‘বেবিট্যাক্সি’ ও অন্যান্য

মুছে যায়? - ৩১
আগের পর্বে

রাসবিহারী কেন্দ্রের কংগ্রেস বিধায়ক ছিলেন লক্ষ্মী বোস। জনপ্রিয় শ্রমিক নেতা তিনি। দৈনিক বসুমতী সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল খুবই। লক্ষ্মী বসুর ডানহাত দেবাশিস হত্যার পেছনে অভিযোগ উঠেছিল রাসবিহারীরই কংগ্রেসের পৌর-প্রতিনিধি নীরেন চ্যাটার্জির দিকে। এই বিষয়ে লক্ষ্মী বসুর সঙ্গে কথা বলে সবিস্তারে একটি প্রতিবেদন লিখি ‘দৈনিক বসুমতী’-তে। তা প্রকাশ পাওয়ার পর বসুমতীর অফিসে হানা দিয়েছিলেন নীরেন চ্যাটার্জি ওরফে চিনা। তবে তাঁর সকল চেষ্টা ব্যর্থ করেই লেখকের নাম প্রকাশ্যে আনেননি সম্পাদক প্রশান্ত সরকার। তারপর…

কবিশেখর কালিদাস রায়ের দুই পুত্রের নাম— ভবভূতি রায় ও জয়দেব রায়। দুজনেই ডব্লু বি সি এস ও সেই সূত্র ধরেই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমলা। কবিশেখর কালিদাস রায়ের ‘ছাত্রধারা’ কবিতাটির কথা এখনও স্মরণে আছে অনেকেরই— ‘বর্ষে বর্ষে দলে দলে…’।

কবিশেখর কালিদাস রায়ের সঙ্গে সঙ্গে করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামও উচ্চারিত হত একসঙ্গে। বলতে গেলে এক নিঃশ্বাসে।

নিঃশ্বাস এই শব্দটি প্রসঙ্গে মনে পড়ল। ‘কাঠখড় কেরোসিন’, ‘বেদে’, ‘পরমপুরুষ ‘শ্রীরামকৃষ্ণ’-সহ ‘খড়গ’, ‘ছন্নছাড়া’-র মতো কবিতা, ‘কল্লোল যুগ’-এর সঙ্গে ‘স্মৃতিচিত্রণ’ খ্যাত অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রায়ই বলতেন, নিঃশ্বাসে নেই বিশ্বাস।

‘কল্লোলিয়া’ অচিন্ত্যকুমার চাকরি করতেন জজিয়তির। কোনো বিয়েবাড়ি গিয়ে তিনি নাকি পাঞ্জাবির পাশপকেট থেকে কাগজে মোড়া দু খানা গুড়ের বাতাসা বের করে এনে বর ও কনের হাতে দিয়ে বলতেন, ঠাকুরের প্রসাদ খাও।

আরও পড়ুন
লক্ষ্মীকান্ত বসু, কোন্ডাপল্লী সীতারামাইয়া ও আরও কিছু

‘ঠাকুর’ অর্থে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। এই ‘প্রসাদ খাও’ উচ্চারণ পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ লেখার পর।

এই কাহিনীর সত্যাসত্য আমার জানা নেই। গল্পটি বলেছিলেন ‘দৈনিক বসুমতী’-র রবিবাসরীয় সম্পাদক, কবি কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। অচিন্ত্য কুমারই বলেছিলেন—
‘ঠাকুর তোমাকে কে চিনত
যদি না চেনাত অচিন্ত্য।’

আরও পড়ুন
মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ…

‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পর্কে অচিন্ত্যকুমারের মন্তব্য— দৈনিক বসুমতী চিরকালই সৈনিক বসুমতীর ভূমিকা পালন করেছে। সৈনিক এবার সেনাপতি হও।

শিবরাম চক্রবর্তীই সম্ভবত একবার কোনো এক শ্রাদ্ধবাড়িতে অচিন্ত্যকুমারের সঙ্গে কথোপকথন প্রসঙ্গে বলেছিলেন, কী বলেছিলেন তা শোনার আগে অচিন্ত্যকুমার কী বলেছিলেন শোনা যাক—

আরও পড়ুন
সাগর— গঙ্গাসাগর মেলা— সাগরসঙ্গমে...

