তরাই-মোরাং-এ সায়েবসময়

সময়ভ্রমণ – ১৮

আগের পর্বে

তরাই অঞ্চলের শেষ সাহেব বাসিন্দা ছিলেন একজন স্কচ। তাঁর নাম ম্যানসন। নব্বইয়ের দশকের শুরু অবধি গয়াগঙ্গা চা বাগানে থাকতেন তিনি। সেই অসম্পূর্ণ গল্প লেখা হয়নি। সাহেবরা চলে গিয়েছেন বহুদিন। বদলেছে তরাইয়ের ভূগোল। আগেও যে বদলায়নি, এমন নয়। যুদ্ধ-বিগ্রহ তো লেগেই থাকত। তবে ১৮৫০ থেকে ১৮৮০-র মধ্যে চেহারা আগাগোড়া বদলে গিয়েছে। এখনও সেই পরিবর্তন চলছে। প্রাকৃতিক নিসর্গ ধ্বংস করে গড়ে উঠছে কংক্রিটের জঙ্গল। বদলাচ্ছে তরাইয়ের মানুষের জীবনও। আদিবাসী সংস্কৃতির মধ্যেই ক্রমশ ছাপ ফেলছে হিন্দু রীতিনীতি।

সিকিম হিমালয়ের পায়ের কাছের যে তরাই-মোরাং এলাকা, সেখানে পুরোদস্তুর সায়েবশাসন কায়েম হয় ১৮৫০-এ। সায়েবদের কাছে এলাকাটার যে খুব একটা গুরুত্ব ছিলো, তা নয়। ঠান্ডা, সাদা দার্জিলিং-এর 'হোম ওয়েদারে' পৌঁছনোর পথ যায় তরাই-য়ের মধ্য দিয়ে, ফলে সে জায়গাটা নিজেদের দখলে থাকলে ভালো হয়, প্রধানত এই বিবেচনায় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিকিম রাজার কাছ থেকে মেচি থেকে তিস্তা অবধি পাদশৈল এলাকা কব্জা করে। ১৮৪৬-এ ব্রায়ান হজসন কোচ-মেচ-ধিমালদের নিয়ে তাঁর বিখ্যাত সন্দর্ভ রচনা করছেন, ১৮৩৯-৪০ এ ক্যাম্পবেল মেচ, লেপচা, লিম্বু ইত্যাদি আদিবাসীদের নিয়ে লিখছেন। 

মেচ-ধিমালদের মাতব্বর ছিলো বীর সিং চৌধুরী, ওপরপাহাড়ে লেপচা-লিম্বুদের জনৈক চেবু লামা। বীর সিং এবং চেবু লামা জাতীয় লোকেরা কোম্পানিরাজের হয়ে জুমিয়া আদিবাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, খাজনা ওঠাতো, দরকারমতো কোম্পানি বাহাদুরের কাজে কুলির যোগান দিত। কোম্পানি আসার আগে এরা সিকিম রাজার হয়ে এই কাজ করত, গোর্খা রাজার হয়েও। তিস্তার ওপারের যে তরাই, ভূটান-তিব্বত যাওয়ার বিভিন্ন পথ যার ভিতর দিয়ে যেত বলে যাকে বলা হত দুয়ার আর সায়েবরা বলত ডুয়ার্স, সেই এলাকার দখল নিয়ে আঠেরো শতকের প্রায় পুরোটা জুড়েই কোচবিহার(কোচ শব্দটা ব্যবহার না করে সংক্ষেপে বলা হতো বেহার বা বাহার) রাজার সঙ্গে ভূটানের রাজাদের যুদ্ধবিগ্রহ চলছিল। সে যুদ্ধ তিস্তা পেরিয়ে মোরাং-তরাই-এ ঢুকে পড়ত যখন তখন, বিশেষত জলপাইগুড়ির রায়কতরা যখন নিজেদের স্বাধীন রাজা বলে ঘোষণা করে ভুটানের সঙ্গে হাত মেলালেন। এ অঞ্চলে কোম্পানির প্রথম আগমনের পিছনেও কোচবিহার রাজার কাতর সাহায্য-আবেদন। সে গল্প অন্যসময় করা যাবে। এখানে কথাটা হল, স্থানীয় মাতব্বরেরা শাসকদের হয়ে স্বভাব-যাযাবর জুমিয়াদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত, সায়েবপূর্ব শাসকদের ক্ষেত্রে যেমন, সায়েবদের ক্ষেত্রেও তেমন। হজসনের লেখা থেকে বোঝা যায়, জুমিয়া সমাজে রাজাপ্রজা উঁচুনিচু ভেদ ছিল না, শাসক বা শাসন ব্যাপারটাই তাঁরা বুঝতেন না। শাসক বা শাসন বলতে রাষ্ট্র। সিকিম, কোচবিহার বা রায়কতদের মতো তুলনায় ছোট রাষ্ট্র, আয়তনে ও শক্তিতে কিঞ্চিদধিক বৃহৎ ভুটান, 'গোর্খা' নেপাল। সর্বোপরি, মুঘলদের এবং কোম্পানিরাজের মতো বড় রাষ্ট্র। 

