ছোটোবেলার ‘ব-ব-জামা’— বড়দিন

মুছে যায়? - ২৪
আগের পর্বে

বড়দিনে বাবা নিয়ে আসতেন বড়ুয়ার কেক। যার প্রসিদ্ধি ছিল 'টিফিন কেক' নামেই। তখন 'ফিরপো', 'নহুম', 'গ্রেট ইস্টার্ন' কেক থাকলেও সেভাবে কেউ নাম জানতেন না কেউ। 'গ্রেট ইস্টার্ন ' পাওয়া যেত হাফ পাউন্ড থেকে শুরু করে দু পাউন্ড পর্যন্ত। 'গ্রেট ইস্টার্ন '-এর কেকও কখনও কখনও আনতেন বাবা। পার্কস্ট্রিটে বড়দিনে লাল-নীল বালবের চেন। পার্ক স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট অঞ্চলে অ্যাংলো ইনডিয়ান রেস্তোরাঁয় গান-বাজনা চলে সারারাত। সেইসঙ্গে মধুচক্রও। পার্ক সার্কাসে ময়দানে তখন বসে শীতের সার্কাস। ছোটমাসি নমিতা ভট্টাচার্য সন্তানদের নিয়ে আসতেন আমাদের বাড়ি। কুমির-সদৃশ কেক নিয়ে আসতেন তিনি। ১৯৬৭-৬৮ সাল নাগাদ খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের পথে চলে যাচ্ছিলাম। শ্রীরামপুর চার্চ থেকে দুজন পাদ্রি এসে হাজির হয়েছিলেন আমাদের বাড়ি। তারপর...

হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারে ছোটোদের জন্য একটা দুটো স্পেশাল ‘ব-ব-জামা’ আসতই। শার্ট-প্যান্ট, পাঞ্জাবি-পায়জামা, ফ্রক, গ্যালিস দেওয়া হাফ প্যান্ট কিংবা নিকারবোকার, সব কিছু থেকেই বেরিয়ে আসত ব-ব-জামা, যা কিঞ্চিৎ মহার্ঘ্যও। একটু সাজানো-গোছানো অনুষ্ঠান, বিয়েবাড়ি, পুজো প্যান্ডেল বা অন্য কোনো উৎসবে যা ছিল পরার নিরিখে আবশ্যিক। ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে ছোটরা চিহ্নিত করতে পারত বা করে ফেলতে এই ‘ব-ব-জামা’। ছোটোরা নিজেরাই এই বিশেষণে ভূষিত করত বিশেষ জামাটিকে। বড়রা কেউ এই বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তারা নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারত ঠিক কোনটা তার ‘ব-ব-জামা’।

হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্তর কাছে— আমাদের বড়দিন, এক্সমাস, ক্রিসমাস বা খ্রিস্টোৎসব এমনই কোনো ‘ব-ব-জামা’। বাহারি নিকারবোকার। অথচ কী আশ্চর্য, ভাবলে একটু অবাকই হতে হয় নাকি আমরা আমাদের সবচেয়ে নিকট প্রতিবেশী ইসলাম ধর্মাবলম্বী যাঁরা আছেন, তাঁদের ‘পরব’— উৎসব নিয়ে আমরা সেভাবে ভাবিত কি?

ফলে ইদ-উল-ফিতর, এইদ-উ-আযহা বা ইদ-উজ-জোহার মধ্যে কী ফারাক আমরা জানি না সেভাবে। ইদ-উ-আযহা বা ইদ-উজ-জোহাকে কেউ কেউ একটু যেন তাচ্ছিল্য করেই বলে থাকেন, বকরি ইদ বা কোরবানি, নয়ত কুরবানির ইদ। অবশ্য ইসলাম ধর্মের মানুষরাও অনেকে বলেন কুরবানির ইদ এই ইদ-উ-আযহাকে।

আমরা জানি না বিস্তারিতভাবে ফতেহা দোয়াজ দাম, শবেবরাত, মহরম, আসলে কী। কেন? ফতেহা দোয়াজ দাম, নবি দিবস, আখেরি চাহাত, শুম্বা, শিয়া ও সুন্নি মযহব, জানি না তো। কেন জানি না? কেন?

