পুজোর মিষ্টি, খাবার – রেডিমেড, হোমমেড

মুছে যায়? – ১৬

আগের পর্বে

পুজোয় নতুন গান ছিল বাঙালির জীবনের এক নস্টালজিয়া। দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করেই হাজির হত তারা। এদিক থেকে প্রথমেই ছিল ‘এইচএমভি’। তারপর ‘মেগাফোন’, ‘সোনেলা’। বেজে উঠত চোঙদার গ্রামোফোনেরা। হেমন্ত, মান্না দে, আশা, লতা, গায়ত্রী বসু, গীতা দত্ত কে ছিল না সেই গায়কীর তালিকায়। গানের পাশাপাশি ভানু-জহরের কমিক, নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের হাস্য কৌতুক, হাজির হত সবই। শিল্পীদের গানের কথা ও ছবি নিয়ে এইচএমভি বার করত শারদ অর্ঘ্য নামের বই। আকাশবাণী থেকে বেরত ‘বেতার জগত’, ‘আকাশী’। গ্রামোফোন ছাড়া পুজোর গান বাজত রেডিওগ্রাম আর রেডিওতেও। তবে পুজোর গানের যে গৌরব, তা এখন একেবারেই হারিয়েছে যেন। বন্ধ হয়েছে সোনেলা, মেগাফোন কোম্পানিও।

মহালয়া আসতে না আসতেই যেন সেজে থাকে দুর্গাপ্রতিমার নিরঞ্জন। এই বছর মল মাসের হিসাবে পঞ্জিকার পাতা সামলে সুমলে দুগগা পুজো নিয়ে বড় গোল বেঁধেছে। দোলায় আগমন, অশ্বে গমন— ফল ছত্রভঙ্গ। নৌকায় এসে গজে গমন নাকি পঞ্জিকা কর্তাদের মতে সবচেয়ে ভালো, ফলাফল শস্যপূর্ণা বসুন্ধরা।

অনেক, অনেক দিন আগে কারা যেন নির্মাণ করেছেন একটি দু লাইনের ছিকুলি, সেই ছিকুলিটি এরকম—

‘মা আসছেন দোলায় চেপে

সঙ্গে মরণ আসছে ক্ষেপে...’

আরও পড়ুন
পুজোর গান— শারদ অর্ঘ্য

নাহ, এই টু লাইনার কোনো পঞ্জিকা বিশ্বাসী করেননি। ১৯৬৩-৬৪ সালে ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’ ‘গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা’ মল মাসের হিসাব ধরে দুর্গাপুজোর আলাদা আলাদা বিধি ও বিধান দিয়ে থাকে।

রামকৃষ্ণ মিশনের সমস্ত পূজা, অনুষ্ঠান বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে হয়ে থাকে। সেই ১৯৬৩-৬৪ সালে, আজ থেকে প্রায় পঞ্চান্ন-ছাপান্ন বছর আগে এক মাসের ফারাকে দু দফার দুর্গাপুজো। আগে ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’ মতে বেলুড়ের দুর্গোৎসব, সঙ্গে কুমারী পুজো। যা বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মিশনের দুর্গাপুজোর অন্যতম বিশেষ অনুষ্ঠান। গুপ্তপ্রেস মতে পরে দুর্গাপুজো হল, প্রায় এক মাস বাদে, সাধারণ ভাবে বারোয়ারি আর ক্লাবের পুজো। বহু বাড়ির দুর্গা আরাধনাই ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’ মতে। আবার ‘গুপ্ত প্রেস’ মতেও যে পুজো একেবারে হয় না, তা নয়।

আরও পড়ুন
ব্লেড, ক্ষুর, রক্তপাত...

‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’, ‘গুপ্ত প্রেস’ ছাড়া ‘পি এম বাকচী’, ‘বেণীমাধব শীল’-এর ফুল ও হাফ পঞ্জিকা সবই তো বাজারে চলে। বেণীমাধব শীল-এর ফুল ও হাফ পঞ্জিকার দাম ‘বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত’, ‘গুপ্ত প্রেস’, ‘পি এম বাকচী’র তুলনায় অনেকটাই কম, বরাবরই।

‘দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা’, ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’, ‘এফিমেরিস’, ‘রাষ্ট্রীয় পঞ্চাঙ্গ’ ইত্যাদি প্রভৃতি নানান ধরণের নাম, যাঁরা পঞ্জিকা নিয়ে, জ্যোতিষ নিয়ে চর্চা করেন, তাঁরা খবর রাখেন পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে।

আরও পড়ুন
ট্রেঞ্চ, সাইরেন, অলক্লিয়ার

প্রসঙ্গ ক্রমে একটি কথা বলি, আমার বাবার জ্যাঠামশাই ভারত বিখ্যাত নব্য ন্যায়ের পণ্ডিত তারানাথ ন্যায় তর্কতীর্থ (রায়) পি এম বাকচীর অনুমোদিত পণ্ডিতকুলের মধ্যে অন্যতম ছিলেন। সীতারাম দাস ওঙ্কারনাথের ঠিক পরেই নাম ছাপা হত তারানাথ ন্যায়তীর্থর।

তিনি রাষ্ট্রপতি পুরস্কার পেয়েছিলেন। কেয়ূর ও দামি শাল এসেছিল উপঢৌকন হিসাবে। হাতে বাঁধার কেয়ূরটি সোনার। তারানাথ ন্যায় তর্কতীর্থ প্রখ্যাত পণ্ডিত গৌরীনাথ শাস্ত্রী, অশোক শাস্ত্রীর শিক্ষক ছিলেন। উত্তর কলকাতার বাগবাজারে ছিল তাঁর টোল— ‘দর্শন’ চতুষ্পাঠী। বাড়িতে ছাত্র রেখে তিনি পড়াতেন। তার জন্য ভাতা পেতেন ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে। দেশ তখন পরাধীন। চল্লিশ বছর হয়ে যাওয়ার পর তারানাথ সংস্কৃত কলেজে চাকরি নেন, পণ্ডিতের— পড়ানোর চাকরি।

আরও পড়ুন
‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে...’

১৯৭৩ অথবা ১৯৭৪ সালে তিনি খড়দার মধ্য পাড়ায় তাঁর বাড়িতে প্রয়াত হন, দুর্গা পুজোর ঠিক আগে আগে।

পঞ্জিকার সঙ্গে গঞ্জিকার একটা ধ্বনিগত সাদৃশ্য আছে। বিশ্বাসী- পঞ্জিকা বিশ্বাসীরা এই বাক্যবন্ধ শুনে খানিকটা ক্ষুণ্ণ হতেই পারেন। কিন্তু পঞ্জিকার পাতায় পাতায় অমুক দিনে বার্তাকু (বেগুন), তমুক দিবসে অলাবু (লাউ), তমুক গতে কুষ্মাণ্ড ভক্ষণ নিষিদ্ধ, এসবই থাকে।

আরও পড়ুন
ঘড়িক্কে 'ঘোড়া' ছোটে

এছাড়া অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ, চূড়াকরণ, সাধভক্ষণ, অব্যূড়ান ভক্ষণ (আইবুড়ো ভাত) সব কিছুর দিন, তারিখ, দিনের শুভাশুভ নির্দেশ থাকে পঞ্জিকায়। অমুক দিনে কোথায় কোথায় কোন দিকে গমন নিষিদ্ধ, অমৃতযোগ কখন, কালবেলাই বা কখন, ঠিক কোন সময়ে এসব বলে যায় পঞ্জিকার পাতা।

