শুখনাই, তাই সুখ নাই

মানিকলমকারি – ১৫

আগের পর্বে

আগন্তুক চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরুর মাত্র দু’মাস পর থেকেই শুরু হয়েছিল শুটিংয়ের কাজ। তবে সেই চিত্রনাট্য লেখার খাতায় সত্যজিৎ রায় লিখে রেখেছিলেন পাঁচটি গল্পের নাম। ‘তারিণীখুড়ো ও বেতাল’, ‘অনুকূল’,‘খগম’,‘বহুরূপী’ আর ‘অতিথি’। চলচ্চিত্রের পর্দায় ‘অতিথি’ই বদলে গেল ‘আগন্তুক’-এ। বাকি গল্পগুলো নিয়েও হয়তো তাঁর পরিকল্পনা ছিল ছবি করার। যাই হোক গল্পের থেকে চিত্রনাট্যে বদলাল চরিত্রের নাম। মফস্বlলের বদলে পটভূমি হল কলকাতা। আর সেই বাড়ির ঠিকানা হল সন্দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয় দপ্তর একশো বাহাত্তর বাই দুই, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ। তবে শেষের চমকটি থাকল গল্পের মতোই। অপরিবর্তিত। ইতিহাস-বিজ্ঞান আর মানবসভ্যতা সম্পর্কে সত্যজিতের ভাবনা প্রতিফলিত হয় এই ছবির সংলাপে।

উপেন্দ্রকিশোরের পৌত্র তিনি। এখানে সেই উপেন্দ্রকিশোরের কথা বলছি, যিনি লৌকিক রূপকথার গল্পের সঙ্গে ছোটোদের শোনাতে পেরেছিলেন মৌলিক রূপকথা। মানে গুপি-বাঘার গল্প, ভূতো-ঘোঁতো-র গল্প যে গোত্রে পড়ে আর কী। আবার ‘দ্রিঘাংচু’-র মতো গল্প লিখিয়ের পুত্র তিনি। ‘দ্রিঘাংচু’-ও তো তা-ই! আবার ধরা যাক, সুবিমল রায়ের ভাইপো তিনি। সুবিমল রায়ের লেখা ‘প্রেতসিদ্ধের কাহিনি’-র কথা মনে আছে তো? তা এহেন উত্তরাধিকার যাঁর আছে, তিনি কি আর লিখবেন না রূপকথার গল্প? গুপি-বাঘার সিকুয়েল ‘হীরক রাজার দেশে’ যেমন লিখলেন তিনি, গু-গা-বা-বা-র দশ বছর পরে। তার সিকুয়েল ‘গুপি বাঘা ফিরে এলো’-র গল্প যেমন লিখলেন তিনি আরো বছর দশেক পরে। ঠিক তেমনই, সিনেমার গল্পের জন্য নয়। একেবারে গল্পের জন্যেই গল্প তো লিখেছেন তিনি। আর আরো বেশ অদ্ভুত ব্যাপার হল, বিশেষ একটা সময়ে, একেবারে পরপর লিখে যান তিনি রূপকথার গল্প। বেশ মনে আছে, তখনকার সেই গল্পগুলি পড়ার সময়ে হঠাৎ মনে হচ্ছিল, সত্যজিৎ রায় কি এবার বদলে ফেললেন তাঁর কলম? নাহলে প্রথমে ‘সন্দেশ’ পত্রিকায় ১৯৮৬ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চ আর মার্চ-এপ্রিল সংখ্যায় দুই কিস্তিতে ধারাবাহিকভাবে তিনি লিখলেন ‘কানাইয়ের কথা’। তারপাশেই ‘নীলকমল লালকলম’ নামে ছোটোদের সাময়িকপত্রে ঠিক এই সময়েই লিখলেন ‘রতন আর লক্ষ্মী’। আবার ‘আনন্দমেলা’-য় রঙিন ছবিসহ ঠিক তখনই, মানে ওই ১৯৮৬ সালের এপ্রিলেই বের হল ‘গঙ্গারামের কপাল’ আর ওই এপ্রিলেই ‘সন্দেশ’-এ আমরা পড়লাম ‘সুজন হরবোলা’। তার মানে ব্যপারটা কী দাঁড়াল? ঠিক ওই ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬ থেকে এপ্রিল ১৯৮৬-র মধ্যে পরপর চারটি রূপকথার গল্প লিখলেন সত্যজিৎ! সত্যজিতের খেরোর খাতা সাক্ষী, ২৫ ডিসেম্বর ১৯৬৪ থেকে ২১ অগস্ট ১৯৬৬-এর মধ্যে সত্যজিৎ লিখেছিলেন গুপি-বাঘার প্রথম ছবির চিত্রনা্ট্য, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৯-তে সত্যজিৎ লিখতে শুরু করেন ‘গুপী-বাঘা রাজার জামাই’--- যে-ছবির নাম পরে হল ‘হীরক রাজার দেশে’। তারপরে এই ১৯৮৬। সেগুলি ছিল সিনেমার জন্য লেখা। এরপরে নিজের পঁয়ষট্টি বছরে পদার্পণের ঠিক আগে পরপর চার-চারটে রূপকথার গল্প।    