রাষ্ট্র ছোট-বড় যেরকমই হোক, জুমিয়াদের প্রতিদিনের জীবনের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকত না। থাকার কথাও নয়।  জুমিয়া সমাজজীবন সহজ সাম্যে প্রোথিত, আকাশ নক্ষত্রপুঞ্জ নদী পাহাড় গাছপালা এসবকে কেন্দ্র করে আবর্তিত যে ধর্মাচরণ, তার মধ্যেও কোনরকম বৈষম্য বা শাসনের স্থান নেই। এই মানুষেরা রাষ্ট্র বিষয়টাকে বুঝবেন কী করে? তরাই জুড়ে সেসময় দুর্ভেদ্য ঘাসবন, শালজঙ্গল, অসংখ্য ছোটোবড়ো নদীনালা। প্রকৃতির সেই গোলকধাঁধার ঠিক কোনখানে জুমিয়া বসতি, কোত্থেকে খাজনা আদায় হবে, হতে পারে, তাই-ই বা বোঝা যায় কী করে? বীর সিং এবং চেবু লামা গোত্রের লোকেরা রাষ্ট্রের কাছে 'না-রাষ্ট্র' জুমিয়াদের দৃশ্যমান করে তুলতেন। ফলে যা উৎসে প্রাকৃতিক, স্বভাব-শাসনহীন, তা শাসনের, শাসকের ক্ষমতাবৃত্তের মধ্যে চলে আসত। উল্টোদিকে, যেমন তখনকার দস্তুর, জুমিয়াদের কাছে দূরবর্তী রাজশাসন বা রাষ্ট্রশাসন দৃশ্যমান হয়ে উঠতো কাছাকাছি থাকা সামন্তপ্রভুদের মাধ্যমে। 