‘শিব্রাম, এবার থেকে আমাদের এই সব অনুষ্ঠানেই দেখা হবে খালি। তারপর স্বর্গে গেলে দেখা হবে তোমার সঙ্গে— মানে আমরা দুজনেই স্বর্গে থাকব যখন।’

উত্তরে ঢলঢলে সিল্কের পাঞ্জাবি আর মিলের ধুতি পরা শিব্রাম চক্কোত্তি বললেন, ‘অচিন্ত্য তুমি কী পাগল হলে! স্বর্গে গিয়ে আমি তোমার ঐ কালো মুখ খুঁজব! আমি খুঁজব সুচিত্রা সেনকে!’

আরও পড়ুন
‘দৈনিক বসুমতী’ হয়ে আরও...

তখন অনেক রকম ছড়া বানানো হত মুখে মুখে, সাহিত্যের আড্ডায়—
‘যত রকমের আছে শয়তানি কেন্দ্রশৈলজানন্দ আর মিত্র প্রেমেন্দ্র…
’আর একটি ছড়া -
‘জল্পনা কল্পনা কথা ও চিত্র
হেমেন্দ্র চুম্বিত প্রেমেন্দ্র মিত্র…’

এইসব ছড়া-ছিকুলি তখন মুখে মুখে, সাহিত্য মহলে, খবরের কাগজের অফিসে অফিসে।

সাহিত্যিকদের অনেকেরই গাড়ি ছিল। শৈলজানন্দ, নজরুল ইসলাম— সকলেরই বিদেশি গাড়ি। ‘কয়লাকুঠি’-খ্যাত শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁর বড় বিদেশি গাড়িতে বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে ফরাসি চন্দননগরে যেতেন ফুর্তি করতে।

ফরাসি মদ্য-ট্যাভার্ন, সুন্দরী ললনা— ফরাসিনী। শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের মুখে চোখে আনন্দ, পকেটে প্রচুর কাঁচা টাকা, ফিল্মের সূত্রে। 

‘কল্লোলিয়া’ প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের বন্ধুত্ব খুবই ঘন, নিবিড়। সেইসঙ্গে শিবরাম চক্রবর্তী, কাজী নজরুল ইসলাম। আবার অচিন্ত্যকুমার পরবর্তী সময়ে একটু দূরে দূরে। পরবর্তী সময়ে প্রবোধকুমার সান্যালের সঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রের দূরত্ব অনেক অনেক। বিমল মিত্রর সঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রর মন-ফারাক বহু দূরের।

সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকায় ‘বনস্পতির বৈঠক’ লিখছিলেন প্রবোধকুমার সান্যাল, ধারাবাহিক আত্মকথা। সেটা সত্তর দশকের গোড়ায় গোড়ায়, সেই কথাযাত্রার একটি অধ্যায়ে প্রবোধকুমার প্রেমেন্দ্রর শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সংশয় প্রকাশ করেন।

বাধ্য হয়ে প্রেমেন্দ্র মিত্রকে তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতার সরকারি প্রমাণপত্র দাখিল করতে হয়, ছাপাও হয় তা ‘দেশ’-এ।

সত্তর দশকের গোড়ায় নির্মলেন্দু গৌতম ও দেবাশিস গৌতমদের পত্রিকা রূপসী বাংলা প্রকাশ-এর উদ্যোগে ক্যালকাটা ইনফরমেশন সেন্টার-এ অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়।

সেই সভায় কবিতা আবৃত্তি করে শোনান রূপবান, সুকণ্ঠের অধিকারী প্রবোধকুমার সান্যাল। ফাইন মিলের ধুতি, মটকার পাঞ্জাবি, মাথাজোড়া টাক। প্রবোধকুমার সান্যাল তাঁর আত্মজীবনী ‘বনস্পতির বৈঠক’-এ লিখেছেন, তাঁর কাশীবাসের অভিজ্ঞতা। প্রবোধকুমারদের আত্মীয় বাড়ি ছিল বারাণসীতে। তিনি যে সাধু হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন একবার, তারও বর্ণনা আছে এই আত্মকথায়। রয়েছে তাঁর দেশপ্রেমিক, বিপ্লবীদের সঙ্গে সম্পর্কের কথাও।

‘কালি কলম’ পুনরায় প্রকাশ হতে থাকে প্রেমেন্দ্র মিত্রর সম্পাদনায়, নব পর্যায়ে সত্তর দশকের গোড়ায়।

অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তর বহু সাহিত্যকর্ম চাপা পড়ে যায় তাঁর ‘পরমপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ’-র নিচে। যিশু খ্রিস্টকে নিয়ে তিনি লিখেছিলেন ‘অমৃতপুরুষ যিশু’। ‘কবি রামকৃষ্ণ’-ও তাঁর লেখা।