পঞ্জিকার পাতায় পাতায় মুক্তকেশী বেগুন, বিজ্ঞাপনে বিজ্ঞাপনে অতি বৃহৎ, রাক্ষুসে লাল ও শাদা মূলা— জায়েন্ট সাইজ মূলা, বাঘের মাথা সদৃশ ফুলকপি ও বাঁধাকপি, বশীকরণ আংটি ও রুমাল, রুমালেও বশীকরণ হয়, পঞ্জিকার দাবি অনুযায়ী, ‘মোহিনী’ রুমাল তার নাম। যে কোনো নারী বা পুরুষকে বশ করার অব্যর্থ দ্রব্য। মূলত লুধিয়ানা, জলন্ধরের ঠিকানা এই বশীকরণ রুমাল, বশীকরণের কাজল ও তাস, প্ল্যানচেটের মেশিন, জাদু দেখানোর সরঞ্জাম, শব্দ ও আগুন ছেটানো রিভলভার, যা দিয়ে বন্য জন্তু তাড়ানো যায়, সেই সঙ্গে শখের থিয়েটার ও পিকনিক ইত্যাদি আনন্দ অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা যেতে পারে এই রিভলভার, খেলা খেলা, সারা বেলার জন্য।

আরও পড়ুন
ব্যা-ব্যা-ব্যায়ামাগার – আখড়া

‘বশীকরণ’ ইত্যাদিতে কাঁয়ুর – কামাখ্যা বা কামরূপ – কামাখ্যার নাম জোড়া থাকে। তাতে বাজার গোছাতে সুবিধে হয়, কাঁয়ুর – কামিখ্যে বা কামরূপ কামাখ্যার ব্র্যান্ড অতি – অতি প্রাচীন ব্র্যান্ড নেমের জন্য। আর প্ল্যানচেট করে ‘আত্মা’ নামানোর মেশিন, সামগ্রী – কলকাতাতেও কিছু কিছু তৈরি হত চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকে।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর অতি আদরের পুত্র শমীন্দ্রনাথের অকাল মৃত্যুর পর পরলোকচর্চা— প্ল্যানচেট অভিলাষী হন। সে সব কথা তো রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ অমিতাভ চৌধুরী লিখেও গেছেন, বই হিসাবে আছেও তা, রবীন্দ্রনাথের পরলোকচর্চা। 

আরও পড়ুন
মুড়ো, মুন্ডু, কল্লা

যতদূর মনে পড়ে শারদীয় ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় অমিতদা— অমিতাভ চৌধুরীর এই গুরুত্বপূর্ণ লেখাটি বেরয়। পরে বই হিসাবে ছাপে ‘আনন্দ পাবলিশার্স’।

কলকাতার বাগবাজারে ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’-যুগান্তর’-এর বাড়িতে নিয়মিত পরলোকচর্চার— প্ল্যানচেটের আসর বসত। শ্রী তুষারকান্তি ঘোষ, তিনি ভীষণ উৎসাহী ছিলেন প্ল্যানচেটে। এছাড়াও কলকাতার থিয়োসফিকাল সোসাইটিতে প্ল্যানচেট ও পরলোকচর্চার ব্যাপারটা ছিল। কলকাতার বহু বড়োলোক বাড়িতে এবং মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রেতচর্চা, প্ল্যানচেট ইত্যাদি, প্রভৃতি ষাট-সত্তর দশকেও চল ছিল। প্ল্যানচেটের মেশিন কিনতে পাওয়া যেত। কাঠের তৈরি চাকা লাগানো সেই মেশিনের বিজ্ঞাপন পঞ্জিকায় সে কথা আগেই বলেছি।