চৌধুরী এবং লামারা সামন্তপ্রভুদের প্রতিনিধি, তাঁরা খাজনা যোগাড় করে ক্ষমতাবান 'সুবা'দের কাছে পৌঁছে দিতেন। তরাই-মোরাং-এর আসল প্রভু ছিলেন সুবারা, তাঁরা প্রচুর ভূসম্পত্তির অধিকারী, দুর্গে কিম্বা বড়ো বাড়িতে থাকতেন, তাঁদের হাতে সৈন্যসামন্ত থাকতো, রাজার হয়ে যুদ্ধবিগ্রহও তাঁরাই করতেন। বুকানন-হ্যামিলটনের গোর্খা বৃত্তান্তে পূর্ব নেপালের কিরাত (অর্থাৎ লিম্বু) রাজত্বের পরিপ্রেক্ষিতে সুবা এবং সামন্তশাসন বিষয়ে বহু তথ্য পাওয়া যায়। সীমান্ত এলাকার কুঠিগুলোতে থাকত সর্দার বা ফৌজদারেরা। সুবাদের বাস ছিলো পুরোনো রাজধানীগুলোয়। যেমন, সিকিমের কাছ থেকে দখল করা অংশের যে সুবা, তিনি থাকতেন চইনপুরে। নাগরিকুঠিতে তাঁর এক প্রতিনিধি মোতায়েন থাকতো। সিকিম অঞ্চল থেকে বারবার লেপচাদের হানা চলতে থাকায়, চইনপুরের গোর্খাঅনুগত সুবা একরকম বাধ্য হয়েই নাগরিকুঠির দায়িত্বে এক লেপচা মাতব্বরকে নিয়ে আসেন। তাকে ডাকা হতো ইউ-তান-কা বলে। দার্জিলিং তরাই-য়ে, এবং ওপরের পাহাড়ে চইনপুর সুবার এলাকায় সরকারি বাড়িঘরের মধ্যে নাগরিকুঠি(লেপচারা বলতো সাম-দাঙ)ছাড়াও ছিলো নিচের দিমালি বা সিওমালি, মহানন্দা নদীর উৎসের কাছে সাতাং গোলা(কারসিয়াং কি?), আরো ওপরে দার্জিলিং দূর্গ, যেখানে গোর্খা সৈন্যদের মূল ডেরা ছিলো। গোর্খা সিকিমের লাগোয়া আসল সিকিম, তার রাজধানী তুমলং। তিস্তার ওপারে ভুটানি ধর্মরাজা আর দেবরাজার রাজত্ব, সেখানকার ওপরপাহাড়ে পুরোনো লেপচাদেশের শেষ চিহ্ন দামসাং দুর্গ। তিস্তা থেকে কিছুটা ভিতরে ঢুকলে ডালিঙকোট দূর্গ, যেখানে ভুটানি সেনার বাস। ভুটানে রাজশাসন পরিচালিত হত বড় বড় দুর্গ বা জং থেকে। দুর্গপালদের বলা হত জংপেন। জংপেনদের আওতায় থাকতো কছাপরা, খাজনা আদায়ের দায় থাকত তাদের ওপর। কছাপরা গ্রামে পাঠাত পিপনদের। হোয়াইট সায়েবের, অর্থাৎ ১৮৮৭ থেকে ১৯০৮ অবধি সিকিমের মহাপরাক্রমশালী ব্রিটিশ রেসিডেন্ট জে ক্লড হোয়াইটের লেখা সিকিম-ভুটানে একুশ বছর বইটার শেষে ভুটানি আইন বলে একটা সংযোজনী আছে, সেখান থেকে এই বর্ণনা দেওয়া। নামে রেসিডেন্ট হলেও আসলে হোয়াইটসায়েব ছিলেন সিকিম-ভুটানের রাজাধিরাজ স্বরূপ, তাঁর কথা অমান্য করার ক্ষমতা রাজবংশীয় অভিজাতদেরও ছিল না। লার্ড কার্জনের আমলে এবং বিশেষত সিকিম ভুটানের ভিতর দিয়ে ফ্রান্সিস ইয়াং-হজব্যান্ড যখন সসৈন্য তিব্বত অভিযান শুরু করেন, তাঁর প্রতিপত্তি কমতে থাকে। হোয়াইটের কথা পরে কখনো বিস্তারিত বলা যাবে। আপাতত যেটুকু বলার, ভুটানি আইন বলে হোয়াইটের বইতে যা লেখা, সেটা যে হোয়াইট নিজেই তৈরি করেন নি, জোর দিয়ে বলা যায় না। 

কথাটা বলবার কারণ আছে। পৃথিবীর অর্ধেকব্যপী রাজত্বের বিভিন্ন প্রান্তে সায়েবপূর্ব শাসন-ব্যবস্থা কোম্পানিসায়েবরা নষ্ট তো করেনইনি, উল্টে সামন্ত-শাসনের গোড়ায় জল ঢেলেছেন মন দিয়ে। এর একটা কারণ যদি রাজনৈতিক হয়, দ্বিতীয়টা অর্থনৈতিক। রাজনৈতিক কারণ বলতে স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাতে রাখা, কোম্পানিরাজ তৈরির নানা কাজে তাদের সাহায্য নেওয়া। মেচ-ধিমাল প্রজাদের নিয়ে বীর সিং যে রাজা বদল করতে চাইছিলো তা তো এমনি নয়। কোম্পানিশাসনের আদি যুগে রাজকার্য চলতো প্রধানত সামন্তিয় কায়দায়। স্থানীয় প্রভাবশালী মাতব্বর, সামন্তপ্রভু, এদের বোলবোলা প্রায়শই অক্ষুণ্ন থাকত, সেই সঙ্গে সায়েবশাসকও কার্যত সামন্তশাসক হয়ে দাঁড়াতেন। বিশাল সাম্রাজ্য, তার দূরবিস্তৃত প্রান্তবর্তী সীমান্ত এলাকা, পৌঁছোতে গেলেই প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়, পৌঁছলেও সুস্থ শরীরে টিঁকে থাকা মুশকিল, সেখানে নেটিভদের সংসারে কী হচ্ছে কে খবর রাখে। ফলে ক্যাম্পবেল থেকে হোয়াইট, সায়েবশাসকদের অন্তত তিন প্রজন্ম ইচ্ছামতো শাসন চালিয়ে গেছেন। খানিক সিপাই বিদ্রোহের ধাক্কায়, খানিক ব্রিটিশ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম তিন দশক ধরে ঘটে চলা একের পর এক আদিবাসী ও কৃষক বিদ্রোহের ফলে, অবস্থায় কিছু বদল আসে। পুরোটা বদলায় না। 