অচিন্ত্যকুমার বিবাহ অনুষ্ঠানে গিয়ে ‘ঠাকুরের প্রসাদ খাও’ বলে বর কনেকে গুড়ের জোড়া বাতাসা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহানট ও নাট্যকার শিশিরকুমার ভাদুড়ীর একটি গল্পও শুনেছি বাবু কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। শিশির ভাদুড়ী নাকি কোনো বিবাহ অনুষ্ঠানে গেলে বরকর্তা বা কন্যাকর্তাকে কয়েকটি ধান আর দূর্বা আনতে বলতেন। তারপর সেই ধান ও দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করতে করতে উচ্চারণ করতেন বি-ই-শা-ল এক সংস্কৃত মন্ত্র।

শিশিরকুমারের অন্য দুই ভাই— তারাকুমার ভাদুড়ী ও বিশ্বনাথ ভাদুড়ী ছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা। বিশেষ করে বিশ্বনাথ ভাদুড়ী। শোনা যায়, স্বয়ং শিশিরকুমারও নাকি যথেষ্ট সতর্ক— হুঁশিয়ার থাকতেন এই বিশ্বনাথ ভাদুড়ীর অভিনয়কলার কাছে।

‘শ্রীরঙ্গম’ থিয়েটার শিশিরকুমার, তারাকুমার, বিশ্বনাথ, প্রভা— সব মিলিয়ে এক দীর্ঘ ইতিহাস। জাতীয় নাট্যশালা— রঙ্গালয়ের জন্য সারা জীবন দাবি জানিয়েছেন শিশিরকুমার ভাদুড়ী। তাঁর শেষ বয়স কেটেছে বেশ অর্থাভাবে, কষ্টে। সিগার, মদ, লেখাপড়া, পাণ্ডিত্য, ঔদ্ধত্য— সব মিলিয়ে মহানট শিশিরকুমার। তাঁর ‘সীতা’ নাটকের কথা তো এক সময় দেশ-বিদেশে খ্যাতি, যশের বিউগল বাজিয়েছে।

শিশিরকুমারকে নিয়ে শিব্রাম চক্কোত্তির সেই অতি বিখ্যাত ছড়া— ‘শিশির ভাদুড়ী তুমি/ নহ বোতলের…’।

নাটক লেখা, গল্প, নাট্যরূপ ইত্যাদি নিয়ে শিশিরকুমারের সঙ্গে শিব্রামের বেশ মন কষাকষি হয়েছিল এক সময়। সম্ভবত শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’-র নাট্যরূপ নিয়ে। 

কলেজস্ট্রিটের কাব্যোৎসাহী ‘দর্শক’ পত্রিকার সম্পাদক দেবকুমার বসু ছিলেন অত্যন্ত শিশির ভাদুড়ী প্রেমী। সজ্জন, সুশীল সকলের প্রিয় দেবকুমার বসু— দেবুদা তাঁর প্রিয় জায়গা শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে হঠাৎ মারা গেলেন ম্যাসিভ স্ট্রোকে। পুরীতে— স্বর্গদ্বারেই তার শ্মশানচিতা জ্বলল।

শৈলজানন্দের বড় গাড়ি তাঁর বন্ধুদের নিয়ে ঢুকে যেত ফরাসি চন্দননগর। সেখানে অতি ফুর্তি। তখন গ্যালনের হিসাবে পেট্রল, তার প্রায় ‘জলের দর’। কলকাতায় তখন ‘বুইক’, ‘ওপেল’, ‘স্টুডি ব্রেকার’, ‘মরিস ফাইভ’, ‘ল্যান্ডমাস্টার’। আরও পরে পরে, ধীরে ধীরে ‘ডজ’, ‘ইম্পালা’, ‘শেভ্রেলো’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর ভর করে দাঁড়ান বহু সিনেমায় দেখেছি ছোট ছোট, কালো গাড়ি, কালো কালো মোটরবাইক। গেস্টাপো, নাৎসি আর্মি, ‘গুজস্টেপ’— সবের সঙ্গেই মিশে রয়েছে এই সব গাড়ি।

আমেরিকানরা তৈরি করল বড় বড় গাড়ি। সেটা চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশক। আমেরিকানদের তো সবই বড় বড়। জার্মানরা ভালো ক্যামেরা, গাড়ি, বন্দুক বানাত। পরে মার্কিনিরা।

বাবু কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিতৃদেব করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছিল দুটি গাড়ি— ‘ওপেল’ আর ‘মরিস ফাইভ’। এই সব গাড়িই বিক্রি হয়ে যায়। কলকাতার রাস্তায় বড় ‘ল্যান্ডমাস্টার’ ট্যাক্সি চলত স্বাধীনতার আগে।

১৯৪৭-এর ১৫ আগস্টের পরও ‘ল্যান্ডমাস্টার’ ট্যাক্সি। এই ‘ল্যান্ডমাস্টার’ থেকে খাজা, বাজে কিছু বোঝানোর জন্য ‘ধ্বজা ল্যান্ড মাস্টার’ শব্দটির উৎপত্তি।

কলকাতায় ডাঃ বিধানচন্ত্র রায়ের মুখ্যমন্ত্রীত্বের সময় ‘বেবি ট্যাক্সি’ আসে। ছোট ছোট গাড়ি। বিধানবাবু নাকি এই সব বেবি ট্যাক্সির লাইসেন্স ঢালাওভাবে দেওয়ানোর ব্যবস্থা করেন বেকার বাঙালি যুবকদের।

বেকার বাঙালি যুবকেরা সেই লাইসেন্স নিলেন। তারপর নাকি তা তখনকার হিসাবে মোটা টাকার বিনিময়ে হ্যান্ডওভার করে দিলেন শিখ— পাঞ্জাবীদের হাতে। তাঁরা চালাতেন সেই ট্যাক্সি, বেবি-ট্যাক্সি। সেই বেবি ট্যাক্সিতে একবারই চড়েছি। হাওড়া স্টেশন থেকে আমার ছোট মাসির বাড়ি, উত্তর কলকাতার তারক প্রামাণিক রোডে। সে বাড়ি ছিল ভাড়া, সামান্য দূরে অলি গলি দিয়ে বিবেকানন্দ রোড। সবই নর্থ। নর্থ ক্যালকাটা।

সেই বেবি ট্যাক্সির ভাড়া, মিটারে ছিল প্রায় তিন টাকা, সেটা ১৯৫৮ সাল-টাল হবে। আমার বয়স পাঁচ। লোকে বলত, পেট্রল নাকি তখন ‘জলের দর’। লিটার নয়, গ্যালনের হিসাব।

পাঞ্জাবি— শিখ ট্যাক্সি চাওলকরা ছিলেন আশির দশক পর্যন্ত কলকাতায়, বেশ জোরের সঙ্গে। পঞ্চ ক— কেশ, কাচ্ছা, কঙ্ঘা, কৃপাণ, কঢ়া— এই পাঁচটি ধর্মীয় বৈশিষ্ট নিয়ে তাঁরা গুরু নানকজির প্রবর্তিত ধর্ম পালন করেন। শিখদের খালসাপন্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

শিখ ধর্মের মূল ধারা থেকে বেরিয়ে নিরাঙ্কারীরা নিজেদের মতো করে নিজেদের ধর্ম ধারা তৈরি করেন। খালিস্তানি আন্দোলন দানা বাঁধার আগে, পরে ‘নিরাঙ্কারীবাবা’— নিরাঙ্কারী সম্প্রদায়ের গুরু, শিখ খালসাপন্থের দশ গুরুদের পর ‘নিরাঙ্কারী’রা তাঁকে গুরু বলেছেন, সেই ‘নিরাঙ্কারীবাবা’ খুন হন অজানা বন্দুকবাজদের গুলিতে। তাঁকে হত্যা করার পর মামলাও শুরু হয়, হত্যা মামলা।

বব্বর খালসা, জার্নেল সিংভিনদ্রানওয়ালে, ইন্দিরা জমানোর কুখ্যাত ‘অপারেশন ব্লু স্টার’— সবই হয়ত এই নিরাঙ্কারী বাবা’ হত্যা নামের সঙ্গে জড়িয়ে যায়।

নিরাঙ্কারী-সন্তসম্মেলন হত কলকাতায়, দিল্লিতে। খুব পোস্টার পড়ত কলকাতায়, ছাপান। সঙ্গে নিরাঙ্কারীবাবার ছবি।

বেবি ট্যাক্সি কলকাতায় চলত ষাটের দশকেও। সর্দারজিরা— শিখ ধর্মের ভাইরা, বন্ধুরা এলেন কলকাতায়, ট্যাক্সি চালাতে। ষাটের শেষ দশকে অখণ্ড পাঞ্জাবে সবুজ বিপ্লব— গ্রিন রেভেলিউশন হয়। তাতে ফসল উৎপাদন বেড়ে যায় অনেক, ‘গ্রিন রেভেলিউশন’। তথাকথিত গ্রিন রেভেলিউশন আমাদের এই পশ্চিমবঙ্গে পিএল৪৮০-র চুক্তিভুক্ত আমেরিকান গম— যা আমেরিকায় শুয়োর, গরু, ঘোড়ারা খেত, নয়ত ফেলে দেওয়া হত সমুদ্রে, সেই গমের পাশাপাশি পাঞ্জাবি গম আসতে শুরু করে, যা স্বাদে অনন্য। 

 তথাকথিত ‘গ্রিন বিপ্লব’— ‘সবুজ বিপ্লবের’ ফলে বহু কৃষি মাঠ নাকি বন্ধ্যা হয়ে গেছে অতিরিক্ত সার প্রয়োগে, এমন সমীক্ষাও আছে আমাদের সামনে।

‘গ্রিন রেভোলিউশন’-এর পর পরই কলকাতার সর্দারজি ট্যাক্সি ড্রাইভাররা একটু একটু করে দেশে— পাঞ্জাবে ফেরেন। তাঁদের পূর্বপুরুষরা কলকাতাতেই থাকতেন হয়তো। অসম্ভব ওয়াফাদার ছিলেন তাঁরা। অনেকসময় ওয়েটিং চার্জও নিতেন না তাঁরা। কলকাতার ট্যাক্সিতে তখন অপেক্ষা করার, ওয়েটিং চার্জ ব্যাপারটা খুব।

‘বাবুজি’ বলে সম্বোধন করতেন তাঁরা ট্যাক্সির কমিউটারদের। এটা কোনো ফিউডাল মনন থেকে শোনা বা ভালো লাগা কথা নয়, বরং খানিকটা বুকের কাছে থাকা জন হিসাবে তাঁদের ভাবা। সেই সব চমৎকার ব্যবহারের শিখ-ট্যাক্সি চলক, যাঁরা অকারণে ঘুরিয়ে ঘারিয়ে নিয়ে যেতেন না গন্তব্যে। অতিরিক্ত-ভাড়া, এম্পটি ফিরবেন বলে এক্সট্রা চাইতেন না রাতেও। ষাট-সত্তর দশকে দেখেছি দক্ষিণ কলকাতার যদুবাবুর বাজারে, যাঁকে সাধারণ জনের মুখে মুখে— জগুবাবুর বাজারও বলেন অনেকে, সেইখানে আকাশে ভাসমান শিখ-পাগড়ির কাপড়ের নানা রং— নীল, হলুদ, ম্যাজেন্টা, সবুজ, গেরুয়া। উড়ছে তারা উড়ছে।

ইন্দিরা গান্ধী হত্যার পর, তারও আগে একবার— ১৯৬৭-৬৮ সালেই হবে হয়ত জ্যোতি বসু তখন পুলিশ মন্ত্রী, প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায়, বরানগরেই হিন্দু-শিখ দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল, লেগেছিলও সামান্য সামান্য, জ্যোতি বসু তাঁকে বাড়তে দেননি। তারপর ‘অপারেশন ব্লু স্টার’— পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে। জার্নেল সিংভিনদ্রানওয়ালের নাম শুনলাম আমরা। ‘অকাল তখত’ বা ‘আকাল তখত’ শব্দটি তখন শুনতে থাকি বার বার, শুনি ‘করসেবা’ নামের শব্দটিও। 

জ্ঞানী জৈল সিং ছিলেন ভারতের রাষ্ট্রম্পতি। জ্ঞানী এই শব্দটির সঙ্গে গুরু গ্রন্থসাহেবের সম্পর্ক নিবিড়। অতি নিবিড়।

অপারেশন ব্লু স্টার— এর পর ১৯৮৪-র ৩১ অক্টোবরে তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিহত হন তাঁর দেহরক্ষীদের হাতে। তারপর তো দেশজুড়ে শিখ হননের জন্য পরিকল্পিত দাঙ্গা লাগান হয়। দিল্লিতে তখন জাতীয় কংগ্রেস সরকার। ষাটের দশকে ‘পাঞ্জাবি সুবা’-র দাবিতে আত্মহত্যা— অগ্নিতে আত্ম বিসর্জনের হুমকি দিতেন মাস্টার তারা সিং। তিনি ছিলেন আকালি বা অকালি দলের নেতা। মাস্টার তারা সিং গ্রুপ ছিল অকালি দলের।

Powered by Froala Editor