সত্যজিৎ রায়কে ‘গুরু’ শিশির ভাদুড়ীর গল্প শোনাতেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

‘জলসাঘর’ ছবির শুটিং চলছে তখন। সত্যজিৎ রায়ের সিনেমার শুটিং দেখতে আসেন অনেকেই। নাটকের অভিনেতারাও আসেন। এমনি একটি ছেলেকে হঠাৎ ডেকে পাঠালেন স্বয়ং পরিচালক। ঘরের মধ্যে তখন ছবি বিশ্বাস এবং সত্যজিৎ রায়। আগন্তুক ছেলেটির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় ছবি বিশ্বাসকে বললেন, ‘এই আমার পরবর্তী ছবির নায়ক’। ব্যাস্, এভাবেই হঠাৎ করে ঢুকে পড়া সিনেমার জগতে। ১৯৫৯ সালে মুক্তি পেল ‘অপুর সংসার’। তারপর এই ৬১ বছর ধরে একভাবে টলিউডের বুকে ছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। সমসাময়িক খুব কম মানুষই এখনও বেঁচে আছেন। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুতে তাই সত্যিই অভিভাবকহীন হয়ে পড়ল টলি জগৎ।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সিনেমায় আসা সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরেই। এরপর একে একে ১৪টি সিনেমা করেছেন তাঁর সঙ্গে। কিন্তু কখনোই সত্যজিৎ-সর্বস্ব হয়ে পড়েননি সৌমিত্র। এমনকি বারবার বাঁধা গতের বাইরে বেরিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। বন্ধু দর্শকরা এক সময় অভিযোগের সুরে জিজ্ঞেস করতেন, সৌমিত্রকে আর নায়কের চরিত্রে সেভাবে দেখা যাচ্ছে না কেন? যেন নায়কের চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসায় খানিকটা মানহানিই ঘটেছে তাঁর। হাসির ছলেই উত্তর দিতেন সৌমিত্র। বলতেন, চরিত্র সৃষ্টির দায় কি শুধু পার্শ্ব-অভিনেতাদেরই? আসলে খুব কম সিনেমাতেই তখন নায়ক চরিত্র নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাহস দেখিয়েছেন পরিচালক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নায়কের চরিত্র একইরকম মধ্যবিত্ত বাঙালির অপূর্ণ চাহিদার প্রকাশ এবং রমণীতোষ সুদর্শন পুরুষ। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের চেহারার মধ্যেই তার সবটুকু ছাপ ছিল। কিন্তু তাও বারবার সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছেন। ‘অশনি সংকেত’, ‘অগ্রদানী’ যেমন করেছেন তেমনই তাঁকে দেখেছি ‘ঝিন্দের বন্দী’, ‘নিশিপদ্ম’-এর মতো সিনেমাতেও।

অভিনয় জগতে সৌমিত্রর আত্মপ্রকাশ সেই ছেলেবেলাতেই। তখন ক্লাস ৫ কি ৬। একটি ইংরেজি নাটকে অভিনয় করছেন ছোট্ট সৌমিত্র। একটা দৃশ্যে কোনোকিছু চাইতে হবে তাকে। কিছুতেই দৃশ্যটা তুলতে পারছেন না তিনি। তখন এক শিক্ষিকা বললেন। ভিখারিরা যেভাবে চাল চায় সেই ভঙ্গিটা একবার দেখাতে। ব্যাস্, অভিনয় শিক্ষার সেই গোড়াপত্তন। সৌমিত্র সেদিন বুঝেছিলেন একটা চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে হবে বাস্তব থেকে শিক্ষা নিয়েই। বারবার বলতেন, যে চরিত্রে বাস্তবের ছাপ নেই, তেমন অভিনয় করতে তাঁর ভালো লাগে না। আর তাই বোধহয় একসময় মূল ধারার সিনেমা থেকে খানিকটা দূরেই সরে গিয়েছিলেন তিনি।

কৃষ্ণনগরের বাড়িতে অভিনয়, আবৃত্তির চর্চা ছিল প্রথম থেকেই। সেই স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, বাড়ির জলচৌকিকে মঞ্চ আর বিছানার চাদরকে যবনিকা বানিয়ে চলত প্রাথমিক জীবনের অভিনয়। তারপর কৃষ্ণনগর সিএমএস স্কুলে দর্শকের সামনে আত্মপ্রকাশ। সেটা স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠান। এরপর যেন পড়াশোনা ছেড়ে অভিনয়ের দিকেই মন টানতে লাগল বেশি করে। নানা ক্লাবের অনুষ্ঠানেও নাটক করতে ছুটতেন সৌমিত্র। তারপর চলে এলেন কলকাতায়। সিটি কলেজে পড়ার সময়েই চুটিয়ে নাটক দেখতে শুরু করলেন বন্ধুদের সঙ্গে। বিশেষ করে শিশির কুমার ভাদুড়ীর নাটক হচ্ছে শুনলেই ছুটতেন। নাটক নাহলে দেখতে যেতেন নাটকের মহড়া। এভাবেই একদিন আলাপ হয়ে গেল নাট্যাচার্যের সঙ্গে। পরে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, বয়সের বেড়া টপকে দুজনের বন্ধুত্বও বেশ গভীর হয়ে উঠেছিল।