ব্রিটিশরাও শাসক ছিল আমাদের দেশের। মোগল, পাঠান-তুর্কিরাও ছিলেন এ দেশের রাষ্ট্রকর্তা। ফলে উর্দু, ফারসি, তুঘ্রা লিপি সব আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে গেল। কিন্তু ইংরেজ শাসকরা দুশো বছরের শাসনে বড়দিন, নিউইয়ার্স, নিউ ইয়ার্স ইভ, গুড ফ্রাইডে, ইস্টার স্যাটারডে মিশিয়ে দিল আমাদের জীবনে। কীভাবে পারল? কেন পারল? আমরা কেন খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের মেনে নিলাম? ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের মানলাম না, কী কারণে, ঠিক কী কারণে? এ নিয়ে আমাদের নিজস্ব কিছু বক্তব্যপ আছে। কিন্তু সেই বক্তব্য পেশের জায়গা এটা নয়। ফলে পুনরায় পুত্রের ধর্মান্তকরণ প্রয়াস, ডাক যোগে বাইবেল শিক্ষা, শংসাপত্র ও যিশু বাবার রঙিন, আর্ট প্লেটে ছাপা ছবি পাওয়া ও অবশেষে সাইকেল আরোহী হিসাবে আমাদের বালির বাড়ি— ৫৯/১৬ শান্তিরাম রাস্তায় জোড়া পাদ্রি— ধর্মযাজকদের আগমন, সবটাই বেশ অশান্তিকারক হয়ে উঠল।

বাড়ির ‘বড়খোকা’টি— গায়ত্রী রায় যাকে আদর সম্বোধনে ‘বড়বাবু’ বলেন, সেই ছেলে খ্রিস্টান বা খেস্টান হয়ে যাবে। কী কাণ্ড!  কয়েকদিন আগে যার উপনয়ন হয়েছে, পৈতের ঘরে ছিল এগার দিন, এই টানা এগার দিন ভূমিশয্যায় শয়ন, হবিষ্য ভক্ষণ, একবেলা, অন্যবেলা মানে রাতে ফলমূল— ফল বলতে পকুও কদলী, আর কিছু না। সাবু, নারকেল— কিছুই না। মিষ্টি বারণ। ফলে কাঁচা মুগ ডাল ভেজান খানিকটা।

আরও পড়ুন
ব ব ব বড়োদিন — হাঃ – হাঃ – হা

মাসে দুটো একাদশী। সেদিন একবেলা লুচি-পরোটা-রুটি, যে কোনো একটা, তার সঙ্গে চাপ ছোলার ডাল, দুপুরে এই আহার। রাতে যথারীতি কদলী আর কাঁচা মুগের ডাল ভেজান—নারকেল, চিনি ছাড়া। এর নাম মুগের জালা। পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণদের এগারদিন থাকতে হয় পৈতের ঘরে। মানে টেন প্লাস ওয়ান। দশ দিন দণ্ডীঘর। বেলদণ্ড, মাধুকরীর ঝোলা, গলায় অজিন— কৃষ্ণসার মৃগের এক টুকরো চামড়া সহ নয়দণ্ডীর পৈতে। তার আগে পৈতের সময় বেতলতার যজ্ঞোপবীত। হোমের আগুন। চরু ভক্ষণ— মিষ্টি ছাড়া ফোটানো দুধ ও আতপ তণ্ডুল।

পাশ্চাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণদের নিতকিত, নিয়মনিষ্ঠা অনেক। দশ দিন থাকতে হয় টানা দণ্ডীঘর বা পৈতের ঘরে। তখন সূর্য বা ‘শূদ্র’র মুখ দেখা নিষেধ। দাক্ষিণাত্য বৈদিক ব্রাহ্মণদের দশ দিনের দণ্ডীঘর বাস— নব্য ব্রহ্মচারীর, এমনই নিয়ম। রাঢ়ীশ্রেণী ও বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের দণ্ডীঘর বা পৈতের ঘরে বাসের নিয়ম তিন দিনের। বৈদ্যরা যখন পৈতে নেন, তখন তাঁদের তিন দিন উপনয়ন গৃহবাস।

