পুজোর গান— শারদ অর্ঘ্য

মুছে যায়? – ১৫

আগের পর্বে

ষাট সত্তরের দশকে ব্লেড বলতে ‘ভারত’, ‘পানামা’, ‘সেভেন ও ক্লক’ ইত্যাদি। ‘ভারত’ ব্লেড পাওয়া যায় সর্বত্র। ‘সেভেন ও ক্লক’ বড়ো লোকেদের ব্লেড। অন্যদিকে সত্তরের দশকে বাজারে আসে ‘অশোক’ ব্লেড। তখন ফোম, আফটার শেভ লোশন, শেভিং সেটের জেল এসব নেই। সত্তরের দশকেই এল ‘ওল্ড স্পাইস’ আফটার শেভিং লোশন। শেভিংয়ের সাবান বলতে গোদরেজ। সব পরিবারেই সেসময় ছিল ফটকিরির ব্যবহার। সেলুন বা নরসুন্দরেরাও তার ব্যবহার করতেন। ব্লেডের বদলে ক্ষুরও ব্যবহার করতেন তাঁরা। তাতে ধার দেওয়ার জন্য থাকত চামড়ার চামাতি।

পুজোর গান, এও তো দুর্গাপুজোকে কেন্দ্র করে। ভারতে নিত্যনতুন গানের কথা, প্রতি বছর, সুর, গাওয়কি, শোনা ছিল এই সেদিনও বাঙালি জীবনের বেঘোর নস্টালজিয়া।
পুজোর শাড়ি
পুজোর জামা কাপড়।
পুজোর সেন্ট।
পুজোর গন্ধতেল।
পুজোর শার্ট প্যান্ট।
পুজোর ফ্রক।
পুজোর শাড়ি মাসে ‘হাকোবা’, ‘গরিবের মেয়ে’, ‘রোলেক্স’, ‘নাইলন শাড়ি’। অনেক পরে সিরিয়াল ধরে এসে গেল ‘বাহা’ শাড়ি। 

পুজোর শার্ট, পাঞ্জাবি বলতে আদ্দির, কেমব্রিক, পপলিন, লং ক্লথ, টুইলের তৈরি। সেই সঙ্গে র-কটন, ডেক্রন, টেরিলিন, টেরিন, টুইংকল— এইসব কাপড় দিয়ে তৈরি হত শার্ট। টুইংকল মূলত মেয়েদের ফ্রক তৈরিতে কাজে লাগত। পরে এইটটি-টোয়েন্টি অর্থাৎ আশিভাগ সিনথেটিক, কুড়িভাগ কটন। স্যানফ্রোডাইজড, ভয়েল, ফুল ভয়েল, রুবিয়া ভয়েল— এইসব কাপড়ের কথা তখনই শুনি।

ভয়েল, রুবিয়া ভয়েলে মেয়েদের ব্লাউজ তৈরি হয়। ছেলেদের পাঞ্জাবি। কথাকার শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় রঙিন, ফাইন রুবিয়ার পাঞ্জাবি পরতেন। তখন তিনি সাপ্তাহিক ‘অমৃত’ সম্পাদনা করেন। পিত্তি রঙের পাঞ্জাবি পছন্দ করতেন খুব। সেই সঙ্গে ছাই রং আর বাসন্তী রং। 

প্যান্ট তৈরি করান হয় মাখন জিন, জিন, কর্ড, আরও কয়েক বছর পরে এল স্ট্রেচলন, সঙ্গে ব্যানলনের গেঞ্জিও। সবই সিন্থেটিক— মানে ব্যানলন আর স্ট্রেচলন। বেল বটম, প্যারালাল, এলিফ্যান্ট— হাতি পা ছিল সত্তর দশকে। রাজেশ, রাজেশ, রাজেশ খান্না— কাশ। অমিতাভ বচ্চন।