আরও পড়ুন
টোকাটুকি, টুকলি, চোতামারা

বশীকরণ সিঁদুরের কথা আছে ‘সাহেব বিবি গোলাম’ নামের বিমল মিত্রর পৃথুল আখ্যানে। পরে তা নিয়ে বাংলা ও হিন্দিতে ছবি হয়। বাংলায় – মানে বাংলা চলচ্চিত্রে ভূতনাথ করেছিলেন উত্তমকুমার। ছোট বউ করেছিলেন অপরূপা সুমিত্রা দেবী (বড়), ছিলেন ছবি বিশ্বাস, নীতিশ মুখার্জি, জহর রায়, পাহাড়ী সান্যাল, অনুভা গুপ্ত করেছিলেন জবা। পাহাড়ী সান্যাল তাঁর বাবার ভূমিকায়। হিন্দি ‘সাহেব-বিবি-আউর গুলাম’-এর ভূতনাথ গুরু দত্ত। ছিলেন রেহমান, ছোট বউ – মীনা কুমারী, জবা - ওয়াহিদা রেহমান। সঙ্গীত পরিচালক হেমন্তকুমার – হেমন্ত মুখোপাধ্যায়।

কী অসামান্য সব গান— ‘ভঁত্তরা বড়া নাদান হ্যায়’। না যাও সাঁইয়া ছুড়াকে বাইয়াঁ। খুব মেলোড্রামা, উচ্চকিত নাটক। থাক, সে সব কথা।

আরও পড়ুন
ছিটকিনি পাইপগান ক্রমশ ক্রমশ...

দুর্গাপুজোয় ‘শচীনের রাঙাজবা’ নামের সিঁদুর ও তরল আলতা খুব চলে। মানে পুজোতে তো দেওয়া হয়ই। সেই সঙ্গে এয়োস্ত্রীরাও কেনেন। ‘সাবিত্রী’ বলে একটি সিঁদুর পাওয়া যেত গালার তৈরি বাহারি কৌটোয়। সেই ডিবে হাত ফসকে মেঝেতে পড়লেই ফট। এরপর অবশ্য প্লাস্টিকের ডিবে এল।

যাঁরা নিত্য সিঁদুর ব্যবহার করতেন, সিঁথিতে, কপালে। তাঁরা রূপোর সিঁদুর কৌটোয় সিঁদুর রাখতেন। কোনো কোনো সিঁদুর দান হত মিনে করা, সুন্দর ডিজাইন। দাম ষাট দশকে এক টাকা, পাঁচ সিকে বড়জোর। পাথর, হাতির দাঁত, প্লাস্টিক, মোষের শিং— সব দিয়ে সিঁদুর কোটো।

আরও পড়ুন
চান্দ্রায়ণ

ওড়িশার কটকে খুব ভালো পাওয়া যেত মোষের শিঙের সিঁদুরদানি। আবার দিল্লি, আগ্রা, জয়পুরে পাথরের, শ্বেত পাথরের, আইভরি – মানে হাতির দাঁত অথবা উটের হাড়ের। সিগারেট হোল্ডার, সিগারেট কেস হত সোনা, রূপোর, উটের হাড়, মোষের শিং, তামার। রুপোর ওপর সোনার জল করা সিগারেট কেসের খুব চলছিল ষাটে, সত্তরের দশকেও।

কটকে রূপোর জালি – ফিলিগ্রির কাজ হত খুব ভালো। সেই সূক্ষ্ম কারুকাজ সমন্বিত সিঁদুর কৌটো পাওয়া যেত ষাট-সত্তর দশকে, পুরীতেও। কটক থেকে রুপো দিয়ে ফিলিগ্রি করা রুপার সিঁদুর কৌটো, মোষের সিঁদুর কৌটো আসত পুরীতে।

মেটে সিঁদুর সিঁথিতে লাগাতেন মূলত আদিবাসী নারীরা, বিহারের নারীরাও মেটে সিঁদুরে যেতেন। সিঁদুর থেকে সিঁথি চুলকোন – পারা থেকে ইনফেকশান হওয়া অনেক সময়ই হত। সিঁথি চুলকোতে চুলকোতে চওড়া হয়ে যায় ক্রমশ, চুল ওঠে।