তের দিনের দিন নিয়মভঙ্গ, মৎস্যাদি গ্রহণ। গেরুয়া বস্ত্র ত্যাগ। ‘রাজবেশ’— ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, সঙ্গে চামড়ার জুতো। কারণ দশদিন উপনয়ন গৃহে পাদুকা বলতে হয় বউলাদার কাঠের খড়ম, নয়ত নগ্নপদ।

আরও পড়ুন
পোস্টকার্ড— পোস্টোকার্ড— পত্তর

এই ছেলেটি, যার এত এত নিতকিত দেখে উপনয়ন হল, সে কি না খেস্টান হবে? বিধর্মী, ম্লেছ! শ্রীরামপুর থেকে সাইকেল চালিয়ে পাদ্রিও আসছেন ব্যাপটিজমের জন্য। যাই হোক, বাবা— অমরনাথ রায় খুবই ভদ্র ভাষায় বলে কয়ে এই ধর্মযাজক যুগলকে বিদেয় করলেন।

আমার কপালে যথেষ্ট বকাবকি জুটল। এই ঘটনার অনেক, অনেক বছর পরে বাংলাদেশে যাই ২০০০ সালের মে মাসে, যশোরে, ফুলতলায় রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়িতে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, আমন্ত্রণে। তখন— মানে সেবার খুলনা, যশোর, রাজশাহী, ঢাকা। ঢাকা হয়ে ফেরা বেনাপোল, পেট্রাপোল, বর্ডার।

যশোরে সাগরদাঁড়ি গ্রাম, মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভিটে। পাশে কপোতাক্ষ— কপোতাক্ষ নদ। খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার পর মাইকেল নাকি অপেক্ষা করেছিলেন তাঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য। যেখানে নৌকো নিয়ে এসেছিলেন তিনি, সেই ঘাটের নাম বিদায়ঘাট। এই বিদায়ঘাটকে নিয়ে অনেক অনেক গল্প, অতিকথা।

আরও পড়ুন
সেলিম মোরশেদের গদ্যের হারিকিরি অথবা কিছু ভ্যাবলা-প্রশ্ন

মাইকেল ফ্রান্সে স্যেন নদীর তীরে বসে স্মরণ করেছেন কপোতাক্ষকে— ‘সতত হে নদ...’।

এইসব কথা মনে পড়ল বড়দিন প্রসঙ্গে লিখতে গিয়ে। বহু গির্জায় খ্রিস্ট কীর্তন হতে দেখেছি, বিশেষ করে কৃষ্ণনগরে। গির্জার আবার স্পষ্ট দু ভাগ— রোমান ক্যাথলিক আর প্রোটেস্টান্ট। গির্জা বলতে গির্জার প্রাধান্য। 

সত্তর দশকের প্রায় শেষ পর্বে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে কালীঘাটে বড় মাসিমার বাড়ি থাকি। ১৬/১ ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিট, কালীঘাট, কলকাতা – ৭০০০২৬, এই হল সেই বাড়ির ঠিকানা। এই বাড়িরই আর একটা ঠিকা— ১এ মুখার্জি পাড়া লেন। মুখার্জি পাড়া লেন ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটের গা ঘেঁষে, সরু গলি। তো সে যাই হোক ঈশ্বর গাঙ্গুলি স্ট্রিটে বসবাসের সময় বড়দিন খুব কাছ থেকে দেখি পার্ক স্ট্রিটে। তখনও অ্যাংলো ইনডিয়ান বেশ্যারা দু-একজন থেকে গেছেন পার্ক স্ট্রিট, সদর স্ট্রিট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে। কাছেই এম এল ও হস্টেল। একটু দূরে ফায়ার ব্রিগেড— দমকলের বড় বাড়ি। অপর্ণা সেনের ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’-এ এই অঞ্চলটা খুব ভালোভাবে উঠে এসেছে। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, দেবশ্রী রায় ছিলেন এই ছবিতে। আর ছিলেন জেনিফার— প্রখ্যাত অভিনেত্রী জেনিফার কাপুর। যিনি শশী কাপুর ঘরণীও। সিনেমা এবং মঞ্চে জেনিফার অনবদ্য। সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে বাইরে’তে, সেইসঙ্গে শ্যাম বেনেগালের ‘জুনুন’, অপর্ণা সেনের ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’। ‘ঘরে বাইরে’তে জেনিফার অভিনীত মেম চরিত্রটির নাম ছিল মিস গিলবি। তিনি বিমলার ইংরেজি শিক্ষয়িত্রী। বিমলার চরিত্রটিতে ছিলেন স্বাতীলেখা, ভিক্টর বন্দ্যোপাধ্যায় নিখিলেশ, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সন্দীপ।