তাহলে, সায়েবপূর্ব রাষ্ট্র ও সায়েবরাষ্ট্র, সীমান্ত এলাকায় তথা আদিবাসী-অধ্যুষিত বনজঙ্গলে দুইয়েরই শাসন চলতো প্রধানত সামন্তিয় কায়দায়। কোম্পানি আমলে শুধু সীমান্ত কেন, দেশের অধিকাংশ চাষযোগ্য জমি পাকাপাকি বন্দোবস্ত করে নতুন-পুরোনো সামন্তপ্রভুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। সুবাবাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের কথা মনে করুন। সিকিম-দার্জিলিং-দুয়ার এলাকায় সে বন্দোবস্ত ছিল না বটে, সরকার তথা রাষ্ট্র সরাসরি জমিতে রাইওত বসাত, কিন্তু সে ব্যবস্থা উনিশ শতকের শেষ দিকে শুরু হচ্ছে। তার আগে পর্যন্ত স্থানীয় মাতব্বরদের সামন্তরাজত্ব চলছে, অর্থাৎ তারা কাগজে কলমে বড় বড় জমির, অর্থাৎ জোতের মালিক হয়ে বসছে, সে জমিতে যে জুমিয়ারা বাস করছে, তারা হয়ে দাঁড়াচ্ছে জোতের প্রজা। এই ব্যবস্থায় পোড়ো বা অকাজের জমিও(সায়েবরা বলত 'ওয়েস্ট ল্যান্ড', যা থেকে খাজনা আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে), কাজের হয়ে উঠছে। কম হলেও খাজনা পাওয়া যাচ্ছে। আরো যা কাজের কথা, কুলির যোগানে ঘাটতি পড়ছে না। সায়েবদের দার্জিলিং যাবার পথ বানানোয় কুলি দিচ্ছিল বীর সিং, ওপর পাহাড়ে বন কেটে শহর বানানোর জন্য কুলি নিয়ে আসছিল চেবু লামা। জয়িতা শর্মা, ক্যাথরিন ওয়ার্নার ও রুন বেননিকের সাম্প্রতিক কিছু গবেষণাকাজে সিকিম-দার্জিলিং এলাকায় সায়েবরাষ্ট্র, তার স্থানীয় সামন্ত প্রতিনিধি ও তাদের 'না-রাষ্ট্র' বা নন-স্টেট জুমিয়াদের সম্পর্কের ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যাবে। 

বুকানন-হ্যামিলটনের পুরোনো বইটার একটা পুনর্মুদ্রিত ভারতীয় সংস্করণ হাতের কাছে আছে। সেটার সঙ্গে ভাঁজ ভাঁজ করা লম্বাটে একটা ম্যাপ। কিছুটা নিজের দেখা, বেশিটাই সঙ্গী ব্রাহ্মণ, লামা ও অন্যান্যদের কথার ওপর ভিত্তি করে আঁকা সে মানচিত্র বুকানন-হ্যামিলটন কলকাতায় কোম্পানির সদর দপ্তরে জমা করেন। পশ্চিমে কালী নদী থেকে পুবে তিস্তা অবধি গোর্খা রাজত্বের পুরোটা সে মানচিত্রে দেখানো। দুশো বছর আগেকার ম্যাপ, কাঠখোদাই করে ছাপা, সেটার অস্পষ্ট প্রতিলিপি আমার বইটায়। রেখা, কালি সব ঝাপসা হয়ে গেছে, জায়গার, পাহাড়ের, নদীর হাতে লেখা নাম কোনোরকমে পড়া যায়। একদম ওপরে সাদার মধ্যে আরো সাদা বরফের পাহাড়, তাকে ঘিরে থরে থরে মোটা কালো দাগ, খানিকটা শুয়োপোকার, বা কাঁটাতারের বেড়ার মতো। সেগুলো আসলে বনে ঢাকা, ঢেউ-খেলানো পাহাড়ের সারি। ছবির নিচেও ওইরকম পাহাড়, পাহাড়ের শেষ, তরাই-এর শুরু। ওপর আর নিচ পাহাড়-এর মধ্যে সাদা জমিতে অসংখ্য স্থাননাম, সরু সরু রেখায় দেখানো নদী, উপনদী। ওপর পাহাড়ের পরে সাদা জমির উপর লম্বা করে লেখা চীন সাম্রাজ্য, তিব্বত, ছোট তিব্বত। ম্যাপ যেখানে শেষ হচ্ছে, সেখানে লেখা ভোটান। 