‘অম্রুতাঞ্জন’-এর শিশি যেন, এমন জল রঙ কাচের শিশিতে যে সিঁদুর থাকত, তা থেকেই এই ইনফেকশান আমার ছোটমাসি নমিতা ভট্টাচার্যর। সেই সিঁদুরের ব্র্যান্ড নেম মনে পড়ছে না।

সত্তর দশক থেকেই হিন্দু বাঙালি নারী আর সিঁদুর ব্যবহার সেভাবে করেন না। বরং বাংলাদেশে দেখেছি হিন্দু বাঙালি রমণীর মধ্যে শাঁখা-সিঁদুরের চল। সংখ্যালঘুর আইডেনটিটি রক্ষার এ এক আলাদা কৌশল। সব দেশেই এটা আছে।

আমি শাঁখা-সিঁদুর নিয়ে কোনো রকম ‘সেন্টু’ বা সমর্থন অসমর্থনের মধ্যে নেই। ফ্যাক্টটুকু বলার চেষ্টা করলাম মাত্র। ব্যস। পাতা সিঁদুর ছিল সস্তার। কাগজের প্যাকেটে মোড়া। ষাট দশকে দাম দশ নয়া পয়সা। দুর্গাপুজোয় পুজো দেওয়ার সময়, দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, তারাপীঠ, আরও অন্য অন্য কালীবাড়ি, কালীস্থান বা পীঠস্থানে অতি সস্তার নোয়া— লোহা, কোরা শাঁখা, সিঁদুরের পাতা, পুজোর ডালায়, কেন কে জানে! ব্যতিক্রম যে নেই, তা নয়। মুখে কর্ক আঁটা আলতার শিশির বদলে আলতা পাতা দেওয়ার রেওয়াজ ছিল এই পুজোর ডালায় – ডালিতে। আলতা পাতা জলে ভেজালে আলতা হয়। কিন্তু বেশ খেলো। ভালো আলতার শিশিতে টিনের ছোট বাটি থাকত, আলতা ঢাকার জন্য। সেই সঙ্গে স্পঞ্জ বা তুলো ধরণের কিছু একটা আগায় দিতে, একটু মোটা তার দিয়ে তুলি – পায়ে আলতা পরবার জন্য।

প্রতি বৃহস্পতিবার, পূর্ণিমা আর একাদশীতে আমার মা গায়ত্রী রায় আলতা পরতেন, যদি না তিনি রজঃস্বলা থাকতেন। আলতা পরাতে আসতেন ছোট কাকিমা, কখনও সেজো কাকিমা। সারা বছর তাঁরা আলতা পরাতেন বাড়ি বাড়ি। পরামানিক – নরসুন্দর কূলের এই বধূরা আলতা ছোপ লাগা বটুয়াতে আলতা নুটি, পায়ের গোড়ালি পরিষ্কারের জন্য, মানে যাঁকে আলতা পরাবেন, তাঁর গোড়ালি সাফ-সুতরো করার জন্য পাথর, পায়ের অতিরিক্ত মাস – বাড়িতি মাংস, কড়া কাটার জন্য, নখ কাটার কাজেও লাগবে, সেই নরুন আনতেন।

এক আনা ছ নয়া পয়সা পেতেন তাঁরা এই ‘কামিয়ে’। ছোট কাকিমা, সেজো কাকিমা দুজনেই সম্ভবত আমার গর্ভধারিণী গায়ত্রী রায়ের থেকে বড়। তাই আলতা পরানোর পর তাঁরা দুজনে দুজনকে হাতজোড় করে নমস্কার করতেন। এই সব কথা বিস্তারিত লিখেছি আমার ‘লুপ্তজীবিকা’ নামের গ্রন্থে। থাক, সে সব প্রসঙ্গ। 