আরও পড়ুন
‘ঈশ্বর’-এর প্রবেশ ও প্রস্থান

‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’-এ কলকাতার অ্যাংলো ইন্ডিয়ান জীবন উঠে এসেছিল। খানিকটা খানিকটা। জেনিফারের একক জীবনে, আয় শূন্য ফ্ল্যাটে দেবশ্রী ও ধৃতিমানের যৌনতা-যাপন, অবাধে। একটি বেড়ালকে খুব সুন্দর ব্যবহার করেছিলেন অপর্ণা, এই ছবিতে।

‘গোল্ডেন ঈগল’ পেয়েছিল এ ছবি। মনে আছে তখন দৈনিক বসুমতীর দক্ষিণ শহরতলির সংবাদদাতা। পুরো এক কলম খবর লিখলে পাঁচ টাকা পাই। অপর্ণা সেন ‘গোল্ডেন ঈগল’-এ সম্মানিত হয়েছেন তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবির জন্য। সম্ভবত এই পুরস্কার টি ম্যানিলার।

অপর্ণা সেন পুরস্কৃত হয়েছেন, গোল্ডেন ঈগল’-এ। সেই খবরটা এল টেলিপ্রিন্টারে, পি টি আই বা ইউ এন আই দিল অপর্ণা সেন ‘গোল্ডেন ঈগল’ জিতেছেন, তাঁর ডেবেউ ফিল্ম থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন-এর জন্য।

সত্যজিৎ রায়ের কাছে ফোনে ফোনে এই ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য বলা হল। আমি ফোন করলাম সত্যজিৎ রায়কে। তিনিই ফোন ধরলেন। উচ্চারণ অসাধারণ, কী চমৎকার ব্যারিটোন ভয়েস। —হ্যালো।

বললাম অপর্ণা সেন ‘গোল্ডেন ঈগল’ পেয়েছেন তাঁর প্রথম ছবির জন্য। এই ব্যাপারে তার প্রতিক্রিয়া যদি জানান।

সঙ্গে সঙ্গে উত্তর— হা-হা-হা তাই নাকি, রীনা গোল্ডেন ঈগল পেল। খুবই আনন্দের কথা। এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে পর পর তাঁর উচ্চারণে টেলিফোনের ওপার থেকে ভেসে এল, অপর্ণার পিতৃদেব চিদানন্দ দাশগুপ্তের কথাও। যিনি চলচ্চিত্র বোদ্ধা ও চলচ্চিত্র পরিচালক। ‘বিলেত ফেরত’ বলে একটি ছবি করেছিলেন তিনি। তার ভেতর ‘ষাঁড়’, ‘গাধা’, ‘রক্ত’ নামে তিনটে গল্প। এই ছবিতে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন।

এর বহু বছর পর তিনি ‘আমোদিনী’ নামে একটি সিনেমা বানান। খানিকটা পিরিয়ড পিস। অকাল প্রয়াত পীযূষ গাঙ্গুলি ছিলেন এই ছবিতে। ‘আমোদিনী’, ‘থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন’-এর অনেক অনেক বছর পরে তৈরি।

আমাকে অপর্ণা সেনের প্রতিক্রিয়া নেওয়ার কথাও বলা হল সত্যজিৎ রায়ের মন্তব্য নেওয়ার পর। অনেকটা বলে গেলেন ‘রে’। আসলে সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, চিদানন্দ দাশগুপ্ত— এঁরা সবাই বন্ধু ছিলেন। আড্ডা দিতেন একসঙ্গে ধর্মতলা কফিহাউসে।

তো সে যাই হোক, আমাদের কাছে বা ‘দৈনিক বসুমতী’ অফিসে অপর্ণা সেনের— ডাকনামে রীনা, যাঁকে ‘রীনা’ বলেই বলে গেছে সত্যজিৎ রায় ফোনালাপে, তাঁর কোনো ফোন নম্বর নেই। আমি সরাসরি অপর্ণা সেনের ফোন নম্বর চাইলাম সত্যজিৎ রায়ের কাছে। ‘দৈনিক বসুমতী’-র সাংবাদিক শ্যামল সান্যাল (ঢোল) আমার পাশে বসে। তিনিই আমায় বলেছিলেন তাঁর ‘মানিকদা’কে ফোন করতে।