তার আগে চোঙা প্যান্ট, চুস প্যান্ট। পরে বসা যায় না। বসলে ওঠা যায় না। সেই সঙ্গে পয়েন্টেড শুড - ছুঁচলো মাথা, চোঙা প্যান্টের সঙ্গে পড়ে। সে সবও বোম্বাইয়া সিনেমারই দান। দশ, বারো ইঞ্চি ঘের বড়জোর। আর এই চুস বা চোঙা প্যান্টের ফ্যাশন ঝোঁক চলে যাওয়ার পরই বেল বটম, প্যারালাল, এলিফ্যান্ট। কুড়ি, পঁচিশ, তিরিশ ইঞ্চি ঘের। বেল বটম ওপর দিকটা টাইট, নিচের দিকটা ঢলকা। কেউ কেউ পুরনো ‘ড্রেন পাইপ’ প্যান্ট— নর্দমা প্যান্ট বা চুস প্যান্টকে নিচের দিকে কাপড় জোড়া লাগিয়ে বেলবটস বা বেলবটম করে ফেললেন। যেমন শাদা মাখন জিনের প্যান্টে খানিকটা নীল কাপড়। একে-বারে যেন ‘ফোর স্কোয়ার’ সিগারেটের বিজ্ঞাপন করা কেউ, মনে হতে পারে এই ডিজাইন কলা দেখলে।

‘যুগান্তর’ পত্রিকায় কার্টুন সহ একটি ছড়া বেরিয়েছিল নর্দমা প্যান্ট বা ড্রেন পাইপ প্যান্টের ব্যাপারে। ছড়াটা এরকম—

আরও পড়ুন
ব্লেড, ক্ষুর, রক্তপাত...

‘নর্মদা প্যানট টাইট বেজায়

নুইতে গেলে পা টেনে যায়

স্টাইল রাখি না ভক্তি রাখি

আরও পড়ুন
ট্রেঞ্চ, সাইরেন, অলক্লিয়ার

ভাবতে বসেছি

দশমীর ঢাক উঠল বেজে

নাচ এখনও বাকি...।’

আরও পড়ুন
‘আলেকজান্ডার বিক্রি করে...’

যারা দশ-বারো ইঞ্চি ঘেরে ড্রেন পাইপ প্যান্ট পরতেন, ষাট দশকে পুলিশ সুযোগ পেলেই তাদের হেনস্থা করতেন। কান ধরে ওঠবোস করাতেন প্রকাশ্য রাস্তায়, নয়ত রাস্তার ওপর নিলডাউন করিয়ে বসিয়ে রাখা।

পরে সত্তর দশকে যাঁরা বড় চুল রাখতেন, সেই সব ছেলেদেরও অনেক সময় চুল কাটানোর ব্যবস্থা করতেন পুলিশ, এমনকি ন্যাড়াও করে দিতেন। কালীঘাট থানায় জনৈক ‘ভদ্র’ পদবির অফিসার, যিনি এই কাজটি অত্যন্ত সুচারুভাবে করতেন। অর্থাৎ একজন তরুণ বা যুবকের ঘাড়, মাথার হিপি-কর্তনই তাঁর অন্যতম মিশন।

ড্রেন পাইপ প্যান্ট পরে ওঠবোস করতে গিয়ে অনেক সময়ই নতুন প্যান্টও ফেটে যায়। এটা পুলিশের কাছে বেশ আনন্দ ও খুশির ব্যাপার বহু ক্ষেত্রেই। হাতি-পা— এলিফ্যান্ট, বেল বটম আসার পর পুলিশ প্যান্টের ভেতর দিয়ে বোতল গলিয়ে অনেক সময় প্যান্টের ঘের মাপত।