কোম্পানি ও কোম্পানি-পরবর্তী সায়েবরাষ্ট্রের সঙ্গে সায়েবপূর্ব রাষ্ট্রের ফারাক দ্রুত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সায়েবরা আসার আগে রাষ্ট্র ছিল, সীমান্তও ছিল। তবে সে সীমান্ত তরল, আজ এই নালা কাল সেই নদী, কে সেই সীমান্ত মানছে না মানছে তা দেখবার ক্ষমতা রাষ্ট্রের ছিল না। জুমিয়ারা কাছের সামন্তপ্রভুকে কর দিত, দূরের রাজা, রাষ্ট্র এসবের স্থান জুমিয়া না-রাষ্ট্রে ছিল না। সুতরাং, যাযাবর জুমিয়ারা এবং পশুচারকরা ইচ্ছামতো সীমান্ত পার করে এরাষ্ট্র-ওরাষ্ট্র করত। সায়েবি আমলে পাকাপাকি মানচিত্রে আঁকা সীমান্তের ব্যবস্থা হল, দাগের এপারে আমার এলাকা, ওপারে অন্যের। প্রকৃতির মধ্যে, জুমিয়ারা যে বনপাহাড়ে জীবন কাটাতেন তার মধ্যে না থাকে সাদাকালো দাগ, না মানচিত্র। সায়েবরা ম্যাপের পর ম্যাপে দাগের পর দাগ কাটতে থাকলেন, সিপাই-দূর্গ-কাঁটাতারে(কাঁটাতার অবশ্য হালের) ভরা নতুন নতুন সীমান্ত পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে উঠল। পুরো তরাই-মোরাং জুড়ে বনে বনে ঘুরে ঘুরে জুম করতেন যে মেচ-ধিমালরা, তাঁদের সূর্য-চন্দ্র-নদী-অরণ্য শাসিত প্রতিদিনের জীবনে আধুনিক রাষ্ট্র ঢুকে এল তার যাবতীয় সৈন্যসামন্ত পাইকপেয়াদা জজম্যাজিস্টর নিয়ে। জুমিয়াদের না-রাষ্ট্রকে গিলে ফেলল সায়েবদের তৈরি 'ইন্ডিয়া', তার নতুন রাজ্য, জেলা, মহকুমা, তালুক। 

সায়েবরা খুব হিসাব করে সিকিম রাজার ডানা ছাঁটলেন, ১৮৪৮ থেকে ১৯০০ সালের ভিতরে সিকিম এবং ভুটানকে কার্যত ব্রিটিশদের করদ রাজ্যে পরিণত করা হলো, অথচ নেপালের গোর্খা রাজাদের ঘাঁটানো হলো না। নেপালকে ছেড়ে রাখার তিনটে প্রধান কারণ। প্রথমত, সিকিম আর ভুটান সায়েবদের হিসেবে বন্য এলাকা, তিব্বত-চীনের আয়ত্তের মধ্যে, সেখানে কবে কী হয় বলা যায় না। তুলনায় নেপালে শক্তিশালী শাসক, যুদ্ধবাজ সৈন্যদল, প্রজারা নিয়মিত খাজনা দেয় বা দিতে বাধ্য হয়। সর্বোপরি, নেপালরাজ হিন্দু, বৌদ্ধ তিব্বত-ভুটানের সঙ্গে তাঁর আঁতাত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দ্বিতীয়ত, নেপাল ঠিক থাকলে সায়েবদের রাজকাজে এবং ব্যবসাকাজে কুলির যোগান নিয়ে চিন্তার কারণ নেই, ওদিকের লোক এদিকে চলে আসবে, আসতেই থাকবে। ক্যাম্পবেল এক জায়গায় বলছেন, দার্জিলিং-এ নেপালের লোক কাজ করলে কোম্পানিরও ভালো, নেপালেরও। এখানে কাজ করে যে পয়সা পাওয়া যাবে তা দিয়ে দেশে বকেয়া খাজনা শোধ হবে। মনে রাখা ভালো, হিমালয় পাহাড়ের বিভিন্ন সায়েবপূর্ব রাষ্ট্রে দাসপ্রথার প্রচলন ছিল, নিচের লোকজনকে ওপরের বাজারে বিক্রি করা হত, খাজনা বাকি পড়লেও দাসশ্রম দিতে হত। হয়তো এ অবস্থা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই দার্জিলিং-এ কাতারে কাতারে মানুষ আসছিলেন। শুধু যে পূর্ব নেপালের লিম্বু এলাকা থেকে, এমন নয়। মানুষ আসছিলেন কাঠমান্ডু উপত্যকা থেকে, মধ্য নেপাল এমনকি হিমালয়ের অন্তঃস্থল সোলো-খুম্বু থেকে, যেখানে স্বভাব-পাহাড়চড়ুয়ে শেরপাদের আদি বাস। তৃতীয়ত, নেপাল থেকে বাছাই-করা লোক নিয়ে ব্রিটিশ সরকার নতুন গোর্খা রেজিমেন্ট তৈরি করে ফেলল। শুরুর দিকে পূর্ব নেপালের লিম্বুদের এই রেজিমেন্টে নেওয়া হত না, বহু চেঁচামেচির পর পূর্ব নেপালের বাসিন্দাদের জায়গা হয়। 

লেপচা এবং মেচ-ধিমাল ইত্যাদি জুমিয়াদের ওপর এক শ্রেণীর সায়েবদের সহানুভূতি ছিল। হজসনের কথা বলেছি। রিসলের ট্রাইবস য়্যান্ড কাস্টস অব বেঙ্গলে মেচদের প্রসঙ্গে বলা আছে দার্জিলিং-এর তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার ওল্ডহ্যাম মন্তব্য করেছিলেন, 'মেচরা হারিয়ে যাচ্ছে, একেবারে মরেই যাচ্ছে বলা যায়। এত তাড়াতাড়ি (নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া) অন্য কোন জাতের কথা আমার জানা নেই, কোথাও পড়িওনি। নিঃসন্দেহে এর প্রধান কারণ সরকারি বন সংরক্ষণের ধাক্কায় চিরাচরিত জুমচাষ বন্ধ হয়ে যাওয়া।' ১৮৮১ নাগাদ তরাই-এ মেচদের সংখ্যা দাঁড়ায় হাজারের কিছু ওপরে, অধিকাংশই জুম ছেড়ে স্থায়ীচাষে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছেন। জুম বন্ধ করা নিয়ে বনদপ্তরের সায়েব অফিসারদের সঙ্গে সায়েব প্রশাসকদের একাংশের তীব্র মতবিরোধ হয়। শুধু এ অঞ্চলে নয়, ব্রিটিশ ভারতের বহু জায়গায়। সেসব গল্পে পরে আসা যাবে। আপাতত যা বলার, জুমিয়াদের প্রতি সায়েবদের একাংশ সহানুভূতিশীল হওয়া সত্বেও, জুমিয়া সমাজ ও নিসর্গ নিয়মমাফিক ধ্বংস করা হয়। তরাই যখন সায়েবরাষ্ট্রের চোখে নিছক পোড়ো জমি, জুম আটকানো হয় নি, উল্টে জুমিয়াদের কোম্পানিরাজত্বের মধ্যে নিয়ে আসা হয়েছে। একইসঙ্গে, এলাকার প্রায় যাবতীয় বনজঙ্গল জলের ধরে নানান সায়েবকে বেচে দেওয়া হয়েছে। নির্বিচার গাছকাটার ফলে তরাইয়ের শালবনে ১৮৭০ নাগাদ ভালো কাঠ নেই বললেই চলে, হান্টার যে বিষয়ে মন্তব্য করছেন। বাংলার সংখ্যতাত্বিক বৃত্তান্তের দার্জিলিং খন্ডে ১৮৭০-৭১ এর বন দপ্তরের বিভাগীয় প্রতিবেদন উল্লেখ করে বলা হচ্ছে, তরাই-এর বন বলতে মেচি, লোহাগড়, বালাসন, গাড়িধুরা, রাঙামাটি, মারগাঁও, চম্পাসারি আর দলকা, তাদের কোনটাতেই ভালো কাঠ দিতে পারে এমন গাছ নেই। ভালো গাছ যা ছিলো কাটা হয়ে গেছে, তার ওপরে বনের মধ্যেই কোথাও ঘাসবন, কোথাও জলা, কোথাও বেতঝোপ। এর ভিতর সবটা সরকারি বন ছিল না, এর বাইরেও বন ছিল। ১৮৭৭-৭৮-এ ডব্লিউ স্লিকের তৈরি  বিভাগীয় প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে যে দার্জিলিং-এর জনৈক ডব্লিউ লয়েডের কাছ থেকে বন দপ্তর ৫৭৯৫ একর, অর্থাৎ আজকের হিসেবে প্রায় ২৪ বর্গ কিলোমিটার বন কিনছেন। তার ভিতর নকসালবাড়ির টুকরিয়াঝাড় আর মেচি এলাকার অনেক বনখন্ড আছে। বালাসন এলাকারও। ব্যক্তিমালিকানাধীন আরো যে যে বন কেনা হবে বলে ঠিক করা হয়েছে, তার ভিতর দলকা ঝাড় বা আজকের বাগডোগরা এলাকার জঙ্গল। 