আমি যখন সত্যজিৎ রায়ের কাছে টেলিফোন নম্বর চাইছি অপর্ণা সেনের, ততক্ষণে অপর্ণা সেনের ফোন নম্বর সত্যজিৎ রায়ের কাছে চাইবার জন্য কোমরে খোঁচা খাচ্ছি শ্যামল সান্যালের আঙুলের। উনি বার বার চাপা গলায় বলছেন, করছ কী? করছ কী!

সত্যজিৎ রায়ের কাছে অপর্ণা সেনের ফোন নম্বর চাওয়াটাতে যে অশোভন শুধু নয়, গর্হিত কর্মও প্রায়, সেটা বুঝতে পারিনি।

সত্যজিৎ রায়— তাঁর আশ্চর্য গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল কালো, ভারী রিসিভার আর আঙুলে ঘোরান ডায়াল সমেত টেলিফোনের ওপার থেকে। বললেন, ধরুন। দিচ্ছি। বলে হয়তো তাঁর টেলিফোনের খাতাটি আনলেন একটু দূর থেকে। আমি টেলিফোন ধরে আছি। সেটা সম্ভবত ১৯৮২ সাল। 

একটু বিরতি।

উনি এলেন। তারপর বললেন, নিন, লিখুন।

আমি ওঁর মুখ থেকে শোনা অপর্ণা সেনের ফোন নম্বর লিখলাম ‘দৈনিক বসুমতী’-র নিউজ প্রিন্টের প্যাডে। তারপর ওঁকে ধন্যবাদ দিয়ে ফোন ছাড়লাম। এরপর ফোন অপর্ণা সেনকে তাঁর প্রতিক্রিয়া জানার জন্য।

সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে আরও একটি দীর্ঘ টেলিফোনিক সংলাপ মনে আছে শিবরাম চক্রবর্তীর প্রয়াণের পর। তখনও ‘দৈনিক বসুমতী’র সাউথ সুবারবন করেসপনডেন্ট। অনেকক্ষণ ধরে তিনি বলছিলেন শিব্রাম চকোরবরতি বিষয়ে। তা দিয়ে একটা ছোটো লেখা হয়ে গেল ‘দৈনিক বসুমতী’তে। তখন প্রশান্ত সরকার ‘দৈনিক বসুমতী’র সম্পাদক। ‘দৈনিক বসুমতী’র রবিবারের পাতা দেখেন কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি এক বিস্ময়কর মানুষ।

প্রখ্যাত সরোদিয়া, রূপবান রাধামোহন মৈত্র প্রয়াত হয়েছেন নীলরতন সরকার-এর তিনতলায়। সেই হাসপাতাল বসুমতী অফিস— ১৬৬ নম্বর বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিট থেকে খুব দূরে নয়। তখনও ‘বসুমতী সাহিত্য মন্দির’-এর সামনে পাতা ট্রাম লাইন ধরে শেয়ালদা-ধর্মতলা ট্রাম চলে। ফ্লাইওভার হয়নি। কলকাতার স্কাই লাইন অন্যরকম। হাসপাতালের বেডে সাদা চাদর ঢাকা রাধিকামোহন মৈত্র। বহুবার তাঁর সরোদ শুনেছি। খুব শৌখিন মানুষ। নাকের নিচে সরু রঙদার গোঁফ। পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত— যিনি ‘বামনের চন্দ্রস্পর্শাভিলাষ’ নামে অসামান্য আত্মকথা লিখেছিলেন মাসিক ‘নন্দন’-এর পাতায়, তাঁর বাজনা এবং রাধিকামোহন মৈত্র’র সরোদবাদন বহুবার শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে, বিভিন্ন প্রাইভেট আসরে। কি দারুণ সরোদ চালনা করেন পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্র।