শুখনাই অসুখে আক্রান্ত রূপসার তাঁতি।

 

অদ্ভুত ঘটনা আর জানি না একে সমাপতন বলব, নাকি এটা একটা লেখক সত্যজিতের মন-পড়ার ধরন হতে পারে, বিষয়টা হল, এই রূপকথার গল্প-লেখার যে-পর্ব, তার ঠিক আগের গল্পটি ছিল ‘নিধিরামের ইচ্ছাপূরণ’। সেখানে একভাবে এতকাল চাকরি করে আসা নিধিরাম হঠাৎ বেছে নিল নাট্যাভিনেতার অনিশ্চিত জীবন আর তার বন্ধু বেশ জনপ্রিয় নাট্যাভিনেতা মনোতোষ বাগচি কোথাও কিছু নেই, নাটক-করা ছেড়ে বেছে নিল চাকুরিজীবীর নিশ্চিন্ততা। তাঁর গল্পের নায়ক অকস্মাৎ এতদিন যে পথে ছিল, সেই পথ ছেড়ে অন্য পথের সাকিন খোঁজে আর সেই গল্পের স্রষ্টা ঠিক এরপরেই লেখেন নিজের ধরনের গল্প-লেখা ছেড়ে রূপকথার গল্প। তাও একটা নয়, পরপর চার-চারটে। কী হতে পারে এই গল্পটার নাম? ‘মানিকবাবুর ইচ্ছাপূরণ’?

তা সেই ইচ্ছাপূরণের বিস্তারিত গল্পমালাতেই আমরা যাব মানিকলমকারি-র পর্বে। তার আগে, সেখান থেকে অন্য একটা প্রসঙ্গ কথা বলে আজকের পর্বটা সেরে নিই।

শুখনাই অসুখে আক্রান্ত রূপসার রাজা।

 

গল্পের নাম ‘কানাইয়ের কথা’। অসুখটার নাম হল ‘শুখনাই’। গল্পটাতে সেই শুখনাই রোগের কথা কীভাবে আছে, সেই সুতোটাই আমাদের মতো করে সাজিয়ে-গুছিয়ে দু-একটা টীকা-টিপ্পুনি দিয়ে, বলে দিয়ে যাই একে একে। কী জানি মনে হয়, তাতেই অনেক কথা বলা হবে। আলাদা করে বুঝি কিছু বলার দরকার-ই পড়বে না!