১৮৫০ সালে তরাই এলাকা সায়েবদখলে আসে। বোঝাই যাচ্ছে তৎক্ষণাৎ এলাকার সমস্ত জমি বন্দোবস্ত করে ফেলা হয়েছিল। ১৮৬০ নাগাদ তরাই-এ চা চাষ শুরু। ১৮৬৮-৬৯ থেকে সরকারি বন বানানো। নামমাত্র দামে জমি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সূত্র উদ্ধৃত করে তরুণ ড্যানিশ গবেষক রুন বেনিককে জানাচ্ছেন, ১৮৬২ থেকে ১৮৬৪-র মধ্যে দার্জিলিং জেলায় নব্বই হাজার একর জমি একরপিছু দু থেকে আট টাকা দরে নিলাম হয়। ১৮৬৪ থেকে ১৮৮২-র মধ্যে আরো বাহান্ন হাজার একর জমি যায়, একর প্রতি বছরে ছ আনা দরে। ব্যাডেন-পাওয়েল সায়েব, যিনি এমিনেন্ট ডোমেইন(মানে, যে কোন জমিতে রাজার অর্থাৎ রাষ্ট্রের দাবি সর্বাগ্রে) শব্দবন্ধটির জন্য বিখ্যাত হয়ে আছেন, তাঁর ল্যান্ড সিস্টেমস অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া বইয়ে বলছেন, জমি বেচাকেনার ধুম পড়েছিলো। বিভিন্ন ফড়েরা ধার করেও সরকারি পোড়ো জমি কিনছিলো, এদিকে জমি বেচার উন্মাদনায় সরকারি লোকজন এতটাই ভেসে গিয়েছিলো যে জরিপ-টরিপ না করেই জমি বেচে দেওয়া হচ্ছিলো। যে জমি চাষ হচ্ছে তাকেও 'সরকারি পোড়ো জমি' হিসেবে দেখিয়ে বেচা হলো, জমি যাদের দখলে তারা জানতেও পারলো না। মূল্যবান বনভূমি, এমনকি ব্রিটিশ রাজ্যের বাইরের এলাকাও বেচে দেওয়া হয়েছিল। বেনিককের হিসাব অনুযায়ী, উনিশ শতক শেষ হবার আগেই দার্জিলিং এর মোট এলাকার কুড়ি শতাংশ ব্যক্তিমালিকানাধীন কোম্পানিদের হাতে চলে যায়। 

সাদা কাগজে কালো শুয়ো আর সরু রেখা টেনে সায়েবরা দেশ দখল করতেন, 'অন্য' রাষ্ট্রে এবং না-রাষ্ট্রে সায়েবরাষ্ট্রের উচিত খাসদখল কায়েম হতো। মানচিত্রে যত রেখা বাড়ত, সাদা জমি ভর্তি হয়ে যেত, দখলে থাকা সত্যিকারের বন্য ভূমিতে পাল্লা দিয়ে গড়ে উঠত নতুন সেনাছাউনি, পরিষ্কার সায়েবপাড়া, নোংরা নেটিভ বাজার। যেখানে বন থাকতো সেখানে বনবস্তি অর্থাৎ টঙিয়া, চা বাগান হলে কুলি ব্যারাক। সায়েবশাসিত নিসর্গের এই যে ম্যাপে-দাগ-টানা, খোপকাটা ধরণ, তরাই-মোরাং-এর আপাত নিসর্গ অদ্যবধি সেখান থেকে বিশেষ বেরোয়নি। শুকনা থেকে পশ্চিমে পাহাড়ের নিচ ধরে যাওয়া হচ্ছে, পথের দুদিকে বন, সেনাছাউনি, বন, চা-বাগান, আবার সেনাছাউনি, আরো বন। শুকনা থেকে অদলপুর হয়ে মিরিক বা কারসিয়াং যাবার বড় রাস্তা, নিসর্গ বদলাচ্ছে না। গাড়িধুরা হয়ে তরাই পরিক্রমাপথ দুধিয়ায় বালাসনের নতুন পাকা সেতু পেরিয়ে পানিঘাটা হয়ে বাঁহাতে বাগডোগরা ডানহাতে নকশালবাড়ি হয়ে বিহার নেপালের দিকে চলে যাচ্ছে। যেখানকার বন, চা-বাগান, সেখানেই আছে। সবুজ, আরো সবুজ, আরো আরো সবুজ, পথ বরাবর নীল-সবুজ পাহাড়ের সারি। সব ঠিক আছে, ঈশ্বরের পৃথিবীতে অনন্ত শান্তিকল্যাণ। 

অথচ, সব বদলে গেছে। নিসর্গের মায়া ছেড়ে না বেরুলে, ভিতর থেকে নিঃস্ব হয়ে যাওয়া বনের ভিতরে লুকিয়ে থাকা টঙিয়া গ্রামে না গেলে, একেবারে বন্ধ হয়ে থাকা আর বছরের অর্ধেক ধরে বন্ধ করে রাখা চা-বাগানের কুলিবস্তিতে না যেতে পারলে, বড় রাস্তা থেকে অনেক ভিতরের জোতগুলোতে না ঢুকলে বোঝা যাবে না, কিছুই আগের মতো থাকে না। প্রকৃতির সময়, জুমিয়াসময় থেকে আগাছার মতো উপড়ে ফেলে তরাই-এর পুরোনো মানুষদের পুঁজিশাসিত সায়েবসময়ে জবরদস্তি ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। পুঁজির নিসর্গ পুঁজির নিয়মে চলে, এখনো চলছে। যে নিসর্গ মানুষের, বুনোদের, বনের, পাহাড়ের, নদীর, পুঁজির নিসর্গের মধ্যে তারা তবুও বেঁচে থাকে, নিজেদের জায়গা করে নেয়। যথেচ্ছ শিকারের পরও তরাই-এর জঙ্গলে বন্য হাতির দল অবলীলায় ঘুরে বেড়ায়। প্রতি হেমন্তে তিস্তা পেরিয়ে প্রায় দেড়শো হাতী ঢুকে আসে মহানন্দার বনে, ছোট নদী বড় নদী, মরে যাওয়া কেটে ফেলা নষ্ট হয়ে যাওয়া বন, পাকানো কাঁটাতারে ঘেরা সেনানিবাস, নতুন গ্রামশহর, সব পার করে তারা পৌঁছে যায় মেচি, ওপার নেপালে ঢুকে পড়ে। চা-বাগানের নালায়, ভাঙা বনে বেঁচে থাকে হলুদ-কালো চিতাবাঘ। রোহিনী নদীর উজানে লামা-গুম্বা পাহাড়ের দুর্ভেদ্য প্রাকৃতিক বনে বিচরণ করে  গউরের পাল। এমনকি বেংডুবি সেনাছাউনির ভিতরে, অস্ত্রভাণ্ডার ঘিরে ফাইভ এফওডি(অর্ডন্যান্স ডিপো)র ঘন বন।  সদ্য শুনলাম, পানিঘাটার কাছে, অর্থাৎ সম্ভবত পুরোনো দিমালি অঞ্চলে, এখনো দু চার ঘর ধিমালের বাস আছে। মেচরা মরে যাচ্ছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, সেই কতদিন আগে বলেছিলেন ওল্ডহ্যাম। আশ্চর্য, তরাইয়ের মেচরা, ধিমালরা সবাই মরে যাননি। মেচির ওপার মোরাং, অর্থাৎ নেপালে ধিমালদের এখনো উল্লেখযোগ্য আবাদি, এপারে পুরোনো মেচবস্তির অনেকগুলোই বেঁচে। সে বাঁচা যেমনই হোক, বাঁচা তো। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। আশা হারালে চলবে না। এই সময়, ওই সময়, অনেক সময়ের গল্প আমাদের চলতে থাকবে।

Powered by Froala Editor