সেই রাধিকামোহন মৈত্র এন আর এস-এর তিনতলায় সাদা চাদর চাপা, একা, নির্জন। দৈনিক বসুমতীর বিমানবন্দর সংবাদদাতা শাশ্বতী সরকার গান-বাজনা করেন। তিনি নিঃসন্তান। তাঁর বাড়িতে একাধিক সারমেয়। দিশি এবং ডোভারম্যান। শাশ্বতীদির একটি সরমা সন্তানের নাম ‘বুড়ি’। সেটি পারিয়া— মানে দেশি, সাদা বাংলায় যাদের নেড়ি বলে, সে নাকি ‘খুব হিংসুটে’। তখন তার বয়স দশ। মানুষের আয়ুকালের হিসাবে ৭x১০ = ৭০।

শাশ্বতীদির ডোবারম্যানদের জন্য ‘হ্যানডলার’ ছিল। ‘হ্যানডলার’ তাদেরই বলে যারা সারমেয়দের নিয়ে বেড়ায়, ট্রেনিং দেয়। ব্যায়াম করায়। একজন ‘হ্যানডলার’-এর ওপর অনেকখানি নির্ভর করে পোষ্যর শিক্ষাপ্রাপ্ত হওয়া।

শাশ্বতীদি আর আমি গেছিলাম নীলরতন সরকার হাসপাতালে, প্রয়াত পণ্ডিত রাধামোহন মৈত্রকে দেখে আসতে। তাঁর শৌখুন, উজ্জ্বল চেহারা চাসছিল চোখের সামনে। তেমন লম্বা নন, গরমের দিনে সাদা আলিগড়ি আর কলিদার আদ্দির পাঞ্জাবি গায়ে বাজাতে বসেছেন। বাঁ হাতে দামি ঘড়ি। সম্ভবত ‘রোলেক্স’। দু হায়ের আঙুলে মহার্ঘ্যপাথর বসান আংটি।

প্রখ্যাত সরোদিয়া নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বাদশা ঠাকুর— শ্যামশ্রী ঠাকুরের বেয়াই। শ্যামশ্রী ঠাকুর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র বাদশা ঠাকুরের স্ত্রী। বাদশা ঠাকুরের ভালো নাম সুমিতেন্দ্র নাথ ঠাকুর। তাঁর পুত্রর সঙ্গে বিবাহ হয় নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কন্যার। শ্যামশ্রী বিভিন্ন ক্লাসিকাল গান-বাজনার অনুষ্ঠানের মূল সংগঠক ছিলেন। তাঁর ডাকনাম জিতা। তিনি আবার সম্পর্কে কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পিসতুতো বোন। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাবা ছিলেন কবি ও এল সালভাদোরের কনসাল জেনারেল। তাঁর নাম করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়। রবীন্দ্র স্নেহধন্য করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় ও শুভ্রজা দেবীর একমাত্র সন্তান কল্যাণাক্ষ। শুভ্রজা দেবী অকাল প্রয়াত।

পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির দৌহিত্র বংশ করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়রা। যতীন্দ্রমোহন ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, প্রদ্যোৎকুমার ঠাকুর, প্রবীরেন্দ্র মোহন ঠাকুর এই পাথুরিয়াঘাটা ঠাকুরবাড়ির কয়েকজন বিখ্যাত চরিত্রের নাম। প্রসন্নকুমার ছিলেন ‘মহারানী— ভারতেশ্বরী’ কুইন ভিক্টোরিয়ার রুবি প্রিন্স। পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে তাঁদের বাড়ির নাম ‘প্রাসাদ’। এই প্রাসাদেই মহারানি সুরীতি দেবীকে দেখি। যাঁকে করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ও ‘মামি’ সম্বোধন করতেন বাবার ‘মাম্মি’ মাকে ‘মামি’ বলে, ডাকার সময় কথা বলার সময়, একই ভাব।

মহারানী সুরীতি দেবী নিঃসন্তান। কিন্তু তিনি সর্বদা সারমেয় সন্নিধানে থাকেন। তাঁর কোলে সর্বদা পমেরিয়ান। সম্ভবত লামা আপাসুও। সুরীতি দেবী পালিত পুত্র জিৎ-এর বিবাহে নিমন্ত্রিত হিসাবে গেছিলাম পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের ‘প্রাসাদ’-এ। কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় আর ‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক প্রশান্ত সরকারের সঙ্গে। সুরীতি দেবীর সঙ্গে দেখা হল, তখনও তাঁর কোলে সারমেয়— ল্যাপ ডগ, নয়ত পকেট ডগও হতে পারে, খুব ছোটো, সাদা, লোমদার।