এবার পুজোর আলতা-সিঁদুর ছেড়ে পুজোর মিষ্টিতে ফিরি। তার আগে একটি কথা বলা দরকার, ‘ছোট কাকিমা’, ‘সেজো কাকিমা’, মাকে লক্ষ্মী পুজো, দুর্গাপুজোর চার দিন আলতা পরাতেন। ওঁরা বাঁ-হাতে যজমান-এর পায়ের গোড়ালি ধরে ওঁদের ডান হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে এক  মোক্ষম টান দিতেন। আলতা পরানো কাকিদের ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ তখন অলক্তক রঞ্জিত। আলতায় আলতা ময়। কিন্তু পায়ের পাতায় রেখা নির্মাণে কোনো অসুবিধেই নেই। এক টানে ফিনিশ।

নিয়মিত আলতা পড়লে নাকি শীতে বা বারোমাস যে গোড়ালি ফাটার সমস্যা, তা থেকে রেহাই মেলে, এমন কথা প্রচলিত ছিল তখন। মানে ষাট-সত্তরেও, এর পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি আছে কিনা জানা নেই।

কোনো কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের ছেলেরা বিয়ে করতে যাওয়ার সময় দু পায়ে আলতা পরতেন। আর পায়ের পাতার মাঝখানে গোল একখানা সূয্যিমামা।

আলতা পরানোর পর ছোট মেয়ে, ছেলেদেরও পায়ে আলতা পরিয়ে দিতেন সেজো আর ন কাকিমারা। আলতা পরার পর ন্যাকড়ায় পা মোছানোর একটা রেওয়াজ ছিল। সেই ন্যাকড়ায় ভালো করে পায়ের পাতা মুছিয়ে দেওয়ার রীতি ছিল।

অনেক আলতা-সিঁদুর হল। এবার পুজোর মিষ্টি, খাবারে ফিরি। আমাদের বালির ৫৯/১৩ শান্তিরাম রাস্তায় যে বাড়ি, সেখানে মা-গায়ত্রী রায় পুজো উপলক্ষে কুচো নিমকি, কুচো গজা, পেরাকি বানাতেন। সব নিজে হাতে। নিমকি ভাজা হত ‘ডালডা’য়। খেজুর গাছ মার্কা ‘ডালডা’, সবচেয়ে দামি তখন। এছাড়াও বেলুন মার্কা ডালডা ছিল, একটু কম দাম। বড় টিনে পাওয়া যেত ডালডা। খেজুর গাছ মার্কা ডালডা পাওয়া যেত গোল পোক্ত টিনেও। সেই টিনের রঙ হলদে। বিজয়ার – মানে দশমীর দিন, প্রতিমা নিরঞ্জনের পর কোলাকুলি, মিষ্টিমুখ, কোনো কোনো বাড়িতে সিদ্ধির শরবত অথবা ভাঙের সবুজ গোলাই, গুলি।

একটা ঝুনো নারকেল – ২৫ নয়া পয়সা, চার আনা।

এক কিলো চিনি – সাঁইত্রিশ নয়া পয়সা, ছ আনা।

এক কিলো ময়দা – দশ আনা, বাষট্টি নয়া পয়সা।

বাঙাল বাড়ি লাড়ু – বড়ি, নাড়ু, তিল ও নারকেলের নাড়ু। উপড়া – খই দিয়ে গুড়ের পাকে হালকা মিষ্টির মোয়া, গঙ্গাজলি, তক্তি।

অনবদ্য নাড়ু বানান আমার কাকিমা রেণুকা রায়, সেই সঙ্গে তক্তি। কাকিমার দিদি রেখা গঙ্গোপাধ্যায়, তিনিও শাদা নাড়ু, তক্তি চমৎকার বানান। কাকিমার মা তিনিও বানাতেন নাড়ু, তক্তি।

মা বানাতেন গুড়ের নাড়ু। শুরু হত নবমী থেকে। আর চলত কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো পার করে। কারণ রোজই তো ‘বিজয়া’ করতে আসেন আশপাশের মানুষ।

আমাদের বালির বাড়িতে মটর-ঘুগনি হত। সেই ঘুগনিতে আলু কুচি, নারকেল কুচি। কখনও কিমা, খাসির মাংসের। অনবদ্য।

