মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ…

মুছে যায়? - ২৯
আগের পর্বে

দৈনিক বসুমতী’র হয়ে সাগরমেলা কভার করেছি দু’বার। সেখানে কপিল মুনির আশ্রমের প্রণামীর টাকা ও অন্যান্য জিনিস অযোধ্যায় নিয়ে যাওয়া নিয়ে স্টোরি করি। সাগরমেলা কভার করার সময় স্টেটসম্যানের ফটোগ্রাফার সুব্রত পত্রনবিশের সঙ্গে সারারাত ঘুরেছি সাগরে। ছোট হোগলা ছাউনির মধ্যে সেখানে সাংবাদিকদের থাকার ব্যবস্থা। বিভিন্ন সংস্থার উদ্যোগে খাওয়ার বন্দোবস্ত। সেবার স্টেটসম্যানের সাংবাদিক হিসাবে গিয়েছিলেন সুব্রত নাগচৌধুরী। সাগরমেলায় আগুন লাগার খবর পাঠাতে খুব সাহায্য করেছিলেন তিনি। কোনোরকম মিননেস নেই স্টেটসম্যানের সাংবাদিকদের মধ্যে। সুব্রত নাগচৌধুরী ও সুব্রত পত্রনবিশের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বহুদিন। তারপর…

‘দৈনিক বসুমতী’ সম্পাদক, তার আগে ‘স্টেটসম্যান’-এর চিফ রিপোর্টার কেদার ঘোষ তাঁর একটি আত্মজীবনী প্রকাশ করেন ‘রূপা’ অ্যান্ড কোম্পানি থেকে। কলকাতার ‘রূপা’ তখন প্রকাশ করে বহু ইংরেজি বই। দাউদয়াল মেহেরা তার মালিক। এখান থেকে বহু চমৎকার ইংরেজি ও বাংলা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়ও। পাবলো নেরুদার অতি বিখ্যাত আত্মজীবনী বঙ্গানুবাদে ‘অনুস্মৃতি’ নামে বেরয়। এই বইয়ের মলাটে একটি আধফোটা রক্তগোলাপ।

দাউদয়াল মেহেরা ছিলেন খুব নামকরা প্রকাশক। কেদার ঘোষ নাকি তাঁর আত্মকথায় লিখেছিলেন তিনি তাঁর কোনো সাবঅর্ডিনেটের বাড়ি গেলে অনেক সময়ই সে বাড়ির কর্তা বাইরে চলে যেতেন। সত্যি মিথ্যে বলতে পারব না।

জরুরি অবস্থার আগে ও ইমার্জেন্সিকালে কেদার ঘোষ ‘দৈনিক বসুমতী’র ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও এডিটর। তিনি কেদারসঙ্গীত লিখেছেন, নিজের নামে বহু গান। সুর দিয়েছেন বিখ্যাত সঙ্গীতবেত্তা বিমলভূষণ। জরুরি অবস্থা- উত্তর কালে, জরুরি অবস্থার সময়েও ‘দৈনিক বসুমতী’র কলকাতার হালখাতা— নোটবুক দেখেন সুভাষ মৈত্র। তিনি প্রখ্যাত চিত্রনাট্য নির্মাতা অমিত মৈত্রর আত্মীয়। সম্ভবত জ্ঞাতি-ভাই। ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র তিনি নাতি। অমিত মৈত্র রাজ কাপুর প্রযোজিত বাংলা ছবি ‘একদিন রাত্রে’-র চিত্রনাট্যকার। ছবিটিতে রাজ কাপুর, নার্গিস এবং ছবি বিশ্বাস। মান্না দে-র সেই বিখ্যাত গান ছবিবাবুর লিপে— এই দুনিয়ায় ভাই সবই হয় ভাই সবই হয়/ সব সত্যি, সব সত্যি। কি দারুণ মাতালের পার্ট করেছিলেন ছবি বিশ্বাস। হিন্দিতে সেই রোলটাই করেন মোতিলাল। ছবিবাবুর পাশে তিনি দাঁড়াতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না।

১৯৫৬ সালে মুক্তি পায় ‘জাগতে রহো’। প্রযোজক রাজ কাপুর। পরিচালক— অমিত মৈত্র ও শম্ভু মিত্র। বাংলা ‘একদিন রাত্রে’র হিন্দি ভার্সান ‘জাগতে রহো’ আগেই লিখেছি। ‘একদিন রাত্রে’-র পরিচালকও অমিত মৈত্র, শম্ভু মৈত্র। ‘জাগতে রহো’-তে রাজ কাপুর, নার্গিস, মোতিলাল ছাড়াও ছিলেন প্রদীপকুমার— প্রদীপকুমার বটব্যাল, স্মৃতি বিশ্বাস, নানা পালসিকার, সুমিত্রা দেবী, ডেইজি ইরানি, পাহাড়ী সান্যাল, ইফতিকার, সুলোচনা চ্যাটার্জি, প্রাণ।

আরও পড়ুন
সাগর— গঙ্গাসাগর মেলা— সাগরসঙ্গমে...

এই দুটি ছবিরই সুরকার সলিল চৌধুরী। কেদারবাবুর সময় ‘দৈনিক বসুমতী’-র যাত্রা-থিয়েটার-সিনেমার পাতা দেখতেন অসীম ঘোষ। ‘দৈনিক বসুমতী’র রবিবাসরীয় দেখেন প্রলয় দাস, চারের পাতার দায়িত্বে অনেকটাই প্রণবেশ চক্রবর্তী, রামেন্দু মুৎসুদ্দি। রামেন্দু মুৎসুদ্দি ধর্ম বিশ্বাসে বৌদ্ধ, চট্টগ্রামের মানুষ। বাইলাইন পোস্ট এডিটোরিয়াল লিখতেন এঁরা। প্রণবেশদা— প্রণবেশ চক্রবর্তীর কলামের নাম ছিল ‘সরাসরি’।

কমবয়েসি সুব্রত মুখোপাধ্যায় ১৯৭৫-৭৬-এ তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী। তাঁর দায়িত্বেই খুব স্বাভাবিকভাবে ‘দৈনিক বসুমতী’ পত্রিকা ও প্রকাশনা বিভাগ। ‘দৈনিক বসুমতী’র আর্ট ডিপার্টমেন্টের দায়িত্বে ছিলেন প্রদীপ দাস। প্রদীপ নামে তিনি কার্টুন আঁকতেন। প্রথম পাতায়, ‘দৈনিক বসুমতী’র পয়লা পাতায় বেরত তাঁর কার্টুন। প্রায় রোজই। তখন ‘যুগান্তর’ অমৃতবাজার পত্রিকায় কার্টুন আঁকেন অমল চক্রবর্তী। অমলদা সাপ্তাহিক ‘অমৃত’তেও কার্টুন আঁকতেন। সেটা ষাট দশকের শেষ। তখন সাপ্তাহিক ‘দেশ’ পত্রিকার পাতায় পাতাজোড়া কার্টুন আঁকতেন কুট্টি। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’তেও প্রথম পাতায় কুট্টির কার্টুন প্রায় রোজই। অসামান্য। কুট্টি পরে ‘আজকাল’-এ চলে যান, কার্টুনিস্ট হিসাবে চাকরি করবেন না। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র প্রথম পাতায় বেরত ছোট, লম্বাটে চৌকো কার্টুন, নাম তির্যক। তির্যক আঁকতেন চণ্ডী লাহিড়ী। তিনি ইংরেজিতে চণ্ডী লিখতেন। ‘যুগান্তর’-এর পয়লা পাতায়, একই সাইজের ব্যঙ্গচিত্র, নাম ‘অব্যর্থ’। হিন্দি দৈনিক ‘সমার্গ’, ‘বিশ্বামিত্র’, ‘ছাপতে ছাপতে’-তে এরকমই কার্টুন। সত্তরের মাঝামাঝি সময়ে ‘মিশ্বামিত্র’, ‘সমার্গ’-এর প্রথম পাতায় যে ছোট কার্টুন ছাপা হত তা থেকে অনেকে সাট্টা খেলার নম্বরের— জেতার সূত্র নাকি পাওয়া যেত।

সাট্টা খেলায় পাত্তিতে পাত্তি, ফিগার সে ফিগার, জুড়ি— এসব নানা রকম সূত্র ছিল। এমন কথা বলতেন অনেকে। সেই অনুযায়ী সাট্টা-জুয়ার নম্বরও ধরতেন। অনেক অনেক টাকা খাটত সাট্টায়। গরিব মানুষ— বাড়িতে বাড়িতে যাঁরা কর্মসহায়িকা, রিকশা-বন্ধু, বাড়ি বাড়ি জল বহন করে পৌঁছে দেওয়া ভারী, যাঁরা মূলত ছিলেন ওড়িশার মানুষ, বাশের পোক্ত দণ্ডের দুপাশে খালি, বড়, ডালডার টিন। তাতে ভর্তি রাস্তার টিউবওয়েলের জল। এই ভারীরা এত ভার— মানে দু টিন জলের জন্য ষাট দশকে চার আনা— পঁচিশ নয়া পয়সা নিতেন। সত্তর দশকে এক ভার জল ছ আনা— সাঁইত্রিশ নয়া পয়সা।

‘বিশ্বামিত্র’ ও ‘সমার্গ’— এই দুই হিন্দি দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা সিঙ্গল কলাম, লম্বাটে চৌকো কার্টুন দেখে অনেকেই সাট্টায় ওপন টু ক্লোজ নম্বর ধরতেন। যাঁরা নম্বর ধরতেন তাঁরা জানতেন এই নম্বর ধরাধরির কৃতকৌশল। ধরা যাক কোনো একজন প্রায় বৃদ্ধ মানুষের হাতে বাঁকা গোলাটে হাতল সমেত ছাতার বাঁট বা লাঠি আছে। যেহেতু ছাতা বা লাঠির বাঁট দেখতে অনেকটা যেন সাত তাই সাত বা সাততার ওপর টাকা খেলা হত। পাড়ায়, পাড়ায় লেখা হত বেআইনি সাট্টার প্যাড। এক টাকা খেলতে পারলে পাত্তি মিললেসাত টাকা। বহু লোককে দেখেছি টাকার নেশায় সাট্টা খেলে ফতুর হয়ে গেছেন একেবারে। সাট্টা ব্যাপকভাবে ছড়ায় ১৯৭২-৭৩-৭৪-৭৫-৭৬, তারও পরে পরে, নকশাল আন্দোলন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর এই জুয়া বেড়ে ওঠে। সেই সঙ্গে হাঁড়ি খেলা। হাঁড়ি খেলা নাকি খেলা হত বড়বাজারে। সাট্টা বন্ধ হয়ে যায় দু হাজার সালের পর। কোটি কোটি টাকা খেলা হতে থাকে। কেউ কেউ কিছু পেলেও গরিব মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে যান বহুক্ষেত্রে। তারপর চলে আসে ‘ডেইলি লটারি’।

আরও পড়ুন
‘দৈনিক বসুমতী’ হয়ে আরও...

তার আগে অবশ্য লটারি বলতে আমাদের বাল্যকালে ‘বারবাটি র‍্যাফেল”, খেলা হত ওড়িশায়। তখন নাকি রেসের ঘোড়া দৌড়ত লটারির জন্য। সত্যি-মিথ্যে জানা নেই। সেই ঘোড়া আদপেই না দৌড়লে, যাঁরা টিকিট কেটেছেন, তাঁরা একটা পেমেন্ট পেতেন। ছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য লটারি। সাট্টা উঠে গেল, নাকি উঠিয়ে দিল উদ্যোক্তারা। কলকাতার বড়বাজারে আর তখনকার বোম্বেতে খেলা হত সাট্টা। বোম্বাই তখনও মুম্বাই হতে অনেকটা দেরি।

‘দৈনিক বসুমতী’তে উজ্জ্বলবাবু ঘোড়ার রেসের ব্যাপারে লিখতেন। কলকাতা ময়দান, টালিগঞ্জ— দু জায়গাতেই রেস হত। টোটে, ট্রিপল টোটে, উইনে ইত্যাদি শব্দবন্ধ উজ্জ্বলদার কাছ থেকেই শিখি, জানি। রেস হত ব্যাঙ্গালোরেও।

উজ্জ্বলদাকে কল্যাণাক্ষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলতেন, আশ্ববিদ। আগেই লিখেছি কলকাতা থেকে প্রকাশিত সমস্ত বাংলা ও ইংরেজি খবরের কাগজে রেসের খবর, রেসে দৌড়ন ঘোড়াদের সম্ভাব্য গতি প্রকৃতি— সবই থাকত। কুকুর ও ঘোড়ার বংশধারা নিয়ে যাঁরা এই দুই ব্যাপারে চর্চা করেন, খুবই ভাবেন। পেডিগ্রিটা তাঁদের কাছে খুবই বড় ব্যাপার।

টালিগঞ্জের ঘোড়দৌড় এক সময় বন্ধ হয়ে গেল একেবারে। শোনা যায় ঘোড়া দৌড়নর ব্যাপারে নানা রকম গটআপ হত বুকিদের সঙ্গে। জকিদের সঙ্গেও। বুকি অর্থে যাঁরা টাকা পয়সা জমা করেন, রেসের মাঠে ঘোড়ার ওপর বাজি ধরার ব্যাপারে। আর জকি অর্থে যাঁরা ঘোড়া চালান, রেসের মাঠে। সাট্টার বাকিরাও অনেকটাকা হ্যানডেল করতেন। মাঝে মাঝে পুলিশ এসে চড়াও হত তাঁদের ওপর। সাট্টার বুকিদের অধীনে থাকতেন পেন্সিলাররা।

আরও পড়ুন
বাঙালির সাহেবি নববর্ষের আদিখ্যেতা ও অন্যান্য

কলকাতার রেসের মাঠ গরম প্রতি ইংরেজি বছরের প্রথম দিনটি— পয়লা জানুয়ারিতে। এছাড়া শনিবার শনিবার। রেসের ঘোড়াদের যত্ন করা হয় খুব। একটু কমজোরি, বেচাকি হয়ে গেলেই নাকি এইসব ঘোড়াদের হত্যা করা হয় গুলি করে। আর তাদের মাংস নাকি চলে যায় চিড়িয়াখানায়। এই মাংস— নিহত অশ্বমাংস বাঘ, সিংহ, হায়েনা, নেকড়ের খাদ্য হিসাবে চিড়িয়াখানায় যাওয়ার ব্যাপারটার পেছনে কতটা সত্যি আর কতটাই বা ‘জল’ আছে জানা নেই।

বোম্বের বড় বড় চিত্রতারকাদের ঘোড়া থাকত। আবার কারও কারও থাকত, এখনও আছে হয়তো ঘোড়ার ফার্ম। ‘জমির’ নামে একটি বোম্বাইয়া সিনেমার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে এখনই। ছবিটিতে ছিলেন শাম্মি কাপুর, অমিতাভ বচ্চন এবং বিনোদ খান্না, সায়রা বানু।

এই সিনেমার একটি বিখ্যাত গান তুমভি চলো হামভি চলে। চলতি রহে জিন্দেগি। ডুয়েটটা কিশোরকুমার এবং আশা ভোসলে।

‘দৈনিক বসুমতী’র ‘অশ্ববিদ’ উজ্জ্বলদা সব সময়েই থাকতেন ট্যাবলেট অথবা ‘গুলির’ প্রভাবে। ঝিম নেশা যাকে বলে, সব সময়ই। সেই সময় কোনো একটি বাংলা দৈনিকে অশ্ব ঘোষ নামে কোনো একজন কলাম লিখতেন। রেসে তখন ডার্বি হয়, নানা রকম কাপ। প্রাইজ মানি। উত্তেজনা প্রবল এক্সাইটমেন্ট। রক্তের ওঠাপড়া।

আরও পড়ুন
আমাদের বড়দিন, সাহেবি নববর্ষ— নিঃসীম

রেসের মাঠের ঘাস, ঘোড়ারা, ঘোড়ার ক্ষুরের দাগ, ঘোড়া গা থেকে উড়ে আসা ঘামের মোহময় ঘ্রাণ— সব মিলিয়ে অন্য জগৎ। রেসের ছোট ছোট বই বেরয় প্রতি শনিবার। সেই পুস্তিকায় থাকে সম্ভাব্য উইন হওয়া ঘোড়ার কথা, সেই ঘোড়া অথবা ঘোড়ি বা ঘুড়ি— স্ত্রী ঘোড়ার পেডিগ্রি— জিনিওলজি— বংশধারা, ফলাফলে তার জেতা বা হারার সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেন পাকা রেসুড়েরা। ফি শনিবার শনিবার রেস-ময়দান জমজমাট। ভিড়। আগেও হয়তো একবার বলেছি, আবারও বলছি সত্যজিৎ রায়ের ‘সীমাবদ্ধ’ সিনেমাটিতে তরুণ-নবীন বরুণ চন্দ তাঁর চলচ্চিত্রের সম্পর্কিত শ্যালিকাটিকে নিয়ে রেসের মাঠে এসেছেন। তখন বরুণ চন্দর মাথা ভর্তি কালো চুল। কোট-প্যান্ট, হাতে বায়নোকুলার। তাঁর শ্যালিকার ভূমিকায় থাকা শর্মিলাঠাকুর অবশ্য শাড়ি।

সমরেশ মজুমদারের ‘দৌড়’ নামের আখ্যানটিতে আছে। কলকাতার রেসের মাঠ, রেসুড়েরা। শংকর ভট্টাচার্য নামে একজন চলচ্চিত্র পরিচালক ‘দৌড়’ নিয়ে সাদা-কালো ছবি করেছিলেন আজ থেকে বহু বছর আগে।

‘দৈনিক বসুমতী’তে একমাত্র ঝাঁট দেওয়া, টেবলে টেবলে জল দেওয়া ছাড়া সব কাজ করেছি। বিজ্ঞাপনের কপি অনুবাদও। বিজ্ঞাপনের কপি অনুবাদের কাজে অসম্ভব ঝুঁকি আছে। সামান্য ভুল, কথার এদিক ওদিক হলে পার্টি পয়সা দেবে না। সে এক মহা কেলেঙ্কারি ব্যাপার। ‘দৈনিক বসুমতী’তে যাত্রা কোম্পানির বিজ্ঞাপন যোগাড় করে আনতে পারলে কমিশন পাওয়া যেত। আষাঢ় মাসে রথ, উল্টোরথে চিৎপুরে যাত্রা কোম্পানির কাজ শুরু। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-র প্রবোধবন্ধু অধিকারীকে বলা হত ‘যাত্রাবন্ধু’। যাত্রা পাড়ার সঙ্গে তাঁর যোগ ছিল নিবিড়। ‘দৈনিক বসুমতী’র অসীমকুমার ঘোষ ছিলেন যাত্রা পাড়ার পরিচিত মুখ।

প্রবোধবন্ধু অধিকারী উপন্যাসও লিখতেন। ছোট গল্পও। তিনি থাকতেন উত্তর কলকাতার বিজন স্ট্রিট অঞ্চলে। সম্ভবত তিনি অখণ্ড বঙ্গের চট্টগ্রামের মানুষ। প্রবোধবন্ধু অধিকারীর একটি উপন্যাসের নাম ‘আবার বনভূমি আবার সমুদ্র’। বেশ মোটা সোটা বই। সাদার ওপর মলাট। প্রবোধবন্ধু অধিকারী ধুতি-শার্ট। চোখে চশমা। পশ্চিমবাংলায় যাত্রা উৎসব করার পিছনে তাঁর পরিশ্রম ও ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি যাত্রার দলও খুলেছিলেন। সুপ্রিয়া চৌধুরীকে তিনি নিয়ে এসেছিলেন যাত্রা পালায়।

তখন শান্তিগোপাল, স্বপনকুমার, স্বপ্না কুমারী, রাখাল সিংহ— যাঁরা অতি বিখ্যাত যাত্রাশিল্পী। ছিলেন কেতকী দত্ত। যাত্রা পালা লিখতেন ব্রজেন দে, ভৈরব গাঙ্গুলি প্রমুখ। জ্যোতির্ময় দে বিশ্বাস একসময় ভালো গল্প লিখতেন। ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’তেও তাঁর গল্প বেরত। ‘সত্যযুগ’-এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। পরে তিনি যাত্রাপালা লেখেন। নাম করেন। শান্তিগোপাল লেনিন, হিটলার, সুভাষচন্দ্র, কার্ল মার্ক্স— সব ভূমিকাতেই অভিনয় করেছেন। তাঁর লেনিন খুবই নাম করেছিল সত্তর দশকে। যাত্রা পালা লিখেছেন উৎপল দত্তও— ‘রাইফেল’। তখনও ‘ওয়ান ওয়াল’ আসতে অনেক দেরি। ওয়ান ওয়াল অবশ্য দীপঙ্কর দে, লিলি চক্রবর্তী, সুপ্রিয়া চৌধুরী, সন্তু মুখার্জি সবাই করেছেন। ওয়ান ওয়াল হত মহাজাতির সামনে।

‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দেশ’-সহ বহু পত্রিকাতে চাকরি করা ও অনেক নতুন নতুন সাহিত্য ও সিনেমা পত্রিকা তৈরি করে তার সম্পাদক হওয়া আবার অবলীলায় তা ছেড়ে দেওয়া এমন একজন সাংবাদিক রবি বসু যাত্রার দল করেছিলেন একসময়। নিয়মিত ঘর— গদি নিয়েছিলেন চিৎপুরে। সে দলও রবি বসুর চির চঞ্চল— অস্থির স্বভাব অনুযায়ী বেশিদিন টেকেনি।

রবি বসুর সঙ্গে উত্তমকুমার ও সুপ্রিয়াদেবীর অসম্ভব হৃদ্যতা ছিল। ‘সাতরং’ নামে একটি চমৎকার পত্রিকা করেছিলেন তিনি, সম্পাদক ও পরিকল্পক। পরে ‘কলেজস্ট্রিট’ পত্রিকাটিও তাঁর হাতে গড়ে উঠতে দেখি। সেখানেও অনেক দিন থাকেননি রবি বসু।

যাত্রা চমৎকার বিবরণ আছে বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’তে, অপুর চোখ দিয়ে দেখান সেই ভুবন। সীতার বিড়ি খাওয়া। বালিতে আমাদের বন্ধু সন্টুর বাবা লোকাল যাত্রা দলে সীতা সাজতেন।

যাত্রার গদি ঘরে নায়েকরা সবসমই পালা বুকিংয়ের ব্যাপারে মূল কারিগর। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ আখ্যান ‘মঞ্জরী অপেরা’তে আছে যাত্রাদল, যাত্রাপালা নায়েক, গদিঘরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা। এই উপন্যাসটি নিয়ে সিনেমাও হয়েছে। উত্তমকুমার ছিলেন, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। তবে সিনেমাটি খুব চলেনি।

লোকাল যাত্রা হত রাত রাত ভ’র। সেখানে ‘মালাডাকা’ ছিল একটা বড় ব্যাপার। চেতলায় ‘বলাই স্মৃতি সংঘ’র মাঠে দেখেছি রামযাত্রা। রাত রাত পার করে। চেতলার জৈবুল্লি মিস্ত্রি লেনে ‘বলাই স্মৃতি সংঘ’। হাওড়া জেলার বালিতে পখবাবু রোডের ওপর শীতলা বাড়ির সামনের মাঠে বসত যাত্রার আসর। চৈত্রমাসে শীতলা পূজা উপলক্ষে। এছাড়াও বালির গোস্বামী পাড়ায় গিরীন স্যাকরার বাড়ির সামনে ফাঁকা জমিতে পালাগান। সেও রামযাত্রা। শীতলাবাড়ির যাত্রাও রামযাত্রা। সবই অ্যামেচার দল। সেখানে ধনুকে ধনুকে সামনা সামনি যুদ্ধে, বাণ ছোড়ার বদলে বাঁশের ধনুকে ধনুক ঠেকিয়ে খট খট, খটাখট। কি কায়দায় যে এই শব্দ হত আজও বুঝি না।

রাম-লক্ষ্মণের দেখাদেখি পাড়ার বাচ্চারাও বাঁশ দিয়ে, বাঁশ চেঁছে ছোট ধনুক অথবা কঞ্চি দিয়ে ছোট ধনুক বানিয়ে কঞ্চির বাণ তৈরি করে নানা রকম ধনুকী কসরত দেখাত। এছাড়াও ঘুড়ি ফেঁসে গেলে বা ছিড়ে গেলে তার কাঁবকাঠি আর ‘বুক’— বুকের সরু, মিহি বাঁশের টুকরো দিয়ে অনায়াসে বানিয়ে ফেলত তীর-ধনুক। এই ধনুকের প্রতাপ তখন সর্বত্র। এমন কি কখনও কারও কারও চোখও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই শরাঘাতে।

বালি ও চেতলার রামযাত্রার মালাডাকা দেখেছি। সীতার গলার মালা চল্লিশ টাকা, রামের গলার মালা সত্তর টাকা। সেটা ১৯৬৭-৬৮ সাল। কেউ এক হাজার টাকা মাইনে পেলে লোকজন— পাঁচ পাবলিক বিস্মায়াবিভূত হয়ে তাকিয়ে থাএ তার দিকে। আমাদের এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় ‘বাটা’ কোম্পানিতে এক হাজার টাকা মাসমাইনের চাকরি করতেন, সেই বাজারে তিনি ছিলেন যথেষ্ট ‘ধনী’। সেটা ১৯৬২-৬৩ সালের কথা।

চিৎপুরের যাত্রা পাড়া, যাত্রা দলের গদী অন্য এক অভিজ্ঞতা দিয়েছে আমায়। প্রতি বছর আষাঢ় মাসের রথযাত্রা এবং উল্টোরথে পাতা পাতা বোঝাই যাত্রা পালার বিজ্ঞাপন থাকত। আর তা ছিল চোখে পড়ার মতো। এখনও অবশ্য যাত্রার বিজ্ঞাপন হয় কিন্তু তার সেই রকরমানি আর নেই।

যাত্রার লোকজন সিনেমায় অভিনয় করতে এসেচেন, এমনটা হাতে গোনা যায়। স্বপনকুমার তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এখনই ‘বনপলাশীর পদাবলী’তে স্বপনকুমারের অভিনয় মনে পড়ছে। এই সিনেমাটির পরিচালক ছিলেন উত্তমকুমার। উত্তমকুমার, সুপ্রিয়া চৌধুরী— পরে যিনি সুপ্রিয়া দেবী লিখতেন, অনিল চট্টোপাধ্যায়, বিকাশ রায়, মাধবী মুখার্জিরা ছিলেন এই সিনেমায়। আর ছিলেন অট্টামা চরিত্রে মলিনা দেবী। ‘বনপলাশির পদাবলী’ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি সিনেমায় অভিনয় করেন স্বপনকুমার। উত্তমকুমারের সঙ্গে স্বপ্নকুমারের সম্পর্ক ছিল খুবই ভালো।

উত্তমকুমার নিজে যাত্রা করেছেন তাঁর পারিবারিক অনুষ্ঠানে। এছাড়াও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় যাত্রা করেছেন, নিমু ভৌমিক, চিন্ময় রায়, সুপ্রিয়া দেবী প্রমুখ। সন্তু মুখার্জি যাত্রা করেছেন। করেছেন আরও অনেকে।

পুরনো দিনের যাত্রার আসরে তীব্র ক্যারিওনেট বাদন, সখীদের নাচ— সবই থাকত শুরুর আগে, থাকত ‘বিবেকের গান’। ‘বিবেক’ গান গেয়ে গেয়ে কাহিনীর সূত্র ধরিয়ে দিতেন। বিবেকের গানে ভয়ানক বিষাদের সঙ্গে দু চোখে জল আসত কখনও কখনও। কখনও জেগে উঠত তীব্র ক্রোধ।

ফসল কাটা হয়ে গেলে শীতে— মাঘ মাসে, ফাল্গুন চৈত্রেও খোলা মাঠে বসত যাত্রার আসর। বাতকম্মের দুর্গন্ধ, বিড়ির কুবাসে ভরে থাকত যাত্রার আসর। তারপর ছোট ছোট ঢিল অথবা মাঠ হলে মাটির টুকরো তুলে সামনের মানুষের মাথায় টিপ করে মারা সেও তো ছিল। 

সন্ধ্যায় ক্যারিনেট— যাত্রার কনসার্ট বেজে উঠলেই ডাকত আসর। মাটিতে অথবা চটের ওপর বসার ব্যবস্থা। কে কে সামনে বসবে, তা নিয়ে প্রতিযোগিতা তখন। বিনা পয়সার যাত্রার পালা। যেটুকু খরচ পালা শেষ হলে যদি কেউ নগদ অর্থ— পালা দেন। আর ‘মালা ডাকা’, সেই টাকা ভাগ হত শিল্পী আর আধিকারীদের মধ্যে।

চিৎপুরে যাত্রা দলে বাবলি রানি, চপলরানিরা ছিলেন বহুবছর। পুরুষরাই নারী সেজে ‘ফিমেল’ করতেন। তাঁদের রঙচঙ, চোখের ইশারা, লজ্জা— সবই মোহময় যে কোনো নারীর তুলনায়। চপলরানিকে নিয়ে তো অনেক কাজ— ডকুমেন্টারি, ফিল্ম ইত্যাদি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে চপলরানিকে নিয়ে অনেক লেখালিখিও হয়েছে।

সত্তর দশকে তরুণ অপেরা, জনতা অপেরা, নট্ট কোম্পানি খুবই নাম করা যাত্রা দল। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম নট্ট কোম্পানির। বড় বড় অভিনেতারাও ছিলেন তাঁদের দলে। তরুণ অপেরার সঙ্গে শান্তিগোপাল অভিনীত যাত্রা পালার যোগের কথাও হয়ত মনে আছে অনেকেরই। আগেই লিখেছি লেনিন, হিটলার, নেতাজি, সুভাষচন্দ্র— সব চরিত্রেই শান্তিগোপাল অপ্রতিরোধ্য। অনবদ্য। নট্ট কোম্পানির ছিল আলাদা গুরুত্ব। নট্ট কোম্পানির নামও ছিল বহুবিস্তৃত। বিজ্ঞাপনও হত তার সবচেয়ে বেশি। বিশেষ করে ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য়। বরাবরই ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় বিজ্ঞাপনের রেট অন্যদের থেকে অনেকটাই বেশি। পরে প্রবোধবন্ধু অধিকারী আলাদা যাত্রা দল করেন। যাত্রার জন্য কনসেশনও চালু হয়, বিজ্ঞাপন ছাপার ব্যাপারে। পরে সব খবরের কাগজই এটা করে। 

যাত্রা, যাত্রা জগতের কথা আপাতত থাক। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি মাঠে বসে, খোলা আকাশের নিচে যাত্রা দেখা খুবই পছন্দ করেছি এক সময়। বাল্যকালে, কিশোরবেলায়। আমার বাবা, মা একেবারেই পছন্দ করতেন না যাত্রা দেখা। মা কথায় কথায় বলতেন, ‘যাত্রা দেখে ভাতরা লোকে/  কবি দেখে ভদ্রলোকে’।

কবির লড়াই— কবিগান, রাত রাত ভোর পালা, কীর্তন, কথকতা, এসবই মায়ের সঙ্গে গিয়ে দেখেছি। রাধারানী দেবীর কীর্তন অপূর্ব। কি চমৎকার গলা তাঁর। আমরা যখন শিবপুরে চাষাধোপা পাড়া লেনে চ্যাংমশাইদের বাড়ি ভাড়া থাকি, সেখান থেকে ভাড়াটে হিসাবে উঠে গিয়ে বেতাইতলার কাছাকাছি জিটি রোড, এরও পরে ওঙ্কারমল জেটিয়া রোডে, গৌরীশঙ্কর চট্টাচার্যের বাড়ি। একতলায় একটা বড় ঘর। সেখানে নাকি দুর্গাপুজো হত এক সময়। মাসভাড়া তিরিশ টাকা, তা মেটাতেই বাবার বেশ কষ্ট হত।

বালিতে তারাপদ সাউ ছিলেন থিয়েটারপ্রাণ মানুষ। আবার যাত্রাও করতেন। তিনি নিজে বামাক্ষ্যাপা— বামদেব সাজতেন। লম্বা, কালো, বেশ দেখনদারি ভুঁড়ি, মাথার কাঁচাপাকা চুল অত্যন্ত ছোট করে ছাঁটা।

এই তারাপদ সাউই যখন সাধক বামদেবের বেশে যাত্রা মঞ্চে ‘জয় তারা, জয় জয় তারা’ ইত্যাদি প্রভৃতি বলে উঠে আসতেন, তখন অন্য ধরণের একটা আবহাওয়া, পরিস্থিতি তৈরি হত। বালি কিংসাই পাড়ায়, পুকুরের ভেতর হত জলের ঠাকুর। পুকুরের জলের ভেতর সরস্বতী প্রতিমা, মাটির। পুরোহিত ডোঙায় করে যেতেন পুজো করার জন্য। তারাপদ সাউয়ের সঙ্গে সম্ভবত এই পুজোরও যোগাযোগ ছিল। বালিতে ‘প্রয়াগ সঙ্গীত সম্মিলনী’র শাখা ছিল। তাদের তত্ত্বাবধানে সঙ্গীতের ডিপ্লোমার পরীক্ষাও হত। প্রয়াগ সঙ্গীত সম্মিলনীর মূল কেন্দ্র ইলাহাবাদ বা প্রয়াগে।

তারাপদ সাউ বামদেব ছাড়া ত্রৈলঙ্গ স্বামীও সাজতেন যাত্রাপালায়। দুটি চরিত্রই তিনি করতেন সম্পূর্ণ খালি গায়ে।

বেলগাছিয়াতে ‘ঠাকুরমশাইয়ের’ শ্রীরাধা (?) থিয়েট্রিকাল যাত্রা পার্টি। ‘ঠাকুরমশাই’ খুবই রোগা, লম্বাটে চেহারা, ফরসা, এক মাথা পাকা চুল, ছোট করে ছাঁটা, তেল দিয়ে পাট করে আঁচড়ান। সব সময় গালে পান।

তিনি বিড়ি বাঁধতেন নিজে। তখন লাল সুতো, সাদা সুতো, কালো সুতো, হলুদ সুতোর বিড়ি পাওয়া যায় বাজারে। এইসব বিড়িরই নাকি আলাদা আলাদা স্বাদ, মেজাজ। সত্যি মিথ্যে জানি না। 

তখন মোতিহারির তামাক পাতা বিখ্যাত। পাট যে মিষ্টি আর তেতো দুরকম হয়, তা জেনেছি গ্রাম বাংলায় ঘুরে ঘুরে, পাট আর তামাকের বিষয়ে গবেষণা করতে করতে। গবেষণা মানে হেঁটে হেঁটে যতটুকু পারা যায়।

দোকানে দোকানে তখন তামাক পাতা বিক্রি হয়, তিনি নয়া— দু পয়সা, চার পয়সার তামাকও পাওয়া যায় মুদিখানায়।

তামাক পাতাকে সাদা পাতা বলতেন আমার দাদামশাই হরিপদ রায়। তিনি নিয়মিত নেশা করতেন ভাজা তামাক পাতায়। আমার মা গায়ত্রী রায় তাঁকে শুকনো খোলায় তামাক পাতা আর ধনের চাল, মৌরি ভেজে, তারপর তাদের একসঙ্গে লোহার হামানদিস্তায় পিষে— গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিতেন। হরিপদ রায় সেই ভাজা তামাক পাতা খেতেন নিয়ম করে, রোজ।

বেশ খানিকটা আগে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা রাম চাটুজ্জে বা রাম চ্যাটার্জির কিছু কথা বলে এসেছি। দক্ষিণ কলকাতার লেক স্টেডিয়ামে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের কোনো প্রকাশ্য সভায় মঞ্চে বসে আছে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা সুহৃদ মল্লিক চৌধুরী, রামবাবু সমস্ত পোডিয়াম ঘুরে বেড়াচ্ছেন। পায়চারি করছেন। পরনে সাফারি। সম্ভবত শীত শীত সময়। সুহৃদ মল্লিক চৌধুরীর গায়ে র্যাপার। ধুতি, হ্যান্ডলুমের পাঞ্জাবি। পায়ে ব্যাক বেল্ট। মাথার চুল উল্টে আঁচড়ান। শ্যামলা রঙ। লম্বা নন একেবারেই। চোখে মোটা, কালো ফ্রেমের চশমা। 

সেই প্রকাশ্য সমাবেশে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী এবং সি পি আই (এম) নেতা হিসাবে উপস্থিত জ্যোতি বসু। মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা অমরবাবুও উপস্থিত ছিলেন সেই মঞ্চে। অমরবাবুর পদবি ঠিক এখনই মনে পড়ছে না।

এই সমাবেশে বক্তৃতা করবেন জ্যোতি বসু। রাম চ্যাটার্জি তাঁর সাফারি স্যুট পরা চেহারাটি নিয়ে বলে উঠলেন লেক স্টেডিয়ামার মঞ্চ থেকে— মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ— জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

হ্যাঁ, পরিষ্কার স্পষ্ট উচ্চারণে বলছেন তিনি— মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ— জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ।

তাঁর উচ্চারিত ‘জিন্দাবাদের’ সঙ্গে গ্লা মেলাচ্ছেন দর্শকাসনে বসে থাকা মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের সমর্থক ও কর্মীরা। যাঁরা বেশিরভাগই এসেছেন হুগলী জেলার তারকেশ্বর, আরামবাগ ইত্যাদি জায়গা থেকে। হুগলী জেলাতেই— মূলত তারকেশ্বরে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের সংগঠন ছিল। রাম চ্যাটার্জিকে কেন্দ্র করেই সেই সংগঠন। তাঁর মৃত্যুর পর মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের সেই সংগঠন আর দানা বাঁধেনি। যদিও তারকেশ্বর বিধানসভা কেন্দ্রে রামবাবুর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী শান্তি চ্যাটার্জি দাঁড়াতেন ভোটে, মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের হয়ে, বামফ্রন্টের সমর্থনে।

হুগলীতে এক সময় জাতীয় কংগ্রেস ও সি পি আই (এম)— দু দলেরই যথেষ্ট প্রভাব ছিল। ফলে সংঘর্ষ অনিবার্য। বিজয় মোদক ছিলেন হুগলীর খুব বড় কমিউনিস্ট নেতা। আর ছিলেন মনোরঞ্জন হাজরা।

মনোরঞ্জন হাজরা পরে যোগ দেন কংগ্রেসে। বিধায়ক থাকার সময় মনোরঞ্জন হাজরা বিধানসভায় ছড়া কেটে কেটে জাতীয় কংগ্রেসের— তখনকার শাসক দলের বিরুদ্ধে নানা কথা বলতেন।

জাতীয় কংগ্রেসে গিয়ে মনোরঞ্জন হাজরা সেভাবে কিছু করতে পারেননি। তাঁর সঙ্গে বহুবার দেখা হয়েছে দৈনিক বসুমতী অফিসে। তখনও তিনি সি পি আই (এম)। ধুতি পাঞ্জাবি, তেমন লম্বা নন। পাঞ্জাবির চাপা থেকেও ভুঁড়ির আভাস অত্যন্ত স্পষ্ট। তিনি তখনও ছড়া বানাতে পারেন— বাঁধতে পারেন মুখে মুখে। লাইনে লাইনে মিল। 

মনোরঞ্জন হাজরা, রাধিকারঞ্জন প্রামাণিক— এঁরা কেউই সি পি আই (এম) থেকে জাতীয় কংগ্রেসে গিয়ে সেভাবে কিছু করতে পারেননি। আজকাল এবেলা ওবেলা দল বদলুদের দেখে এসব কথা মনে পড়ে গেল।

রবীন্দ্রসরোবর স্টেডিয়াম বা লেক স্টেডিয়ামে মার্ক্সবাদী ফরোয়ার্ড ব্লকের সেই প্রকাশ্য সমাবেশে টেরিকট অথবা টেরিউলের ছাই ছাই রঙ সাফারি পরা রাম চ্যাটার্জির মুখে বার বার মার্ক্সবাদ, লেনিনবাদ, সুভাষবাদ, জ্যোতিবাদ— জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ শুনে স্বয়ং জ্যোতি বসুও খানিকটা যেন বিব্রত হয়েছিলেন ফ্র্যাকশন অফ আ সেকেন্ডের জন্য। তাঁর চকচকে গালে, ওষ্ঠ ভঙ্গিতে সামান্য একটি তরঙ্গ উঠতে না উঠতেই মিলিয়ে গেল।

জ্যোতি বসু সেই সমাবেশে বক্তৃতাও করলেন, নানা কথা উঠে এল তাঁর বক্তব্য পেশ করার সময়ে। তখনকার রাজ্যের পরিস্থিতি তিনি বর্ণনা করছিলেন। খুব প্রাঞ্জল ভাষায় তাঁর নিজের মতো করে, নিজস্ব স্টাইলে।

সেই সভা পুরোটাই কভার করার জন্য বসে রইলাম। সাংবাদিক হিসাবে যা করা আবশ্যিক ছিল ডিউটির মধ্যে।

ওড়িয়াপাড়ায় ওড়িয়া যাত্রা দেখেছি। রাম যাত্রাই। কৃষ্ণ যাত্রা। কলকাতায় যে ওড়িয়া মানুষেরা থাকতেন বা থাকেন, তাঁরা অধিকাংশই মূলত প্লাম্বার— কলের মিস্ত্রি। বাড়ি বাড়ি জল পৌঁছে দেন তাঁরা খালি ‘ডালডা’র টিন ভর্তি করে। যতদিন বাজারে বাজারে কচ্ছপের মাংস বিক্রি হত, ততদিন ওড়িয়াবন্ধুরা সেই মাংস বিক্রির কাজটি করতেন। এছাড়াও পৌরহিত্য— বাড়ি বাড়ি পুজো করা— গঙ্গার ঘাটে ঘাটপাণ্ডা হওয়া, পুণ্যার্থীরা স্নান সেরে উঠলে তাঁদের কপালে টগর ফুলের বোঁটা দিয়ে ফোঁটা দেওয়া, শ্বেত অথবা রক্ত চন্দন ফোঁটা, কাঠি দিয়েও দিতেন তাঁরা চন্দন ফোঁটা, লাল কুমকুম ফোঁটা। সোনাগাছির বেশ্যা পল্লীতে প্রতি ঘরে ঢুকে ঢুকে তাঁরা লক্ষ্মী-গণেশের পুজো করেন। অনেক অনেক দোকানও তাঁদের বাঁধা, ফুল-জল-চন্দন দেওয়ার জন্য।

ওড়িয়া যাত্রা হত চেতলায়। কলকাতায় বেশ কয়েকটি ওড়িয়াপল্লী বা ওড়িয়াপাড়া ছিল। ষাট, সত্তর, আশি, নব্বইয়ের দশকেও সেখানে বহু মানুষ। জগন্নাথ মন্দির ইত্যাদি। বেশ কয়েক বছর হল খিদিরপুরে একটি জগন্নাথ মন্দির হয়েছে। সেখানেও খুব ভিড় হয় দর্শক, ভক্তদের। তার মধ্যে যেমন ওড়িয়া ভক্তরা আছেন, তেমনই ওড়িয়া নন, এমন ভক্তরাও আছেন। আসলে বঙ্গভূমির সঙ্গে কলিঙ্গ, শ্রীক্ষেত্র, পুরুষোত্তমপুর, পুরী— পর্বে পর্বে, যুগে যুগে সময়-সময়ান্তরে নাম বদলান এই ভূমির সঙ্গে আমাদের এই বঙ্গভূমির যোগাযোগ বহু প্রাচীন। শ্রীচৈতন্যদেব, তাঁর ধর্ম আন্দোলন এবং প্রভাব কতটা বিস্তৃত, তা নিয়ে বহু আলোচনার অবকাশ আছে।

রাত রাত ভ’র ওড়িয়া যাত্রা। মূলত রামযাত্রা বা কৃষ্ণযাত্রা। সব মিলিয়ে ভক্তিরসাত্মক কাহিনি। ওড়িশায় সরলা দাসের মহাভারত অতি বিখ্যাত। যাঁরা মহাভারত পড়তে চান ওড়িশায়, তাঁরা সরলা দাসের মহাভারতই পড়েন মূলত।

রাতে ওড়িয়া যাত্রার কুশীলব লোকাল লোকজন। মানে ওড়িয়া মানুষ। ছেলেরাই গোঁফ-দাড়ি কামিয়ে, চড়া, সস্তার মেকআপ আর পরচুল বেণী ইত্যাদি নিয়ে ফিমেল করেন। সে ভারি চিত্তাকর্ষক ব্যাপার স্যাপার। রাবণ বা কোনো রাক্ষস রাজ বাংলা যাত্রায় যেমন হয়, তেমনই ‘কোকাকোলা’ পান করে। ‘কোকাকোলা’র দাম তখন চার আনা।

Powered by Froala Editor