সুরীতি দেবী তেমন লম্বা নন। পরনে খুব দামি, পাড় ছাড়া সিল্ক। মুখে যত্নের প্রসাধন। তাঁর গায়ের রং ময়লার দিকেই, জানি না তাঁকে উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ বলা যাবে কিনা। হাতে সোনার ঝলমলে সরু চুড়ি। তিনি বসেছিলেন একটা উঁচু থ্রোনে। জিৎ স্যুট পরা।

মহারানী সুরীতি দেবী অসম্ভব ভদ্র। তাঁর কণ্ঠস্বর অতীব সুরেলা।

পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের বড় বাড়ি ‘প্রাসাদ’। করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন সেখানে, একটি ঘরে। তাদের দেখাশুনো করতেন ঘোষ পদবির একজন মানুষ। কুক কাম কমবাইনড হ্যান্ড এই ঘোষ। বহুদিন ছিলেন তিনি পিতা-পুত্রর সঙ্গে। করঞ্জাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁরও শরীর ভেঙে পড়ে। কিছুদিন পরই তিনি তাঁর দেশে চলে যান।

এই বাড়িতেই থাকতেন মোহন বাদোরিয়া নামে একজন জৈন ধর্মের মানুষ। মোহন আর্ট ও অ্যান্টিক কেনাবেচা করতেন। মহনের গোডাউন ছিল ‘প্রাসাদ’-এর কয়েকটা ঘর। ফলে তিনি থাকতেন এই কথা সর্বাংশে সত্য নয়। মানে রাতটুকু কাটাতেন নিজের বাড়িতে। কাছেই তাঁর বাড়ি।

মোহন বাদোরিয়ার একটি মুদ্রাদোষ ছিল, যেতে দে ভাই, যেতে দে ভাই। জৈন মানুষদের মৃত্যুর পর কোনো জৈন মন্দিরে নিয়ে যেতে হয়, সেই পার্থিব অবশেষ। মোহন তাঁর বাবার প্রয়াণের পর তাঁর পিতৃদেবের পার্থিব অবশেষ লোকাল শিব মন্দিরে নিয়ে গেলেন। তারপর সেখান থেকে শ্মশানযাত্রা।

কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকনাম ছিল বলু। লোকাল লোকজন বলুদা, বলুবাবু বলতেন তাঁকে সম্বোধনে। মুখে মুখে তিনি আবার কখনও ‘বুলুবাবু[‘ বা ‘ভুলুবাবু’। মোহন বাদোরিয়ার বাবার শিব মন্দিরে  নিয়ে যাওয়ার পর কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে শিব মন্দিরে কেন আনা হল ডেড বডি, তা নিয়ে প্রশ্ন করলে, মোহনের সপাট উত্তর, যেতে দে ভাই বলু, যেতে দে।

কল্যাণদা পরে বলেছেন, মোহনের উত্তর শুনে তো আমি রীতিমত থ। ‘প্রাসাদ’-এর বেশ কয়েকটি ঘর মহারানী সুরীতি দেবীর কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে মোহন চিৎপুরের যাত্রাপার্টিকে ভাড়ায় দিতেন, তাঁদের মহলার জন্য। যাত্রা দলের জিনিসপত্র রাখার ব্যাপারেও তাঁরা এইসব বড় বড় ঘর ব্যবহার করতেন।

মোহন বাদোরিয়া বাঙালি কন্যার পাণিগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের কোনো সন্তানাদি নেই। আগাগোড়া টাক মাথা, ফর্সা, গোলমুখের মোহন ধুতি-পাঞ্জাবি। অভ্যস্ত মাছ-ভাত, শিব-কালি পুজোয়। বাংলা বোলি-বচনে।

মোহন বাদোরিয়াকে বহুবার মিট করেছি। আমার ‘যক্ষ’ নামের আখ্যানে আর্ট ও অ্যান্টিক জগৎ নিয়ে নানা কথা আছে। বহু তথ্য। ‘যক্ষ’ উপন্যাসটি কলকাতার আর্ট আর অ্যান্টিক বাজার নিয়ে। সেখানে সুভোগেন্দ্রনাথ— সুভো ঠাকুর, কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মোহন বাদোরিয়া, উত্তর কলকাতার পাথুরিয়া স্ট্রিটের প্রাসাদ, সব আছে।