আবার পেঁয়াজ-রসুন-কিমা ছাড়া নিরামিষ ঘুগনিও হত। ঘুগনি মটর বা কাবলি ছোলা ভিজিয়ে রাখতে হত অনেকটা সময়। তখন তো বাড়ি বাড়ি প্রেশার কুকার নেই। ঘুগনি হত তিজেলে, হাঁড়িতে ফুটত অনেকক্ষণ। মটর ‘গলা’র জন্য। 

ষাট দশকে এক কিলো ভালো আখের গুড় চার আনা। মুদির দোকানে দু পয়সা  মানে তিন নয়া পয়সার গুড়, এখোগুড়, নুন, চানাচুর, নোনতা বাদাম – সব দেয়।

আমার গর্ভধারিণী কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর নাড়ু বানাবার সময় পাশে বক হয়ে বসে থাকতাম। মাছ প্রত্যাশী বক যেমন পুকুর পাড়ে। মা ডান হাতের তালুতে সরষের তেল দিয়ে নাড়ু বা লাড়ু পাকাতেন। সেই পাকিয়ে তোলা নাড়ুর একটা মেঝেতে পড়লেই সেটা আর ঠাকুরের ভোগে লাগবে না। ওটা আমার।

আমার শাশুড়ি মা আশালতা দেবী বিজয়া দশমীর খাবার তৈরি করতেন কুচো গজা, কুচো নিমকি, জিবে গজা, লবঙ্গ লতিকা তো ছিলই। জিবে বা জিভে গজা মা-ও করতেন। তখন কিমা – খাসির কিমা দেড় টাকা কিলো, সেটা ষাট দশক। বালি বাজারে খাসির মাংস পাঁচ সিকে – এক টাকা চার আনা কিলো। সঙ্গে চর্বি, মেটে ফ্রি। কচ্ছপের মাংস ছ আনা – সাঁইত্রিশ নয়া পয়সা কিলো। এটা ১৯৬০ সালের হিসেব। কচ্ছপের মাংস তখনও নিষিদ্ধ হয়নি। মাংসের সঙ্গে বাদি, মেটে, ডিম ফ্রি।

খাসির মাংসের কিমায় চমৎকার পাঁঠার ঘুগনি। ডিলিশাস। গায়ত্রী রায় করতেন, তিনি নিজে কোনোরকম মাংস খেতেন না। তখন তো পাশ্চাত্য বৈদিক বাড়ির মাংস বলতে পাঁঠা আর ক্বচিৎ কদাচিৎ খাসির। ‘বৃথা’ মাংস অর্থাৎ দেবী-দেবতার সামনে বলি না দেওয়া মাংস প্রাচীনরা খেতেন না। মহিলারা অনেকেই মাংস ছুঁতেন না। কোনো কোনো ইসলাম ধর্মাবলম্বী প্রাচীন নারী এখনও গো মাংস খান না, আমার চোখে দেখা।

মা বিজয়ার মিষ্টি হিসাবে তৈরি করতেন বোঁদে, মিহিদানা, পানতুয়া, বাজার থেকে – ময়রার দোকান থেকে রেডিমেড আসত নারকেল ছাবা বা নারকেল ছাপা, কুচো গজা, ক্ষীর ও নারকোলের চন্দ্রপুলি। মিহিদানা, বোঁদে। 

বাড়িতে মিহিদানা, বোঁদে, মালপোয়া, কুচো গজা আশালতা ভট্টাচার্যও করতেন। মা পেরাকির ভেতর দিতেন সুজি-চিনির পুর সঙ্গে কখনও কখনও ক্ষীর। সে সবও ছিল বিজয়া দশমীর মিষ্টি হিসাবে খুবই প্রচলিত আইটেম।

অলংকরণ – প্রণবশ্রী হাজরা 

Powered by Froala Editor