আরও পড়ুন
অতিথি যখন আগন্তুক

শুখনাই যে কী অসুখ, তার কোনো সন্ধানই সেভাবে জানা ছিল না ডাক্তার-বদ্যির। নসু কবরেজও বেশ ঘাবড়ে গিয়েছিলেন এই অসুখটা কানাইয়ের বাপ বলরামের হয়েছে বলে। এই অসুখে রোগীকে খাওয়ানো যায় না কিছুই, কারণ তার পেটে কোনো কিছুই সহ্য হয় না। নসু কবিরাজের কথায়, ‘এ ব্যারামের লক্ষণই এই। পেটে কিছুই সহ্য হয় না। আর দিনে দিনে শরীর শুকিয়ে যেতে থাকে।’ সেই অসুখের অব্যর্থ দাওয়াই হল চাঁদনি গাছ আর ওই গাছ পাওয়া যায় বাদড়ার জঙ্গলে। কিন্তু বহু পরিশ্রমে সেই বাদড়ার জঙ্গলে পৌঁছে কানাই জানতে পারে, ‘রূপসা-র মন্ত্রী সেপাই সান্ত্রী নিয়ে এসে গাছ তুলে নিয়ে গেছে।’ তাদের নিয়ে যাওয়ার কারণটা কী? খবর নিয়ে জানতে পারে, ‘রূপসার প্রজাদের ব্যারাম হয়েছে--- শুখনাই ব্যারাম--- বিশদিনে না খেয়ে হাত-পা শুকিয়ে মরে যায় তাতে।’ রূপসা রাজ্য কেমন রাজ্য? সেকথাও শুনতে পাই গল্পে। কানাইয়ের মনে পড়ে, ‘রূপসা মানে যেখানের তাঁতের কাপড়ের খুব নামডাক’। সেই তাঁতের জন্য বিখ্যাত সেই নগরে পৌঁছয় কানাই। আর গিয়ে দেখে, বাজারের দুদিকে ভর্তি দোকানপাট। ‘তাতে নানা রকম জিনিসের মধ্যে কাপড়ই বেশি আর সেই কাপড়ের বাহর দেখেই কানাই তো থ। দেশ-বিদেশের লোকেরা সে কাপড় দেখছে,দর করছে, কিনছে। কিন্তু একটা জিনিস দেখে কানাইয়ের ভারি অদ্ভুত লাগল। যারা সে কাপড় বেচছে তাদের কারুর মুখে হাসি নেই।’ কথা বলে জানা যায় তাদের এই গভীর বিষাদের কারণ! তাঁতিপাড়ায় মড়ক লেগেছে, শুখনাইয়ের মড়ক। ‘এখন তাঁতিপাড়ায় লেগেছে, কিন্তু ছড়িয়ে পড়তে আর কতদিন? তাঁতিরা সব না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মরে যাচ্ছে।’ খবর জেনে আরো আশ্চর্য হয় কানাই। কারণ, সে তো জানে, রাজার মন্ত্রী সেই বাদড়ার বন থেকে চাঁদনির পাতা নিয়ে এসেছে। সে ওই আনার গল্পটা জানে, জানে না, সেটা নিয়ে আসার আসল কারণটা। কানাইকে সেই কারণটা বলে, এক বুড়ো তাঁতি। রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতে গিয়েছিল তাঁতিরা। তারই মধ্যে এসে পড়ে এই শুখনাই--- প্রজারা যাতে শুখনাইয়ের প্রতিষেধক না জোগাড় করতে পারে, তার জন্যই আগেভাগে তার ওষুধ সরিয়ে রেখেছে রাজা, নিজের লোক দিয়ে।

হীরক রাজার সঙ্গে বেশ মিল ছিল রূপসার রাজার।

 

কাহিনির শেষে ওই শুখনাইতেই ধরে স্বয়ং রাজামশাইকেও। রাজা হিংস্র আর বদমাশ হলে কী হবে, রাজার ছেলে কিশোর ভারি ভালো। সে তার নতুন বন্ধু কানাইকে বলে, ‘তাঁতির যা-অসুখ, তোমার বাপের যা অসুখ, বাবারও সেই অসুখ।’ শুখনাইয়ের মড়ক এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছড়ায়, এক শ্রেণি থেকে আরেক শ্রেণিতে বিস্তারলাভ করে। কল্পনাতে এমনই এক মড়কের গল্প ভেবেছিলেন সত্যজিৎ।

আরও পড়ুন
সই আর সত্যজিৎ

মজার ব্যপার কী, অদ্ভুতভাবে লক্ষ করা যায়, এই ছবির অলংকরণে, দুষ্টু রাজার মুখ আঁকতে গিয়ে তিনি যে ছবি আঁকেন, তার সঙ্গে হীরক রাজার আশ্চর্য মিল। আর সেই রাজার গায়ে যে চাদর সেই চাদরের ডিজাইনেও আছে হীরক রাজার দরবারে বারবারে ব্যবহৃত জ্যামিতিক মোটিফ।             

কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের রূপকথার গল্প বলতে গিয়ে কেন যে এবারে আলাদা করে মানিকলমকারির পাঠকদের কাছে ‘শুখনাই’-এর কথাটা এবারে পাড়লাম, সে তো বলা বাহুল্য।

খুব আনন্দে আর ততোধিক সাবধানে কাটুক সকলের এবারের পুজো। এখনকার ‘শুখনাই’ বিদেয় না হলে যে কারো মনেই সুখ-নাই!

আরও পড়ুন
বিরিঞ্চিবাবা আর ভবানন্দের চ্যালাদের বদল-বৃত্তান্ত

Powered by Froala Editor