থাক সে সব কথা।

শাশ্বতী সরকারের সঙ্গে এন আর এস-এ গেছিলাম পণ্ডিত রাধিকামোহন মৈত্রর ডেডবডি দেখতে। বিখ্যাত সেতারি নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাজনাও শুনেছি বহুবার। এবং বলতে কোনো দ্বিধা নেই উস্তাদ বিলায়েত খাঁ সাহেব ও পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাজনা আমাকে যতটা মোহিত করেছে, পণ্ডিত রবিশঙ্করজি ততটা নয়। অন্নপূর্ণা দেবীর বাজনা শুনেছি সিডিতে। বাবা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের কন্যা, একদা পণ্ডিত রবিশঙ্করজির স্ত্রী অন্নপূর্ণা দেবীর বাজনা অনবদ্য। বর্ধমানের স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় অন্নপূর্ণা দেবীর ছাত্র।

বর্ধমানে— বলতে গেলে প্রায় বর্ধমান-বীরভূম সীমান্তে খড়িখড়ে নদীর পাড়ে ‘আলো-বাতাস’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠনের সারা রাতের দোল উৎসব। মাথার ওপ্র দোলপূর্ণিমার ভরা চাঁদ। কাছেই খড়ি নদী। অমলবাবু নামে এক ভদ্রলোক ‘খড়ির গণ্ডী’ নামে এই ঘেরা বনের মালিক। অনেক, অনেকটা জমি। কাছেই গুসকরা। বন সৃজনের গাছ এখানে, অনেকটা জায়গা জুড়ে।

এই বনে শেয়াল আছে। বেজি, হয়ত সাপও। সারা পশ্চিমবাংলায় যেদিন দোল, তারপর দিন বর্ধমানের দোল। বর্ধমানের ‘রাজা’— মহাতাবচাঁদরা এই দোল উৎসবকে প্রথা হিসাবে সামনে নিয়ে আসেন।

স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় অন্নপূর্ণা দেবীর ছাত্র ‘খড়ির গণ্ডী’-তে দোলের রজনীতে পূর্ণ চাঁদের আলোয় বাজিয়েছেন সেতার। তখন তাঁর দু হাঁটুতে রাখা। তবু পা মুড়ে তিনি বাজালেন, অনেকক্ষণই বাজালেন। বাজাতে থাকলেন।

বসন্ত বাসাতে তখন রাগ দরবারি। জয়জয়ন্তী। পূর্ণ, লালচে চাঁদ চলে যাচ্ছে দিগন্তে। হচ্ছে অস্তমুখী। সমস্ত চরাচর চাঁদের আলোয় বিধুর, বিভ্রমময়। স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায় বইও নির্মাণ করেছিলেন অন্নপূর্ণা দেবীকে নিয়ে।

বড়দিন বলতে গিয়ে আরও আরও কথা উঠে এল। আবারও ফিরব বড়দিন-এ। কলকাতার বড়দিন-এ। পার্ক স্ট্রিটে দাঁড়িয়ে, ঘুরে ঘুরে, এশিয়াটিক সোসাইটি ফুটপাতে, ‘ট্রিঙ্কাস’-এর সামনে মরা সাহেবের সেকেন্ড বা থার্ড হ্যান্ড কোট-প্যান্ট পরে আমাদের বন্ধু কালীকৃষ্ণ চক্রবর্তী এবং আমরাও ভিক্ষে করছি পার্কস্ট্রিটে, ইংরেজিতে ভিক্ষে চাইছি আমরা, বেংলিশে।

তখনও বড়দিন। এক্সমাস, পার্কস্ট্রিটের আকাশে লাল-নীল-সবুজ আলো। ‘মোকাম্বো’, ‘ট্রিঙ্কাস’, গোটা পার্কস্ট্রিট জুড়ে আলোর চেন, চিটির পিটির টুনি বালব। ঝিকি মিকি আলো।

অনেক রুজ, লিপিস্টিক, বাহার। সে বড়দিনের গল্প নয় পরে বার। ২৫ নম্বর এপিসোডে।

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor