণ রসিক মানুষ ছিলেন। একবার তাঁর শোবার ঘরে গল্প করতে করতে বলেই ফেলেছি বিয়েবাড়িতে আমার চটি চুরি হয়ে যাওয়ার কথা। ব্যস! দাদুভাই কপট রাগ দেখিয়ে বললেন “সেকি রে! তুই না আমার নাতি! তোর কিনা বিয়েবাড়িতে চটি চুরি হয়ে গেল? কোথায় খুলেছিলি চটি?”

 

আরও পড়ুন
ভাষা বাঁচাতে সুদূর মানভূম থেকে হেঁটে কলকাতায় এলেন বাঙালিরা, নেতৃত্বে বাসন্তী রায়ও

আমি বলি “কনের ঘরে ঢোকার আগে দরজার বাইরেই খুলেছিলাম চটি। বেরিয়ে এসে আর পেলাম না।”
“দু’পাটিই এক জায়গায় খুলেছিলি?”
বলি “হ্যাঁ, তাইতো খুলেছিলাম।”
উনি বলেন “বিয়েবাড়িতে চটি খোলার নিয়মই তো দেখছি জানিস না তুই। একপাটি একতলায় খুললে অন্য পাটি দোতলায় খুলতে হয়। অনেক খুঁজেও জোড়া না পেয়ে চটিচোর বিরক্ত হয়ে হাল ছেড়ে দেবে। ফেরার পথে দু’জায়গা থেকে দু’পাটি পরে নিয়ে বাড়ি ফিরে এলেই হল।” পরিবারের মধ্যে কখনো রাজনৈতিক আলোচনা করতেন না। কেউ করতে চাইলেও কৌশলে এড়িয়ে যেতেন। অথচ ভীষণ পারিবারিক মানুষ ছিলেন। একেবারেই অভিভাবকের মতো। 

স্মৃতিশক্তিও ছিল প্রখর। একতলায় ওঁর বৈঠকখানা যা কিনা অফিসও ছিল, সেখানে অন্ধ্রপ্রদেশের রাজমুন্দ্রি থেকে দেখা করতে আসা এক কমরেডের কাছে খোঁজ নিচ্ছিলেন সেই গ্রামের মানুষজনের কথা, নাম ধরে, এক এক করে। ভদ্রলোক তো অবাক। দাদু আরো অবাক করে দিয়ে বললেন যে তিনি ঐ গ্রামে বেশ কয়েকমাস আত্মগোপন করে ছিলেন – যখন কমিউনিস্ট পার্টি প্রথমবার নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়। যা প্রায় চল্লিশ বছর আগের ঘটনা। 

শুভঅনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাওয়ার গল্পটিও তাঁর মৌলিক। বলতেন “দ্যাখ আমি তো জনপ্রতিনিধি, তাই কেউ বিয়ের নেমন্তন্ন করে গেলে আমায় তা রক্ষা করতেই হয়। কিন্তু এত নেমন্তন্ন পেলে উপহার কিনব কত? কাজেই আমি সব জায়গাতেই বেগুনি চিন-কাগজে মুড়ে একটা সুপুরির সিঁদুর কৌটো নিয়ে যাই।” আমাদের ছেলেবেলায় বড় সুপুরি কুঁদে একরকম ছোট সিঁদুরকৌটো তৈরি এবং বিক্রি হত। অনেকেই সোনার দুল বা আংটি ঐ কৌটোয় ভরে স্যাকরাদের বেগুনি কাগজে মুড়ে সে উপহার নিয়ে যেত বিয়েবাড়িতে। 

আমরা জিজ্ঞেস করি “তাহলে সব জায়গাতেই তুমি সোনার গয়না নিয়ে যাও?”
উনি বলেন “আরে না না। সে কি সম্ভব! সব জায়গাতেই আমি খালি কৌটো নিয়ে যাই। তারপর বিয়েবাড়ির গেটের কাছাকাছি পৌঁছে যেন লুকিয়ে একবার দেখে নিচ্ছি, এইভাবে পাঞ্জাবির পকেট থেকে বেগুনি কাগজে মোড়া সেই কৌটো একবার বার করে আবার যথাস্থানে রেখে দিই। খুব খাতির করে গোলাপজল ছিটিয়ে ভিতরে ডেকে নেয় আমাকে।”

আমরা বলি “গেটকে ফাঁকি দিলেও বৌয়ের ঘরে তো ধরা পড়েই যাবে।” উনি বলেন “আরে সেখানে গেলে তো! আমি বৌয়ের ঘরের বাইরেই বারান্দা বা করিডোরে পরিচিত কারুর সঙ্গে আড্ডা জুড়ে দিই। তারপর বৌয়ের ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে এমন কারুর সঙ্গে ফেরার পথ ধরি। তিনি হয়তো প্রশ্ন করেন বৌ কেমন দেখলেন পতিতদা? আমি বলি, আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের জন্য বেশ ভালোই তো। ঐ একই কৌটো পরের বিয়েবাড়িতেও কাজে লেগে যায়।” 

 


একবার দেশের বাড়ির জমির কম্পেনশেসানের ব্যাপারে নিয়মিত রাইটার্স যেতে হচ্ছিল। দাদুভাই তখন পরিষদীয় মন্ত্রী ও মুখ্যসচেতক - বামফ্রন্টের। বসতেন বিধানসভা ভবনেই।

ঐ সময়ে মাঝে মাঝে বিধানসভায় ওনার অফিসে চলে যেতাম রাইটার্সে যাবার আগে। উনিও মাঝেমধ্যে আমার সঙ্গেই হেঁটে হাইকোর্ট পাড়া, জি.পি.ও হয়ে রাইটার্স যেতেন। যেহেতু উনি ছাড়া বাকি সব মন্ত্রীরাই রাইটার্সে বসতেন। যাবার পথে ভোজনরসিক মানুষটি হাইকোর্ট পাড়ায় চিনিয়ে দিতেন কলকাতার সেরা রাবড়ির দোকানটি। চা এবং সিঙাড়া কোথায় সবচেয়ে ভালো। প্রায় এক কিলোমিটার এই পথটি যেতে সেই পূর্ণমন্ত্রীকে কোনোদিন গাড়ি ব্যবহার করতে দেখিনি। 

আরেকটি দিনের কথা খুব মনে পড়ছে। সেদিন ওঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ আমাদের। দুপুরের খাওয়া সদ্য শেষ হয়েছে সবার। দাদুভাই এসে বসেছেন তাঁর রকিং চেয়ারটিতে। আমরা খাটে, টুলে, মাটিতে বসেছি তাঁকে ঘিরে। এমন সময় কলিং বেল বাজে। উঁকি দিয়ে দেখা যায় এক নিম্নবিত্ত মহিলা নিচের অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন দেখা করবেন বলে। ঘড়িতে দুপুর আড়াইটে হবে। মা বেশ বিরক্ত হয়েই বলেন ‘মামা, আপনি আর নামবেন না তো! আগামীকাল সময়ে আসতে বলে দিচ্ছি।’ 

দাদু বলেন ‘তা হয় না বৌমা। লোকের বাড়ির কাজ, ছেলেমেয়েকে স্কুল কলেজ পাঠানো, বরকে খেতে দেওয়া হয়ে গেলে তবেই তো আসবে জনপ্রতিনিধি মন্ত্রীর কাছে।’ এই বলে নিচে নেমে যান দেখা করতে।

সত্যিই তিনি জননেতা হয়ে উঠেছিলেন। যেদিন মারা যান ২০০২ সালের ৭ই ডিসেম্বর – বালি, বেলুড়, লিলুয়া অঞ্চলের রাস্তাঘাট আক্ষরিক অর্থেই জনসমুদ্র হয়ে গিয়েছিল। তাঁর খাট ধরার দায়িত্ব বর্তেছিল লোকাল কমিটি, জোনাল কমিটি, রাজ্য কমিটির হাতেই। আমরা কাঁধ লাগাবার সুযোগ পাইনি।

Powered by Froala Editor