সারা জীবন শিশির ভাদুড়ীকেই অভিনয়ের গুরু বলে মেনে এসেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। পরবর্তী জীবনে সত্যজিৎ রায়ের সংস্পর্শে এসে আরও নানা খুঁটিনাটিই শিখেছিলেন। কিন্তু গুরুর আসনে আর কাউকে বসাতে পারেননি। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ যোগাযোগ ছিল না শিশির ভাদুড়ীর। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কেই তাই মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন নাট্যাচার্যের সম্বন্ধে। তাঁর জীবন যাপন কেমন, কী ধরনের বই পড়তে ভালোবাসতেন; সবই। সৌমিত্রও আনন্দের সঙ্গে সমস্ত গল্প করতেন।

অভিনয় জীবনে আরেকজন মানুষ ব্যাপক প্রভাব ফেলেছিলেন সৌমিত্রর উপর। তিনি আর কেউ নন, ছবি বিশ্বাস। সেই জলসাঘর সিনেমার শুটিং দেখতে গিয়েই চমক লেগেছিল। কেমন সহজ ভঙ্গিতে নিজের ব্যক্তিত্বকে মেলে ধরেন ক্যামেরার সামনে। এরপর তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ সিনেমায় একসঙ্গে অভিনয় দুজনের। প্রথম থেকেই দক্ষ অভিনেতাদের সঙ্গে কাজ করার ছাপ পড়েছিল সৌমিত্র চটোপাধ্যায়ের। এই সমস্ত কাজ তাঁর অভিনয় শেখার খিদে বাড়িয়ে দিয়েছিল, এমনটা বলেছেন একাধিকবার। আর সহ-অভিনেতাদের থেকে শিখে সেইসমস্ত রীতি অনুশীলন করতেন নিজে নিজেই। এরপর আবার সত্যজিৎ রায়ের ‘দেবী’ সিনেমাতে ছবি বিশ্বাসের সঙ্গে কাজ করলেন সৌমিত্র।

আবারও সেই ফিরে আসতে হয় সত্যজিৎ রায়ের কাছেই। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের জীবনে এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সিনেমার নাম ‘অভিযান’। নতুন ধরনের চরিত্র। নরসিং, অর্থাৎ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত চরিত্র বাংলায় জন্মালেও তাঁর বংশ বিশুদ্ধ রাজপুত। এইখানে একটি পরীক্ষা করতে চাইলেন সৌমিত্র। সামান্য হিন্দির টান মেশানো বাংলায় সংলাপ বলা যায় কিনা, জিজ্ঞেস করলেন পরিচালককে। সত্যজিৎ রায় প্রথমে কোনো উত্তর দিলেন না। মনে হল যেন তাঁর ঠিক পছন্দ হল না। রিহার্সালের সময়েও উত্তর দেন না। শেষে ফাইনাল টেকের ঠিক আগে সৌমিত্র আবার অনুমতি চাইতে গেলে একটু হেসে ঠিক একইভাবে হিন্দি টানে বাংলায় সম্মতি দিলেন সত্যজিৎ। তখন থেকেই নিজের উপর আত্মবিশ্বাস বাড়তে থাকে সৌমিত্রর। তাই গুপী-র চরিত্রে যখন সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, সৌমিত্রকে দেখে চাষির ছেলে বলে মনে হয় না, তখন একটু ক্ষুণ্ণই হয়েছিলেন তিনি। যদিও পরে স্বীকার করেছিলেন, তপেন চট্টোপাধ্যায়ের মতো করে চরিত্রকে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন না নিজে।

তবে অভিনয় তো একটা সত্তা মাত্র। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় কবিতা লিখেছেন। কবিতা পড়েছেন। কাজ করেছেন আকাশবাণীতেও। আজও ‘শেষের কবিতা’-র অমিত-এর কথা বললেই ভেসে আসে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের ভরাট গলা। আর ‘বনলতা সেন’ হয়তো জীবনানন্দ লিখেছিলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পড়বেন বলেই। বৈচিত্রে ও বৈশিষ্ট্যে হয়তো অপু থেকে ফেলুদা কেউই টপকে যেতে পারেনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে। তাঁর জীবনের এমন নানা ঘটনাকে নিয়েই তৈরি হচ্ছিল একটি চলচ্চিত্র। সেই সূত্রেই মহামারী পরিস্থিতেও ফিরে এসেছিলেন শুটিং ফ্লোরে। আর সেখানেই ঘটল দুর্ঘটনা। অভিনেতার অবসানে থেকে গেল শুধু চরিত্রগুলো। আর থাকল নিজেকে ভাঙা-গড়ার একটা রূপকথা।

তথ্যসূত্রঃ মানিকদার সঙ্গে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়
চরিত্রের সন্ধানে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়

Powered by Froala Editor