আরও পড়ুন
ঘড়িক্কে 'ঘোড়া' ছোটে

চুস প্যান্ট— চোঙা বা ড্রেনপাইপ, নয়তো নর্দমা প্যান্ট মেয়েরা সে ভাবে পরেননি বোম্বাইয়া সিনেমায়। স্ল্যাকস, শারারা, গারারা, সালোয়ার, কামিজ তো পরেছেনই। কিন্তু চোঙা প্যান্ট খুব না। ‘সূরজ’-এ রাজেন্দ্রকুমারের বিপরীতে বৈজয়ন্তী মালা চুস প্যান্ট পরলেন কি? মনে পড়ছে না। অথচ নায়করা ড্রেন পাইপ মাস্টার। জিতেন্দ্র, মনোজকুমার ইত্যাদি প্রভৃতিরা। কিন্তু দেবানন্দ সাব, রাজ কাপুর, দিলীপ কুমার— দিলীপ সাব চোঙা প্যান্ট না পরলেও বেল বটম বা বেল বটসে খুবই আগ্রহী হলেন। দেবানন্দ, দিলীপকুমার পরলেন। নায়িকারা অনেকেই— বিশেষ করে তরুণতররা। হেমা মালিনী, মালা সিনহা, ববিতা, নিতু সিং, জিনত আমন, পরভিন বাবি, রাধা সালুজা, মুমতাজ, রেহানা সুলতানা, জাহিরা, জাহিদা, শ্রী দেবী, উর্মিলা।

রাজ কাপুরের ছবিতে— ‘মেরা নাম জোকার’-এ সিম্মি, পদ্মিনী পরলেন চোঙা প্যান্ট।

সুরাইয়া, মধুবালা, মীনা কুমারী, ওয়াহিদা রেহমান, মালা সিনহা, নন্দা, সাধনা, সায়রা বানু, ভিম্মি, সবাই শাড়ি ফিল্ম শটে। কদাচিৎ শারারা, গারারা, নয়ত খুব টাইট ফিটিং সালোয়ার কামিজ।

আরও পড়ুন
ব্যা-ব্যা-ব্যায়ামাগার – আখড়া

তখন পুজোর দিন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে প্রচুর ক্যাপ ফাটে। সিংহ মার্কা, কাঠ-বেড়ালী মার্কা পাতলা পিসবোর্ডের গোল কোটো তিন নয়া পয়সা, দু পয়সা রোল ক্যাপ এল একটু পরে। দাম সামান্য বেশি। চার নয়া।

বারোয়ারি পুজো প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে অনেকটা ঢেঁকি চেহারার, খালি ‘গুলো’ মানে কাঠে যে শক্তটুকু দিয়ে মাটির গর্তের ভেতর আতপ চাল  ‘কোটা’ হয়, সেই ‘গুলো’ ছাড়া, অনেকটা যেন চেহারায় মেলে এমন ক্যাপ ফাটাবার যন্ত্র। দাম দশ নয়া পয়সা। নাট বল্টু ফিট করে তার গায়ের ধাতব ঢাকায় ক্যাপ সেট করে মাটিতে শক অথবা কঠিন স্থানে— মেঝেয় আছড়ে ক্যাপ ফাটানো যে ব্যবস্থা তার দাম তিন নয়া পয়সা। এসবই ষাটের গোড়ার হিসেব।

একটি ক্যাপ ফাটানোর বন্দুক চার আনা— পঁচিশ নয়া পয়সা। পরে ষাটের দশকের শেষে যখন রোল ক্যাপ এল, তখন বন্দুকের দাম— খেলনা রিভলভারের দাম হল একটাকা। রোল ক্যাপের কৌটো দশ নয়া পয়সা হয়ে গেল।

আরও পড়ুন
মুড়ো, মুন্ডু, কল্লা

বড় বড় বেলুনে, যা রাস্তায় বিক্রি হয় পঞ্চাশ নয়া পয়সায়, তাদের গায়ে সায়রা বানু, নন্দা, সাধনা, মীনাকুমারী। দিলীপকুমার, রাজ কাপুর।

বেশি জল লাগলে দ্রুত মুছে যায় এইসব হিরো হিরোইন মুখ।

আসলে পুজোর গান— শারদ অর্ঘ্য বলতে গিয়ে এত কথা লেখা এই জন্য। তখন কার ফ্যাশন ট্রেন্ডটি যতটা পারা যায় জানিয়ে দেওয়া।

আরও পড়ুন
টোকাটুকি, টুকলি, চোতামারা

পুজোর হো-হো জামার ফ্যাশন ওঠে ষাটের গোড়ায়, ছেলেদের শার্টে। ছোটদের জন্যই মূলত। তখন নিকার বোকবর, গ্যালিস দেওয়া হাফপ্যানট চার-পাঁচ বছরের বাচ্চারাও পরে।

পুজোর সেন্ট বলতে ‘কান্তা’, ‘প্রিয়া’ আর ছিল ‘কনক’। দিশি সেন্ট। একটাকা দেড়টাকা দামের ছোট শিশি। সেটা ষাট দশকের শুরু।

মাথায় দেওয়ার গন্ধ তেল বলতে ‘মহাভৃঙ্গ রাজ’, ‘ভৃঙ্গল’, ‘কোলগেট’ তেল। সি কে সেনের ‘জবাকুসুম’। ‘ক্যালকাটা কেমিক্যাল্‌’-এর ‘ক্যান্থারাইডিন’। এসবই কম বেশি কেনা হয় ‘পুজো আসব, পুজো আসব’ সময়ে।

আরও পড়ুন
ছিটকিনি পাইপগান ক্রমশ ক্রমশ...

ফ্রকের মধ্যে লো কাট ফ্রকের ডিজাইন, যে ডিজাইন চালু ছিল ষাটের শেষ, সত্তরেও, তাও তো বেশ ইন্টারেস্টিং।

এবার আসি পুজোর গানে।

পুজোর গানের রেকর্ড বার করার ব্যাপারে ‘এইচ এম ভি’ এক নম্বর। এর বাইরে ‘মেগাফোন’, ‘সোনেলা’ কোম্পানি।

আরও পড়ুন
চান্দ্রায়ণ

এইচ এম ভি— চোঙদার গ্রামোফোনের সামনে সেই বাধ্য সারমেয়টি, তাকে ঘিরে কত কত কল্পনা। গল্পবাহার। 

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, জগন্ময় মিত্র, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অখিলবন্ধু ঘোষ, শচীন দেববর্মণ, শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা বসু, গায়ত্রী বসু, গীতা দত্ত, আশা ভোঁসলে, লতা মঙ্গেশকার। প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমন কল্যাণপুর, আরতি মুখোপাধ্যায়, নির্মলা মিশ্র, রাহুল দেববর্মণ, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়, বনশ্রী সেনগুপ্ত, পিন্টু ভট্টাচার্য, হৈমন্তী শুক্লা, চন্দ্রাণী মুখার্জি, মিনা মুখার্জি, মলয় মুখোপাধ্যায়, অমল মুখোপাধ্যায়, জপমালা ঘোষ। প্যারডি গানে মিন্টু দাশগুপ্ত, ‘দুই বেচারা’।

আবৃত্তি রেকর্ডে নজরুল পুত্র কাজী সব্যসাচী, উৎপল দত্ত, প্রদীপ ঘোষ, শম্ভু মিত্র, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, গিটারে কাজী অনিরুদ্ধ, ইনিও কাজী সাহেবের সন্তান। এছাড়াও মহম্মদ রফি, কিশোর কুমার, মুকেশ, তালাত মামুদ, বাংলা গানে। পুজোর গানে।

আরও ছিলেন সনৎ সিংহ, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর জহর রায়ের কমিক, কখনও এক সঙ্গে, কখনও বা আলাদা আলাদা। নৃপতি চট্টোপাধ্যায়ের হাস্য কৌতুকও আছে রেকর্ডে।

পল্লীগীতিতে নির্মলেন্দু চৌধুরী, পূর্ণদাস বাউল। আর একটু পরে প্রহ্লাদ ব্রহ্মচারী, অংশুমান রায়।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গিটার, ভিবালসারার মিউজিক কনসার্ট, দীপেন বল্লভের গিটার বাদন— সবই আসতে থাকে। হয়ত পুরোটাই দুর্গাপুজোর আনুষঙ্গে নয় কিন্তু দীপালি নাগের ভোকাল, পণ্ডিত মনিলাল নাগ, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বিলায়েত খাঁ সেতার বাদনে মশগুল করে রাখেন। বাঁশিতে পান্নালাল ঘোষ। একই ভাবে আসেন পণ্ডিত বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত ও রাধিকা মোহন মৈত্র, আমজাদ আলি খাঁ সাহেব, সরোদে এবং সেতারে পণ্ডিত রবিশঙ্কর।

মৃণাল চক্রবর্তী, সুদাম বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁদের গানও এইচ এম ভি-র রেকর্ডালাপে, অথবা অন্য কোনো রেকর্ড কোম্পানির লোগো ও নাম মাথায় নিয়ে।

বেরোয় সারদার বাংলা গান। অরুন্ধতী হোম চৌধুরী, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, বেগম আখতার তাঁদের সঙ্গীত লহরি ও সুষমা নিয়ে আসেন। 

কী চমৎকার এইচ এম ভি-র শারদ অর্ঘ্য নামের বইটি। সব শিল্পীর গানের কথা, শিল্পীদের ছবি। কবিতা আবৃত্তি যিনি করেছেন, সেই আবৃত্তিকারের নাম, ছবি। পান্নালাল ভট্টাচার্যর আধুনিক ও শ্যামাসঙ্গীত, ভবানীচরণ দাসের শ্যামাসঙ্গীত, হিরালাল সরখোলের ভক্তিমূলক গান, দিলীপ কুমার রায়ের দেশাত্মবোধক সঙ্গীত, সবই রেকর্ডে আসে। বেশি দাম ছিল না এই এইচ এম ভি-র শারদ অর্ঘ্যের। গোটা দশেক টাকা সম্ভবত। তাও কি চাহিদা তখন, চট করে বিক্রি হয়ে যেত সব। প্রতি বছর পুজোর আগে আগে বেরোত গানের বই।

তখন আকাশবাণী থেকেও ‘বেতার জগৎ’, ‘আকাশবাণী’, ‘আকাশী’ বেরোয় পনেরো দিন অন্তর অন্তর। তার মধ্যেও রেডিও থেকে সম্প্রচারিত, কথিকা, গল্প— সব থাকত। সেই সঙ্গে অনুষ্ঠান সূচি।

‘বেতার জগৎ’-এর স্বাধীনতা দিবস স্মরণে মোটাসোটা সংখ্যা বেরত। মহাশ্বেতা দেবী ‘অরণ্যের অধিকার’ ধারাবাহিক লিখেছেন বেতার জগৎ-এ। তখন ‘বেতার জগৎ’ সম্পাদক সুভাষ বসু।

রেকর্ড থেকে ক্যাসেট, ক্যাসেট থেকে ইউটিউব— এই ঝপ ঝপ পরিবর্তনে বাংলা গানের কি যে হয়ে হয়ে গেল। আলো কুণ্ডুর ক্যাসেট কোম্পানি উঠে গেল। ‘ভেনাস’ নামে একটি ক্যাসেট হয়েছিল, তাও উঠে গেল। ক্যাসেট যুগে শুরু হল চরম পাইরেসি— গান গ্যাঁড়ান। বহু পাইরেটেড সংস্করণ বেরতে লাগল ক্যাসেটের। 

আমাদের চোখের সামনে পার্ক স্ট্রিটের মিউজিক ওয়ার্ল্ড নামের অতি বিখ্যাত, বি-ই-শা-ল ক্যাসেটের দোকানটি তৈরি হল, আবার বন্ধও হয়ে গেল। ‘মেলোডি’-র আবস্থা কী খুব ভালো? বুঝতে পারি না।

১৭৫ টাকায় ‘ফিলিপস’-এর ‘ফিয়েস্তা’ পাওয়া যেত ষাট দশকের শেষ দিকেও। রেডিওতে ফিট করে সেই ‘ফিয়েস্তা’-য় রেকর্ড বাজানো যেত। তখন ‘ফিলিপস’ কোম্পানির একটি বড় রেডিওগ্রামের দাম হাজার পাঁচেক। এটা ১৯৬৫-৬৬ সালের কথা বলছি।

রেডিওগ্রাম বা গ্রামো রেডিও তখনকার কোনো কোনো বড়লোক বাড়িতে দেখা যেত। অটোমেটিক রেকর্ড বেজে আসে ওপর থেকে, একটা বাজানো শেষ হলেই।

পেতলের চোঙা-অলা গ্রামোফোন তখন দামি অ্যান্টিক বিশেষ। এই সব গ্রামোফোনের কারও কারও চোঙা আবার লালচে সেলুলয়েডের।

হাতে করে ঘোরাতে হত হ্যান্ডেল। তাতে কলের গান দম খেত। তখন অধিকাংশ রেকর্ডই গালার। পড়লেই দুম ফটাস। এইসব রেকর্ড বাজত গ্রামোফোন পিনে। গানের পর, রেকর্ড থামিয়ে পিন বদলাতে হত। হলুদ রঙের ছোট বাক্সে শাদা, ধারাল পিনেরা থাকত। যা সাইজে এক করেরও কম।

ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের গান রেকর্ডে বেঁধে বার করেছে ‘মেগাফোন’ কোম্পানি। আরও বহু ভালো রেকর্ড তারা বার করেছে। ‘সোনেলা’ রেকর্ড কোম্পানির কথা আগেই বলেছি। এইচ এম ভি’র গানের রেকর্ড পাঁচ সিকে থেকে পাঁচ টাকা— সবই দেখেছি। ষাটে, সত্তরে বড় রেকর্ড আস্তে আস্তে ছোট হয়ে এল। এপিঠ, ওপিঠ মিলিয়ে দুটো দুটো চারটে গান। তারপর ৪৫ রেকর্ড।

এসবই এখনও স্মৃতিময়, ভিজে বারুদ ঘর। শারদ অর্ঘ্যের মলাট হয় ডাকের সাজের দুর্গার বড় বড় টানা চোখের সঙ্গে জেগে থাকা মুখ দিয়ে। পাশে কখনও শেফালিকা গুচ্ছ।

পুজোর গান বেজে উঠত কোনো কোনো বাড়িতে, কলের গানে। রেডিওতেও। তারপর তো বারোয়ারি পুজোর প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে। হেমন্ত, মান্না, সন্ধ্যা, অখিলবন্ধু ঘোষ। 

পুজো, কালীপুজো শেষ হলেই জলসা। বিচিত্রানুষ্ঠান। বোম্বাই ও বাংলার শিল্পীদের কম্বিনেশান কখন নাইট কখনও, সারা রাতব্যাপী অনুষ্ঠান।

সেখানে মহম্মদ রফি, আশা, লতা, হাস্যকৌতুকে জনি হুইস্কি, জনি ওয়াকার, জনি লিভার, মেহমুদ, আই এস জোহর। সেই সঙ্গে মহেন্দ্র কাপুর, উষা মঙ্গেশকর, বাণী জয়রাম। একটু আগে সুলক্ষণা পণ্ডিত, আরও পরে কবিতা কৃষ্ণমূর্তি। সুরেশ ওয়াডকার।

কবিতা কৃষ্ণমূর্তি, বাণী জয়রামরা, যখন গাইছেন, তখন একটু একটু করে বাঙালি মধ্যবিত্তের ‘জলসা’ প্রীতি, রাত জেগে আধুনিক গান শোনা— সবেতে বড় দাঁড়ি টেনে দিল সময়।

বন্ধ হয়ে গেল এইচ এম ভি শারদ অর্ঘ্য। পুজোর গানের বই। ‘সোনেলা’, ‘মেগাফোন’ তারাও বন্ধ হয়ে গেল একে একে। গানের জলসা আর হয় না। এই জলসা, এই পুজোর গানের বই, পুজো রেকর্ড, আর কোনো রাজ্যে আছে বলে জানা নেই।

বাঙালির অনেক কিছুর সঙ্গে সঙ্গে গানের যে গৌরব, এখানে পুজোর গানের কথাই বলছি, একেবারে ডুবে গেল।

এখনও ইউটিউবে গান ঘোরে– পুরনো, নতুন, রিমেক। সেইসব স্বর্ণময় গানের কথা, সুর শুনে যে তরঙ্গ ওঠে বুকের ভেতর, তা যেন সব সময়ই উদ্বেলিত করতে থাকে আমাদের।

অলংকরণ - প্রণবশ্রী হাজরা

Powered by Froala Editor